ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ কুকুরদের সঙ্গে যে রকম ব্যবহার করে সেটা খুব ভালো লাগত ভালিয়ার। কখনো গলা চড়াত না সে, চটে উঠত না। যেন কুকুর নয়, ছোটো ছোটো ছেলেদের মানুষ করে তুলছে।
শাস্তির সশঙ্ক প্রত্যাশায় কয়েকদিন কাটল তিয়াপার। ভয়ানক বুক ঢিপ ঢিপ করে রাত্রে জেগে উঠত সে, খাড়া হয়ে উঠত চার পায়ের ওপর, জান বাঁচানোর জন্যে রুখে দাঁড়াত একেবারে, আস্তে হলেও বেশ ভয়ানক সুরে গরগর করে উঠত।
নিশ্চয় ঝাড়ুটাই ওর চক্ষুশূল,' ভালিয়াকে বলত ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ।
'চশমার তল থেকে সহৃদয় চোখে সে চেয়ে দেখত কুকুরটার দিকে। এই সব মুহূর্তে কেমন অস্বস্তি লাগত তিয়াপার, মাথা নাড়াত এদিক ওদিক। অপ্রীতিকর ঘটনার কথা মনে পড়ত কেবল তার নতুন নামটায়। ওকে যে সবাই খেকুরে বলে ডাকে এটা ওর কিছুতেই অভ্যাস হচ্ছিল না।
'ভয় নেই,' মনের ভাবনাটা শুনিয়ে শুনিয়েই বললে ডাক্তার, 'শান্ত হয়ে আসবে, মন বসবে, হয়ে উঠবে এক খাসা মহাকাশযাত্রী। কী বলেন ভালিয়া?'
'মহাকাশযাত্রী...' স্বপ্নাচ্ছন্নভাবে বললে ভালিয়া, 'ভেসে যাওয়া মহাকাশ দিয়ে। খেকুরে তো আর জানে না ওর ভবিষ্যৎ কী সুন্দর। কী চমৎকারই না হত যদি আমি যেতে পারতাম ওর জায়গায়!'
'এই রে! শুরু হয়েছে তো সব ছেলেমানুষি,' ভুরু কোঁচকাল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ, 'আপনি হলেন মহাজগতের চিকিৎসাকর্মী ভালিয়া, কথাটা দয়া করে যেন ভুলবেন না। জাহাজের ডাক্তার জাহাজেই যায়। ফুটবল টিমের ডাক্তার বসে থাকে গোল পোস্টের কাছে বেঞ্চিতে। সার্জেন রোগীর ওপর অস্ত্রোপচার করে টেবিলে। আর মহাজগতের ডাক্তার সবচেয়ে জরুরী মুহূর্তটিতে কিন্তু সে উড়ো জাহাজে নয়, রকেটে নয়, তার ইনস্ট্রুমেন্টের কাছে।'
'আমার কেবলি মনে হয়,' একটু আহত স্বরে বলল সহকারিণী, 'আপনি যেন একেবারে মহাজগতের ডাক্তার হয়েই জন্মেছেন। ছেলেবেলায় খেলনাপাতি নিয়ে নয়, ডাক্তারি ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়েই বুঝি খেলা করেছেন।'
হেসে উঠল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ।
'রাগ করবেন না ভালিয়া লক্ষ্মীটি; জানেন, আমার জীবনে যা ঘটেছে সে ভারি চমৎকার।
আপনাদের কাছে সবই খুব সোজা সাপটা। কাল স্কুলে পড়েছেন আজ ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট আর কাল
জানেনই তো কাল কী হবেন, কলেজে পড়ছেন। আর আমি যখন পড়তাম তখন রকেট তো ছিলই না, জেট প্লেনকেই ধরা হত খুব অভিনব বলে। আর আমি ভাবলাম, পশুচিকিৎসকই হওয়া যাক।'
'তারপর কী হল?'
'হল এই: কলেজ শেষ করলাম। আমায় বললে দুটো সাবেকী বিজ্ঞানকে মেলাবার কাজে যোগ দিতে চাও চিকিৎসাবিদ্যা আর জ্যোতির্বিদ্যা? কাজ করবে সবচেয়ে নতুন একটা বিজ্ঞান মহাজাগতিক চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে? বুক ধক করে উঠল আমার পাখা মেলে যেন একেবারে উড়ে গেলাম। তারপর এই এখানে...'
ভাসিলি ইওলকিন যখন পশুচিকিৎসা কলেজের ছাত্র হয় তখন কেউ অবাক হয়নি। জীবজন্তু নিয়ে তার উৎসাহের কথা বাড়ির লোকে, স্কুলে, বলতে কি গোটা পাড়াতেই সবাই জানত। এলোমেলো চুল, নরম হাসি আর হাড্ডিসার চেহারার এই লম্বা ছোকরাটাকে দেখলে ছেলেরা চ্যাঁচাত , 'গরুর বদ্যি, ও গরুর বদ্যি, পেট ব্যথা করছে আমার।' ওরা জানত লোকটা চটে না, ছুটে এসে তারা, তার ফুলে ওঠা পকেটের মধ্যে কৌতূহলী উঁকি দিত। সর্বদাই কিছু না কিছু একটা নড়াচড়া, ফোঁসফাঁস, কিচিরমিচির করত সেখানে। বুড়িরা গিন্নিরা ইওলকিনের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসত চোখ না ফোটা কুকুর বেড়ালের বাচ্চা। পথে ফেলে দেওয়াদের প্রথম ঘর মিলত কাঠের বাক্সে। ভাসিলির কামরার কোণে জমে উঠেছিল সজারু, গিনিপিগ, কাছিম আর অন্যান্য নানা প্রাণীর এক দিব্যি সংসার।
ঝঞ্ঝাটও বাদ যেত না। ভালিয়ার কাছে গল্প করেছিল ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ:
'বাড়িতে একদিন হুলুস্থুলু বেধে গেল। ডাস্টবিন থেকে একটা সাপ বেড়িয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল আঙিনায়। সে কী কাণ্ড! চিৎকার, চেঁচামেচি। ঝটপট দরজা জানলা সব বন্ধ। কেউ আর বেরয় না। মিলিশিয়ার লোক আর দরোয়ান লাঠি হাতে একেবারে আমাদের ফ্ল্যাটে: এখুনি আঙিনা পরিষ্কার করে ফ্যালো! আমি তখন ঘরে নেই। স্কুলে। মা বললে, 'আমাদের এখানে মোটেই কোনো সাপ কখনো ছিল না। সব দোষই চাপাবে আমার ছেলের ঘাড়ে? নিজেরা পরিষ্কার করো গে!' ওরা গিয়ে হাজির হল স্কুলে, হেড মাস্টারের কাছে। আপনাদের জীববিজ্ঞানীটিকে একবার চাই! লোকে কাজে যাবে, দোকানপাট করবে, কিন্তু কেউ বেরতে পারছে না। অমনি আমি বুঝলাম ব্যাপার কী। জলা থেকে আমি আগের দিন কিছু হেলে সাপের ডিম জোগাড় করেছিলাম। মা নিশ্চয় সেগুলোকে আবর্জনার স্তূপে ফেলে দিয়েছে। আর ডাস্টবিনের গরমের মধ্যে রোদ্দুরে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে থাকবে। পথে যেতে যেতে কী, কেন, কোথায় এসব বোঝাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মিলিশিয়ার লোকটা কোনো কথাই শুনতে চায় না, কেবলি বলে, 'বিষাক্ত সাপ দিয়ে বাসিন্দাদের সবাইকে ভয় দেখানো হচ্ছে!' ডিম ফোটা সবকটি বাচ্চাকে খুঁজে বার করে দেখালাম, কামড়ায় না। হলে কী হয় জরিমানা কিন্তু মাপ হল না...। তখন কিন্তু ভালিয়া আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি যে আমার ঐ নেশাটাই হয়ে উঠবে আমার পেশা...'।
দ্বিতীয় ঘটনাটার কথা ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ কারো কাছেই বলেনি: কী ভাবে বিমান স্কুলে ভর্তি হবার চেষ্টা করেছিল সে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভিতকা চের্নিয়ায়েভ ছাড়া আর একটি লোকও জানত না যে এই বিদঘুটে ভালোমানুষ ইওলকিন, ছেলেরা যাকে গরুর বদ্যি বলে ডাকে, সে জীববিজ্ঞানী নয়, পশুর ডাক্তার নয়, এমন কি আফ্রিকায় শিকারী হবারও স্বপ্ন দেখত না, স্বপ্ন দেখত বৈমানিক হবে। সব ছেলেরই বৈমানিক হবার সাধ থাকে, কিন্তু পরে যত বয়স বাড়ে তত অন্যরকম নানা ইচ্ছা আর সংকল্প দেখা দেয়। ভাসিলি কিন্তু স্কুলের পরীক্ষা শেষ হতেই তার বন্ধু ভিতকার সঙ্গে গিয়ে দরখাস্ত দেয় বৈমানিক স্কুলে।
'নমস্কার কমরেড...। ক্যাপটেন,' টেবলের ওপাশে যে সামরিক লোকটি বসেছিল তার কাঁধের স্ট্যাপে তারার সংখ্যা গুনে চোখ কচকে বললে ইওলকিন।
'নমস্কার,' বলে ক্যাপটেন টেবল থেকে একটা খবরের কাগজ তুলে দেখালেন। 'হেড লাইনটা পড়ুন, না না, এগিয়ে আসবেন না, ঐখান থেকেই। বটে... চশমা আছে? তাহলে দরখাস্ত দিলেন যে বড়ো? বুঝেছি, বুঝেছি... কিন্তু বৈমানিকের শুধু একটি চশমা বৈমানিক চশমা।' -
বন্ধুকে কিন্তু ভর্তি করে নিয়েছিল ওরা। নিজের উল্লাস চেপে সে এসেছিল ভাসিলিকে সান্ত্বনা দিতে:
'নে গরুর বদ্যি, মন খারাপ করিস না। চশমা পরা ডাক্তার, সে তো আরো ভালো। বেশ ভারিক্কী...'
ভিতকা সৌভাগ্যবান, বিমানের সবকিছু সে শিখলে, লাফ দিত প্যারাশুট নিয়ে, ট্রেনিং বিমানে বাঁক নিয়ে 'লুপ' করে দেখাল এবং মোটের ওপর তৈরি হল জেট বৈমানিক হিসাবে। পরে জেট ফাইটার চালাত সে, পৃথিবীটাকে দেখত আকাশের উপর থেকে।
মনে মনে তাকে ঈর্ষা করত ভাসিলি। কিন্তু হঠাৎ যখন অপ্রত্যাশিতভাবে হয়ে উঠল মহাকাশের ডাক্তার তখন আর হিংসা হত না। পৃথিবীটাকে চের্নিয়ায়েভ যেভাবে দেখেছে, ইওলকিন সেভাবে দেখত না। পৃথিবীটা তার কাছে বন, নদী, নগরের ছোপ নয়, মস্ত একটা গোলক তাতে মহাদেশ আর মহাসমুদ্রের রেখা। ওড়বার জন্যে ইওলকিন যাদের তৈরি করবে তাদের চোখে পৃথিবীটা তো ঠিক এই রকমই লাগবে।
সানন্দেই সে মহাজগতের ডাক্তার হিসাবে কাজ করতে লাগল। কিন্তু একটা জিনিসে তার কিছুতেই অভ্যেস হল না। লোকে যে তাকে ভাসিলি বলে না ডেকে সম্মান দেখিয়ে পুরো নাম ধরে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ বলে ডাকে এটা তার বরদাস্ত হত না। কেমন বিব্রত হয়ে লাল হয়ে উঠত সে। তারপর একদিন এই ভেবে শান্ত হল যে সম্মানটা ব্যক্তিগতভাবে ওর প্রতি নয়, নতুন বিজ্ঞানের প্রতি।