ঠিক দুপুরবেলা গলিটা খাঁ খাঁ করছে। লোক দুটো আরও দুই পা এগিয়ে এল। লোক দুটোর ছায়া এখন একসঙ্গে এসে পড়েছে রাব্বির ওপর। রাব্বি এখন কী করবে?
: কিরে রাব্বি এখানে কী করিস? কী আশ্চর্য, কৌশিকদা ঠিক তার পিছে।
: আমি মানে...গলা দিয়ে কথা সরে না যেন। লোক দুটো ততক্ষণে রাব্বিকে অতিক্রম করে হাঁটা শুরু করেছে, খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। যেন ছোট্ট এই গলিটাতে রাব্বিই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোনোমতে রাব্বিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল, যেন তাদের খুব জরুরি কাজ আছে।
: কিরে কথা বলিস না যে!
: মানে ওই লোক দুটো দেখলে?
: দেখলাম তো তোর চেনা? সজোরে মাথা নাড়ল রাব্বি। কৌশিকদা তাদের পাড়ার ছেলে। বড় ভাই, শুধু বড় ভাই না, বেশ বড় ভাই। এখানকার একটা কলেজের বিজ্ঞানের শিক্ষক। সম্ভবত কলেজ থেকেই ফিরছিলেন। হাতে খাতাপত্র।
: কিরে, একা একা ঘুরিস, তোর বন্ধুরা কেউ এখনো ফেরেনি?
: কৌশিকদা তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। গম্ভীর হয়ে বলার চেষ্টা করে রাব্বি।
: বলে ফেল।
: ওই যে লোক দুটোকে দেখলে?
: হ্যাঁ, দেখলাম তো।
: ওদের একজনের কোমরে পিস্তল আছে।
: তাই নাকি? তাতে তোর সমস্যা কী? হয়তো সিভিল ড্রেসে পুলিশ ডিউটিতে যাচ্ছে।
: না না পুলিশ না...
: তুই কী করে জানিস ওরা পুলিশ না?
: আমি জানি। হড়বড় করে এবার রাব্বি সব বলতে শুরু করে। কৌশিকদার একটা গুণ হচ্ছে পাড়ার বাচ্চাদের যেকোনো কথা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে শোনেন। যেন তারা তার সমবয়সী। আজকেও তাই, রাব্বির কথাগুলো সব শুনতে লাগলেন। সেই লাল দালানে ঢোকা, বৃদ্ধাকে দেখা...বৃদ্ধার নির্দেশে ফাঁকা গুলি করা। তারপর বৃদ্ধার বাসায় ক্লান্টুকে পাওয়া...তারপর ক্লান্টুর পিছু পিছু রহস্যময় রাস্তা দিয়ে ভেজা লাল মাটি মাড়িয়ে বাইরে আসা। সব খুলে বলে...
ততক্ষণে তারা দুজন কৌশিকদার বাসায় পৌঁছে গেছে। কৌশিকদা একা থাকে। তার ঘরে দুনিয়ার বইপত্র। কোনোমতে দুটো চেয়ার বইপত্রের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে, তার একটাতে বসল কৌশিকদা, আরেকটায় রাব্বি।
: দাঁড়া দাঁড়া। একটু চা খাওয়া যাক। চা খেতে খেতে তোর রূপকথা পর্যালোচনা করা যাবে।
: কৌশিকদা বিশ্বাস করো, একদম সত্যি কথা। কৌশিকদার মতো দ্রুত চা বোধ হয় আর কেউ বানায় না। তার ঘরে একটা রাশিয়ান সমোভার আছে, (এটা নাকি তিনি রাশিয়া থেকে এনেছেন, তিনি যে কবে রাশিয়া গেলেন, এটাও একটা রহস্য) তাতে সব সময় পানি গরম থাকে বোধ হয়। চট করে হালকা লাল রঙের চা বানিয়ে ফেললেন তিনি। শুধু একবার চেঁচালেন,
‘তোর চায়ে চিনি কয় চামচ, নাকি ডায়াবেটিস আছে তোর?’
‘দুই চামচ।’
‘বলিস কী? তাহলে তো শরবত হয়ে যাবে।’
দ্রুতই দুটি মগে করে চা নিয়ে এলেন। চায়ের মগ থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। খুব সম্ভব কোনো বিশেষ চা-পাতা হবে, রাব্বির মগে আবার একটা স্ট্র!
‘স্ট্র কেন? স্ট্র দিয়ে কেউ চা খায়?’
‘আমি মাঝেমধ্যে খাই। আমরা সাধারণত চা বা পানি ওপরের লেয়ার থেকে খেতে শুরু করি। কিন্তু যখন স্ট্র দিয়ে খাই, তখন কিন্তু উল্টো, নিচের লেয়ার থেকে খেতে শুরু করি। চামচ পাইনি, চা নাড়াতে পারলাম না, তাই তোকে স্ট্র দিলাম, স্ট্র দিয়ে নাড়তে পারিস। তবে স্ট্র দিয়ে নিচের লেয়ারে মিষ্টি বেশি পাবি, খা...মানে পান কর...আচ্ছা তোর রূপকথা শুরু কর দেখি। চায়ে চুমুক দিয়ে কৌশিকদা বলল।
‘রূপকথা না কৌশিকদা সব সত্যি।’
‘আচ্ছা মানলাম, এটা একটা সত্যি রূপকথা...তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস দক্ষিণ পাড়ার ওই তিনতলা লাল বাড়িটার ভেতরে ঢুকেছিলি?’
‘আমি ইচ্ছা করে ঢুকিনি। ওই লোক দুটো জোর করে ঢুকিয়েছে।’
‘আচ্ছা বুঝলাম, তোকে জোর করে ঢুকিয়েছে। ঢুকে দেখলি তোর হারানো ক্লান্টু আর এক বৃদ্ধাকে, বৃদ্ধা তোকে গুলি করতে বলল আর তুই গুলি করে বসলি তা–ও আবার পরপর দুই রাউন্ড। শাব্বাশ! তুই তো দেখি বাঘের বাচ্চা রে!’
‘দেখো কৌশিকদা ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস।’
‘শোন শোন তোর সত্যিই ডায়াবেটিস নেই তো? আজকাল বাচ্চাদেরও ডায়াবেটিস হয়।’
‘কেন, ডায়াবেটিস হবে কেন আমার?’
‘আরে শরীরে সুগারের ঘাটতি হলে আমাদের মস্তিষ্ক উল্টাপাল্টা সিগন্যাল দেয়, তখন দিনদুপুরে হ্যালুসিনেশন হয়। খুব সম্ভব তোর তা–ই হয়েছিল, হয়তো তোর শরীরে সুগার...।’
অসম্ভব রাগ ওঠে রাব্বির। সে উঠে দাঁড়ায়। ‘না, আমি গেলাম।’
‘আরে বোকা, বস না। আমাদের সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তুই যে লাল দালানের কথা বলছিস, সে দালানটা একটা হান্টেড হাউসের মতো। ওখানে কেউ থাকে না। ওখানে একটা মার্ডার হয়েছিল, তারপর গভর্নমেন্ট ওই বাড়িটা সিল করে দেয়।’
‘কিন্তু আমি যে দেখলাম...’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, আজ বিকেলে তুই আর আমি ওখানে গিয়ে সরেজমিনে দেখব, যাকে বলে রেকি করব। এখন যা, বাসায় গিয়ে খেয়েদেয়ে একটু ঘুম দে। ঠিক চারটায় আমি তোর বাসায় গিয়ে তোকে নিয়ে ওই লাল দালান পরিদর্শনে যাব।’
‘ঠিক আছে। তাহলে আমি গেলাম।’
‘ওকে যা।’
ঠিক চারটা দশে কৌশিকদা আর রাব্বি এসে দাঁড়াল লাল দালানটার সামনে। চারদিকে সুনসান শূন্যতা, আশপাশে কেউ নেই।
‘তুই কোন জানালাটা দিয়ে ঢুকেছিলি?’
‘এই দিকেই তো ছিল জানালাটা, এখন দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
‘দুজনে মিলে আরেকটা চক্কর দিল। হ্যাঁ, একটা জানালা পাওয়া গেছে। যেটা ভেতর থেকে বন্ধ।’
‘এটা দিয়ে ঢুকেছিলি?’
কী জানি ঠিক বুঝতে পারছি না। এই জানালাটা বেশ উঁচুতে, ওটা তো মনে হচ্ছে বেশ নিচুতে ছিল।’
‘উঁচু থাকলে সমস্যা কী? ওরা তো তোকে ধরে ভেতরে ঢুকিয়েছিল তাই না?’
‘হ্যাঁ তা অবশ্য...।’ রাব্বি ঘটনাটা মেলাতে পারে না। কোথায় যেন একটা ফাঁক আছে। বাড়িটার পেছনে একটু জংলামতো। তারপর অনেকটা জায়গাজুড়ে ফাঁকা জমি তারপর সেই খালের আশপাশে কোনো বাড়িঘর নেই বললেই চলে, এক কোনায় একটা চায়ের দোকান। সেখানে তিনজন বৃদ্ধ বসে চা খাচ্ছে।
‘চল চা খাই।’ তারা দুজনে গিয়ে চায়ের দোকানে বসে।
‘মামা দুই কাপ চা দাও।’ বৃদ্ধরা একটু সরে বসে, ওদের জায়গা করে দেয়। তারা তিনজনই শূন্য কাপ হাতে বসে আছে, তার মানে ওদের চা খাওয়া শেষ। কৌশিকদা ওনাদের দিকে তাকায় হাসি মুখে বলে ‘আদাব, আপনারাও চা খাবেন নাকি আরেক রাউন্ড আমাদের সঙ্গে?’
‘খাওয়া যায়।’
‘মামা পাঁচ কাপ দাও।’ রাব্বি বুঝে যায় কৌশিকদা ওদের সঙ্গে আলাপ জমাতে চাচ্ছে।
‘আপনারা প্রায়ই এখানে চা খেতে আসেন?’
‘হ্যাঁ, বিকালের চা–টা আমরা এখানেই খাই। তাই না মবিন মিয়া?’ মবিন মিয়া মানে চা বিক্রেতা বিরক্ত মুখে চামচ নাড়তে থাকে। বোঝা যাচ্ছে লোকটা কোনো কারণে বিরক্ত। হয়তো এই তিন বৃদ্ধের ওপরই বিরক্ত। যদিও এরা তার রেগুলার কাস্টমার।
‘আচ্ছা আঙ্কেল আপনারা এখানে রেগুলার চা খান, গত পরশুও এখানে চা খেয়ে ছিলেন নিশ্চয়ই?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা, গত পরশু কি আপনারা এখানে বসে গুলির শব্দ শুনেছিলেন?’
‘কোল্ট থার্ট এইট পিস্তলের গুলি ছিল। পরপর দুই রাউন্ড।’ একজন বৃদ্ধ কথাটা বলে। ‘হ্যাঁ, আমরা তিনজনই শুনেছি।’ কৌশিকদা আড়চোখে তাকাল রাব্বির দিকে। ভাবটা এ রকম, রাব্বি তোর গল্প এখন বিশ্বাস করা যায়।
‘এখানে রাজনীতির আলাপ করবেন না।’ চাওয়ালা বেশ গম্ভীর স্বরে বলে। কৌশিকদার চোখে যেন কৌতুক খেলে যায়। চাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘মবিন মিয়া তুমি শুনো নাই গুলির শব্দ?’
‘না।’
‘ও তুমি তাহলে কানে কম শোনো?’
চাওয়ালা কথা বলে না। তাকে আরও গম্ভীর মনে হয়। সে এদিক–ওদিক তাকায়, কিছু খোঁজে। তারপর বলে, ‘আমি দোকান বন্ধ করব। আপনারা আরও কিছু খাইবেন? মাল আনতে চকে যাব।’
‘হ্যাঁ, দোকান বন্ধ কর। চকে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে তোমাকে একটু থানায় যেতে হবে।’ গম্ভীর হয়ে বলে কৌশিকদা। হঠাৎ করে চেহারা বদলে যায় মবিন মিয়ার। ‘সে ভয় পেয়েছে।’
‘স্যার, আমি কী করছি?’
‘সেটা থানায় গিয়ে শুইনো।’
‘আপনি কি গোয়েন্দা?’ তিন বৃদ্ধের একজন বলে। তিনিই কোল্ট থার্টি টু পিস্তলের কথা বলেছিলেন একটু আগে।
‘তা বলতে পারেন। আপনি কী করে বুঝলেন ওটা কোল্ট থার্টি টু পিস্তলের গুলির শব্দ?’ এই প্রশ্নে বৃদ্ধ খুশি হয়। তবে উত্তরটা দেয় আরেকজন।
‘আমরা ৩ জন একসঙ্গে যুদ্ধ করছি, ১১ নম্বর সেক্টরে। ও ছিল আমগো গ্রুপ কমান্ডার। ওর একটা পিস্তল ছিল কোল্ট থার্টি টু।’ গল্পটা ওনারে বল পাশের বৃদ্ধটা বলে।
‘বাদ দে এই সব কথা।‘ প্রথম বৃদ্ধ সিগারেট ধরায়। সে অন্য প্রসঙ্গে যেতে চায় যেন। ‘এই জায়গা এই রকম ছিল না।’
‘কী রকম ছিল?’
‘এই লাল বিল্ডিং, বাড়ি, দোকানপাট কিছুই ছিল না। তবে মাটি ছিল টকটকে রক্তের মতো লাল। আর ছিল জঙ্গল।
জঙ্গলের মাঝখানে একটা পাহাড় ছিল। লাল পাহাড়...এই লাল দালানটা যেখানে...’
‘আপনারা দেখছেন?’
‘দাদায় দেখছে। বাবায়ও দেখছে।’
‘আপনারা দেখেননি?’ প্রশ্নটা আবার করে কৌশিকদা।
‘দেখছি আবার দেখি নাই।’ একজন বৃদ্ধ দার্শনিকের মতো উদাস গলায় বলে।
‘লাল পাহাড়ের যে গল্প শুনছি ছবির মতো ভাসে সব চোখের সামনে!’ সবচেয়ে কম কথা বলা বৃদ্ধটি মুখ খোলে।
‘ঠিক কথা।‘ অন্য বৃদ্ধরা সায় দেয়। লাল দালানটা যেখানে পাহাড়টা ঠিক এখানেই ছিল, লাল পাহাড়...রাব্বির মাথাটা কেমন যেন গোলমাল লেগে যায় এসব কী শুনছে? কৌশিকদা অবশ্য ঠান্ডা মাথায় সব শুনছে। কোনো মন্তব্য করছে না। আর চাওয়ালা মবিন ফ্যাকাশে মুখে একবার কৌশিকদার দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার বৃদ্ধদের দিকে তাকাচ্ছে। তার এখন আর দোকান বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
এই সময় কৌশিকদা রাব্বির দিকে ঝুঁকে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে, ‘রাব্বি তুই বাড়ি যা...আমি পরে আসছি!’ কৌশিকদার গলায় এমন কিছু ছিল, রাব্বি কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়। হাঁটা দেয় বাসার দিকে। এমনিতেও যেতে হতো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
রাব্বি চোখের আড়াল হতেই কৌশিকদা উঠে দাঁড়ায়। ‘মবিন মিয়া তুমি অপেক্ষা করো, আমি আসছি, আপনারা ভালো থাকুন, আপনাদের সঙ্গে পরে আরও কথা হবে।’ তারা তিনজন একসঙ্গে মাথা নাড়ে।
রাব্বির কৌশিকদা, অর্থাৎ কৌশিক মিত্র যিনি স্থানীয় মডেল কলেজের বিজ্ঞানের শিক্ষক, তার কী মনে হলো, তিনি ফের হেঁটে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন সেই লাল বিল্ডিংটার সামনে। সেই জানালাটার কাছে, রাব্বি দাবি করছে যে জানালা দিয়ে তাকে ভেতরে ঢোকানো হয়েছিল জোর করে। জানালাটা তখন খোলা ছিল, আজ বন্ধ। ঠিক তখনই শেষ বিকেলের দুটো দীর্ঘ ছায়া এসে স্পর্শ করল কৌশিকদাকে। সেই লোক দুটো। আজ দুপুরে গলির মোড়ে তাদের যথেষ্ট ভদ্র মনে হয়েছিল, এখন মনে হচ্ছে না তারা অতটা ভদ্র। তারা যেভাবে এগিয়ে আসছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তারা কৌশিক মিত্রকে আক্রমণ করবে। কিন্তু কেন?
রাব্বি বলেছিল চক্করবক্কর শার্ট পরা লোকটার কোমরে পিস্তল আছে। মনে হচ্ছে না পিস্তলটা এখনি বের করবে সে। দ্বিতীয় লোকটির ভাব দেখে মনে হচ্ছে দুই হাতে ট্র্যাডিশন্যাল হরাইজন্টাল পা মাড়ার তালে আছে, তার মানে তার দুই হাতের কনুই দুটো বাইরের দিকে থাকবে, ভেতরে শরীরের মেইন স্ট্রিম ফাঁকা। ওই ফাঁকা রাস্তায় একটা কিক মারা যেতে পারে...সোজা গিয়ে লাগবে থুতনিতে! কৌশিক মিত্র নিজেকে প্রস্তুত করে। ওরা হয়তো জানে না কৌশিক মিত্র শুধু একজন কলেজের বিজ্ঞানের শিক্ষক নন, তিনি একজন কারাতে ব্ল্যাকবেল্ট পাওয়া; অনেক দিন চর্চা করা হয় না, তবে আজ মনে হয় করতে হবে! ওরা এগিয়ে আসছে...