অচিন পাখি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এক

জায়গাটা লেকের পাড়ে, গাছগাছালির ছায়ায়। খোলামেলা, ঝোপঝাড়ও তেমন নেই। এখান থেকে লেক আর বনের দৃশ্যটা অপূর্ব দেখায়।

‘বিউটিফুল!’ সোল্লাসে বলে উঠল অয়ন হোসেন। ‘এমন একটা জায়গাই খুঁজছিলাম মনে মনে।’

‘ঠিক বলেছিস,’ একমত হলো জিমি পারকার। ‘এর চেয়ে ভালো জায়গা আর দুটো হতে পারে না।’

কিন্তু ভিক্টোরিয়া ওয়েস্টমোরকে দ্বিমত পোষণ করতে দেখা গেল। ও বলল, ‘কিন্তু জায়গাটা বড্ড ভেতরে পড়ে গেল না? সব জিনিস বয়ে আনতে জান খারাপ হয়ে যাবে।’

‘মাই ডিয়ার লেডি,’ বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল জিমি, ‘মালপত্র বইবে ছেলেরা। এ নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।’

‘খবরদার, আমাকে লেডি বলবে না!’ ফুঁসে উঠল রিয়া।

‘তাহলে কি জেন্টলম্যান বলব?’

‘অ্যাই! ভালো হচ্ছে না কিন্তু!’

‘তোমরা থামবে?’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল অয়ন। ‘সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে...’

‘সামান্য ব্যাপার!’ রাগী গলায় বলল রিয়া। ‘মেয়েদের অপমান করছে, এটা সামান্য ব্যাপার হলো?’

‘অপমান!’ জিমি হতভম্ত।

‘নয়তো কী? এমন ভাব দেখাচ্ছ যেন সব কাজ তোমরাই করবে। মেয়েরা বুঝি সাহায্য করে না?’

‘আমি কি তা-ই বলেছি?’

‘এক শ বার বলেছ!’

‘ধ্যাত্তেরি!’ চরম বিতৃষ্ণা প্রকাশ পেল অয়নের গলায়। ‘তোমাদের সঙ্গে আনাই বিরাট ভুল হয়েছে। এ রকম সুন্দর একটা জায়গায় তোমরা ঝগড়া করো কী করে?’

দাঁত দিয়ে জিব কাটল রিয়া। বলল, ‘সরি, ভুল হয়ে গেছে।’

জিমিও বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল।

আগামী সপ্তাহে ক্লাসের বার্ষিক বনভোজন। তার জন্য চমৎকার একটা স্পট খুঁজে বের করার দায়িত্ব পড়েছে অয়ন আর জিমির ওপর। ভোটাভুটি করেই জিতেছে ওরা, কিন্তু রিয়া জিতেছে গলাবাজি করে। পিকনিক স্পট নির্বাচনের সময় মেয়েদের কোনো প্রতিনিধি থাকবে না, এটা নাকি হতেই পারে না। ভীষণ চেঁচামেচি করছিল, উপায় না দেখে তাকে সঙ্গে নিতে বাধ্য হয়েছে দুই বন্ধু।

লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে কয়েক মাইল দূরে স্যাভয়ল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক। কয়েক বর্গমাইলজুড়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এক পাশে পাহাড়, মাঝে একটা লেকও রয়েছে। পিকনিকের জন্য বিখ্যাত কোনো জায়গা নয় বটে, তবে নতুনত্বের জন্য এখানেই স্পট খুঁজতে এসেছে ওরা তিনজন। আইডিয়াটা অবশ্য অয়নের।

আকাশে মেঘের ঘনঘটা। গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে অয়ন বলল, ‘বৃষ্টি নামবে।’

‘ভাগ্যিস সঙ্গে তাঁবু এনেছি,’ বলল জিমি। ‘আয়, খাটিয়ে ফেলি। তাঁবুতে বসেই খাওয়াদাওয়া সেরে ফেলা যাবে।’

ছোট, হালকা একটা প্লাস্টিকের তাঁবু সঙ্গে এনেছে ওরা, সেটা খাটানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আজ বিকেল পর্যন্ত এখানেই কাটানোর ইচ্ছা। তাঁবু খাটানো শেষ হতে না হতেই মেঘের গর্জন ছাপিয়ে ইঞ্জিনের গুরুগম্ভীর আওয়াজ শোনা গেল। অবাক হয়ে ঘাড় ফেরাতেই ওরা দেখল, একটা পুরোনো মোটরবোট লেকের পানি কেটে এদিকেই এগিয়ে আসছে। এতক্ষণ বাঁকের আড়ালে ছিল বলে দেখা যায়নি।

বোটটা ছোট, মাঝারি উচ্চতার একজন ভদ্রলোক চালাচ্ছেন ওটা। পোশাক-আশাক ভারি অগোছালো। মাথায় কাপড়ের টুপি, চোখে চশমা। লেকের পাড়ে বোট ভিড়িয়ে তিনি গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, ‘অ্যাই বাচ্চারা! তোমরা এখানে কী করছ?’

‘হ্যালো, স্যার,’ অভিবাদন জানিয়ে বলল অয়ন। ‘আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি। আমার নাম অয়ন; ওরা আমার বন্ধু—জিমি আর রিয়া।’

‘তা-ই? সঙ্গে কেউ আসেনি?’

‘নাহ্। আর কে আসবে? আমরা আসলে পিকনিক স্পটের জন্য জায়গা খুঁজতে এসেছি।’

‘তাহলে তো ভালোই,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘তা, পাখি শিকারের ধান্দা নেই তো?’

‘না না, শিকার করব কেন? এটা তো রিজার্ভ ফরেস্ট।’

‘সেটা তো সবাই মনে রাখে না,’ উদাস গলায় বললেন ভদ্রলোক।

‘কিছু মনে করবেন না,’ বলল অয়ন। ‘আপনার পরিচয়টা জানতে পারি?’

‘আমার নাম গ্যাব্রিয়েল ফার্গুসন,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘আমি একজন অর্নিথোলজিস্ট।’

‘অর্নিথোলজিস্ট?’ বোকার মতো বিড়বিড় করল জিমি। শব্দটা ওর কাছে নতুন।

‘পক্ষীবিদ,’ অর্থটা বুঝিয়ে বলল অয়ন।

‘আপনি কি পাখির খোঁজেই এখানে এসেছেন, মি. ফার্গুসন?’ জানতে চাইল রিয়া।

‘ঠিকই ধরেছ,’ হাসলেন ফার্গুসন। ‘এখানে যে কত্ত রকমের পাখি আছে, তা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।’

‘আপনার নামটা কোথায় যেন পড়েছি...’ বিড়বিড় করল অয়ন, তারপরই উত্তেজিত গলায় বলল, ‘ইউরেকা! মনে পড়েছে! দ্য ওয়ান্ডারফুল বার্ডস অব আমেরিকা—বইটা আপনার লেখা না?’

‘তুমি পড়েছ ওটা?’ ফার্গুসন বেশ অবাক হয়েছেন। ‘ওটা তো ছোটদের বই না!’

‘আমাদের অয়ন আবার বইয়ের পোকা,’ বলল জিমি। ‘যা পায়, তা-ই পড়ে ফেলে।’

‘খুবই ভালো অভ্যাস,’ মন্তব্য করলেন ফার্গুসন। তাকালেন আকাশের দিকে। ‘বৃষ্টি নামল বলে...তোমরা কি এখানেই থাকবে?’

‘সঙ্গে তাঁবু আছে। কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু আপনি যাবেন কোথায়?’

‘মাইলখানেক দূরে বন বিভাগের একটা পুরোনো লজ আছে। ওখানেই উঠেছি আমি, সচরাচর তা-ই উঠি। তোমরাও আসতে পারো।’

প্রস্তাবটা লোভনীয়, তবে বৃষ্টির মাঝে তাঁবুতে সময় কাটানোর মধ্যে আলাদা রোমাঞ্চ আছে। তাই অয়ন বলল, ‘থ্যাংক ইউ, স্যার। তবে আমরা এখানেই থাকতে চাই।’

‘যা তোমাদের ইচ্ছা,’ কাঁধ ঝাঁকালেন ফার্গুসন। ‘তবে কোনো অসুবিধা হলে নির্দ্বিধায় চলে এসো। লেকের পাড় ধরে বাঁ দিকে হাঁটতে থাকলেই লজটা পেয়ে যাবে।’

‘জি, অবশ্যই।’

বোট নিয়ে চলে গেলেন ফার্গুসন।

রিয়া বলল, ‘চমৎকার মানুষ। আমার পছন্দ হয়েছে।’

‘হুঁ,’ বলল জিমি। ‘কিন্তু অয়ন, বৃষ্টির মধ্যে এখানে থাকার দরকারটা কী? মি. ফার্গুসনের সঙ্গে চলে গেলেই কি ভালো হতো না?’

‘আসলে পরিবেশটা আমার ভীষণ ভালো লাগছে,’ বলল অয়ন। ‘পাহাড়-অরণ্য-জলাশয়...এসব ছেড়ে আমি লজে গিয়ে ঢুকতে রাজি নই।’

‘আরে, আরে! কবি হয়ে গেলে নাকি?’ খোঁটা দিল রিয়া।

‘মহাকবি অয়ন হোসেন দ্য গ্রেট,’ সুযোগ পেয়ে জিমিও হুল ফোটাল।

মনে হচ্ছিল খেপে যাবে, কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা। মুচকি হেসে অয়ন বলল, ‘কবিতা-টবিতা লিখতে পারলে আসলে মন্দ হতো না। কিন্তু কী করা, আল্লাহ আমাকে সেই প্রতিভা দেননি।’

‘ধ্যাত্তেরি!’ মুখ বাঁকা করল রিয়া। ‘একে খেপিয়েও কোনো মজা নেই।’

‘খাওয়াদাওয়া সেরে ফেললে কেমন হয়?’ প্রস্তাব দিল জিমি। ‘খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।’

‘সেকি! এক্ষুনি খিদে পেয়েছে?’ বলল রিয়া। ‘কী রাক্ষস রে, বাবা! আন্টি বুঝি সকালে নাশতা খেতে দেয়নি?’

‘অ্যাই, মুখ সামলে কথা বলো!’ শাসাল জিমি।

‘থাক, আর ঝগড়া করতে হবে না,’ ওদের থামাল অয়ন। ‘খিদে কিন্তু আমারও লেগেছে। চলো, খেয়ে নিই। তারপর ঘুরতে বেরোব।’

‘বৃষ্টির ভেতর?’ রিয়া ভ্রুকুটি করল।

‘হ্যাঁ। ভিজতে ভিজতে ঘুরব। কেন, বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে না তোমার?’

‘তা লাগে।’

‘তাহলে আর চিন্তা কিসের?’

তাঁবুতে ঢুকতে না ঢুকতে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।

নীরবে খাওয়া সারল ওরা। তারপর বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। থামল তো না-ই, বরং আরও বাড়ল বৃষ্টি। সেই সঙ্গে দমকা হাওয়া। খানিক পরপর বাতাসের তোড়ে তাঁবু উড়ে যেতে চাইছে। ভেতরে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকতে থাকতে সারা শরীরে খিল ধরে গেল ওদের।

‘এ-ই যদি অবস্থা হয়, তাহলে পিকনিক আর করা লাগবে না,’ মন্তব্য করল জিমি। ‘কী ভয়ানক বৃষ্টি!’

‘নাহ্,’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল রিয়া। ‘এভাবে আর বসে থাকা সম্ভব না।’

‘কী করা যায়?’

‘চলো, লজে মি. ফার্গুসনের কাছে যাই।’

‘ভিজে একশা হয়ে যাব।’

‘রেইনকোট আছে তো। তা ছাড়া এই তাঁবুর ভেতরে বসে থাকার চেয়ে বৃষ্টিতে ভেজা ভালো।’

‘খালি আমাদের কবি সাহেব রাজি থাকলেই হয়,’ ফোড়ন কাটল জিমি।

‘আমার কোনো আপত্তি নেই,’ অয়ন বলল। ‘আমি তো বৃষ্টির ভেতরে ঘুরতেই চাইছিলাম।’

‘তাহলে চল, বেরিয়ে পড়ি।’

রেইনকোট পরে তাড়াতাড়ি তাঁবু গুটিয়ে ফেলল ওরা। তারপর মি. ফার্গুসনের দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল। রেইনকোট কোনো কাজে এল না, ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল তিনজনই। তার ওপর তীব্র বাতাস। পারলে ওদের উড়িয়ে নিয়ে যায় আরকি।

‘আচ্ছা শিক্ষা হয়ে গেছে,’ বলল রিয়া। ‘এখানে পিকনিকে আসা যাবে না।’

‘দোষটা জায়গার নয়, আবহাওয়ার,’ বলল অয়ন। ‘যে রকম ওয়েদার দেখছি, এই মৌসুমে পিকনিকেই আসা উচিত হবে না।’

‘উফ্,’ বিরক্ত গলায় বলল জিমি, ‘লজটা আর কত দূরে?’

‘বেশি দূর হওয়ার কথা নয়,’ আশ্বাস দিল অয়ন। ‘মি. ফার্গুসনের কথা শুনে তো তেমনই মনে হলো।’

মোটামুটি মিনিট পনেরো হাঁটার পর দেখা মিলল লজটার। কাঠের তৈরি পুরোনো আমলের একটা একতলা বাড়ি। জীর্ণশীর্ণ অবস্থা বাড়িটার, বারান্দার রেলিং-টেলিং সব ভেঙে গেছে। দেয়াল বা দরজা-জানালার অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়। অত কিছু অবশ্য দেখার চেষ্টা করল না তিন বন্ধু, বাড়িটা চোখে পড়তেই ছুটে গিয়ে বারান্দায় উঠে পড়ল।

চালের ফুটো দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে। বৃষ্টির ছাঁটও এসে লাগছে গায়ে। তারপরও এটা অনেক নিরাপদ আশ্রয়। অবশ্য একটু পরেই ধারণাটা পাল্টে গেল ওদের। যাহোক, বারান্দায় উঠেই ওরা লক্ষ করল, দরজার পাশে কোনো কলিং বেলের সুইচ নেই। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগলেও যখন ওরা আবিষ্কার করল, বাড়িতে আসলে কোনো ইলেকট্রিসিটিই নেই, তখন আর সেটা তেমন খাপছাড়া ঠেকল না।

দরজার কড়া নাড়ল অয়ন। কোনো জবাব পাওয়া গেল না।

‘ব্যাপার কী? নেই নাকি?’ বিড়বিড় করল ও, তারপর আবার কড়া নাড়ল। মুখেও ডাকল, ‘মি. ফার্গুসন, ভেতরে আছেন?’

এবারও সব চুপচাপ।

‘নেই বোধ হয়,’ বলল জিমি।

‘কিন্তু যাবেন কোথায়?’ বিস্মিত গলায় বলল রিয়া। ‘আমাদের তো বললেন, এখানেই ফিরছেন।’

‘আধপাগল মানুষ। পাখি নিয়ে পড়ে থাকে। এদের কথার কোনো ঠিকঠিকানা আছে নাকি?’

‘এক দেখাতেই বুঝে ফেললে উনি আধপাগল?’ চোখ সরু করল রিয়া। ‘অবশ্য...পাগলে পাগল চেনে।’

‘কীইই! আমি পাগল?’

‘ঝগড়াঝাঁটি থামা তো,’ বলল অয়ন। ‘চল, গিয়ে দেখি ওনার বোটটা আছে কি না। তাহলেই বোঝা যাবে, ভদ্রলোক লজে ফিরেছেন কি ফেরেননি।’

‘গুড আইডিয়া,’ স্বীকার করল জিমি।

জিনিসপত্র বারান্দাতেই নামিয়ে রাখল ওরা, তারপর মাথায় রেইনকোটের হুড তুলে নেমে এল বারান্দা থেকে। লজটা লেকমুখী, সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। লেকের পাড়টা আগাছা আর ঝোপঝাড়ে ছাওয়া। কাঠের তৈরি একটা ঘাট আছে, সেখানে মোটরবোটটা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেল।

‘আরে!’ বলে উঠল রিয়া। ‘বোট তো দেখি আছে!’

‘কিন্তু মি. ফার্গুসন গেলেন কোথায়?’ চিন্তিত গলায় বলল জিমি।

হঠাৎ পেছন থেকে কথা বলে উঠল কেউ।

‘কী ব্যাপার, বাছারা? কাউকে খুঁজছ মনে হয়?’

ঝট করে ঘুরল তিন বন্ধু। রুগ্‌ণ চেহারার এক লোক দাঁড়িয়ে আছে, মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

‘জি,’ বলল অয়ন। ‘মি. ফার্গুসনকে খুঁজছি। কিন্তু আপনি কে?’

‘আমি কে, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়,’ কর্কশ গলায় বলল লোকটা। ‘ফার্গুসনকে কেন খুঁজছ?’

লোকটার কথা বলার ভঙ্গি ভালো লাগল না ওদের। অয়ন বলল, ‘সেটা তাঁকেই বলব। কোথায় তিনি?’

‘ফার্গুসনের সঙ্গে দেখা করতে চাও?’ বলে খিকখিক করে হাসল লোকটা। পরমুহূর্তে জামার পকেট থেকে ঝট করে বের করল একটা পিস্তল। ‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।’

জমে গেল তিন বন্ধু।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

দুই

অস্ত্রের মুখে ওদের নিয়ে আসা হলো লজে। তিন বন্ধু রীতিমতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

সামনের ঘরে আরও তিনজন মানুষের দেখা মিলল—তাদের ভেতর দুজনের চেহারা গুন্ডার মতো; অন্যজন মাঝবয়সী, পোশাক-আশাক ভদ্রগোছের, হাবভাবে তাকেই এদের নেতা বলে মনে হলো।

‘ধরতে পেরেছ তাহলে?’ বলল সে। ‘গুড।’

‘এসবের মানে কী, জানতে পারি?’ শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল অয়ন। ‘আমাদের ধরে আনা হয়েছে কেন?’

‘মন খারাপ কোরো না, খোকাবাবু,’ বিশ্রীভাবে হেসে বলল এক গুন্ডা। ‘ভুল সময়ে ভুল জায়গায় এসে পড়েছ তোমরা। সমস্যাটা ওখানেই।’

‘ভুল সময়ে ভুল জায়গায়...ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।’

‘অত কিছু বোঝার দরকারও নেই!’ ধমকে উঠল নেতাগোছের লোকটা। কড়া চোখে তাকাল হাসতে থাকা গুন্ডার দিকে। ‘অ্যাই মেনডেজ! তোমাকে দাঁত কেলাতে কে বলেছে? যাও, পুরো বাড়িতে ভালোমতো তল্লাশি চালাও।’

‘একবার তো দেখলাম, বস,’ গোমড়ামুখে বলল মেনডেজ। ‘পাখিটাখি নেই এখানে।’

‘হয়তো লুকিয়ে রেখেছে। আমি যে পেছনে লেগেছি, তা তো টের পেয়েছে আগেই। বেটা বিরাট পাখিদরদি।’

‘কী পাখি খুঁজছেন আপনারা?’ ফস করে জানতে চাইল জিমি।

রাগী চোখে ওর দিকে তাকাল লোকটা। ‘তা দিয়ে তোমার কাজ কী?’ খেঁকিয়ে উঠল সে। খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা লোকটাকে বলল, ‘গিবন, নিয়ে যাও এদের। ফার্গুসনের সঙ্গে আটকে রাখো। আর হুপার, হাত লাগাও মেনডেজের সঙ্গে। ভালোমতো তল্লাশি করবে, ঘরের কোনো কোনাকাঞ্চি বাদ দেবে না।’

ধাক্কা দিয়ে তিন বন্ধুকে এক প্রান্তের একটা কামরায় ঢুকিয়ে দিল গিবন। বাইরে থেকে আটকে দিল দরজা। ছোট একটা শোবার ঘর, বিছানার ওপর বসে আছেন মি. ফার্গুসন। আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকালেন। বিস্ময় ফুটল তাঁর চেহারায়।

‘আরে! তোমরা এখানে!’ বললেন তিনি।

‘বৃষ্টি খুব বেড়ে গেছে বলে আপনার এখানে থাকতে এসেছিলাম,’ জানাল জিমি। ‘ব্যস, আটকে ফেলল।’

‘না না,’ মাথা নাড়লেন ফার্গুসন, ‘ক্রিস কাজটা মোটেই ভালো করছে না। আমার সঙ্গে যা খুশি করুক, তোমাদের কেন আটকাবে? তোমাদের সঙ্গে তো এসবের কোনো সম্পর্ক নেই।’

‘ব্যাপারটা কী, একটু খুলে বলবেন?’ বলল অয়ন। ‘কী সব পাখিটাখি খোঁজার কথা শুনলাম। আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ক্রিস কে? বাইরে লিডারের মতো যাকে দেখলাম, ওই লোকটা?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকালেন ফার্গুসন। ‘হ্যাঁ, ওরই নাম ক্রিস...ক্রিস্টোফার জেনকিন্স। আমার সহকর্মী। আমেরিকান অর্নিথোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে কাজ করি আমরা। ক্রিসও অর্নিথোলজিস্ট। সেই সঙ্গে পাখির চোরাচালানি।’

‘পাখির চোরাচালানি!’ একটু অবাক হলো রিয়া। ‘পাখি আবার চোরাচালান হয় নাকি?’

‘হয়,’ বললেন ফার্গুসন। ‘দুনিয়ায় অনেক প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় পাখি আছে। সেসব পাখি ধরা বা শিকার করা নিষিদ্ধ। আর তাই সেগুলো হাতে পেতে অনেক টাকা খরচ করে কালেক্টররা। অর্নিথোলজিস্ট হওয়ার কারণে দুর্লভ পাখির খোঁজ জানে ক্রিস। আইন ভেঙে বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে আনে ওসব পাখি। চড়া দামে বিক্রি করে। সঙ্গে যে তিনজনকে দেখেছ, তারা ওর শাগরেদ।’

‘পুলিশ ওদের ধরে না কেন?’

‘প্রমাণ থাকলে না ধরবে! ক্রিস খুবই ধূর্ত। যা করে সবই গোপনে। কোনো প্রমাণ রাখে না অপকর্মের।’

‘এখানেও কি কোনো দুর্লভ পাখির সন্ধানে এসেছে?’

‘হ্যাঁ। স্যাভয়ল্যান্ডের এই জঙ্গলে কিছুদিন আগে এক প্রজাতির দুর্লভ পাখি পেয়েছি আমি। ছবি তুলে রেখেছিলাম, আর সেই ছবি দেখে ফেলেছে ক্রিস। সেই থেকে পিছু লেগেছে আমার। নানাভাবে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছে, ওই পাখির ছবি আমি কোথায় তুলেছি। জবাব না দিয়ে এড়িয়ে চলেছি ওকে। সুবিধা করতে না পেরে নিশ্চয়ই ফেউ লাগিয়েছিল আমার পেছনে। আজ হঠাৎ হাজির হয়েছে এখানে।’

‘কী পাখি পেয়েছেন আপনি?’ জানতে চাইল অয়ন।

‘আইভরি বিল্ড উডপেকার,’ বললেন ফার্গুসন। ‘তা-ও আবার একটা নয়, তিনটা। একটা মা পাখি, আর দুটো বাচ্চা।’

‘এ আবার কোন পাখি?’ বোকা বোকা কণ্ঠে বলল জিমি। ‘জীবনে নাম শুনিনি।’

‘আমিও না,’ রিয়াও মাথা নাড়ল।

‘আমি শুনেছি...মানে, পড়েছি,’ বলল অয়ন। ‘মি. ফার্গুসনের লেখা বইয়ে আছে ওটার কথা। একধরনের কাঠঠোকরা। বৈজ্ঞানিক নাম, Campephilus principalis। আমেরিকায় ১৯৪৪ সালের পর থেকে এই পাখি আর দেখা যায়নি। শেষ দেখা গেছে কিউবাতে—১৯৮৭ সালে।’

‘বাহ্!’ প্রশংসা করলেন ফার্গুসন। ‘তোমার দেখছি সবই মনে আছে!’

‘ও কিছু না,’ বিব্রত গলায় বলল অয়ন। ‘তথ্যগুলো ইন্টারেস্টিং, তাই ভুলিনি। কিন্তু স্যার, এ পাখি আপনি পেলেন কী করে? বেশির ভাগ মানুষের তো ধারণা, পাখিটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’

‘হয়নি,’ বললেন ফার্গুসন। ‘অন্তত স্যাভয়ল্যান্ডে তিনটা পাখি আজও টিকে আছে।’

‘কিন্তু আমি তো পড়েছিলাম, পাখিটা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে...বিশেষ করে লুইজিয়ানা আর ফ্লোরিডায় থাকত। ক্যালিফোর্নিয়ায় এল কী করে?’

‘ওদিককার আবাস ধ্বংস হওয়ার পর হয়তো কোনোভাবে মাইগ্রেট করে চলে এসেছে। সেটা বড় কথা না, কথা হলো ওদের বাঁচাতে হবে। ক্রিসের হাতে পড়লে নির্ঘাত কারও কাছে বিক্রি করে দেবে। আর জঙ্গলের স্বাভাবিক পরিবেশ হারালে বেশি দিন বাঁচতে পারবে না ওরা।’

‘আপনি খোঁজ না দিলেই হয়,’ বলল জিমি।

‘কতক্ষণ মুখ বন্ধ রাখতে পারব জানি না,’ বড় করে শ্বাস ফেললেন ফার্গুসন। ‘ওরা ভয়ংকর লোক। কথামতো কাজ না করলে হয়তো টর্চার করবে।’

‘কোনোভাবে পুলিশে খবর দেওয়া যায় না?’

‘তাই তো!’ সচকিত হলো রিয়া। ‘আমার কাছে তো সেলফোন আছে! ব্যাটারা আমাদের শরীর তল্লাশি করেনি বলে পায়নি।’ তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোনটা বের করল ও।

‘লাভ নেই,’ ফার্গুসন মাথা দোলালেন। ‘এখানে সেলফোনের নেটওয়ার্ক নেই।’

ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মুখ কালো হয়ে গেল রিয়ার। কথাটা ঠিক।

‘ল্যান্ডফোন আছে লজে?’ জানতে চাইল জিমি।

‘তা-ও নেই। যোগাযোগের জন্য শুধু একটা রেডিও সেট আছে। সেটা এ মুহূর্তে ক্রিসের কবজায়। সাহায্য চাওয়ার কোনো উপায় নেই আমাদের।’

‘সে ক্ষেত্রে একটা রাস্তাই দেখতে পাচ্ছি,’ গম্ভীর গলায় বলল অয়ন। ‘পালাতে হবে আমাদের।’

‘অসম্ভব। ওরা চারজন। সবার কাছে অস্ত্র আছে।’

‘আমরাও চারজন, স্যার। তা ছাড়া দুনিয়ায় কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। চোখ-কান খোলা রাখলে সুযোগ অবশ্যই পাব।’

‘খুব কনফিডেন্ট দেখছি!’ ভুরু কোঁচকালেন ফার্গুসন। ‘ব্যাপার কী? তোমরা কি আগেও এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছ?’

‘জি স্যার। আপনাকে বলা হয়নি, আমরা শখের গোয়েন্দা। বহু রহস্য সমাধান করেছি। সে জন্য প্রায়ই গুন্ডাপান্ডা বা মন্দ লোকদের সঙ্গে টক্কর দিতে হয়। লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।’

চোয়াল ঝুলে পড়ল ফার্গুসনের। ‘তোমরা তো আমাকে অবাক করে দিচ্ছ হে!’

‘আমাদের সাহায্য নিতে আপত্তি নেই তো?’

‘কিসের আপত্তি? এখন তাড়াতাড়ি বলো, কী করতে চাও।’

‘যা বলেছি তা-ই। পালাব আমরা—যে কজন পারি। তারপর সেলফোনের নেটওয়ার্কের আওতায় গিয়ে পুলিশে খবর দেব।’

‘ফোন তো এই একটাই,’ নিজের ফোনটা দেখিয়ে বলল রিয়া। ‘আমি যদি পালাতে না পারি?’

‘আপনার ফোন নেই?’ ফার্গুসনকে জিজ্ঞেস করল জিমি।

‘আমারটা ওরা কেড়ে নিয়েছে,’ জানালেন অর্নিথোলজিস্ট।

‘তাহলে অন্য কোনো কায়দা বের করতে হবে,’ বলল অয়ন। ‘বদমাশগুলোকে যদি লজ থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়, রেডিও সেটের মাধ্যমে সাহায্য চাইতে পারি আমরা।’

‘লজ ছেড়ে বেরোবে কেন ওরা?’

মুচকি হাসল অয়ন। ‘আইভরি বিল্ড উডপেকারের জন্য। পাখিগুলো ধরতে চাইছে ওরা, রাইট? তার মানে লজ ছেড়ে জঙ্গলে যেতেই হবে। তখনই পালাব আমরা। লজে ফিরে এসে রেডিওতে পুলিশ ডাকব।’

‘আর যদি পুলিশ আসার আগেই পাখি নিয়ে পালায়?’

‘পাখিগুলো ঠিক আছেটা কোথায়?’

‘লেকের ওপারের জঙ্গলে। ছোট একটা পাহাড় আছে, দেখেছ? ওটার চূড়ার কাছাকাছি একটা বড় গাছের খোঁড়লে ওদের বাসা।’

‘হুম। পরিস্থিতি তেমন বেগতিক দেখলে বদমাশদের ধোঁকা দিয়ে পাখিগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। আপনি বরং আমাদের একটা ম্যাপ এঁকে দিন।’

পকেট থেকে নোটবুক বের করলেন ফার্গুসন। কলম দিয়ে দ্রুত হাতে এঁকে ফেললেন ম্যাপ। একটা জায়গায় দাগ দিয়ে বললেন, ‘এই যে, এখানে গেলেই দেখতে পাবে গাছটা। চিনতে অসুবিধা হবে না। গাছের চারদিকে লাল রঙের মার্কার ফ্ল্যাগ লাগিয়ে রেখেছি আমি।’

দরজায় খুটখাট আওয়াজ হলো। ছিটকিনি খোলা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি নোটবুকের পাতাটা ছিঁড়ে পকেটে ভরে ফেলল অয়ন। কয়েক মুহূর্ত পর দোরগোড়ায় দেখা গেল গিবনকে। হাতে উদ্যত পিস্তল।

‘বেরোও!’ বলল সে। ‘বস কথা বলবে।’

সামনের কামরায় নিয়ে যাওয়া হলো ওদের। একটা চেয়ারে বসে আছে জেনকিন্স। থমথম করছে মুখ। উঠে এসে ফার্গুসনের সামনে দাঁড়াল।

‘পাখিগুলো কোথায়, গ্যাব্রিয়েল?’ ঝাঁজালো কণ্ঠে জানতে চাইল সে।

‘আমার কাছে জানতে চাইছ কেন?’ বাঁকা গলায় বললেন ফার্গুসন। ‘তখন তো বললে, নিজেই খুঁজে বের করে ফেলতে পারবে।’

‘ভেবেছিলাম ওগুলোকে খাঁচায় ভরে লজের কোথাও লুকিয়ে রেখেছ,’ বলল জেনকিন্স। ‘এখন বুঝতে পারছি, তা করোনি। এখনো জঙ্গলেই আছে পাখিগুলো।’

‘তাহলে যাও না! নিজেই খুঁজে নাও।’

‘মশকরা কোরো না, গ্যাব্রিয়েল। আমি সিরিয়াস। পাখিগুলো আমার চাই!’

‘মরে গেলেও তোমাকে আমি ওগুলোর খোঁজ দেব না।’

‘সে ক্ষেত্রে আমাকে কঠিন হতে হবে।’

‘কী করবে তুমি, শুনি?’

তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কথা জোগাল না জেনকিন্সের মুখে। তবে কয়েক সেকেন্ড পরই হেসে উঠল সে। বলল, ‘মাই ডিয়ার গ্যাব্রিয়েল, তুমি কি চাও এখানে রক্তপাত হোক?’

‘রক্তপাত মানে?’

‘তুমি কথা না শুনলে আমি আর কী করতে পারি, বলো?’

‘মানে, পাখির খোঁজ না দিলে তুমি আমাকে খুন করবে?’

‘ছি ছি, তোমাকে খুন করতে যাব কেন? তুমি মরে গেলে পাখির খোঁজ দেবে কে?’ ক্রূর হাসি ফুটল জেনকিন্সের ঠোঁটে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল অয়ন, জিমি আর রিয়ার দিকে। ‘আমি ভাবছিলাম এদের কথা।’

‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ক্রিস! কী বলছ নিজেও জানো না।’

‘মাথা আমার ঠিকই আছে,’ কড়া গলায় বলল জেনকিন্স। ‘জ্যান্ত তিনটা আইভরি বিল্ড উডপেকারের দাম কত হতে পারে, অনুমান করতে পারো? সত্যি বলতে কি, কাস্টমারও পেয়ে গেছি আমি। পাখিগুলো বিক্রি করে বাকি জীবন পায়ের ওপর পা তুলে রাজার হালে কাটাতে পারব। তুমি তাতে বাগড়া দেওয়ার কে?’

‘হুমকি দিয়ে লাভ হবে না। পাখির খোঁজ আমি দেব না তোমাকে।’

‘হুমকিতে কাজ হবে না?’ ঠোঁটের কোনা বেঁকে গেল জেনকিন্সের। ‘তাহলে কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করে দেওয়া যাক। গিবন, মেয়েটাকে গুলি করো।’

‘ইয়েস, বস,’ ময়লা দাঁতের পাটি বেরিয়ে পড়ল গিবনের।

আঁতকে উঠল অয়ন আর জিমি, লোকটা অত্যন্ত প্রভুভক্ত দেখা যাচ্ছে। রিয়ার দিকে এগিয়ে এল সে। পিস্তল ঠেকাল ওর পিঠে। আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল বেচারী।

ঝাঁপ দেওয়ার পাঁয়তারা করছিল জিমি, এমন সময় গমগম করে উঠল ফার্গুসনের কণ্ঠ।

‘থামো!’

সশব্দে হেসে উঠল জেনকিন্স। ‘কী, মত পাল্টেছ?’

জবাব দিলেন না পক্ষীবিদ। পরাজিত সৈনিকের মতো ভেঙে পড়েছেন তিনি।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

তিন

লেকের অপর পাড়ে, পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি রয়েছে পাখিগুলো, সংক্ষেপে জেনকিন্সকে জানালেন ফার্গুসন। শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন লোকটা। বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে তক্ষুনি রওনা হতে চাইল। তার তিন সঙ্গী একটু গাঁইগুঁই করল, কিন্তু বসের কড়া ধমকের সামনে টিকতে পারল না।

রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, এই ফাঁকে তিন বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাইলেন ফার্গুসন। ‘আমি সত্যিই দুঃখিত, বাচ্চারা। শুধু শুধু তোমাদের বিপদে ফেললাম।’

‘আপনি তো কিছু করেননি, যা করার করছেন এই লোকগুলো,’ তাঁকে সান্ত্বনা দিল অয়ন। ‘শুধু শুধু এ নিয়ে মন খারাপ করবেন না। একটু আগে যা বলেছি, সেটা মাথায় রাখুন।’

‘না না,’ তাড়াতাড়ি বললেন ফার্গুসন। ‘তোমরা কিছু করতে যেয়ো না। পাখি নিয়ে যেতে চাইলে যাক। পরে পুলিশে খবর দিয়ে কিছু একটা করা যাবে।’

‘সে সুযোগ কি আদৌ পাব? জেনকিন্সকে মোটেও সুবিধার লোক বলে মনে হচ্ছে না। পাখি পেলেই যে আমাদের ভালোয় ভালোয় ছেড়ে দেবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ দেখছি না।’

‘কী সর্বনাশ!’ আঁতকে উঠল রিয়া। ‘তাহলে?’

‘নিজেদের চেষ্টাতেই এই বিপদ থেকে মুক্ত হতে হবে আমাদের।’

‘বোকার মতো কথা বোলো না,’ চোখ রাঙালেন ফার্গুসন। ‘এতগুলো গুন্ডার সঙ্গে পেরে উঠবে তোমরা?’

‘মারামারি তো আর করতে যাচ্ছি না। শুধু পালাতে চাইছি।’

‘তা-ও পারবে না। কীভাবে চোখে চোখে রাখছে আমাদের, দেখেছ?’

‘কতক্ষণ আর রাখবে?’ ভুরু নাচাল অয়ন। ‘একটা না একটা সুযোগ ঠিকই পাব।’

‘দেখা যাক।’

একটু পরই হাজির হলো হুপার আর গিবন।

‘চলো, যাওয়ার সময় হয়েছে।’

লজ থেকে বের করে আনা হলো ওদের। অস্ত্রের মুখে নিয়ে যাওয়া হলো বোটের ঘাটে। জেনকিন্স আর মেনডেজ দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। বোটে তোলা হয়েছে পাখি ধরার নেট, খাঁচা ইত্যাদি।

‘আমরা আটজন, বস,’ ওরা পৌঁছাতেই বলল মেনডেজ। ‘এই ছোট্ট বোটে সবার জায়গা হবে না।’

‘সেটা কোনো সমস্যা না,’ বলল জেনকিন্স। ‘দুই ট্রিপে যাব। চলো।’

প্রথম ট্রিপের জন্য নির্বাচন করা হলো মি. ফার্গুসন আর রিয়াকে। জেনকিন্স আর মেনডেজের সঙ্গে যাবে ওরা। বোট চালাবে হুপার। কিছুক্ষণের মধ্যেই রওনা হয়ে গেল তারা। এপারে অয়ন-জিমিকে রেখে যাওয়া হলো গিবনের জিম্মায়।

এ-ই বোধ হয় সুযোগ। ফিসফিস করে জিমির সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে নিল অয়ন।

‘অ্যাই!’ ধমকে উঠল গিবন। ‘কী কথা হচ্ছে?’

‘কিছু না,’ গোবেচারা চেহারা করে বলল জিমি।

‘কিছু না হলে কানে কানে কথা বলছ কেন? মতলব ভাঁজছ না তো?’

‘আরে নাহ্। কী যে বলেন!’

‘খবরদার! এরপর কানে কানে কথা বলতে দেখলে কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।’

চুপ করে গেল দুই বন্ধু। আপাতত আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। প্ল্যান করা হয়ে গেছে। অপেক্ষা শুধু সেটাকে যথাসময়ে কাজে পরিণত করার।

বাকিদের লেকের অন্য পাড়ে নামিয়ে দিয়ে বোট নিয়ে ফিরে এল হুপার। এবার তাতে অয়ন আর জিমিকে নিয়ে চড়ল গিবন। রওনা হলো বোট। সেটি লেকের মাঝামাঝি পৌঁছাতেই জিমির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল অয়ন।

ঝট করে উঠে দাঁড়াল দুই বন্ধু। ওদের নড়াচড়ায় দুলে উঠেছে বোট, দুই গুন্ডা নিজেদের সামলে নেওয়ার আগেই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা।

চেঁচিয়ে উঠল হুপার, ‘অ্যাই! অ্যাই!’

বৃষ্টির জন্য লেকের ওপার থেকে ঘটনাটা ঠিকমতো দেখতে পায়নি জেনকিন্স। গলা চড়িয়ে সে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে, গিবন? পানিতে কী পড়ল?’

‘সর্বনাশ হয়েছে, বস,’ বলল গিবন। ‘ছেলে দুটো পানিতে লাফ দিয়েছে।’

‘বলে কী!’ খ্যাপাটে শোনাল জেনকিন্সের গলা। ‘তোমাদের সামনে দিয়ে লাফ দেয় কী করে?’

‘বুঝতে পারিনি, বস।’

‘গাধার বাচ্চারা এখনো বসে আছ কেন? ধরো ওদের!’

তাড়াতাড়ি বোট ঘোরাল দুই দুর্বৃত্ত। পানিতে দুই বন্ধুর সাঁতার কাটার শব্দ হচ্ছে। সেদিক লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল তারা।

‘অ্যাই ছেলেরা! ফিরে এসো বলছি। নইলে কিন্তু গুলি করব,’ হুমকি দিল গিবন।

থেমে গেল অয়ন আর জিমি। এখন পানিতে গলা উঁচিয়ে ভাসছে। চেহারায় স্বস্তি ফুটল দুই গুন্ডার। বোটের ইঞ্জিন নিউট্রাল করে ধীরে ধীরে এগোতে থাকল, ওদের তুলে নেবে পাশে গিয়ে। কিন্তু বোটটা কাছে যেতেই টুপ করে ডুব দিল দুই বন্ধু।

‘আরে,’ বোকা বোকা গলায় বলল হুপার। ‘গেল কোথায়?’

‘বিচ্ছু দুটো বোকা বানাচ্ছে আমাদের,’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল গিবন। ‘হাতের নাগালে একবার পেলেই হয়, চাবকে পিঠের ছাল তুলে ফেলব।’

‘কীভাবে পাবে হাতের নাগালে? ডুব দিয়েছে তো। আগেই বলে দিচ্ছি, আমি পানিতে নামতে পারব না।’

‘তার কোনো দরকারও নেই। পানির তলায় আর কতক্ষণ থাকবে? উঠলেই ক্যাঁক করে ধরে ফেলব। একটু অপেক্ষা করো।’

বোটের কিনারে উবু হয়ে ওত পেতে রইল দুই গুন্ডা। কিন্তু তাদের জানা নেই, ডুবসাঁতার দিয়ে বোটের উল্টো পাশে মাথা তুলেছে অয়ন-জিমি। পরস্পরের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে সংকেত বিনিময় করল ওরা। তারপরই বোটের গায়ে হাত রেখে দিল এক ধাক্কা।

কাত হয়ে গেল বোট। টলে উঠল দুই গুন্ডা, ভারসাম্য হারিয়ে ঝপাঝপ পড়ে গেল পানিতে। তলিয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। ততক্ষণে ঝটপট বোটে উঠে পড়েছে অয়ন আর জিমি। ইঞ্জিন তো চালুই ছিল, থ্রটল বাড়াতেই চলতে শুরু করল বোট, পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকা হুপার আর গিবনকে ফেলে রওনা হয়ে গেল আরেক দিকে।

একটু পর কাশতে কাশতে পানিতে মাথা তুলল দুই গুন্ডা। কী ঘটেছে বুঝতে পেরে বিস্ময়ে স্থবির হয়ে গেল তারা।

‘কী হলো!’ লেকের পাড় থেকে চেঁচাল জেনকিন্স। ‘গিবন, হুপার, হচ্ছেটা কী ওখানে?’

‘বিচ্ছু দুটো বোট নিয়ে পালিয়েছে, বস,’ খাবি খেতে খেতে বলল হুপার। ‘আমাদের পানিতে ফেলে দিয়েছে।’

হাততালি দিয়ে উঠল রিয়া। ‘কী মজা!’

মি. ফার্গুসনও হাসি ঠেকাতে পারলেন না।

‘গাধার বাচ্চা বলে কী!’ চিৎকার করে উঠল জেনকিন্স। ‘দুটো পুঁচকে ছোড়া তোমাদের বোট নিয়ে গেল?’

‘পুঁচকে ছোড়া না, বস। সাক্ষাৎ ইবলিশ!’

‘এখন কী করব, বস?’ কাতর গলায় জানতে চাইল গিবন।

‘পানিতে ডুবে মর, হারামজাদা!’ গাল দিয়ে উঠল জেনকিন্স। ‘দুটো অপদার্থ এসে জুটেছে আমার সঙ্গে।’

‘মাথা গরম করে লাভ হবে না, বস,’ পাশ থেকে নরম গলায় বলল মেনডেজ। ‘কিছু একটা তো করতে হবে। ছেলে দুটো যদি পুলিশের কাছে যায়?’

‘হুঁ, ঠিকই বলেছ। তার আগেই ঠেকাতে হবে ওদের। গিবন, হুপার, আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি তোমাদের। যাও, ছেলে দুটোকে খুঁজে বের করো। সাবধান, পুলিশের কাছে যেন পৌঁছাতে না পারে। কী, পারবে তো?’

‘নিশ্চয়ই, বস,’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল গিবন। ‘এক ভুল আমরা দুবার করি না। বিচ্ছু দুটোর কপালে আজ খারাবি আছে।’

হুপারকে নিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করল সে।

‘ওদের নিয়ে কী করবে, তা আমি জানতে চাই না,’ পেছন থেকে বলল জেনকিন্স। ‘শুধু ওদেরকে ঠেকানো চাই। বুঝলে?’

‘ইয়েস, বস।’

‘কী করতে যাচ্ছে ওরা?’ ভয়ার্ত গলায় জানতে চাইলেন ফার্গুসন।

‘সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না,’ মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল জেনকিন্স।

‘হায় ঈশ্বর! ওরা ছোট বাচ্চা, ক্রিস।’

‘কাজকর্ম যদি বাচ্চাদের মতো হতো, তা হলে তো কোনো কথাই ছিল না। আমি আগেই সতর্ক করেছিলাম তোমাদের। কথা না শোনার শাস্তি এখন ওদের পেতেই হবে।’

হাঁটতে শুরু করল জেনকিন্স। পিঠে মেনডেজের পিস্তলের গুঁতা খেয়ে ফার্গুসনও হাঁটতে বাধ্য হলেন।

‘চিন্তা করবেন না, স্যার,’ নিচু গলায় তাঁকে বলল রিয়া। ‘অয়ন-জিমি যে-সে ছেলে নয়। এত সহজে কাবু হবে না।’

‘কী যে বলো! ওদের কাছে পিস্তল আছে। ছোট্ট দুটো ছেলে তার বিরুদ্ধে কী করতে পারবে?’

এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারল না রিয়া।

চার

সরাসরি লজের সামনের ঘাটে গিয়ে বোট ভেড়াল অয়ন আর জিমি। মোটরবোট চালানোর অভিজ্ঞতা আছে ওদের, খুব একটা অসুবিধা হলো না। বোটের দড়ি বাঁধা হলে নেমে পড়ল ঝটপট।

বৃষ্টি একটু কমেছে, কিন্তু বইছে ঠান্ডা বাতাস। সারা শরীর ভেজা দুজনের, শীতে কাঁপছে ঠকঠক করে। দাঁতের ঠোকাঠুকি কোনোমতে ঠেকিয়ে জিমি জানতে চাইল, ‘এবার?’

‘লজে চল। জলদি!’ তাড়া দিল অয়ন। ‘ওখানে রেডিও সেট আছে। পুলিশ ডাকব।’

ছুট লাগাল দুই বন্ধু। খোলা জায়গাটা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল লজে। ভেতরে ঢুকেই শুরু করল তল্লাশি, সিটিং রুমের লাগোয়া একটা দরজা খুলল। ওপাশে স্টোররুম—নানা রকম জিনিসে বোঝাই। স্টোররুমের পাশের দরজা খুলতেই একটা রিডিং রুম দেখা গেল, এক পাশের টেবিলের ওপর শোভা পাচ্ছে রেডিও সেটটা। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সুইচ অন করল জিমি। নব ঘোরাল। কিন্তু আলো জ্বলে উঠল না সেটের গায়ে। স্পিকারেও শোনা গেল না কোনো আওয়াজ।

‘ব্যাপারটা কী!’ ভুরু কোঁচকাল ও। সুইচ অন-অফ করল কয়েকবার, এদিক-ওদিক ঘোরাল সব কটি নব। তা–ও জ্যান্ত হলো না রেডিও সেট।

কী যেন সন্দেহ হওয়ায় পেছনে উঁকি দিল অয়ন। পরমুহূর্তে চেহারায় তিক্ততা ভর করল ওর। বলল, ‘লাভ নেই রে। বেটাদের যতটা কাঁচা ভেবেছিলাম, ততটা কাঁচা নয় মোটেই।’

‘মানে?’

মুঠো করে একগোছা ছেঁড়া তার তুলে দেখাল অয়ন। ‘যাওয়ার আগে সব তার ছিঁড়ে রেখে গেছে বদমাশগুলো। কোনো রিস্ক নিতে চায়নি।’

‘হায় হায়! এখন তাহলে পুলিশে খবর দেব কীভাবে? সেলফোনটাও তো রিয়ার কাছে।’

‘ওটা থাকলেও লাভ হতো না। পানিতে লাফ দিয়েছিলাম আমরা, ফোন ভিজে নষ্ট হয়ে যেত। নষ্ট যদি না-ও হতো, নেটওয়ার্ক না থাকায় ব্যবহার করতে পারতাম না।’

‘এই এলাকা থেকে বেরিয়ে গেলে তো নেটওয়ার্ক পেতাম।’

‘আদৌ কি বেরোতে পারব? গিবন আর হুপার নিশ্চয়ই ধরতে আসছে আমাদের। ওদের কাছে পিস্তল আছে, দূর থেকেও গুলি করতে পারবে আমাদের।’

‘ফাঁদে পড়ে গেলাম?’

‘সে রকমই তো মনে হচ্ছে।’

‘তাহলে উপায়?’

একটু ভাবল অয়ন। তারপর বলল, ‘লজ থেকে বেরোনো ঠিক হবে না, এখানেই আমরা কাবু করব হুপার আর গিবনকে। তারপর নিজেরাই যাব মি. ফার্গুসন আর রিয়াকে উদ্ধার করতে। কারণ, পুলিশ ডেকে আনার সময় নেই।’

‘তো খুব সহজ শোনাচ্ছে, কিন্তু কাজটা যে কত কঠিন, তা বুঝতে পারছিস? পিস্তলঅলা দুটো গুন্ডাকে আমরা কীভাবে কাবু করব?’

‘অতীতে যেভাবে করেছি, সেভাবে,’ মুচকি হাসল অয়ন। ‘ফাঁদ পেতে।’

‘ইয়েস!’ উত্তেজিত হয়ে উঠল জিমি। ‘কী ধরনের ফাঁদ পাততে চাইছিস?’

‘সিম্পল,’ আশপাশে চোখ বোলাল অয়ন। রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটা ক্যাবিনেট। এগিয়ে গিয়ে ওটার দরজা খুলল ও। ভেতরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কতগুলো বোতল। দুটো বোতল তুলে নিল। ‘এই তো, এগুলো দিয়েই কাজ হবে। আর দরকার একটা দড়ি।’

‘আমাদের মালপত্রের সঙ্গে তাঁবু বাঁধার দড়ি আছে,’ মনে করিয়ে দিল জিমি। ‘এক্ষুনি নিয়ে আসছি।’

ছুটে বেরিয়ে গেল ও। ওদের সব জিনিস এখনো বারান্দায় পড়ে আছে, সেখান থেকে দড়ির বান্ডিল নিয়ে ফিরে এল একটু পরই।

ততক্ষণে সামনের কামরায় চলে এসেছে অয়ন, ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জিমিও হাত লাগাল। ঠেলাঠেলি করে দুটো সোফা নিয়ে এল সদর দরজার কাছে; চৌকাঠের দুপাশে এমনভাবে বসাল, যেন ওগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকা যায়।

প্ল্যানটা জিমিকে বুঝিয়ে দিল অয়ন, ওর হাতে ধরিয়ে দিল একটা বোতল আর দড়ির এক মাথা। এক পাশের সোফার পেছনে গিয়ে ঘাপটি মারল জিমি। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে অয়নও লুকাল অন্য সোফার পেছনে। ওর হাতে থাকল দড়ির অন্য প্রান্ত, আর দ্বিতীয় বোতলটা।

শুরু হলো অপেক্ষা।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

*

ঢালু পথ ধরে ধীরে ধীরে উঠছে রিয়াদের দলটা। বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে মাটি, তাই পা ফেলছে সাবধানে। জেনকিন্স কয়েকবারই তাড়া দিয়েছে তাড়াতাড়ি এগোনোর জন্য, কিন্তু পাত্তা দেননি ফার্গুসন। রিয়া তক্কে তক্কে আছে, পারলে পক্ষীবিদকে নিয়ে পালাবে। তবে অয়ন-জিমির ঘটনায় সতর্ক হয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা, এক সেকেন্ডের জন্য ওদের ওপর থেকে নজর সরাচ্ছে না।

‘গ্যাব্রিয়েল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তুমি আমাদের?’ হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠল জেনকিন্স।

‘কোথায় আবার? যেখানে যেতে চাইছ সেখানেই,’ শান্ত গলায় জবাব দিলেন ফার্গুসন।

‘এত সময় লাগছে কেন?’

‘দূরের রাস্তা, তাই সময় লাগছে। তুমি কি ভেবেছিলে, পাখিগুলো তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য কাছে কোথাও এসে বসে আছে?’

‘আমার সন্দেহ হচ্ছে। চালাকি করছ না তো?’

‘মাথা খারাপ?’

চালাকি অবশ্য সত্যিই করছেন ফার্গুসন। বুদ্ধিটা রিয়ার। কানে কানে তাঁকে বলে দিয়েছে, যতটা পারেন যেন সময় নষ্ট করেন। পুলিশ নিয়ে ফিরে আসার জন্য অয়ন-জিমির সময় দরকার। পরামর্শটা যে তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে, এমন নয়। কিন্তু এ-ও বুঝতে পারছেন, আপাতত ছেলে দুটোর ওপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায় নেই তাঁর। তাই উল্টাপাল্টা পথে ঘুরিয়ে মারছেন জেনকিন্স ও মেনডেজকে।

ধোঁকাটা শেষ পর্যন্ত যখন ধরা পড়ল, তখন প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। ধরতে পারল মেনডেজ, এগিয়ে গিয়ে বসকে নিচু গলায় জানাল ব্যাপারটা। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল জেনকিন্স, ‘থামো, গ্যাব্রিয়েল!’

ঘুরে দাঁড়ালেন ফার্গুসন। ‘কী ব্যাপার?’

হাতের পিস্তলটা ভয়ংকর ভঙ্গিতে নাড়ল জেনকিন্স। ‘তোমার চালাকি ধরা পড়ে গেছে। তুমি আমাদের অযথা ঘোরাচ্ছ।’

‘তোমার তা-ই ধারণা?’

‘ধারণা-টারণা না। আমি বুঝে ফেলেছি।’

‘এতটা নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?’ ফার্গুসনের কণ্ঠ আশ্চর্য রকমের শান্ত।

‘আপনি ভীষণ বোকা, মি. ফার্গুসন,’ বলল মেনডেজ। ‘আমাদেরও তা-ই ভাবছেন। সন্দেহ হচ্ছিল আমার, তাই পথের ওপর নজর রাখছিলাম। বড় একটা পাথর পেরিয়ে এলাম খানিক আগে, ওটার পাশ দিয়ে আগেও একবার গিয়েছি। কোনো ভুল নেই।’

চুপ করে রইলেন ফার্গুসন।

‘আর কোনো চালাকি নয়,’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল জেনকিন্স। ‘এবার তুমি আমাদের ঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে, বুঝলে? নইলে...’ রিয়ার দিকে পিস্তল ঘোরাল সে।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফার্গুসন। ‘বেশ।’

‘গুড,’ সন্তোষ ফুটল জেনকিন্সের। ‘তবে এই যে আমাদের এতটা সময় নষ্ট করলে, তার জন্য একটা শাস্তি পাওনা হয়েছে তোমার। মেনডেজ, ব্যবস্থা নাও।’

‘ইয়েস বস,’ বলে এগিয়ে গেল গুন্ডা। মি. ফার্গুসনের পেছনে গিয়ে তাঁর ঘাড়ের ওপর পিস্তলের বাঁট দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত হানল। হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন পক্ষিবিদ। কলার ধরে তাঁকে আবার দাঁড় করাল সে।

জেনকিন্স ও তাঁর অনুচর মি. ফার্গুসনকে নিয়ে ব্যস্ত, এই সুযোগে উল্টো ঘুরে দৌড় দিল রিয়া।

‘আরে, আরে!’ চেঁচিয়ে উঠল জেনকিন্স। ‘মেয়েটা পালিয়ে গেল তো! মেনডেজ, ধরো ওকে!’

পিস্তল বাগিয়ে রিয়ার পিছু পিছু ছুটল গুন্ডা। চিৎকার করে বলল, ‘অ্যাই মেয়ে! থামো বলছি! নইলে গুলি করব!’

কে শোনে তার কথা, ছোটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল রিয়া। গুলি করল মেনডেজ। কানের পাশ দিয়ে গুঞ্জন তুলে ছুটে গেল বুলেট। কেঁপে উঠল রিয়া। প্রাণের মায়ায় ছুটতে থাকল পাগলের মতো।

হঠাৎ আলগা পাথরে পা হড়কাল ওর। তাল সামলাতে পারল না বেচারী, পাহাড়ি ঢালে আছড়ে পড়ল, তারপর গড়াতে শুরু করল নিচ দিকে।

অনেক দূর যাওয়ার পর একটা বড় ঝোপের সঙ্গে বাধা পেয়ে থামল ওর পতন। প্রচণ্ড ঝাঁকিতে চোখেমুখে অন্ধকার দেখল ও, মনে হলো দম বেরিয়ে যাবে। কিছুক্ষণের জন্য নড়াচড়ার শক্তি হারাল। ওই অবস্থাতেই দেখতে পেল, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মেনডেজ। চুলের মুঠো ধরে টেনে তুলল ওকে।

দুর্বল হাতে মার্শাল আর্টের প্যাঁচ কষতে গেল রিয়া, তাতে কাজ হলো না; বরং প্রচণ্ড এক চড় খেতে হলো।

‘দেখে নেব,’ মনে মনে কসম কাটল ও।

*

হাঁচড়েপাঁচড়ে পানি থেকে উঠে এল হুপার আর গিবন। সাঁতার কাটতে কাটতে হাঁপিয়ে গেছে দুজনই। ডাঙায় উঠে কিছুক্ষণ বড় বড় শ্বাস নিল, স্বাভাবিক করতে চাইল নাড়ির গতি।

একটু পর সোজা হলো দুজন। হুপার বলল, ‘কোথায় যেতে পারে বিচ্ছু দুটো?’

ঘাটে বাঁধা বোটটা দেখাল গিবন। ‘বোট যখন এখানে, তাহলে লজেই গেছে। নিশ্চয়ই রেডিওতে পুলিশ ডাকতে চাইছে।’

‘কিন্তু রেডিও তো আমরা নষ্ট করে দিয়েছি। ওই অচল যন্ত্র নিয়ে বসে থাকবে এতক্ষণ?’

‘আগে লজটাই চেক করি। যদি না পাই, তা হলে জঙ্গলে খুঁজব। চিন্তার কিছু দেখছি না, বৃষ্টিতে মাটি ভিজে গেছে। লজ থেকে বেরোলেও বাইরে ওদের পায়ের ছাপ পাওয়া যাবে।’

হাতে পিস্তল নিয়ে লজের দিকে এগোল দুজন। পা টিপে টিপে বারান্দায় উঠল। সাবধানে ধাক্কা দিল দরজায়। কিন্তু খুলল না পাল্লা।

ঠোঁটে শয়তানি হাসি ফুটল গিবনের। হুপারকে বলল, ‘দরজা ভেতর থেকে আটকানো। তার মানে ভেতরেই আছে দুই বিচ্ছু। চলো, হামলা চালানো যাক।’

দরজার ওপর সর্বশক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। মড়মড় করে উঠল কাঠ, গোড়া থেকে উপড়ে এল ছিটকিনিটা। হাট হয়ে খুলে গেল পাল্লা। হইহই করে ভেতরে ঢুকে পড়ল দুই গুন্ডা।

সোফার পেছন থেকে জিমিকে ইশারা দিল অয়ন, টান দিল হাতের দড়িতে। জিমিও টান দিয়েছে একই সঙ্গে। মেঝের কয়েক ইঞ্চি ওপরে উঠে এল টান টান দড়ি। সেটা দেখতে পেল না গুন্ডারা, বরং দ্রুত এগোতে গিয়ে পা বাঁধল ওতে। তাল হারিয়ে হুড়মুড় করে দুজনেই মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে, ককিয়ে উঠল ব্যথায়।

পরমুহূর্তে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল অয়ন আর জিমি। নির্দয়ভাবে হাতের বোতল দুটো ভাঙল তাদের মাথায়। আর্তনাদ করে উঠল হুপার আর গিবন। তারপরই জ্ঞান হারাল।

‘গুড জব,’ বুড়ো আঙুল তুলে সংকেত দেখাল জিমি।

‘আয়, ব্যাটাদের বেঁধে ফেলি।’

ঝটপট অজ্ঞান দুই গুন্ডাকে দড়ি দিয়ে লাট্টুর মতো পেঁচিয়ে ফেলল ওরা। মুখে গুঁজে দিল কাপড়।

‘ব্যস, এদের কম্ম সারা,’ সন্তুষ্ট গলায় বলল অয়ন। ‘এবার জেনকিন্স আর মেনডেজের পালা।’

মেঝেতে হুপার আর গিবনের পিস্তল পড়ে আছে, সেগুলো তুলে নিল জিমি। ‘যাক, এবার আমাদের কাছে পিস্তল থাকছে।’

‘লাভ কী?’ বলল অয়ন। ‘পিস্তল ওদের কাছেও আছে। গোলাগুলি করে সুবিধা করতে পারব না আমরা। তা ছাড়া বন্দুক-পিস্তল চালাতেও জানি না।’

‘তাহলে?’

‘বুদ্ধি খাঁটিয়ে কাজ সারতে হবে।’

‘মানে...আরেকটা ফাঁদ?’

মাথা ঝাঁকাল অয়ন।

‘কিন্তু পাতবি কোথায় ফাঁদটা?’ জিমি শুধাল। ‘আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে জেনকিন্স আর ওর শাগরেদ। ওদের নাগাল পাবি কীভাবে?’

‘দেখি কোনো উপায় আছে কি না।’

পকেট থেকে মি. ফার্গুসনের আঁকা নকশাটা বের করল অয়ন। পানিতে কাগজটা ভিজে গেছে বটে, তবে বলপেন দিয়ে এঁকেছিলেন তিনি, তাই কালি ছড়িয়ে যায়নি। সাবধানে ভাঁজ খুলল ও। সিটিংরুমের কফি টেবিলের ওপর বিছিয়ে নজর বোলাল তীক্ষ্ণ চোখে।

‘হুম। লেকের ওধারে পাহাড় থেকে বেশ খানিকটা দূরেই নেমেছে রিয়ারা। বোট নিয়ে আমরা আরও সামনে গিয়ে নামতে পারি। তারপর এই পথটা ধরে...’ নকশার ওপর একটা কাল্পনিক রেখায় আঙুল বোলাল অয়ন, ‘...শর্টকাটে পৌঁছে যেতে পারব পাখিগুলোর কাছে।’

‘ওদের আগে?’ সন্দেহ প্রকাশ করল জিমি। ‘আমার তা মনে হয় না। ওরা তো অনেকক্ষণ আগেই রওনা হয়েছে।’

‘আমার বিশ্বাস, রিয়া ওদেরে দেরি করাবে।’

‘কিসের জন্য? ও তো আর জানে না, আমরা ওখানে গিয়ে ফাঁদ পাততে চাইছি।’

‘পুলিশ আসার সময় দেওয়ার জন্য দেরি করাবে।’

‘একটু বেশিই আশা করে ফেলছিস। ওর মাথায় এত বুদ্ধি থাকলে তো! ওই কাউয়া বুড়ি পারে শুধু ঝগড়া করতে।’

তিরস্কারের চোখে তাকাল অয়ন। ‘রিয়াকে তুই আন্ডারএস্টিমেট করছিস, জিমি। অনেক দিন থেকেই তো ও আছে আমাদের সঙ্গে। বেশ কয়েকটা কেসে সাহায্যও করেছে। ও জানে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করতে হয়।’

‘তোর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।’

‘চল এখন। সময় নষ্ট করা যাবে না। আর হ্যাঁ, স্টোররুমে কয়েকটা জিনিস দেখেছি, ফাঁদ পাতার জন্য ওগুলো লাগবে আমাদের...’

পাঁচ

যতটা সম্ভব দ্রুত পথ চলছেন ফার্গুসন, আর কোনো কৌশল খাটানোর চেষ্টা করছেন না। বুঝতে পেরেছেন, তাতে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। পক্ষিবিদের ঠিক পেছনে রয়েছে জেনকিন্স, সবার শেষে মেনডেজ। রিয়াকে রাখা হয়েছে দুজনের মাঝখানে, যেন পালাতে না পারে।

পাহাড়ের অনেকটাই ওপরে উঠে এসেছে চারজনের দলটা। ঢালের গায়ে বেড়ে উঠেছে অসংখ্য ঝোপঝাড় আর বড় বড় গাছ। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন ফার্গুসন। তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে।

‘কী হলো, থামলে কেন?’ বলে তাঁর পাশে গেল জেনকিন্স। সামনে চোখ পড়তেই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘মার্কার ফ্ল্যাগ!’

সত্যিই তা-ই। মস্ত বড় একটা পাইনগাছের চারপাশ ঘিরে গেঁথে রাখা হয়েছে লাল রঙের ছোট ছোট পতাকা। শুধু তা-ই নয়, গাছের গায়ে লাল রঙের রেখাও টানা হয়েছে, সেই রেখা উঠে গেছে একেবারে মগডালের কাছ পর্যন্ত—৫০ থেকে ৬০ ফুট।

‘এটাই কি সে গাছ?’ উত্তেজিত গলায় জানতে চাইল জেনকিন্স।

চুপ করে রইলেন ফার্গুসন।

‘ইয়াহু’জাতীয় একটা শব্দ করল জেনকিন্স, ছুটে গেল গাছের কাছে। বন্দীদের কথা ভুলে মেনডেজও এগিয়ে গেল। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আরেকবার দৌড় দেবে কি না ভাবল রিয়া, কিন্তু মত পাল্টাল মি. ফার্গুসনের চেহারা দেখে। কপালে গভীর ভাঁজ পড়েছে তাঁর, চেহারায় ফুটে উঠেছে অস্বস্তি।

পাশে গিয়ে দাঁড়াল ও। নিচু গলায় বলল, ‘কোনো সমস্যা?’

‘এটা ভুল গাছ, রিয়া,’ বললেন ফার্গুসন। ‘এ গাছে আইভরি বিল্ড উডপেকারগুলো নেই।’

‘মানে!’

‘যে গাছে ওদের বাসা, সেটা আরও সামনে। তা ছাড়া ওটা সিডারগাছ, আর এটা পাইন।’

‘তাহলে ওই চিহ্নগুলো?’

‘পতাকাগুলো আমি লাগাইনি। গাছের গায়ে আমি কোনো লাল দাগও দিইনি। কে যে এ কাজ করল...’

একমুহূর্ত ভাবল রিয়া, তারপরেই চোখ জোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। চাপা গলায় বলল, ‘বদমাশগুলোকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই, যা খুশি করতে দিন ওদের।’

‘কিন্তু পাখি না পেলে...’

‘দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কিছু একটা ঘটতে চলেছে। আপনি মুখে তালা দিয়ে রাখুন।’

প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলে ফার্গুসনের দিকে ফিরল জেনকিন্স। বলল, ‘মার্কার ফ্ল্যাগ কেন লাগিয়েছ, বুঝতে পারছি। কিন্তু লাল দাগটা কিসের?’

‘সেটাও বুঝতে পারছেন না?’ পক্ষীবিদকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলে উঠল রিয়া। ‘গাছে অনেকগুলো খোঁড়ল আছে। ঠিক কোনটার ভেতরে পাখিগুলো আছে, সেটা চেনার জন্য ওই দাগ।’

‘বুদ্ধিটা খারাপ নয়,’ দাঁত বের করে হাসল জেনকিন্স। ঘুরল মেনডেজের দিকে। ‘এবার তোমার খেলা দেখাও, মেনডেজ। ধরে আনো পাখিগুলো। লাল দাগের শেষ মাথায় পাবে ওদের।’

‘ইয়েস, বস।’

পিঠ থেকে পাখির খাঁচা নামাল মেনডেজ। কোমরে গুঁজল নিজের পিস্তল। শুধু নেট ঝুলতে থাকল কাঁধে। এরপর লাফ দিয়ে গাছের নিচু একটা ডাল ধরল। কসরত করে উঠে গেল তাতে। সেখান থেকে এ-ডাল ও-ডাল ধরে তরতর করে উঠতে থাকল ওপরে। কয়েক মিনিট পরেই পৌঁছে গেল লাল দাগের শেষ সীমায়। সরু একটা ডাল রয়েছে ওখানে, সেটার ওপরে দাঁড়াল কায়দা করে।

‘পৌঁছে গেছি, বস,’ জানাল সে।

‘কী দেখছ?’ জেনকিন্স জিজ্ঞাসা করল।

‘খোঁড়ল একটা আছে বটে, কিন্তু পাখিটাখি তো দেখছি না।’

‘ভালো করে দেখ, ব্যাটা! নিশ্চয়ই আছে। বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাবে পাখিগুলো?’

‘আচ্ছা, দেখছি,’ বলে একটু নড়ল মেনডেজ। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল মড়াৎ করে একটা শব্দ। ভেঙে পড়ল ডালটা।

আর্তচিৎকার করে উঠল মেনডেজ। অবলম্বন পাওয়ার আশায় ছুড়ল হাত-পা, তবে লাভ হলো না। নিচে পড়ে গেল সে। সরাসরি পড়ল না। ঠোকর খেতে থাকল একের পর এক ডালে। শেষ পর্যন্ত যখন মাটিতে আছড়ে পড়ল, ততক্ষণে সে বেহুঁশ।

হতভম্বের মতো অনুচরের নিস্তেজ দেহের দিকে তাকিয়ে রইল জেনকিন্স। আর তক্ষুনি কাছের একটা ঝোপের আড়াল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল দুটি ছায়ামূর্তি, ছুটে এল তার দিকে। অয়ন আর জিমি!

পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঝট করে ঘুরল সে, হাতের পিস্তল তাক করতে গেল ওদের দিকে। কিন্তু কাছে চলে এসেছে রিয়া, পাশ থেকে একটা লাথি মারল তার হাতে। উড়ে চলে গেল পিস্তলটা, লোকটা ককিয়ে উঠল ব্যথায়। পরক্ষণে রাগবি খেলোয়াড়দের ভঙ্গিতে তাকে লক্ষ্য করে ডাইভ দিল অয়ন আর জিমি।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বুকে-পেটে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে মাটিতে চিতপটাং হলো জেনকিন্স। শরীরের শক্তি হারাল ক্ষণিকের জন্য। তার গায়ের ওপর চড়ে বসল দুই বন্ধু। হুপারের পিস্তলটা বের করে তার কপালের দিকে তাক করল অয়ন। বলল, ‘নড়াচড়া না করলেই ভালো করবেন।’

হুমকিটা মানতে চাইল না জেনকিন্স, গা ঝাড়া দিয়ে অয়ন-জিমিকে ফেলে দিতে চাইল গায়ের ওপর থেকে। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দিল না রিয়া। এগিয়ে এসে একটা কিক করল লোকটার মাথায়। ঝাঁকি খেল জেনকিন্স, অস্ফুট আওয়াজ করে জ্ঞান হারাল।

বাঁকা চোখে রিয়ার দিকে তাকাল অয়ন। ‘লাথি মারার দরকার ছিল না। লোকটা এমনিতেই কাবু হয়েছিল।’

‘প্রতিশোধ নিলাম,’ বলল রিয়া। ‘মেনডেজ বদমাশটা আমাকে চড় মেরেছিল। ও তো অলরেডি বেহুঁশ, তাই ওর বসের ওপর নিলাম প্রতিশোধটা। আফটার অল, এ-ই তো নাটের গুরু।’

‘হুম। বোঝা গেল, ভুলেও তোমার গায়ে হাত তোলা যাবে না।’

‘কেন, সে রকম কোনো খায়েশ আছে নাকি?’

‘পাগল? জিমি, বেটাকে বেঁধে ফেল। আমি মেনডেজের অবস্থা দেখছি।’

আরেক গোছা দড়ি নিয়ে এসেছে জিমি, সেটা দিয়ে বাঁধতে শুরু করল জেনকিন্সকে। অয়ন আর রিয়া গেল গাছের তলায়। অচেতন মেনডেজকে পরীক্ষা করল। হাড়গোড় ভেঙেছে বলে মনে হলো না, তবে গাছের ডালের বাড়ি খেয়ে বেশ কয়েকটা আলু গজিয়েছে মাথায়। লোকটাকে ধরাধরি করে নিয়ে এল ওরা। জেনকিন্সের সঙ্গে একসঙ্গে বেঁধে ফেলল।

এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি ফার্গুসন, ঘটনার আকস্মিকতায় স্থবির হয়ে গিয়েছিলেন। এবার পায়ে-পায়ে এগিয়ে এলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, ‘কী ঘটল, বলো তো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘সহজ ব্যাপার, স্যার,’ বলল রিয়া। ‘ফাঁদে ফেলে বদমাশদের ঘায়েল করেছে আমার বন্ধুরা। আসল গাছের পাশ থেকে মার্কার ফ্ল্যাগ তুলে এনে লাগিয়েছে আরেকটা গাছের পাশে। লাল দাগ এঁকে টোপ ফেলেছে, যাতে ওপরের ওই ডালটায় ওদের কেউ উঠলেই ভেঙে পড়ে। জানত, তাতে চমকে যাবে নিচেরজন, তখন হামলা চালিয়ে কাবু করা যাবে তাকে।’ দুই বন্ধুর দিকে তাকাল ও। ‘তবে বেশ ঝুঁকি নিয়েছ। ডালটা যদি না ভাঙত?’

‘তার কোনো আশঙ্কাই ছিল না,’ হাসিমুখে বলল জিমি। ‘লজের স্টোররুম থেকে করাত নিয়ে এসেছিলাম। লাল পেইন্টও ওখানেই পেয়েছি। করাত দিয়ে কেটে রেখেছিলাম ডালের অর্ধেকটা।’

‘তুমি?’

‘বুদ্ধিটা অয়নের, কাজটা আমার,’ বলল জিমি। ‘এসব কঠিন কাজ তো সাধারণত আমার ঘাড়েই চাপে। অলসের হদ্দ অয়ন কি আর গাছে ওঠে?’

‘কী বললি!’ চটে উঠল অয়ন। ‘আমি অলসের হদ্দ?’

হেসে ফেললেন ফার্গুসন। ‘গিবন আর হুপার কোথায়?’

‘বেহুঁশ,’ জানাল অয়ন। ‘লজের ভেতর ওদের ভালোমতো বেঁধে রেখে এসেছি। ছুটতে পারবে না।’

‘আশ্চর্য তো! অস্ত্রধারী দুটো গুন্ডাকে হারালে কী করে?’

‘মাথামোটা লোকদের ঘায়েল করা কঠিন কিছু না,’ হেঁয়ালি করল অয়ন।

‘কিন্তু তোমরা আমাদের আগে এখানে পৌঁছালে কী করে?’

‘শর্টকাট ধরে। আপনার আঁকা ম্যাপটা ছিল তো আমাদের কাছে! তা ছাড়া আপনারাও মনে হচ্ছে অনেকটা পথ ঘুরপাক খেয়ে এসেছেন, সময় নষ্ট করেছেন। বুদ্ধিটা কার ছিল? নিশ্চয়ই রিয়ার?’

মাথা ঝাঁকালেন ফার্গুসন।

জিমির দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল অয়ন। ভাবখানা এমন—কী, বলেছিলাম না?

‘তোমাদের তুলনা হয় না,’ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন ফার্গুসন। ‘তোমরা না থাকলে আজ যে কী হতো! কীভাবে ধন্যবাদ জানাব, তা বুঝতে পারছি না।’

‘ধন্যবাদ দিতে হবে না, স্যার,’ বলল অয়ন।

‘বিপদে পড়েছিলেন, সাহায্য করাটা তো আমাদের কর্তব্য ছিল।’

‘বাহ্, বিনয়ও দেখি করতে জানো,’ হাসিমুখে বললেন পক্ষিবিদ। ‘চলো, এবার পুলিশ ডাকা যাক। পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে বোধ হয় সেলফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে।’

‘তাড়া কিসের? বদমাশরা কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে না। চলুন না, অচিন পাখিগুলো দেখে আসি।’

‘অচিন পাখি!’

‘আইভরি বিল্ড উডপেকার নামটা বড্ড খটমটে, তাই অচিন পাখি বললাম। তা ছাড়া এক হিসাবে অচিনই তো। বহু বছরে কেউ তো ওই পাখি দেখেনি। দেখাবেন আমাদের?’

‘অবশ্যই দেখাব। এসো আমার সঙ্গে।’

মি. ফার্গুসনের সঙ্গে পা বাড়াল তিন বন্ধু।