টাইফুন
‘খেয়েই দেখো, অনেক মজা।’
রেলস্টেশনের উল্টো দিকের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। সবকিছু ভিজে একসা। মা এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে, বৃষ্টির জন্য দেরি হচ্ছে বোধ হয়। বুড়ো লোকটা কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরই পাইনি। পরনের জামাকাপড়গুলো জীর্ণ হলেও মুখের হাসিটা সতেজ। দেখলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। আমার দিকে বিস্কুটের একটা প্যাকেট বাড়িয়ে ধরেছে।
‘তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষুধা পেয়েছে,’ বলল সে কিছুক্ষণ পর, ‘নাও না, এখানে অনেক আছে।’
আসন্ন টাইফুনের প্রবল বাতাস ছাপিয়েও তার শরীর থেকে একটা টক টক গন্ধ কীভাবে যেন আমার নাকের রন্ধ্র বরাবর ঠিকই জায়গা করে নিচ্ছে।
‘ওহ! বিস্কুট!’ উৎসাহের সঙ্গে বলে ভদ্র ছেলের মতো দুটো তুলে নিলাম।
বিস্কুটগুলো হাতের তালুতে লুকিয়ে মুখে দেওয়ার অভিনয় করছি, এ সময় বয়স্ক ভদ্রলোক সামনের চৌরাস্তা বরাবর হাত তুলে অকস্মাৎ বলল, ‘ওই লোকটাকে দেখছ না? এদের কখনো খাটো করে দেখবে না।’ স্যুট পরিহিত একটা লোককে দেখাচ্ছে সে। রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে খুব সম্ভবত। দমকা হাওয়ায় হাতের ছাতাটা ধরে রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে।
চেহারা স্বাভাবিক রাখতে বেশ কসরত করতে হলো। আসলে আমি এতক্ষণ ছাতা আঁকড়ে ধরে থাকা লোকটাকে দেখে মনে মনে হাসছিলাম। যখনই টিভিতে টাইফুনের খবর দেখি, ক্যামেরা এ রকম কাউকে না কাউকে খুঁজে নেয়। আমি কিছুতেই বুঝে পাই না যে এ রকম বোকামি তারা কীভাবে করে! হাত থেকে মাথা অবধি ভিজে একাকার, তবুও প্রাণপণে ধরে রাখা ছাতাটা। বলতে ইচ্ছা করে, ‘আপনাদের মাথায় ঘিলু বলে কিছু আছে তো? ছাতা ওভাবে খুলে রেখেছেন কেন?’ তবে মনের এসব ভাবনা আজ অবধি কারও কাছে প্রকাশ করিনি।
‘দেখতে থাকো,’ বুড়ো লোকটা বলল, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটবে ঘটনাটা।’
তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু লোকটার কণ্ঠস্বরে কেমন যেন সম্মোহনী একটা ভাব আছে। ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিক থেকে নজর ফেরাতেই পারছি না। এখন ফুটপাতের রেলিং ধরে আছে সে, যেকোনো সময় ঝোড়ো বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিছুক্ষণ আগে ওই জায়গাটুকু পার হওয়ার সময় আমারও একই অবস্থা হয়েছিল। একদম মুখে এসে ঝাপটা মারছিল দমকা হাওয়া। চৌরাস্তার মোড় হওয়ায় বাতাস সরাসরি ধাক্কা দেওয়ার সুযোগ পায়।
‘তিন! দুই! এক!’ এ সময় হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল বুড়ো। আর ঠিক তখনই উল্টে গেল চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো লোকটার ছাতা। চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল ছাতার কাপড়, যেন কোনো অদৃশ্য ভ্যাকুয়াম ক্লিনার টেনে নিয়েছে। এখন তার হাতে কেবল সদ্য প্রয়াত ছাতার কঙ্কাল।
চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলাম না। একদম ঠিক সময়েই গুনতে শুরু করেছিল বুড়োটা, যেন আগে থেকেই জানত।
******
এ রকম লোকজনের সঙ্গে বেশি কথাবার্তা বলা যে ঠিক না, এটা ভালো করেই জানি। তা সত্ত্বেও তার বেশভূষা কিংবা শরীরের গন্ধ এখন আর তেমন ভাবাচ্ছে না আমাকে। আবারও আমার দিকে বিস্কুটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলে কয়েকটা তুলে নিলাম। মনে মনে খাওয়ার অভিনয় করার জন্য তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তবে আমার দিকে কোনো মনোযোগ নেই বুড়োর। আদিবাসী গোত্রের ছোট একটা ছেলের ব্যাপারে গল্প ফেঁদেছে এখন। বিদেশি একটা লোক একবার তাদের গ্রামে ছাতা নিয়ে গিয়েছিল। আর যে করেই হোক ছাতাটা ছেলেটার চাই।
‘ওই গ্রামের লোকেরা একে অপরকে লাঠি দিয়ে পেটাত,’ বলল বুড়ো। বাতাসের দমকে বেয়াড়া চুলগুলো উড়ছে তার। কত দিন ওগুলোতে কাঁচি চলেনি, কে জানে!
‘লাঠি?’ বললাম আমি।
‘হ্যাঁ, লাঠি। এটা ওদের একটা অনুষ্ঠানের মতো। বছরের নির্দিষ্ট সময় পুরুষেরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে একে অপরকে লাঠি বা ডাল দিয়ে আঘাত করত। সবাই একসঙ্গে নয়, একজন একজন করে। কোনো রকম শব্দ না করে যে সবচেয়ে বেশি আঘাত সহ্য করতে পারবে, তাকেই বিজয়ী ঘোষণা করত মোড়ল। আর সেবারের অনুষ্ঠানে বলা হয়েছিল, বিজয়ীকে বিদেশির আনা ছাতাটা উপহার হিসেবে দেওয়া হবে। গ্রামের লোকেরা ভেবেছিল, ছাতা জিনিসটা বিদেশিরা একে অপরকে পেটাতে ব্যবহার করে। আসলে বৃষ্টি থেকে যে বাঁচতে হবে, এই ধারণাই তাদের কখনো হয়নি। স্থানীয় পুরাণের বিশ্বাস অনুযায়ী, মানুষের পুনর্জন্ম হয় পতঙ্গের বেশে। আর সেই রূপান্তরের জন্য বৃষ্টিতে ভেজাটা জরুরি। বৃষ্টি হচ্ছে অরণ্যদেবের আশীর্বাদ।’
কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে এখন। পোকার ডিমে চোখ পড়লে যে রকম লাগে, সে রকম। লোকটার মুখে ‘অরণ্যদেব’ কথাটা শোনার পরই অস্বস্তির মাত্রা বেড়ে গেছে। রীতিমতো ভয় করছে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে। কোনো খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না তো? বুড়োর হাতের ছাতার হাতলের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছি না। হাতের বিস্কুটগুলো পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম।
এখনো কথা বলছে সে, চুলগুলোও আগের মতো উড়ছে অবিন্যস্তভাবে। ‘ছেলেটা ওই ছাতা নিজের করে পাওয়ার জন্য এতটাই মরিয়া ছিল যে গ্রামের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়। তার প্রতিদ্বন্দ্বী লোকটা একের পর এক আঘাত করতেই থাকে, তবু একবারের জন্য টুঁ শব্দটিও করেনি। বুঝতে পারছ তো? প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় বয়স আর ওজন অর্ধেক ছিল তার। অবশেষে মাঝবয়সী লোকটা যখন হাতের ব্যথার কারণে গুঙিয়ে ওঠে, ছেলেটা সেখানেই পড়ে যায়। নিশ্চল শুয়ে থাকে সেখানেই। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। মারা গিয়েছিল সে।
‘ছাতাটা কেন এভাবে চাইছিল সে, জানো?’
প্রশ্নের জবাবে দ্রুত মাথা ঝাঁকালাম, ‘ইয়ে মানে, না। জানি না।’
‘তার বিশ্বাস ছিল যে ছাতার সাহায্যে মানুষ উড়তে পারে।’
গল্পটা শেষ হওয়ায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম ঠিকই, কিন্তু মনে মনে একটু হতাশই হয়েছি। এ রকম সমাপ্তি আশা করিনি। মা যে কখন আসবে, এই বুড়োর কাছ থেকে যত দ্রুত সম্ভব নিস্তার চাই আমি। এ সময় বাতাসের বিপরীতে ছাতা খুলে রাখা আরেকজনের দিকে নির্দেশ করল বুড়ো, ‘এখনো কথাটা বিশ্বাস করে তারা।’ এরপর গুনতে শুরু করল, ‘তিন! দুই! এক!’
যা ঘটছে তা শতভাগ বাস্তব, তবু নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক লোক খুব কসরত করে ছাতা হাতেই রেলিং বেয়ে ওপরে উঠে লাফ দিল। দমকা হাওয়া নিমেষে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেল তাকে।
‘এই তো! এবার পেরেছে!’ আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল বুড়ো, ‘জানতাম যে পারবে, ওর কৌশলটা একদম ঠিকঠাক ছিল।’
স্যুট পরিহিত লোকটাকে বাতাস কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা দেখার জন্য ছাউনি থেকে মাথা বের করতেই বিমূঢ় হয়ে গেলাম। কালো মেঘে ঢাকা আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য মানুষ। প্রত্যেকেই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে আছে তার ছাতা। কমপক্ষে পঞ্চাশ জন তো হবেই। বেশিও হতে পারে।
আমি নিশ্চিত যে একমুহূর্ত আগেও আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল বুড়োটা। কিন্তু আমি পেছনে ফিরে দেখি, সেখানে কেউ নেই। ছাউনিতে আমি একা।
‘পরে কখনো দেখা হবে আবার!’ মাথার ওপর থেকে একটা শব্দ শুনতে পেলাম এ সময়। ছাতা হাতে বুড়োও যোগ দিয়েছে অন্যদের সঙ্গে।
******
এখন আর কাউকে ঝড়ের মধ্যে ছাতা ফুটিয়ে হাঁটতে দেখলে হাসি পায় না। তাদের অপরিমেয় মানসিক শক্তিকে খাটো করে দেখার আমি কে? তারা প্রকৃতির এমন কিছু রহস্য সম্পর্কে অবগত, যার সম্পর্কে ছিটেফোঁটা ধারণাও নেই আমার। ভবিষ্যতে আমি যদি কখনো ছাউনিতে ঝড়ের মধ্যে আটকা পড়ি আর আমার পাশে ছোট একটা ছেলে এসে দাঁড়ায়, তাহলে তার দিকে বিস্কুটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলব, ‘খেয়েই দেখো, অনেক মজা।’
বাসায় ফেরার পথে পকেট থেকে একটা বিস্কুট বের করে মুখে দিলাম। আমার এগারো বছরের জীবনে এ রকম সুস্বাদু কিছু খাইনি কখনো।
বুড়ো লোকটাকে পরদিন রাস্তায় পাওয়া যায়, একটা বাস চলে গিয়েছিল তার ওপর দিয়ে। কিন্তু সুযোগ পেলেই তার গল্পটা আমি সবাইকে বলে বেড়াই। যদি ঠিকঠাক বলা যায়, তাহলে ‘পরে কখনো দেখা হবে আবার!’ অংশটুকু লোকজনের বাহ্বা কুড়াবেই।