দুই নম্বর গেটের সকলেরই এইটে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল যে প্রতি সকালে সেখানে পাঁচ তলায় একচল্লিশ নম্বরের দরজা খুলে যাবে আর বেরিয়ে আসবে একটা ঝাঁকড়া কুকুর আর লাল গেঞ্জি পরা একটা পাঁশুটে চুলো ছেলে। হুটোপুটি করে তারা নামবে সিড়ি দিয়ে আর কুকুরটার খুশির ডাক যার কানে যাবে সেই মনে মনে ভাববে সাড়ে সাতটা বাজল। কাজের লোকেরা যখন লিফটে করে নামতে থাকে, ততক্ষণে ছেলেটা আর কুকুরটা তরতরিয়ে ফের উঠে আসে নিজেদের তলায়। সাধারণত তাদের সঙ্গে দেখা করতে ঐ পাঁচ তলার চত্বরেই চল্লিশ নং ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসত ঘুম চোখে একটি ছেলে, গায়ে তার স্ট্রাইপ দেওয়া স্লিপিং স্যুট, হাই তুলে জিজ্ঞেস করত, 'গুড মর্নিং! ক চক্কর দিলি? পাঁচ? চমৎকার!' তারপর কুকুরটাকে দু পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে চলে যেত স্লিপিং স্যুট পরা পড়শী ছেলেটি।
সোমবারে কিন্তু কুকুরের ডাক কেউ শুনলে না, যদিও লাল গেঞ্জি পরা বরকা স্পেলভ একচল্লিশ নং ফ্ল্যাট থেকে বরাবরের মতোই বেরিয়ে এল ঠিক সাড়ে সাতটায়। হালকা পায়ে স্লিপার পরে সে চুপি চুপি নেমে এল নিচে, তারপর বাড়িটার চারপাশে চক্কর দিতে শুরু করলে। কয়েক চক্কর দিয়ে ব্যায়ামবীর ছুটে গেল পোড়ো জমিটার দিকে, ব্যায়াম করতে শুরু করলে।
কাজের লোকেরা বহু আগেই পা চালিয়েছে মেট্রোর দিকে, ইয়ারোস্লাভ ইভানভিচ স্মেলভ তাঁর সকালের শিফটের আগে শেষ কাপ চা খেয়ে শেষ করলেন, আর লাল গেঞ্জি পরা আমাদের ব্যায়ামবীর তখনো পোড়ো জমিটায় ফ্রিহ্যান্ড কসরত করে চলেছে।
'সত্যি কী হল বরকার? নাকি স্কুলে লেট হবার ইচ্ছে ওর?' পকেট ঘড়িটার দিকে চাইলেন ইয়ারোস্লাভ ইভানভিচ, 'তিয়াপাকেও কাল থেকে দেখা যাচ্ছে না। কুকুরটার কথা একবার বরকাকে জিজ্ঞেস কোরো তো গিন্নি।'
আলনা থেকে টুপিটা নিয়ে স্পেলভ চলে গেলেন কারখানায়। বাপের পরিচিত মূর্তিটা মোড় নিতেই বরকা ছুটে এল বাড়িতে। চল্লিশ নম্বরের যে ফ্ল্যাটে থাকে তার বন্ধু গেনা কারাতভ, সেখান থেকে উকি দিলে না কেউ। এ দরজার ওপাশেও সেদিন সকালে যা শুরু হয়েছিল সেটা ঠিক দৈনন্দিনের মতো নয়।
সাংবাদিক আনাতোলি ইয়েভগেনিয়েভিচ কারাতভ সংবাদপত্রের দপ্তরে না গিয়ে সেদিন ঠিক করেছেন ছেলের সঙ্গে একটা সিরিয়স আলাপ করতে হবে। পিঠের দিকে হাত রেখে তিনি পায়চারি করছিলেন ঘরের মধ্যে। হাত মুখ ধুয়ে টেরি কেটে ছেলে তখন প্রাতরাশ খাচ্ছিল টেবলে বসে।
'এসব বাঁদরামি কবে বন্ধ হবে?' রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন আনাতোলি ইয়েভগেনিয়েভিচ, 'প্রথমে মামুলী একটা পটকা, তারপর হৈচৈ করে টিনের কৌটোর একটা হাউই ছাড়া হল আর শেষ পর্যন্ত ঐ বেচারা কুকুরটাকে পুরে ঐ সাঙ্ঘাতিক টিউব। জরিমানা দিয়ে দিয়ে যে আমি হয়রান হয়ে গেলাম!'
'সমস্ত মহান বৈজ্ঞানিককেই কিছু না কিছু আত্মত্যাগ করতে হয়,' শান্তস্বরে উত্তর দিলে ছেলে।
'প্রথমত তুই মহান নোস। আর দ্বিতীয়ত, আত্মত্যাগের কথাই যখন তুললি,' আনাতোলি ইয়েভগেনিয়েভিচ পায়চারি থামিয়ে সপ্রশ্ন চোখে তাকালেন ছেলের দিকে, ভরেছিলি?' 'টিউবটার মধ্যে কী
একটু ইতস্তত করলে গেনা।
'ইয়ে আরকি, সিনেমা ফিল্মের ছাঁট; আর মানে দুশ বাক্স দেশলাই; মানে এমনি সব জিনিস। গুপ্ত পদ্ধতি, জানোই তো উদ্ভাবকেরা তা সব ফাঁস করে না।'
'খুব গুপ্ত পদ্ধতি ফলাচ্ছিস যা হোক। কিন্তু জানিস যে তোর গুপ্ত পদ্ধতি বহুকাল থেকেই কাজে লাগিয়েছে লোকে? আর খুবই শোচনীয় ফল হয়েছে তার? চীনা মান্দারিন হাউইয়ে করে কী ভাবে আকাশে উড়েছিল শুনেছিস?'
'চীনা মান্দারিন, হাউইয়ে করে?'
খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল গেনার। ও জানত যে বারুদ, কম্পাস, কাগজের মতো হাউই-ও উদ্ভাবন করেছিল প্রাচীন চীনা জ্ঞানীগুণীরা। জিনিসটা আগুনে বর্শা গোছের বারুদভরা একটা নল উড়ে যেত শত্রুর দিকে।
কিন্তু হাউইয়ের ওপর সওয়ার হতে চেয়েছে এমন মান্দারিনের কথা সে কখনো শোনেনি।
'ভেবে দ্যাখ, চীন দেশে ছিল তেমন এক মান্দারিন বাং হু। বলতে গেলে তোর মতোই অনেকটা। সেও ভেবেছিল আতসবাজির হাউই দিয়ে আকাশে উড়বে। একটা বসবার জায়গা করলে বাং হ, তার সঙ্গে জুড়ে দিলে দুটো মস্ত ড্রাগন, যাতে আকাশে ভর দিতে পারে তাদের ওপর, তারপর এই উড়ন যন্ত্রটাতে ফিট করে দিল বহু হাউই।'
কিন্তু হাউইয়ের ওপর সওয়ার হতে চেয়েছে এমন মান্দারিনের কথা সে কখনো শোনেনি।
'ভেবে দ্যাখ, চীন দেশে ছিল তেমন এক মান্দারিন বাং হু। বলতে গেলে তোর মতোই অনেকটা। সেও ভেবেছিল আতসবাজির হাউই দিয়ে আকাশে উড়বে। একটা বসবার জায়গা করলে বাং হ, তার সঙ্গে জুড়ে দিলে দুটো মস্ত ড্রাগন, যাতে আকাশে ভর দিতে পারে তাদের ওপর, তারপর এই উড়ন যন্ত্রটাতে ফিট করে দিল বহু হাউই।'
'সাবাস বুদ্ধি!' উল্লাসে চেয়ারের ওপরেই লাফিয়ে উঠল গেনা।
'অত খুশি হবার কিছু নেই। এ কাহিনীর শেষটা বড়োই করুণ। বাং হু ভেবেছিল হাউইগুলো একের পর এক ফাটবে, কিন্তু ফাটল সবই একসঙ্গে, সাতচল্লিশটি হাউয়ের সব কটিই! প্রাণ গেল বাং হ-র। এই হল তোর আতসবাজির গুপ্ত পদ্ধতি।'
'তাহলেও সাহসী লোক কিন্তু বাবা!'
'আঃ, খুব হয়েছে থাম,' আনাতোলি ইয়েভগেনিয়েভিচ হতাশায় হাত নাড়লেন, 'তোর, সঙ্গে কথা বলা বৃথা। আজ থেকে,' দৃঢ় গলায় জানিয়ে দিলেন, 'বাথরুমে তোর রসায়ন ল্যাবরেটরি যেন আর দেখতে না হয়। রকেট সম্পর্কে ঐ বইগুলো সব তালাবন্ধ। খুব কড়া রুটিনে চলতে হবে। ভালো কথা, দেখি তোর প্রগ্রেস রিপোর্ট। দেখেছিস শরীরচর্চায় ফের দুই নম্বর মাত্র। জিজ্ঞেস করি কেন? একচল্লিশ নম্বর ফ্ল্যাটে তোর বন্ধুটি রোজ সকালে ব্যায়াম করে আর তুই কেন কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকিস? তোর বন্ধু দ্যাখ তো কেমন দড়ির মতো পাকানো, আর তুই ন্যাতার মতো নরম?'
'মানুষের পক্ষে সবচেয়ে বড়ো জিনিস তার বুদ্ধি,' খুব নিশ্চিত সুরে জানিয়ে দিয়ে গেনা তার প্লেটটা ঠেলে দিলে।
'খাসা! খাসা বলেছিস বটে... আর সিনেমা হলে কুকুর নিয়ে গিয়ে শো মাটি করার বুদ্ধিটা তোর ঐ বন্ধুর মাথায় কে ঢুকিয়েছিল শুনি, তুই না?'
'কিন্তু মহাজগতের পরিস্থিতির সঙ্গে পরীক্ষাধীন জন্তুর পরিচয় করিয়ে রাখা যে দরকার বাবা। দুর্ঘটনা ঘটবে কে জানত বলো। বেচারি তিয়াপা, বেশ ছ্যাঁকা খেয়েছে বোধ হয়।'
'বটেই তো: বিনা দোষে ভুগল কুকুরটা। আমি অবশ্য ভালো করে দেখতে পারিনি। বের করে আনতেই ছুটে পালাল। এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে গেছে।'
'না ফিরে আসেনি তো। কোথায় ছেড়ে দিয়েছিলে ওকে?'
'মানে তোর রকেটটা কোথায় পড়ে আছে জানতে চাস তো?' বাপ চোখ কোঁচকাল, 'ও চালাকিটা গেনা, খাটছে না। আর তাছাড়া তোর এখন স্কুলে যাবার সময় হয়ে গেছে।'
স্কুলে গিয়ে যখন হাজির হল বরকা আর গেনা, তখন ঘণ্টা বাজছে। খাতাপত্র, কান দাঁত, প্রগ্রেস রিপোর্ট ইত্যাদির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা পরীক্ষা করে দেখার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের কয়েকজনের ওপর এক একটা ভার। ৬ 'ক' নম্বর ক্লাসে মহাশৃঙ্খলা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সব অসংখ্য ভারপ্রাপ্তদের মধ্যে ল্যবকা কাজাকোভার ওপর স্বাস্থ্য দেখার ভার। সেই কেবল ওদের হাত পরীক্ষা করে দেখলে অখণ্ড মনোযোগে, যেন সেখানে কী এক সাংকেতিক লিপি লেখা আছে। অন্য ভারপ্রাপ্তেরা আগেই ডেস্কে গিয়ে বসেছে। ক্লাসের মনিটর ল্যেভকা পমেরানিচক কেবল কিল দেখালে এই দুটি লেট লতিফের দিকে।
সাহিত্যের শিক্ষিকা 'শরৎ' কবিতাটির যে পড়া দিয়েছিলেন সেটা নিয়ে কিন্তু জিজ্ঞেস করলেন না (কালকের পরীক্ষকদ্বয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচল), হুকুম দিলেন খাতা নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করতে; বিষয়: বন্ধুত্ব সম্বন্ধে কী পড়েছি।
বন্ধুত্ব সম্বন্ধে প্রত্যেকেই বলতে পারে অনেক। কাগজে কাগজে ফুটে উঠতে লাগল রঙচঙে নানা মূর্তি'। নীল লাইনটানা খাতায় কোথাও দেখা গেল ভেড়ার লোমের কালো আলখাল্লা পরা বীর চাপায়েভ, তার পেছনে কমিশার ক্লিচকভ, তার পেছনে বিশ্বস্ত এ্যডজ্যুটান্ট পেতকা। কোথাও ফুটল শত্রুর সম্মুখে তরুণ রক্ষীদের পতাকার নিচে নির্ভয় তরুণদলের সংহতি। কোথাও সমুদ্রে ধবধব করে উঠল জেলের ছেলে আর স্কুল ছাত্রের সেই অমল ধবল পাল। বেগুনী কালির ছিটের মধ্যে একটা খাতায় এমন কি কু'জো ঘোড়ার পিঠে বোকা ইভানের রূপকথাটাও বাদ গেল না।
আর শিক্ষিকা ছাত্রছাত্রীদের সারির মধ্যে ধীরে ধীরে পায়চারি করতে করতে ভাবছিলেন তাঁর ক্লাসের কথা। ভাবছিলেন, স্বভাবে একেবারে মিল নেই এমন ছেলেদের মধ্যে কী অটুট বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যেমন ঐ শেষের বেঞ্চির ছেলেদুটি। একজনের কলম চলছে তরতরিয়ে, লেখার ফাঁকে ফাঁকে হেসে এদিক ওদিক চাইছে, পাশের ছেলেকে গাঁতো দিচ্ছে। অন্য ছেলেটি ঘাড় গজে লিখে চলেছে ভুরু কু'চকে, প্রত্যেকটি শব্দ যেন ও মনের মধ্যে রসিয়ে নিচ্ছে।
"গেনা কারাতভ বেশ বুদ্ধিমান ছেলে,” শিক্ষিকা ভাবলেন, "ছেলেরা ওর নাম দিয়েছে উদ্ভাবক, অঙ্কের মাস্টার খুবই তারিফ করেন ওর। ছেলেটা যত ন্যাকামিই করুক, মাঝে মাঝে বিখ্যাত রুশ বৈজ্ঞানিক ৎসিওলকভস্কির অনুকরণে যখন ছেলেটা কানে না শোনার ভান করে তখনো সবই মাপ করে দেন তাকে।"
তাঁর কিন্তু বেশি ভালো লাগে চুপচাপ ঐ ছেলেটি বরকা স্পেলভকে। যদিও ও অবশ্য প্রায়ই তার আত্মবিশ্বাসী বন্ধুটির প্রাধান্য মেনে নেয়, তাহলেও তার এই সংযমের মধ্যে থেকে তার সবল একাগ্র স্বভাবের আভাস মেলে। শক্ত টানটান চটপটে ছেলেটি, দূরন্তপনায় সেও কম যায় না, কিন্তু চালাকি করে না, অন্য ছেলেদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজে লুকিয়ে থাকে না।
গেনা আর বরকাকে শিক্ষিকা ভালোই জানতেন, তবু তাদের রচনা পড়ে তাঁর অবাক লাগল। মার্ক টোয়েনের সেই বিখ্যাত গল্প হেকলবেরি ফিন আর টম সয়েরের বন্ধুত্বের বিষয়ে লিখেছে কারাতভ, তাদের স্বাবলম্বনের কথায় উচ্ছ্বসিত হয়েছে: "পারিবারিক অভিভাবকত্বে নিপীড়িত হয়েছে টম। অথচ পিসির কাছ থেকে টম যখন পালিয়ে গেল তখন তার আর বন্ধু হেকলবেরির জীবনে শুরু হল সব খাঁটি অ্যাডভেঞ্চার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হেকলবেরি ফিন আর টম সয়ের নিশ্চয় বিখ্যাত লোক হয়ে উঠেছে, নিশ্চয় কোনো বিখ্যাত পরিব্রাজক বা ইঞ্জিনিয়র। অবশ্য বড়োরা যেমন কাউকে কাউকে বাধা দেয়, তেমন বাধা যদি তারা না পেয়ে থাকে।” এই 'কাউকে কাউকে' কারা, সে কথা রচনায় লেখা ছিল না।
আর গোটা সাহিত্যের মধ্যে থেকে বরকা বেছে নিয়েছে তুর্গেনেভের লেখা বোবা দরোয়ান গারাসিম আর কুকুর মুমু-র মধ্যে মর্মস্পর্শী বন্ধুত্বের গল্পটা: "আমি হলে কর্তার কথা শুনতাম না, কুকুরটাকে জলে ডুবিয়ে দিতাম না," বরিস লিখেছে, "সাধারণত কুকুরকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।” এই বলে সে আচমকা শেষ করেছে তার রচনা।
শিক্ষিকার মনে এ সন্দেহই হয়নি যে এই লাইনটা লেখার সময় লেখক এক ক্ষুধার্ত কুকুরের কথাই ভাবছিল, শরতের ঠান্ডা স্যাঁৎসে'তে বনে যে এখন ঘুরে মরছে...
ক্লাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পোড়ো জমিটার শেষ প্রান্তের এই বনে দুই বন্ধু সোজাসুজি বইয়ের ব্যাগ হাতেই এসে হাজির হল। বনের ধারটা তারা তন্ন তন্ন করে খুজল কিন্তু রকেটের কোনো চিতুই নেই।
মুহূর্তে দুজনেই চমকে উঠল: খাদের মধ্যে কী যেন নড়াচড়া করছে। ছুটে গিয়ে দেখে... ল্যবকা। উবু হয়ে বসে সে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছে রকেটটার পোড়া দিকটায়।
'কী, হাত ময়লা কিনা দেখতে এসেছিস বুঝি এখানে,' খিঁচিয়ে উঠল গেনা, আর বরকার পিছু পিছু লাফিয়ে নামল খাদটায়।
'নেই এর মধ্যে!' ঠাট্টা গায়ে না মেখে বললে ল্যবকা, গাছের ঝোপ ধরে খাদটা থেকে উঠে এল। তিয়াপার নাম না করলেও বরকা তখুনি বুঝল কার কথা বলছিল ল্যবকা।
পাইপটা সত্যিই শূন্য। কিন্তু ঐ কালো টোলখাওয়া জিনিসটাই আকর্ষণ করল গেনাকে। খাদের তলায় বসে সে তখন হিসেব করছিল, পাইপটাকে ফের কাজে লাগানো যায় না কি। সেই মুহূর্তে চোখে পড়ল মাথার ওপরে ল্যবকার হলদে জুতো। গেনা লাফিয়ে উঠল:
'এখনো পালাসনি? ভাগ এখান থেকে। নইলে দেখেছিস?' কিল দেখালে গেনা।
'অতো ভয় দেখাচ্ছিস কীসের,' সগর্বে বেণী ঝাঁকিয়ে বললে ল্যবকা।
'তাড়াতাড়ি- জলদি!' জবরদস্ত হুকুম দিলে গেনা। (ল্যবকা পিছিয়ে গেল।) 'কাউকে যদি একটা কথাও বলিস তো ভালো হবে না বলছি,' কারাতভ চে'চাল তার উদ্দেশে।
বরকা ওদিকে বনের মধ্যে ছুটল তিয়াপার সন্ধানে। প্রতিটি গহ্বরের মধ্যে উ'কি দিলে সে, কাঁটাভরা ফার গাছের মধ্যে দিয়ে বেপরোয়া হেটে গেল, নাম ধরে ডাকলে, কান পেতে শুনলে ওই বুঝি সাড়া দেয় তিয়াপা...
একটা লম্বা বাদামী পাইন গাছের নিচে শাদা মতো কী একটা চোখে পড়ল বরকার, বুক ধক করে উঠল তার: ক্লান্ত হয়ে বেচারী কুকুরটা হয়ত বা শুয়ে আছে ওখানে। ছুটে গিয়ে সক্ষোভে পা দিয়ে খুঁচিয়ে দেখলে একটা দলামোচড়া খবরের কাগজ।
কোথায় একটা ইঞ্জিনের শিস শোনা গেল: ওর মনে হল বুঝি একটা কুকুর ডাকছে। আরো জোরে হইসিল দিল ইঞ্জিন; দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে বরকা: না, ও নয়।
একটা ঝোপের মধ্যে থেকে মস্ত একটা ছেয়ে রঙের কুকুর ছুটে এল বরকার দিকে। কিন্তু তার দিকে দুকপাত না করে একটা কাঠি কামড়ে ধরে নিঃশব্দে উধাও হয়ে গেল: কেউ হয়ত তার নিজের কুকুরটাকে ট্রেনিং দিচ্ছিল।
ছেলেটার ডাকে সারা বনের মধ্যে আর কেউ সাড়া দিল না। বড়ো কুকুরটা পর্যন্ত চুপ করে গেল। ইঞ্জিনটাও চলে গেল কোথায়।
হাত পা ছড়ে হতাশ হয়ে বরকা যখন বনের খোলা জায়গায় ফিরল, তখন দেখা গেল বন্ধু সেই খাদটার মধ্যেই মরচে ধরা পাইপটা নিয়ে বসে আছে।
'সে কী, তুই এখনো এখানে? তিয়াপাকে খাঁজছিস না যে বড়ো?' বিরক্ত হয়ে বললে বরকা।
'ধুত্তোর তিয়াপা, তিয়াপা!' হে'ড়ে গলায় ধমক দিল বন্ধু, 'এই দ্যাখ, ফুটোগুলো বন্ধ হয়ে গেছে কীসে। তারই জন্যে পড়ে গিয়েছিল রকেটটা। আর ঐটে,' অপসূয়মান ল্যবকার উদ্দেশে বললে সে, 'এবার রটিয়ে বেড়াবে। কী করে টের পেলে যা হোক। বয়েই গেল। সবচেয়ে বড়ো কথা পিছু হটা চলবে না। দাঁড়া, পাইপটাকে পরিষ্কার করে ফের ছাড়ব। কিছুতেই অ্যাকসিডেন্ট হবে না।'
'তুই তো আগেও বলেছিলি হবে না। তিয়াপাটার কেবল ধকল গেল। কোথায় যে গেল তাও জানি না...' 'বৈজ্ঞানিক পরীক্ষকদের চরিত্র হওয়া চাই লোহার মতো,' ওকে থামিয়ে দিলে গেনা, 'আর তুই কেবল কোন এক খে'কী কুকুরের কথা ভেবে মন খারাপ করছিস।' 'বটে!' ফাঁসে উঠল বরকা। 'খুব যে বৈজ্ঞানিক
দেখছি। থাক তুই বসে তোর ঐ খাদের মধ্যে। আমি আর
তোর অ্যাসিস্ট্যান্ট হচ্ছি না, তোর সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ
নেই আমার!'
বোঁ করে ঘুরে ও চলে গেল বনের মধ্যে।
'তোর ব্যাগটা ফেলে যাচ্ছিস!' খাদের মধ্যে থেকে চ্যাঁচাল গেনা।
বরকা ফিরেও চাইল না।
গেনাকে তাই ল্যবকার হাতে পায়েই ধরতে হল; বোঝাতে হল বন্ধুর ব্যাগটা যেন নিয়ে যায়। গর্বিত উদ্ভাবকের এই বিব্রত হতভম্ব ভাব দেখে ভারি অবাক লাগল তার। রাগ করার কথাও আর মনে রইল না।
বুঝদারের ভাব করে বললে, 'বেশ, নিয়ে যাব। কিন্তু মনে থাকে যেন, আমিও থাকব হাউই ছাড়ার সময়।'
নীরবে মাথা নাড়লে গেনা।
ব্যাগটা ল্যুবকা পৌঁছে দিলে সন্ধ্যায়। বেল টিপতেই বাড়ির সকলেই ছুটে গেল দোর খুলতে, ভেবেছিল তিয়াপা। কিন্তু তিয়াপা আর ফিরল না।