হ্যাদোয়ার
পুলিশের চাকরিতে ঢোকার আগে বড় বড় স্বপ্ন দেখেছিল মাহবুব। চলন্ত ট্রেনে লাফিয়ে উঠে ডাকাত দলের মোকাবিলা করা, ঘোড়া ছুটিয়ে খুনিকে পাকড়াও করা—এমনকি বঙ্গোপসাগরে ডুবসাঁতার দিয়ে জলদস্যুদের নাস্তানাবুদ করার মতো স্বপ্ন দেখেছিল সে। বলা বাহুল্য, সেসব স্বপ্নের অধিকাংশই ছিল হলিউডি সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত। সারদার পুলিশ একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে সে যখন বিরামপুর থানায় যোগ দিল, তখন অকস্মাৎ চুপসে গেল তার স্বপ্নের বেলুন। রুপালি পর্দা ও বাস্তবের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব। হররোজ ডাকাতি হয় না। চুরি-ছিনতাইও হয় না। মানুষ খুনও হয় কদাচিৎ। কাজকর্ম না থাকায় মাহবুব থানায় বসে বসে হাই তুলে দিন কাটাতে লাগল। বিরামপুরে সিনেমা হল নেই। কল্পনার ঘড়িতে দম দেওয়ার জন্য নিয়মিত ডিটেকটিভ নভেল পড়ার অভ্যাসটা চালু রাখল সে।
তখন ইংরেজ শাসনের যুগ। দেশ তখনো ভাগ হয়নি। বাংলার রাজধানী ঢাকা নয়, কলকাতা। বিরামপুর থেকে দার্জিলিং মেইল ট্রেন ধরে অনায়াসে কলকাতায় যাওয়া যায়। কাজকর্ম বিশেষ নেই বলে দারোগা মাহবুব রেলস্টেশন এলাকায় ঘুরে বেড়ায় এবং অপেক্ষা করে, কখন আসবে বীরত্ব দেখানোর মওকা! কিন্তু কয়লায় চালিত ট্রেন একরাশ ধোঁয়া ও কয়লার কুচি উড়িয়ে যায়-আসে। অপরাধ-টপরাধ ঘটে না।
মাহবুবের হতাশা দেখে কনস্টেবল শম্ভু নাথ বলে, ‘ঘাবড়াবেন না, স্যার। সবে শুরু, বীরত্ব দেখানোর ঢের সুযোগ পাবেন। তখন ছিলাম বিহারের কারমাটাঁড় থানায়। বড় দারোগা ছিলেন কপিলাকান্ত মুখার্জি। বাঘের মতো বিরাট মাথা, অজগরের মতো গোঁফ, আষাঢ়ের মেঘের মতো ঘন ভুরু। যখন গর্জন ছাড়তেন, মনে হতো শ্রাবণের মেঘ ডাকছে...।’
বিরক্ত হয়ে চলে যায় মাহবুব। একবার কথা বলতে শুরু করলে শম্ভু আর থামতে চায় না। এমনিতে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি নেহাত কম নয়। পুলিশের চাকরিতে ইতিমধ্যে ৩৪ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। আর বছর দুয়েকের মধ্যে রিটায়ারমেন্টে চলে যাবে। তার দোষের মধ্যে আছে ভাং সেবন। দিন নেই, রাত নেই ভাঙের শরবত সে পান করবেই। গালমন্দ, চাকরি থেকে বরখাস্তের ভয়—কিছুতেই সে নেশা ছাড়তে রাজি নয়। ভাং খেলে তার মুড ভীষণ ভালো হয়ে যায়। হয় সে গলা ছেড়ে ভাওয়াইয়া গান ধরে, নইলে পুলিশি জীবনের গল্প বলতে আরম্ভ করে। একই জেলায় বাড়ি বলে মাহবুব ও শম্ভুর মধ্যে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা আছে। নাম ধরে ডাকার রেওয়াজ থাকলেও সে শম্ভুকে নানা বলে ডাকে। বুড়ো, হ্যাংলা, কাঁচা-পাকা দাড়ি কামাতে ভীষণ অনীহ শম্ভু নাথ এতে ভীষণ খুশি হয়। মাহবুবকে সে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় অভয় দেয়, ‘হিরোইজম দেখানোর সুযোগ অনেক পাবেন, স্যার। আপাতত কেবল ধৈর্য ধরুন।’
সুযোগটা এত শিগগির আসবে, মাহবুব আশা করেনি। থানার বড় দারোগা আনোয়ার হোসেন সেদিন ভোরে কুয়ার পানিতে গোসল করতে গিয়ে ভিজে শেওলায় আছাড় খেয়ে কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা পেলেন। পল্লিচিকিৎসক ভোলানাথ বর্মণ এসে দারোগা সাহেবের কোমর টিপেটুপে হাসপাতালে ভর্তি হতে বললেন। অগত্যা বড় দারোগা সাহেবকে গরুর গাড়িতে তুলে সদরের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সিনিয়রিটিতে তার পরই মাহবুব। সুতরাং, থানার দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে।
অঘটন ঘটল সেদিন রাতে। থানা থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের সোনাঝুরি গ্রাম থেকে খবর এল, গ্রামের কৃষক আজিজার মুন্সির গোয়ালের বেড়া কেটে সাতটি গরু নিয়ে গেছে চোরেরা। মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠল মাহবুব, এখন বাজে সকাল আটটা। চোরের দল গরুর পাল নিয়ে এতক্ষণে কোথায় সটকে পড়েছে কে জানে! থানার আস্তাবল থেকে সবচেয়ে তাগড়া ঘোড়াটা নিয়ে টগবগিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে ছুটল সে। শম্ভুও চুরির খবর শুনে ঘুম থেকে উঠেছিল। সে চোখ রগড়ে দারোগার পিছু নিল।
আজিজারের গোয়াল দেখে মনে মনে প্রমাদ গুনল মাহবুব। ইছামতী নদীর তীরে ঢালু মতন একটুকরা জায়গায় আজিজার মুন্সির বাড়ি। সেটাকে মাউন্ট এভারেস্টের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায়, একেবারে শীর্ষে আজিজারের বাঁশ ও খড়ের দুখানা ঘর। মাঝখানে বেজক্যাম্পে লাউ-কুমড়ার মাচা ও সর্বনিম্ন বিন্দুতে আধা ভাঙা শণের বেড়ার একখানা গোয়ালঘর। তার একেবারে পাশেই মৃতপ্রায় ইছামতী নদী। ঘর থেকে গোয়ালে রাতের অন্ধকারে কোনোভাবেই সুস্থভাবে আসা সম্ভব নয়। একবার হোঁচট খেয়ে পড়লে গড়াতে গড়াতে একেবারে নদীতে গিয়ে পড়তে হবে। চোরের দল নিশ্চিত নদী পার হয়ে এসেছিল।
নদীর পাড়ে গিয়ে ব্যাপারটা নিশ্চিত হলো মাহবুব। কাদার মধ্যে গরু ও মানুষের অনেকগুলো পায়ের ছাপ। মানুষের খালি পা, কোনো জুতার ছাপ নেই।
‘ইশ্!’ দুম করে হাতে কিল মেরে বলল মাহবুব, ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মতো আমাদেরও যদি থানায় প্লাস্টার অব প্যারিসের ব্যবস্থা থাকত। এই পায়ের ছাপ সংরক্ষণ করে সন্দেহভাজনদের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারতাম।’
বিড়বিড়িয়ে খানিকটা আপনমনেই কথাটা বলেছিল মাহবুব, কিন্তু পাশ থেকে শম্ভুনাথ শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় বলল, ‘বিলাতি পা আর বাঙালির পায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে স্যার। শুকনা মাটিতে যা চীনা মেয়ের পায়ের মতো, কাদামাটিতে আবার সেটাই হাতির মতো ধ্যাবড়া হয়ে পড়ে।’
‘এ কী নানা, তুমি কখন এলে?’ মাহবুব বিস্মিত হয়ে বলল।
‘অনেকক্ষণ। তদন্ত করতে আপনি এতই মশগুল ছিলেন যে ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাননি।’ শম্ভু গম্ভীর গলায় বলল। অদূরে তার ঘোড়াটি গরুর জন্য রাখা খড়ের সদ্ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
আজিজার মুন্সি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘গরুগুলো বড় আদরের ছিল সাহেব। আজ পাঁচ বছর ধরে সন্তানের মতো পেলেপুষে বড় করেছি। দুটি থেকে সাতটি হয়েছিল। আমার মেয়ে রমিছা ওদের শোকে বিছানায় পড়েছে। আমি সারা দিন খেতে কাজ করি। গরুগুলো ও-ই পালন করত।’
মাহবুব বলল, ‘চিন্তা করবেন না। গরুগুলো ঠিক উদ্ধার হয়ে যাবে; কিন্তু এভাবে নদীর পাড়ে কেউ গোয়াল বানায়? আপনার সৌভাগ্য যে গরুগুলো আগে চুরি হয়নি।’
মাহবুবের তর্জন-গর্জন শুনে ঘর থেকে রমিছা বেরিয়ে এল। বয়স ১০ কি ১২। পরনে তাঁতের শাড়ি। খালি পা। নাকে নাকছাবি। চোখের কোণে কান্নার দাগ শুকিয়ে এসেছে। সে তার বাবার পাশে এসে দাঁড়ালে মাহবুব বলল, ‘এই বুঝি আপনার মেয়ে রমিছা? তো রমিছা, সর্বশেষ গরুগুলোকে কখন দেখেছ?’
‘গতকাল সন্ধ্যায়। গোয়ালে ঢুকিয়ে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলাম।’ ভাঙা গলায় বলল রমিছা।
মনে মনে লজ্জিত হলো মাহবুব। গোয়ালটাই তো এখনো দেখা হয়নি। সে কাদা ও গোবর এড়িয়ে গোয়ালের চারপাশটা ঘুরে দেখল। গোয়ালের পেছন দিকে সিঁদ কেটে ভেতরে ঢুকেছে চোর। তারপর ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে শণের বেড়া কেটে বের করে নিয়েছে গরুগুলো।
‘তার মানে, চোর ছিল কমপক্ষে চারজন। নইলে অতগুলো গরু সামলাতে পারবে না।’ ভাবল মাহবুব। আজিজারকে জিজ্ঞেস করল, ‘এতগুলো গরু নিয়ে গেল, আপনারা কোনো শব্দ পাননি?’
আজিজার কলের পুতুলের মতো ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘একটা পাতা পড়ার শব্দও পাইনি।’
রমিছা বাপকে ধমক দিয়ে বলল, ‘ঘুমালে তোমার কি হুঁশ থাকে, বাবা?’
আরও কিছুক্ষণ সূত্রের সন্ধানে খানাতল্লাশি করল মাহবুব। চোরেরা খুবই পেশাদার। একটা সুতাও ছেড়ে যায়নি।
ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে প্রায় এককোমর পানি ডিঙিয়ে ওপারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মাহবুব ও শম্ভুর জামাকাপড় ভিজে জবজবে হয়ে গেল। তীরে উঠতে গিয়ে শম্ভু একবার পিছলে পড়েছিল। পড়বি তো পড়, একেবারে একতাল কাদার মধ্যে পড়েছে। সেই কাদা মুখে মেখে শম্ভুকে দেখাচ্ছে একেবারে সঙের মতো। মাহবুবের তাড়া খেয়ে সে মুখ ধুয়ে এল।
জ্যৈষ্ঠের গরমে ঘামতে ঘামতে শিউরে উঠল মাহবুব। নদীর ওপারে কয়েক মাইল বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। ধান কাটার পর শূন্য পড়ে আছে। মাঠ পেরিয়ে পরবর্তী লোকালয়টি হলো কুখ্যাত ত্রিমোহনী গ্রাম। গরুচোরদের একচেটিয়া নিবাস সেখানে। কিন্তু ওরা কখনো নিজেদের এলাকায় চুরি করে না। দূরদূরান্তে যায়। এ জন্য পুলিশও বিশেষ ঘাঁটায় না ওদের। ওরা কি তবে নিয়ম ভেঙে আজিজারের গোয়ালে হানা দিয়েছে?’
শম্ভু মাহবুবের কানে কানে বলল, ‘দুই দিন পরই কোরবানির ঈদ। তাড়াতাড়ি করতে হবে স্যার। নইলে একবার হাটে উঠলে গরুগুলোর লেজও খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
মাথা নেড়ে সায় দিল মাহবুব। তারপর আজিজারকে প্রশ্ন করল, ‘গরুগুলোকে চিনব কী করে?’
রমিছা তাকে দাঁড়াতে বলে এক দৌড়ে বাড়ির ভেতর থেকে পিতলের একটা ছোট্ট ঘণ্টা এনে বলল, ‘এই ঘণ্টা বাজাবেন। গরুগুলো এর আওয়াজ চেনে। যেখানেই থাকুক সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসবে।’
মাহবুব ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে শেষ প্রশ্নটা করল, ‘আচ্ছা ৮-১০ দিনের ভেতর আপনাদের বাড়িতে সন্দেহজনক কেউ এসেছিল?’
আজিজার আমতা-আমতা করে বলল, ‘সে রকম কাউকে তো মনে পড়ছে না।’
রমিছা কিন্তু নির্দ্বিধায় বলল, ‘একজন বেঁটে, কালোমতো লোক এসেছিল। বাবা, তোমার মনে নেই? ওই যে লোকটার গালভর্তি গুটিবসন্তের দাগ? আমাদের গোয়ালের দুটি গরু কিনতে চেয়েছিল। দামে বনিবনা হয়নি বলে মুখটা কী রকম অন্ধকার করে চলে গেল।’
‘সেই লোককে তোমার সন্দেহ হয়?’ মাহবুব দৃঢ় গলায় প্রশ্নটা করল।
রমিছা বলল, ‘হতেও পারে। লোকটার চাহনিটা কেমন যেন ডাকাতের মতো ছিল। গরুগুলোর দিকেও কেমন লোভীর মতো তাকাচ্ছিল। বাবা প্রায় রাজিই হয়ে গিয়েছিল লোকটার দামে। কিন্তু আমার ওকে একটুও পছন্দ হয়নি। তাই রাজি হইনি।’
শম্ভু ফিসফিসিয়ে বলল, ‘হ্যাদোয়ার হতে পারে, স্যার।’
মাহবুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাদোয়ার? সেটা আবার কী?’
শম্ভু চাপা গলায় বলল, ‘হ্যাদোয়ার জানেন না? সোর্স, স্যার, সোর্স। আমাদের পুলিশের যেমন ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট আছে, যাকে বলে আইবি। চোরদেরও সে রকম ইন্টেলিজেন্সের লোক আছে। ওরা চোরদের হয়ে সোর্সের কাজ করে। কার গোলায় কতটুকু ধান আছে, কার সিন্দুকে কত টাকা আছে, গোয়ালে কতগুলো গরু আছে—সব খবর চোরদের হ্যাদোয়াররাই দেয়। ওরা ছদ্মবেশ ধারণে পটু। পরিচয় ভাড়িয়ে লোকেদের মিষ্টি কথায় ভোলাতে ওস্তাদ। ওরা কখনো ফেরিওয়ালা, কখনো ভিখারি, কখনো মজুরের ছদ্মবেশ ধরে বাড়িতে আসে। এসে ভালো করে দেখে নেয় বাড়িতে কী কী আছে। কোন পথে ঢুকতে হবে, চুরি করে কোন পথে সটকে পড়তে হবে—সবই মনের মধ্যে গেঁথে নেয়। গেরস্ত কখন ঘুমাতে যায়, সকালে কখন ওঠে, বাড়িতে অস্ত্রশস্ত্র কিছু আছে নাকি, তার খবরও হ্যাদোয়াররা জোগাড় করে দেয়। সেই সব খবর শুনে চোরেরা টার্গেট ঠিক করে। তারপর চৌর্যবৃত্তি সেরে পালিয়ে যায়। বিনিময়ে হ্যাদোয়ারদের কিছু বখরা দিতে হয়। ওটাই ওদের জীবিকা।’
মাহবুব ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, ‘তুমি বলছ ওই লোকটা হ্যাদোয়ার হতে পারে?’
তাড়া দিয়ে বলল শম্ভু, ‘সত্যি সত্যি গরুর দালালও হতে পারে। ত্রিমোহনী গাঁয়ের লোকেরা তো সেটাই পরিচয় দেয়। তাড়াতাড়ি সেখানে চলুন।’
রমিছার ঘণ্টাটা পকেটে পুরে ত্রিমোহনী গাঁয়ের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল মাহবুব। লাল পাগড়ি পরা শম্ভুনাথ আরেকটি ঘোড়ায় চড়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগল।
ত্রিমোহনী গ্রামটা ভৌগোলিকভাবে একটু অদ্ভুত। গাঁয়ের এক পাশে একটা মরা নদী বয়ে গেছে। দুদিকে বইছে ইছামতী নদী। জ্যৈষ্ঠ মাস বলে নদীতে তেমন পানি নেই। অন্য পাশটা বছর কুড়ি আগেও শুকনা ছিল। গাঁয়ের দুষ্ট চোরেরা পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেটুকুও খুঁড়ে গ্রামটাকে একটা দ্বীপের রূপ দিয়েছে। যাকে বলে একেবারে দুর্ভেদ্য গ্রাম।
ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে প্রায় এককোমর পানি ডিঙিয়ে ওপারে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মাহবুব ও শম্ভুর জামাকাপড় ভিজে জবজবে হয়ে গেল। তীরে উঠতে গিয়ে শম্ভু একবার পিছলে পড়েছিল। পড়বি তো পড়, একেবারে একতাল কাদার মধ্যে পড়েছে। সেই কাদা মুখে মেখে শম্ভুকে দেখাচ্ছে একেবারে সঙের মতো। মাহবুবের তাড়া খেয়ে সে মুখ ধুয়ে এল।
গ্রামে ঢুকতেই কড়ইতলায় একজন বেঁটে লোকের সঙ্গে মাহবুবদের দেখা হয়ে গেল। লোকটাকে দেখেই শম্ভু চাপা গলায় চিঁ চিঁ করে বলল, ‘ওই যে হ্যাদোয়ার, স্যার। ব্যাটা আবার একটা গরুও চরাচ্ছে। শিগগির পাকড়াও করুন।’
মাহবুবও লোকটাকে দেখেছিল। সে ইশারায় শম্ভুকে চুপ করতে বলে লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। লোকটা নির্বিকার। লুঙ্গিটাকে হাফপ্যান্টের মতো ফোল্ডিং করে পরেছে, বাদবাকি গা খালি। মাহবুবকে দেখে চৌকিদারের মতো একটা স্যালুট ঠুকল সে। স্যালুট পেয়ে মাহবুব অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল। কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে বলল, ‘তুমি কি চৌকিদার?’
‘জি, স্যার।’ লোকটা বলল বিগলিত গলায়। লুঙ্গির প্যাঁচ শক্ত করে বেঁধে সে আবার বলল, ‘প্রতি সপ্তাহে থানায় রোলকলে যাই। স্যার বুঝি খেয়াল করেননি?’
লজ্জিত হলো মাহবুব। কত চৌকিদারই তো থানায় হাজিরা দিতে আসে, কতজনকে মনে রাখা যায়? সে মর্যাদা বজায় রাখার অভিলাষে জোর গলায় বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। চিনেছি তো।’
চৌকিদারের এক হাতে একটা দড়ি। যার এক প্রান্তে একটা এঁড়ে বাছুর বাঁধা। দড়ির খুঁটাটা নরম মাটিতে গাঁথতে গাঁথতে সে বলল, ‘তারপর এদিকে কেন আসা হলো, হুজুর?’
এইবার খ্যাঁক করে উঠল শম্ভু। দারোগার অনুকরণ করে বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে বলল, ‘এই গরু কোথায় পেয়েছ? চুরির মাল নয়তো?’
চৌকিদার বিগলিত হয়ে বলল, ‘কী যে বলেন স্যার! চুরির মাল কেন হতে যাবে? এটা আমার বাছুর। পেলেপুষে বড় করছি। খুব দুষ্টু বাছুর স্যার। ছাড়া পেলেই মুশকিল। একবার এর খেতে তো আরেকবার অন্য কারও খেতে মুখ দেয়। সে জন্য চোখে চোখে রাখি।’
শম্ভু দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল, ‘চোর না হলেও তুমি নিশ্চয়ই হ্যাদোয়ার। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা।’
একটুও না ভড়কে চৌকিদার বলল, ‘আপনি ভুল করছেন, স্যার। আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। হ্যাদোয়ার হতে যাব কেন? অন্যদের মতো আমরাও পরিশ্রম করে খাই। পূর্বপুরুষের কিছু দোষত্রুটি ছিল, এ কথা আমি মানি। কিন্তু সেসব সেই কবেকার কথা। ত্রিমোহনী গাঁয়ের মানুষ এখন আর ওসবে নেই।’
‘আচ্ছা। চলো, খানাতল্লাশি করব তোমার বাড়িতে। যদি চোরাই গরু পাই, তাহলে চৌদ্দ শিকের ভাত খাইয়ে ছাড়ব। বুঝেছ?’ কড়াভাবে বলল মাহবুব।
‘সে তো আমার সৌভাগ্য, স্যার।’ ঘাবড়াল না চৌকিদার, ‘আমার বাড়িতে দারোগা সাহেবের পায়ের ধুলা পড়বে, এ তো পরম সৌভাগ্য। আজ কিন্তু না খেয়ে যেতে পারবেন না।’
মাঠের ভেতর দিয়ে অনেকটা পথ হেঁটে তিনজনে পৌঁছাল চৌকিদারের বাড়ি। ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় কোনো জনমানবের বসতি নেই। ফসলের মাঠের মধ্যে একখণ্ড উঁচু জমির ওপর বানানো হয়েছে বাড়িটা। বাড়ি মানে খড়ের দুখানা ঘর। একটা গোয়ালঘর। গোয়ালঘরে কোনো বেড়া নেই। একটা হাড্ডিসার ময়লা রঙের ষাঁড় হাঁটু গেড়ে বসে জাবর কাটছে। চারপাশে কলা, সফেদা ও নারকেলগাছ বাড়িটা ঘিরে আছে প্রাচীরের মতো। শম্ভু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।
চৌকিদার বলল, ‘ঘরের ভেতরে চলুন, হুজুর। গরিব মানুষের বাড়ি, স্যার। কোথায় বসাতে গিয়ে কোথায় বসাই, ভুল হলে মাফ করবেন।’
‘বাড়িতে কে কে আছে?’ ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল মাহবুব।
‘আমি, আমার স্ত্রী আর আমার বাবা। আমি আর স্ত্রী এই ঘরে থাকি। বাবা বুড়ো মানুষ, ওই ঘরে একা থাকেন। তা ছাড়া আমাদের ছেলেপুলে নেই।’
মাহবুব ঘরের ভেতরে গেল না। ঘুরে ঘুরে বাইরে থেকে ঘরগুলো দেখতে লাগল। উঠানের এক কোণে চৌকিদারের স্ত্রী ঘোমটা টেনে রান্নাবান্নার কাজ করছে। চৌকিদার সুরেল গলায় বলল, ‘শুনছো, দারোগা সাহেবের জন্য চা করো তো।’
মাহবুব গম্ভীর গলায় বলল, ‘চা খাব না। ঘন দুধ থাকে তো খেতে পারি।’
চৌকিদার সোল্লাসে বলল, ‘আছে মানে, খুব ভালো দুধ আছে। কই গো, স্যারদের দুই গ্লাস গরম দুধ দাও।’
মাটির গ্লাসে সর ওঠা দুই গ্লাস দুধ এল। তাতে চুমুক দিতে দিতে চোখাচোখি করে নিল মাহবুব ও শম্ভু।
চৌকিদার মাহবুবদের জন্য গাছের ডাব পেড়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছিল। তাকে থামিয়ে জেরার মতো করে মাহবুব বলল, ‘তোমার বাড়িতে তো দুটিই ষাঁড় দেখছি। তা দুধ কোথায় পেলে?’
চৌকিদার খানিকক্ষণ হে হে করে হেসে বলল, ‘গরিব মানুষের কি শখ-আহ্লাদ থাকতে নেই, হুজুর? দুধ কিনে এনেছি। বাবা বুড়ো মানুষ। দুধ খেতে খুব পছন্দ করেন। রোজ দুই গ্লাস করে খান।’
মাহবুব ও শম্ভু গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। পেছনের দিকে মাটি বেশ স্যাঁতসেঁতে। তাতে অনেকগুলো খুরের দাগ পড়েছে। শম্ভু আড়চোখে মাহবুবের দিকে তাকিয়ে দেখল, গভীর মনোযোগ দিয়ে দাগগুলো পরীক্ষা করছে সে।
খুরের দাগগুলো উঠানের এক প্রান্তে গিয়ে মিলিয়ে গেছে। সেখানে বেশ খানিকটা জায়গা ঝোপঝাড়ে বোঝাই। চৌকিদারের পরিষ্কার নিকানো উঠানের সঙ্গে জায়গাটার কোনোই মিল নেই। সেদিকে দেখিয়ে মাহবুব বলল, ‘ওখানে কী আছে?’
এইবার মেজাজ হারাল চৌকিদার। যে খানিকটা রূঢ় গলায় বলল, ‘কেন শুধু শুধু গরিব মানুষকে সন্দেহ করছেন? দেখাই যাচ্ছে আগাছার জঙ্গল গজিয়েছে, তারপরও কেন জিজ্ঞেস করছেন? এই যে আমি ঝোপের ওপর গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। এবারে খুশি তো?’
রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল শম্ভু, কিন্তু মোটেই রাগল না মাহবুব। বাঁ হাত তুলে থামিয়ে দিল শম্ভুকে। ডান হাতে পকেট থেকে বের করে আনল সেই ছোট্ট পেতলের ঘণ্টাটি। কালবিলম্ব না করে জোরে জোরে বাজাতে শুরু করল ঘণ্টা। অমনি যেন লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে গেল। প্রচণ্ড ধাক্কায় চৌকিদার উড়ে এসে পড়ল মাহবুবদের সামনে। আগাছার ঝোপটি ভেদ করে ততক্ষণে প্রকাণ্ড শিংওয়ালা একটা লাল রঙের ষাঁড় বেরিয়ে এসেছে। তার পিছু পিছু একে একে আরও ছয়টি গরু ও বাছুর বেরিয়ে এল।
শম্ভু তাড়াতাড়ি গিয়ে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলল চৌকিদারকে। পরাজিতের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সে।
মাহবুব ঝোপের নিচের গুপ্ত কুঠুরিটা পরীক্ষা করে দেখতে দেখতে বলল, ‘ভালোই প্ল্যান করেছিলে। চোরাই গরু লুকানোর হেব্বি বন্দোবস্ত করেও শেষ রক্ষা হলো না।’
চৌকিদারকে ঘোড়ার পিঠে তুলে থানার দিকে ছুটল মাহবুব। ভেবেছিল লোকটা হ্যাদোয়ার, আসলে সে-ই চোরের সরদার। থানায় গিয়ে লোকটাকে ভালোমতো জিজ্ঞাসাবাদ করে এর সঙ্গীসাথিদের ঠিকুজি বের করতে হবে।
মাঠের বুক চিরে মাহবুব ও শম্ভু নাথের ঘোড়া ঊর্ধ্বশ্বাসে থানার দিকে ছুটতে আরম্ভ করল। টগবগ শব্দে কান পাতা দায়। তারপরও শম্ভু চেঁচিয়ে বলল, ‘বলেছিলাম না স্যার, হিরোইজম দেখানোর সুযোগ অনেক পাবেন।’