ভূতেরা সব কোথায় গেল

কখনো ভেবেছেন, আজকাল ভূতেদের তেমন একটা দেখা যায় না কেন? কোথায় হারিয়ে গেল ওরা?

আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে একটা লোকের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা হয়েছিল। লোকটা পেশায় আইনজীবী, তখনো খুব একটা নাম করতে পারেনি। ফলে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। তো একবার সে করল কী, শহরের কোনার দিকের এক পুরোনো বাড়ির পুঁচকে একটা ঘর ভাড়া নিল।

বলে রাখি, ঘরটা অনেক বছর ধরেই বন্ধ ছিল। ওই বাড়ি নিয়ে নানা কাহিনি ছড়িয়ে ছিল এলাকার লোকেদের মুখে মুখে। ওখানে নাকি অতৃপ্ত আত্মারা থাকে। কিন্তু তাতে ওটার মালিকের খুব একটা আসত-যেত না। ঘরগুলোর ভাড়া ছিল খুবই কম...তাই কম রোজগারের লোকেদের ভিড় লেগেই থাকত। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়, তাদের আবার ভূতের ভয় করলে চলে! আমার পরিচিত লোকটা সেই বন্ধ ঘরটা নিয়মিত ভাড়ার অর্ধেকে পেয়ে গেল। যেহেতু ওটা দীর্ঘকাল বন্ধ ছিল আরকি।

ঘরটায় আসবাব বলতে একটা বড় আলমারি, কিছু পুরোনো কাগজপত্র (না জানি কোন ভাড়াটে সেসব রেখে গিয়েছিল) আর একটা টেবিল। একমাত্র জানালায় ঝুলছিল সবুজ পর্দা, পুরোনো ফায়ারপ্লেসটায় জমে আছে একরাশ ধুলা। আলমারি দিয়ে সে কী করবে? হুম, কাগজপত্রগুলো রাখা যেতে পারে...জামাকাপড়ও রাখতে পারবে।

খানিক পরই নিজের সব আসবাব নিয়ে এল লোকটা। আসবাব বলতে চারটে পুরোনো চেয়ার, একটা ছোট্ট ব্যাগ আর কিছু কাগজ। চেয়ারগুলো বেশ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখল লোকটা। তারপর ফায়ারপ্লেসের সামনে এক বোতল পানীয় নিয়ে বসল সে। পরিচিত দোকান থেকে ধারে কিনেছে ওটা। কবে দাম দিতে পারবে, সেটাও জানে না। একদৃষ্টে আলমারিটার দিকে তাকিয়ে রইল সে।

‘কী ফালতু একটা ঘরে উঠলাম,’ আপনমনেই বলে উঠল সে, ‘আজকাল দালালরা যা হয়েছে না! এতগুলো টাকা নিয়ে কেমন পুরোনো একটা বাড়িতে উঠিয়ে দিল আমাকে!’

অভিযোগটাই আসলে ফালতু। ওর পকেটে যে টাকা ছিল, তা দিয়ে এর চেয়ে ভালো ঘরে ওঠা একেবারেই সম্ভব নয়। দালালের কোনো দোষই নেই।

‘কী উদ্ভট একটা আলমারি,’ চেঁচিয়ে উঠল সে, ‘আমি বাড়ির মালিক হলে এতক্ষণে এটাকে টুকরা টুকরা করে ফায়ারপ্লেসে দিয়ে দিতাম!’

ঠিক তখন একটা অদ্ভুত আর্তনাদের শব্দ এল ওর কানে। শব্দটা এসেছে আলমারির দিক থেকে! চমকে উঠল আইনজীবী! কিসের শব্দ? পাশের ঘরের ভাড়াটে তো একটু আগেই বাইরে খেতে গেল! তবে? বাড়ির এদিকটায় এই দুটোই ঘর। বাকি সব ভাড়াটে অপর পাশে থাকে।

আরও পড়ুন

আবার সেই শব্দ হলো আর আলমারির পাল্লা দুটো গেল খুলে। অবাক হয়ে আইনজীবী খেয়াল করল যে আলমারির ভেতর এক বেঁটে লোক দাঁড়িয়ে আছে। পরনে অদ্ভুত পোশাক...বেশ পুরোনো ধাঁচের! এই যুগে কেউ এগুলো পরে নাকি? লোকটার চেহারা ফ্যাকাশে, চোখগুলো কেমন যেন বসা...অবাক দৃষ্টিতে আইনজীবীর দিকে তাকিয়ে রইল সে।

অস্বস্তিকর সেই চাহনি।

‘কে?’ লাফিয়ে উঠল আইনজীবী, ফায়ারপ্লেস খোঁচানোর লাঠিটা তুলে নিল সে, ‘কীভাবে ঢুকলেন? আমি তো ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করেই বেরিয়েছিলাম!’

‘লাঠিটা ছুড়ে শুধু শুধু নিজের শক্তি নষ্ট করবেন না,’ খোলা গলায় বলে উঠল সেই অদ্ভুত লোক, ‘ওটা আমার কিছুই করতে পারবে না...দেহের ভেতর দিয়ে চলে যাবে। আসলে আমি একজন ভূত...বুঝলেন? এসব লাঠিতে আর কী হবে?’

ভূতের কথা শুনে খানিকটা চমকে উঠল আইনজীবী। কিন্তু ভয় পেল না। আইনজীবীদের অত সহজে ভয় পেলে চলে!

‘তা ভূত সাহেব,’ বলে উঠল সে, ‘কী চান আপনি? হুম?’

‘এই ঘরেই আমার মৃত্যু হয়েছিল, বুঝলেন? দীর্ঘদিন ধরে জমিজমা নিয়ে আত্মীয়দের সঙ্গে বিবাদ চলছিল। আলমারির পুরোনো কাগজগুলো দেখছেন? ওই সব মামলারই কাগজ। সব কটি মামলায় হেরে যাই আমি...সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারিনি! সারা দিন এই ঘরে শুয়ে থাকতাম...তারপর একদিন পট করে মরে গেলাম! শোক সহ্য করতে পারিনি আরকি। যা–ই হোক, আপনি কে হে? যে আলমারিতে আমি থাকি, সেটাই পোড়ানোর কথা বলছেন? ওসব বাদ দিন...চলে যান এ ঘর থেকে। এ ঘর আমার। এখানে কোনো মানুষকে থাকতে দেব না আমি...চলে যান, নইলে ফল ভালো হবে না!’

অবস্থা বেগতিক দেখে আইনজীবী বলে উঠল, ‘দেখুন, আপনি আমার আগে থেকে এই ঘরে আছেন। সে অধিকারে আমাকে চলে যেতে বলতেই পারেন। আমিও জোর করে এই ঘরে থাকতে চাই না। তবে যাওয়ার আগে আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই...যদি অনুমতি দেন।’

‘বলুন।’

‘মানে, একটা জিনিস আমার মাথায় ঢোকে না। আপনারা ভূতেরা এমন কেন?’

‘মানে?’

‘মানে এই যে এই নোংরা ঘরটা...এখানেই আপনার মৃত্যু হয়েছিল...ভালো কোনো স্মৃতিও নেই! তো এখানেই কেন আপনাকে থাকতে হবে? আমি শুনেছি, আপনারা উড়ে উড়ে যেখানে খুশি চলে যেতে পারেন...পৃথিবীতে কত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে, এমনকি চাইলে মহাকাশেও যেতে পারেন! আপনারা এই সব নোংরা বাড়িতেই কেন পড়ে থাকেন? হুঁ?’

‘তা–ই তো!’ অবাক হলো ভূতটা, ‘এভাবে তো ভেবে দেখিনি!’

‘সেটাই তো...এই যে দেখুন, একটা পুঁচকে আলমারিতে কষ্ট করে আছেন! কেমন বাজে আর স্যাঁতসেঁতে একটা জায়গা...ওখানে কেন থাকবেন? লন্ডন শহরেই কত বড় বড় বাড়ি আছে...ওগুলোয় গিয়ে থাকুন! কেউ আপনাদের মানা করবে না...আর ভূতদের মানা করার সাহসই–বা আছে কজনের?’

আরও পড়ুন

‘স্যার!’ চেঁচিয়ে উঠল ভূতটা, ‘অনেক ধন্যবাদ আমার চোখ খুলে দেওয়া জন্য! এই ফালতু জায়গায় থাকতে থাকতে আমার মন বিষিয়ে গেছে। এবার একটু অন্য জায়গায় যাওয়া দরকার, এখানে আর ফিরব না!’

ভূতটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে শুরু করল। ওর পা দুটো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল...তখনই আইনজীবীর মাথায় একটা নতুন জিনিস খেলে গেল।

‘ও স্যার,’ বলে উঠল সে।

‘হ্যাঁ বলুন...’

‘আপনার মতো আরও যেসব অশরীরী ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা আছেন, তাঁদেরও একটু বলে দেবেন, এই সব পুরোনো জায়গায় যেন না থাকেন। আরামদায়ক আর ভালো জায়গায় থাকলে আপনাদের মন ভালো থাকবে...মানুষদেরও ভয় দেখাবেন না, তাই না?’

‘একদম! একদম! আমি সবাইকে খুলে বলব আমাদের বোকামির কথা। যুগের পর যুগ আমরা এইভাবে পুরোনো জায়গায় থেকে গেছি! নাহ্‌...এটা তো ঠিক নয়...অনেক হয়েছে, আর নয়।’

পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল ভূতটা। এরপর আর তাকে ওই ঘরে দেখা যায়নি। আইনজীবী বেশ আরামেই ছিল বাকি দিনগুলোয়।

এর পর থেকেই নাকি ভূতেরা আর পোড়োবাড়িতে থাকতে চায় না। বড় বড় শহরগুলোর রাস্তায়, অভিজাত বাড়িতে, টাউন হলে, সমুদ্রসৈকতে, স্কুলে...সবখানেই ওদের দেখা যায় (যদিও লোকেরা বোঝে না যে ওরা ভূত)।

ফলে মানুষের মন থেকেও ভূতের ভয় কেটে যাচ্ছে। আজকালকার বাচ্চারাও বলে, ‘ভূত? ওসব শুধুই কল্পনা! ভূত বলে কিছু নেই!’ পাড়ার ছেলেছোকরারা দল বেঁধে পোড়োবাড়িতে রাত কাটায়, তারপর সকালে হাসতে হাসতে ঘরে ফেরে আর বলে, ‘সব এলাকার বিটকেল বুড়োদের রটনা, সারাটা রাত তো কাটিয়ে এলাম। ভূত কই এল, হুম? আর আসবে কী করে? ভূত বলে আবার কিছু আছে নাকি? হুম?’

এলাকার বুড়োরা সন্ধ্যাবেলায় চায়ের আড্ডায় বসে গম্ভীরমুখে বলে, ‘আচ্ছা, ভূতগুলো গেল কোথায়, বলো দেখি! আমাদের সময় তো সন্ধ্যাবেলায় রাস্তায় বের হতেই ভয় পেতাম! আর এখন গভীর রাতেও ওদের দেখা মেলে না! তা দিনকাল যা হয়েছে, আজকাল চারদিকে শুধু আলো আর আলো, রাতের বেলায়ও রাস্তায় আলো জ্বলে। আলোতে কি আবার ভূত আসে নাকি?’

ওরা কেউ জানে না সেই আইনজীবীর কাহিনি।

‘উকিলের বুদ্ধি’ বলে কথা।

মূল গল্প: দ্য লইয়ার অ্যান্ড দ্য গোস্ট

লেখক পরিচিতি: চার্লস ডিকেন্স

পুরো নাম চার্লস জন হাফাম ডিকেন্স। ১৮১২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথে জন্মগ্রহণ করেন। ছিলেন মা–বাবার সংসারে আট সন্তানের একজন। পরিবারকে সাহায্য করার জন্য স্কুল ছাড়তে বাধ্য হন। মাত্র ১২ বছর বয়সে বুটজুতা কালি করার কারখানায় দিনে ১০ ঘণ্টা কাজ করতেন। শৈশব বড় দুঃখে কেটেছে ডিকেন্সের। তরুণ বয়সে হতে চেয়েছিলেন অভিনেতা। তবে অডিশনে সময়মতো উপস্থিত হতে না পেরে লেখালেখিতে মনোযোগ দেন। হয়ে ওঠেন বিশ্বসেরা ঔপন্যাসিক। প্রথম পত্রিকায় গল্প পাঠান ১৮৩৩ সালে। সেরা উপন্যাসের মধ্যে আছে ডেভিড কপারফিল্ড (১৮৫০), আ টেল অব টু সিটিজ (১৮৫৯), অলিভার টুইস্ট (১৮৩৮), পিকউইক পেপারস (১৮৩৭) ইত্যাদি। জীবনে দুবার যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। ইংল্যান্ডে মারা যান ১৮৭০ সালের ৯ জুন।

আরও পড়ুন