বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম করে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ধুকপুক করা যন্ত্রটা এবার চলেই আসবে বাইরে। নিয়নের দিকে তাকাই। তার চোখমুখেও উত্তেজনা-অস্থিরতা। নাকের ফুটো হয়ে আছে অস্বাভাবিক রকমের বড়; কিন্তু তার চেয়েও দেখার মতো চেহারা রবিনের। চোখ সরু সরু করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে এমনভাবে, যেন চোখ না, ও দুটো দুরবিন!
আমরা আছি মাইক্রোবাসের ভেতরে। নিমতলার মোড় পেরিয়ে রাস্তা যেখানে দুভাগ হয়েছে, বড়টা গেছে স্টেশনের দিকে, আর ছোটটা মিলেছে পুনর্ভবার ঘাটে, ঠিিক সেখান থেকে ৫০ গজ পেছনে, একটা ঢালকে এক পাশে রেখে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একটা বাবলাগাছ, রাস্তার পাশে, প্রাগৈতিহাসিক ধুলার মধ্যে কোনোভাবে টিকে আছে। তারই পাশে আমরাও যেন টিকে আছি ওই কোনোভাবেই। ঘণ্টাখানেক ধরে। রবিন এরই মধ্যে সময় দেখে। বলে, শালা…এখনো আসতেছে না!
এখন সাড়ে ১১টার মতো বাজে।
মিজানুরের আসার কথা অন্তত ১১টায়। আসার কথা মানে, এ রকম সময়েই সে সাধারণত বাজার থেকে ফেরে। স্টেশনের দিকে যায়। স্টেশনের পাশেই নুড়ির বাড়ি। আমরা ঠিক করেছি, মিজানুরকে কিডন্যাপ করার এটাই এক মোক্ষম সময়।
এমনিতে মিজানুরের সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। ঘটনা একটাই, মিজানুর বাসায় গিয়ে ফিজিকস পড়ায় নুড়িকে। নাইনের ফিজিকসে কী এমন জাদুজাল আছে আমরা জানি না। কারণ, আমরা তিনজনই আর্টসের ছেলে। আমাদের প্রাইভেট পড়ার ঝামেলা নেই। তবে ঝামেলা ওই নুড়িতে। আমরা তিনজনই নুড়ির বন্ধু। নুড়ি বলেছে, মিজানুর স্যার হলো বেকুব। তাকে আচ্ছা করে সাইজ দেওয়া লাগবে!
আমরা মিজানুর স্যারকে কিডন্যাপ করে নিয়নদের বাগানবাড়িতে আটকে রাখব দুই দিন। এতেই তার যথেষ্ট সাইজ হওয়ার কথা! যদি না হয়, কাঁচা কঞ্চি থেরাপিও দেওয়া যেতে পারে। এত সাহস…নুড়ির সঙ্গে ঝামেলা করে! তবে আমরা এটাও নিশ্চিত না যে নুড়ির সঙ্গে কী এমন জটিল ঝামেলা করেছে মিজানুর!
প্রথমত, নুড়ি সবকিছু বলে না। আবার গুনগুন করে যতটুকু বলে, তাতে সব কথা তেমন স্পষ্টও হয় না। কিন্তু নুড়ি মেয়ে এবং আমাদের তিনজনেরই চোখের মণি বন্ধু। ফলে নুড়ি যদি মিজানুরকে বেকুব বলে, তবে সে অবশ্যই বেকুব। নুড়ি যদি মিজানুরকে নীল আর্মস্ট্রং বলে, তাহলে সে নীল আর্মস্ট্রং! আর নুড়ি যদি তাকে ফালতু বলে, তবে সে হলো ফালতুর মহারাজ!
মফস্সলের পোলাপান আমরা। মাইক্রোবাস জোগাড় করতে জান বেরিয়ে গেছে আমাদের। ভাগ্য ভালো ক্লাসভাঙা এক বন্ধু ছিল আমাদের! নাম সুমন…সিক্স শেষে যে আর সেভেন করেনি, সোজা ঢুকে গেছে বাপের ট্রান্সপোর্টের ব্যবসায়। তাদের তিনটি মাইক্রোবাস। সেখান থেকেই আমরা একটি ধার করেছি। ১২টার মধ্যে বাসটাকে ছেড়ে দিতে হবে। কারণ ১২টায় যাত্রী নিয়ে মাইক্রোবাস যাবে রাজশাহীতে! এত সব গূঢ় হিসাব-নিকাশের মধ্যেই নিয়ন হাই তোলে। বলে, বোধ হয় আইজ আসবে না রে!
লাফ আমরাও দিই। রবিন নিয়ন ঠিকই সামলে নেয়, ঝামেলায় পড়ি আমি। ঢালে পা পড়তেই, পা হড়কে যায়। ডিগবাজি খেয়ে থ্যাপ করে পড়ি লালচে ধুলোমাটির ওপর। মুখ ফসকে ‘মাগো’ বেরিয়ে আসে। তাতে নিয়ন বদমাইশটা হেসেও ওঠে জোরে। আমার রাগ এমন হয়, একমুঠো ধুলো আছড়ে দিই নিয়নের চোখে!
রবিন রেগে তাকায়—আসবে না মানে! নুড়িকে কী বলছি খেয়াল নেই? বলছি, আমরা আইজকাই সাইজ দিব। আইজকা মানে আইজকাই!
আমি বললাম, তা ছাড়া কালকে মাইক্রোবাসও তো পাব না। মাইক্রোবাস ছাড়া কিডন্যাপ হয় নাকি?
নিয়ন বলে, সব সিনেমায় মাইক্রো দিয়াই কিন্তু কিডন্যাপ দেখায়, এইটা সত্যি!
আমি সব সময় সত্যি কথাই বলি…বলতে গেলাম কথাটা; কিন্তু তখনই রবিন চেঁচিয়ে ওঠে—আসছে আসছে…ওই যে নীল শার্ট!
তাকাই সবাই ঝটপট!
ঠিকই। আসছে একটা নীল শার্ট। নিমতলার মোড় পেরিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, পাটকাঠির ওপর শার্ট পরানো। নিয়ন বলে, যাহ! এইটাই মিজানুর। এইটার জন্য পুরা এক মাইক্রো! এর সামনে আমিই যদি দাঁড়াই…ভয়ে তো সে শেষ…
আমি বলি, চুপ থাক। শুনেছি, খুবই ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। এসএসসি এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা পার্টি!
রবিন বলে, স্ট্যান্ড করা পোলাকে নিলডাউন করাইতেও মজা! ভাই গাড়ি আগান।
ড্রাইভার স্টার্ট দেয়। এগিয়ে যায় গাড়ি। মিজানুর ক্রমেই কাছাকাছি হচ্ছে। একদম তার সামনে পড়তেই মাইক্রোবাস নেয় এক বেমক্কা ব্রেক। ঘ্যাঁচ শব্দ হওয়ার কথা! কিন্তু গাড়িতে কোনো ঝামেলা থাকায় আওয়াজ হলো ক্যাঁআআআআক! যেন এক্ষুনি ভেঙে পড়বে সে। সচেতন থাকার পরও আমরা ঝাঁকি খাই মারাত্মকভাবে। নিয়ন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার ওপর। আমরা দুজন পড়ি রবিনের ওপর। রবিন ততক্ষণে অবশ্য দরজা খোলার চেষ্টা করছে; কিন্তু দরজায় জ্যাম! রবিন ধাক্কাধাক্কি করে চূড়ান্ত। তবে গাড়ির দরজা নড়ে না এতটুকুও!
মিজানুরের দিক থেকে দেখলে ব্যাপারটা তার ইহজীবনের অস্বাভাবিক ঘটনাই বলতে হয়!
একটা তামাটে মাইক্রোবাস তার সামনে হঠাৎ এসে ক্যাঁক করেছে। উপরন্তু গাড়িটার ভেতরে রয়েছে কয়েকটা ছেলে। তারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে দরজা খোলার। অথচ খুলতে পারছে না। মিজানুর বেচারা ভাবে, ছেলেগুলোর সাহায্য দরকার! ফলে এগিয়ে বরং বাইরে থেকে দরজা খোলার চেষ্টা করে মিজানুরই। আমরা ভেতর থেকে, মিজানুর বাইরে থেকে, চেষ্টা অশেষ; কিন্তু দরজার খোলার নাম নেই।
ড্রাইভার ভাইয়ের দয়াই হয় শেষে। নেমে আসে দ্রুত। আর তখনই, কোনো কারণ ছাড়াই, খুলে যায় দরজা। মিজানুর একেবারে আমাদের হাতের নাগালের মধ্যে। কথা নেই বার্তা নেই নিয়ন সিনেমার ভিলেনের মতো চিৎকার দিয়ে ওঠে—ওওওওওই খাইছি তোরে!
মিজানুরের কী হয় কে জানে। নিয়নের কথা শুনে একপলক তাকিয়েই দেয় ঝেড়ে দৌড়!
আমরাও লাফ দিই। মিজানুর দৌড়াচ্ছে সামনে সামনে, আমরা পেছন পেছন। ওদিকে ড্রাইভার ভাই বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে মাঝরাস্তায়। তার কী করণীয়, বুঝে উঠতে পারছে না কিছুতেই।
ঢাল পেরোলেই ছোট রাস্তাটা আতকা নেমে গেছে একটা আরেক ঢালের দিকে। মিজানুর সেদিকেই লাফ দেয় এবার।
লাফ আমরাও দিই। রবিন নিয়ন ঠিকই সামলে নেয়, ঝামেলায় পড়ি আমি। ঢালে পা পড়তেই, পা হড়কে যায়। ডিগবাজি খেয়ে থ্যাপ করে পড়ি লালচে ধুলোমাটির ওপর। মুখ ফসকে ‘মাগো’ বেরিয়ে আসে। তাতে নিয়ন বদমাইশটা হেসেও ওঠে জোরে। আমার রাগ এমন হয়, একমুঠো ধুলো আছড়ে দিই নিয়নের চোখে!
ওদিকে ঢাল পেরোলেই নদী। পুনর্ভবা।
মিজানুর পুনর্ভবার পাড় ধরে দৌড়াচ্ছে।
এখন শুষ্ক মৌসুম। নদী একদম ছোট হয়ে আছে। ফলে এপারে ধানগাছ লাগানো হয়েছে। মিজানুর সেগুলোকে মাড়িয়েই দৌড়াচ্ছে। আমরাও মাড়াচ্ছি। পলিমাখা নরম মাটিতে দেবে যাচ্ছে পা। রবিন চিৎকার করে—ওই দাঁড়া…দাঁড়া বলছি!
বললেই কি দাঁড়াবে নাকি! যখন তার পালানোর এই মতি!
কিন্তু বিস্ময়! মিজানুর দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘুরে তাকায়। হাঁপায়। তারপরই হেসে লাফ দেয় পানিতে।
মানে কী রে ভাই!
তোকে কি আমরা খুন করতে আসছি নাকি? সিম্পল একটা কিডন্যাপ করব। দুই দিন আটকে রেখে সাইজ দেব। এইটার জন্য এত কী!
কোথায় ভেবেছিলাম, সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো হবে। মিজানুর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রাস্তায় হেঁটে আসবে, আমরা ধাম করে তার সামনে মাইক্রোবাস নিয়ে দাঁড়াব। দরজা খুলে ধপাধপ নামব রাস্তায়। তারপর বলব, ওইইইইই…
এর পরই দুপাশ থেকে ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নেব, ব্যস! তামাশা শেষ!
কিন্তু এখন?
এখন নতুন নতুন তামাশা নিজেদেরই করতে হচ্ছে। মিজানুর পুনর্ভবায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। পাতলা খিটখিটে ছেলে। বয়স হয়তো ৩০; কিন্তু পানিতে ছুটছে তিরের বেগে। রবিন আমার দিকে তাকিয়ে নেয় একবার। যেন বুঝতে চাইছে কী করা উচিত!
আমি বলি, বাদ দে।
রবিন বলে, সে–ই। পানিতে নামা ঠিক হইব না!
তখন ঝপাৎ করে আওয়াজ। পাশ থেকে নিয়ন লাফ দিয়েছে। একটা ডুব দিয়ে উঠে মুখের পানি কুলি করে ছেড়ে বলে, নুড়ি যখন বলছে, তখন আমি তো জীবনেও বাদ দেব না। নুড়ির কথা আমার কাছে শেষ কথা! আর নুড়ি আমাকেই তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু মনে করে!
বলে কী এই গাধা! নুড়ির সবচেয়ে ভালো বন্ধু আমি। আমার তো প্রতিবেশীও সে। শুধু স্কুলে যাতায়াত নাকি? আমরা তো বই থেকে সেমাই-পায়েসও এবাড়ি–ওবাড়ি শেয়ার করি। আমিই সবচেয়ে ভালো বন্ধু নুড়ির! আমার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই দেখি, আরেকটা ঝপাৎ শব্দ। লাফ দিয়েছে রবিন।
পানিতে নেমেই রবিন জাপটে ধরেছে নিয়নকে—তুই না, গাধা! আমি রবিন। আমিই নুড়ির সবচেয়ে ভালো বন্ধু!
নিয়ন বলে, না আমি। আমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড!
‘আমি…আমি বেস্ট ফ্রেন্ড!’
‘না, আমি।’
‘আমি।’
আর নেওয়া যায় না। লাফ দিই আমিও। পানিতে নেমেই বলি, আর আমি কি পুনর্ভবাতে ভেসে এসেছি? আমি বেস্ট ফ্রেন্ড নুড়ির!
নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ মারামারি হতে পারত এটা নিয়ে; কিন্তু ততক্ষণে দেখা যায়, মিজানুর ঘাটের ওই পাড়ে উঠে গেছে। ওই পাড়ে গিয়ে বদমাশটা হাঁপাচ্ছে আর তাকাচ্ছে। যদি পালিয়ে যেত, তবু নাহয় হতো। এই যে এভাবে তাকিয়ে আছে, এটা রীতিমতো বেয়াদবি! আমরা ঝগড়া ছেড়ে, নুড়ি কার বেস্ট ফ্রেন্ড এই অতীব জরুরি প্রসঙ্গ ছেড়ে, শুরু করি সাঁতরাতে। মিজানুরকে আচ্ছামতো সাইজ দিতে হবে, আচ্ছামতো।
পুনর্ভবা ছোট হয়ে এসেছে সত্যি! কিন্তু এতখানি দৌড়ে নদীর ওপার যাওয়া কম কষ্টের না! পায়ে–পিঠে টান লাগে। মাংসপেশিতে আতকা আতকা চিনচিন করে। এরই মধ্যে যখন কাছাকাছি পৌঁছাই, তখনো মিজানুর পালায় না। সে আমাদের কাছাকাছি আসার অপেক্ষা করতে থাকে!
কেন?
উত্তর বড় ঢেলার চেহারা ধরে আসে একটু পরেই। আমাদের পাড়ে আসার আগেই ঢেলাগুলো পড়তে থাকে ধাপধুপ করে। ঢেলা তো না, যেন বোমা পড়ছে। মাথার ওপর পড়লে মাথা ফাটবে নিশ্চয়ই; কিন্তু আমরাও অপ্রতিরোধ্য! আকাশ থেকে ঢেলা পড়ছে তো কী হয়েছে? আমরা ধরলাম ডুবসাঁতার। পানির গভীরে গিয়ে উঠে আবার গভীরে গিয়ে পৌঁছালাম একেবারে বুকপানিতে। সেখান থেকে এক লাফে, হল্লা করে, পুনর্ভবাকে আছড়ে, পাড়ে উঠতেই দেখি মিজানুর হাওয়া!
নুড়ি এত বিস্ময় নিয়ে তাকায় আমাদের দিকে যে আমরা ভড়কে যাই। এমন বড় বড় চোখ কখনো তো দেখিনি তার! নুড়ি বলে, তোরা কি গাধা?
এপারের পুরোটা বাগান। আমবাগান। মুকুল ফুরিয়ে গাছে এখন গুটি গুটি আম। খররোদের মধ্যেও বাগানের ভেতর শীতলতা। আমরা খুঁজছি মিজানুরকে। হারিয়ে গেছে। নেই কোথাও!
তখনই একদিক থেকে খসখস আওয়াজ। ছুটলাম সেদিকে। হ্যাঁ, ঠিক। মিজানুরই। লুকিয়েছে ফজলি আমগাছের গোড়ায়। গাছটা অনেক পুরোনো। গোড়া একেবারে বেঢপ। তারই আড়ালে বদমাশটা বসে আছে। আমাদের দেখেনি। উল্টো দিকে তাকিয়ে আমাদের খুঁজছে। পেছন থেকে টোকা দেয় নিয়ন—ভাই রে!
তাকায় মিজানুর। ঠিক সিনেমার মতো তাকে একটা ঘুষি মারে রবিন। মুখ বরাবর; কিন্তু লাগে কপালে। মিজানুরের কী হয় দেখার সুযোগ থাকে না, কারণ ‘বাবা রে মা রে’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে রবিন নিজেই। মিজানুরের শক্ত কপালে লেগে খুব খারাপভাবে ব্যথা পেয়েছে রবিন। হাত আর নাড়াতে পারছে না। আর এরই মধ্যে ধপাস করে একটা আওয়াজ হয়। তাকিয়ে দেখি, ফজলি আমগাছের তলায়, শেওলাজমা মাটিতে, চিৎপটাং হয়ে গেছে মিজানুর। হারিয়েছে জ্ঞান!
২
নিয়নদের বাগানবাড়িটা আসলে অত কিছু না। মাত্র দুটো মাটির ঘর। একটাতে থাকে চারটে গরু। মানে ওটা গোয়ালঘর। লাগোয়া যে ঘরটা সেটা রাখালের। রাখালের নাম জাহাঙ্গীর। দুনিয়ার সবকিছুতেই তার বিস্ময়। জ্ঞান হারানো মিজানুরকে দেখে তার প্রথম প্রশ্ন—মইরা গেছে জি?
চুপ।
না না। মরলে তো কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
চুপ থাক!
নিয়ন যতই ধমক দেয় না কেন, জাহাঙ্গীরের দিক থেকে প্রশ্নের কমতি থাকে না কোনো। ভয় এবার আমরাও পাওয়া শুরু করেছি। মিজানুরকে যতই ডাকি, পানির ছিটা মারি মুখে, চোখ একেবারেই খোলে না। রবিন তার বুকের কাছে কান পাতে। তেমন কোনো আওয়াজও নাকি পাচ্ছে না।
জাহাঙ্গীর বলে, যদি মইরা যায়, থানা–পুলিশ হবে জি ভাই। আপনারা কে কে খুন করছেন অরে? আহারে বেচারা বড় ভালো মানুষ ছিল!
ভালো মানুষ মানে? চিনতি তুই? তিন মাসও হয় নাই এই এলাকায় আসছে সে!
না না। চিনতুম না; কিন্তু মুখটা দেইখাই তো মনে হইতেছে, বড় ভালো মানুষ আছিল! কী মাসুম চেহারা!
মেজাজ খিঁচড়ে যায় আমাদের। রবিন চোখমুখ পাকিয়ে বলে, শোন নিয়ন, একটা খুন আর দুইটা খুন দুইটারই সাজা হলো ফাঁসি…
নিয়নও চেঁচায়—জাহাঙ্গীর বদটাকে খুন করতে পারলে তোর ফাঁসি আমি গলায় নেব, যা।
জাহাঙ্গীরের মুখ এবার শুকায়। তাড়াতাড়ি বলে, ভাই, গরুগুলাকে খাইতে দিয়া আসি। আপনারা থাকেন লাশের সঙ্গে।
জাহাঙ্গীর তার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। রেখে যায় আমাদের অস্বস্তিতে। এখন মনে হচ্ছে এ রকম হঠাৎ করে কিডন্যাপের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক হয়নি। তা ছাড়া সে যখন পালাতে শুরুই করল, তখন এভাবে পিছু নেওয়াও ঠিক হয়নি। বেচারা! সত্যিই কি…
নিয়ন পালস খোঁজে। রবিন আবার বুকে মাথা লাগায়। আর তখনই সেখানে হাজির হয় নুড়ি।
নুড়ি যখন যেখানে যেভাবে আসে না কেন, জায়গাটা আলো করে ফেলে। জাহাঙ্গীরের মাটির ঘরটা হঠাৎই যেন নূরে ভরে ওঠে; কিন্তু নুড়ির মুখ অন্ধকার—কী করছিস তোরা স্যারের সাথে?
নিয়ন বলে, চাইছিলাম তো সাইজ দিতে।
রবিন বলে, বেকুবটারে কিডন্যাপ করছি না।
নুড়ি বলে, মানে?
আমি বলি, তুইই না বলছিলি অরে সাইজ দিতে হবে! সাইজ একটু বেশিই হয়ে গেল কি না, বুঝতেছি না। এখন তো দেখা যায় দমও নেই!
নুড়ি এত বিস্ময় নিয়ে তাকায় আমাদের দিকে যে আমরা ভড়কে যাই। এমন বড় বড় চোখ কখনো তো দেখিনি তার! নুড়ি বলে, তোরা কি গাধা?
আমি বলি, রবিন আর নিয়ন তো গাধাই। আমি কিন্তু…
চুপ থাক! স্যার…এই স্যার…
নুড়ি মিজানুরের কাছে গিয়ে স্যার স্যার বলে এতবার ডাকতে থাকে যে স্যারের ভেতর সার কিছু থাকলে অবশ্যই ফিরতি উত্তর দিত। কিন্তু মিজানুর বেকুবটা পড়েই আছে লাশ হয়ে।
আমি বলি, আশ্চর্য! একটা ঘুষিতে কেউ মরে?
রবিন এর ভেতরেও ক্রেডিট নেয়। বলে, আমার ঘুষি খা একবার, তখন ঠিকই বুঝবি!
নুড়ি এবার ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ওপর। তার বক্তব্যের সারসংক্ষেপ বোঝা মুশকিল। কী থেকে কী বলছে, যেন আমাদের কখনো কান, কখনো চোখ, কখনো মাথার ওপর দিয়ে যেতে থাকে। প্রথম কথা বলে ওঠে নিয়ন; কিন্তু বলার আগে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে। বলে, তুই এই মিজানুরকে সাইজ দিতে বলছিস বেশি বেশি পড়া দেয়, সে জন্য?
তো আর কিসের জন্য দেব?
আমরা তো ভাবছি লোকটা তোকে জ্বালায়, ঝামেলা করে তোরে সঙ্গে। ওই যে করে না কিছু কিছু… আড়চোখে তাকাবে, পানি খেতে গিয়ে হাতটা ধরে নেবে...এই জন্যই তো একে সাইজ করতে…
সব সময় একটু বেশি বুঝিস ক্যান তোরা? এক লাইন বললে এক লাইন না বুঝে এক প্যারা বুঝিস ক্যান?
আমি তো ঠিকই তোকে বুঝি। তুই তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। রবিন আর নিয়ন বোঝে না। এরা গাধা ছিল, গাধা আছে আর গাধাই থাকবে!
রবিন আর নিয়ন লাফিয়ে ওঠে আমাকে মারতে। আমিও লাফিয়ে উঠি পালাতে; কিন্তু লাফটা ভালো হয় না। হুমড়ি খেয়ে পড়ি মিজানুরের লাশের ওপর। আর পড়তেই হঠাৎ মিজানুর হাঁপ ছাড়ে যেন। কেশে ওঠে খকখকিয়ে। নুড়ি বলে, বেঁচে আছে। স্যার বেঁচে আছে...
মিজানুর ঘোলা চোখে তাকায় চারদিকে। নুড়িকে দেখে বলে ওঠে, তুমি এখানে কী করছ?
নুড়ি আগাগোড়া সব বলতে শুরু করে। প্রতিটা কথায় সে আমাদের এতবার বেকুব, গাধা, ফালতু, ফাতরা বলে যে মনে হয়, গলায় কলসি ঝুলিয়ে পুনর্ভবায় শরীর ভাসিয়ে দিই। জীবনে এত অপমানও বাকি ছিল!
তবে জাহাঙ্গীর ঠিকই বলেছে। মিজানুর মানুষ ভালো। সব কথা শুনে বেচারা হেসেই দেয় শেষ পর্যন্ত। নুড়ি বলে, হাইসেন না স্যার। এদের শাস্তি দেন। নাহলে এরা আবার এ রকম করবে!
মিজানুর বলে, কাল থেকে নুড়ির বাড়িতে তোমরাও পড়তে আসবা। ম্যাথে তোমরা কেমন কী, সেটা একটু দেখা লাগবে!
নাহ্! লোকটা আসলে ভালো না!
এরই মধ্যে জাহাঙ্গীর অবশ্য হাজির। একা নয়। জাহাঙ্গীর ডেকে এনেছে পুলিশ। সিনেমার মতোই শেষ হতে যাচ্ছে তাহলে ব্যাপারটা। শেষে পুলিশ এসে বদমায়েশদের ধরে নিয়ে যাবে। আমরাই সেই বদমায়েশ।
কিন্তু কী অদ্ভুত!
নুড়ি পুরো ব্যাপারটা সামলে নেয় কীভাবে কীভাবে যেন! বলে, ইন্সপেক্টর স্যার, এরা একটু বেকুব সত্যি, কিন্তু এরা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তো… বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্য মানুষ মাঝেমধ্যে আজব কাজ করে ফেলে।
মিজানুরও তাতে সুর মেলায়। ইন্সপেক্টরও হাসে। বলে, তিনজনই তাহলে বেস্ট ফ্রেন্ড?
আমরা একসঙ্গে চিৎকার করে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা তিনজনই বেস্ট ফ্রেন্ড…তিনজনই!