পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে

অলংকরণ: রেহনুমা প্রসূন

ইদানীং সবকিছু কেমন যেন অচেনা লাগে জোজোর। এমনটা নয় যে কোনটা বাথরুম আর কোনটা ড্রয়িংরুম, সেটা গুলিয়ে ফেলছে। তবে ওর মনে হয় সবকিছু কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। এমনকি ওর সহপাঠীরা, বন্ধুরা সবাই৷

এই যেমন সেদিন। সাধারণত ক্লাসে গিয়ে প্রতিদিন প্রিয় বন্ধু ফারশিদের পাশেই বসে ও। যে আগে যায়, সে অপরজনের জন্য সিট রেখে দেয়৷ কিন্তু ওই দিন জোজো জায়গা রেখে দেওয়ার পরও ফারশিদ এসে দিব্যি বসে পড়ল হামজার পাশে। একবার ঘুরেও তাকাল না ওর দিকে৷ মনের ভেতরকার জটিল সমীকরণ জোজো খুব একটা ভালো না বুঝলেও এ ঘটনায় মনটা যে ভীষণ খারাপ হয়ে গেল, তা ঠিকই বুঝতে পারল। কিন্তু তখনো অবাক হওয়ার ঢের বাকি। কিছুক্ষণ পর ফারশিদের জন্য রাখা সিটে এসে বসল নোমান। এমন ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগল ওর সঙ্গে যেন প্রতিদিন এমনটাই হয়ে আসছে। অথচ এই নোমানের সঙ্গে খেলার মাঠে কে আগে ব্যাট করবে, তা নিয়ে ঝগড়ার কারণে কথা হয় না দীর্ঘদিন। জোজোই অগত্যা উঠে গিয়ে অন্য জায়গায় বসেছিল। কিন্তু থেকে থেকে নোমান এমনভাবে তাকাচ্ছিল ওর দিকে যেন বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে সে।

এসব ভাবতে ভাবতেই স্কুলের উদ্দেশে হাঁটছিল জোজো। স্কুলটা ওর বড্ড পছন্দ। জলেশ্বরী পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, স্থাপিত ১৯৭৯ সালে। স্কুলের সামনে বিশাল মাঠ, একদিকে বড় পুকুর। বন্ধুদের সঙ্গে বিকেলবেলা এই মাঠেই ফুটবল খেলে জোজো। মেসি ওর প্রিয় খেলোয়াড়। গত বিশ্বকাপের সময় কে যেন স্কুলের দেয়ালে আর্জেন্টিনার পতাকা এঁকেছিল বড় করে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফিকে হয়ে এসেছে পতাকাটা, কিন্তু তাকালে বোঝা যায়। তবে বিশ্বকাপটা সেবারে জেতা হয়নি মেসির। রানার্সআপের মেডেল নেওয়ার সময় জুলুজুলু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কেবল কাপটার দিকে। মূলত সেই মুহূর্তেই জোজোর আর্জেন্টিনা দলটার প্রতি কেমন যেন ভালো লাগা শুরু করে। বাবার কাছে আবদার করে একটা ফুটবল জুটিয়ে নেয়, পরদিন থেকে নেমে পড়ে মাঠে। সেটা বছর দুয়েক আগের কথা।

বাড়ি থেকে স্কুল পর্যন্ত যেতে জোজোর সময় লাগে ১০ মিনিট। আজ কেন যেন পথটা দীর্ঘ মনে হচ্ছে। আরও মিনিট চারেক হাঁটার পর অবশেষে স্কুলে পৌঁছাল ও। বাঁ হাত দিয়ে কপালের ঘাম ঝেড়ে সামনে তাকাতেই থমকে গেল। ও কি চোখে ভুল দেখছে? নাকি ভুল জায়গায় এসে পড়েছে? এই গতকালও যেখানে বড় করে লেখা ছিল ‘জলেশ্বরী পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, স্থাপিত ১৯৭৯ ইং’, এখন সেখানে লেখা ‘হরিণমারা পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, স্থাপিত ১৯৬৭ ইং’। স্কুলের সামনের মাঠটা অবশ্য ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু পুকুরটা গেল কোথায়! রাতারাতি একটা পুকুর তো উধাও হয়ে যেতে পারে না। স্বপ্ন দেখছে না তো ও? বাহুতে একবার জোরে চিমটি কাটল জোজো। স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই ঘটছে এসব। উল্টো দিকে ঘুরে জোরে দৌড় দেবে, এমন সময় ওর নাম ধরে ডাক দিল কেউ।

‘অ্যাই জোজো, কোথায় যাচ্ছিস?’

ফারশিদের কণ্ঠটা চিনতে অসুবিধা হলো না। ঘর্মাক্ত শরীরে ওর দিকে দৌড়ে এল ছেলেটা। নির্ঘাত মাঠে ফুটবল খেলছিল এতক্ষণ। প্রতিদিন স্কুল শুরু হওয়ার আগে এমনটাই করে সে। জোজো বুঝতে পারল না, গত এক সপ্তাহ ওর সঙ্গে অমন ব্যবহারের পর আজ কেন সেই পরিচিত সুরে কথা বলছে ছেলেটা, যেন কোনো সমস্যাই হয়নি ওদের মধ্যে। ‘স্কুলে যাবি না? ওদিকে যাচ্ছিলি কেন?’ হাঁপাতে হাঁপাতে ওর পিঠে চাপড় মারল ফারশিদ। বিমূঢ় ভঙ্গিতে বন্ধুর পিছু নিল জোজো। একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে ওর মনে। অথচ এই ভাবনাটা জোর করে এত দিন দূরে ঠেলে রাখতে চেয়েছিল। ওর কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?

আরও পড়ুন

কিছুদিন পর বড় চাচার মতো সে-ও কি মাকে জিজ্ঞেস করবে যে বাইরে বরফ পড়ছে না কেন?

বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়িপেটা করছে জোজোর। ও যে পাগল হয়ে যাচ্ছে, এটা কাউকে বুঝতে দেওয়া চলবে না। নতুবা বগা-পাগলার মতো জায়গা হবে স্টেশনে। যেখানেই যাবে, পেছন পেছন ধাওয়া করবে বাউন্ডুলের দল।

স্কুলে ঢোকার সময় খেয়াল করল আর্জেন্টিনার পতাকাটাও জায়গামতো নেই। ওখানে এখন কালো, লাল আর হলুদ দাগটানা। পতাকাটা পরিচিত মনে হলেও এ মুহূর্তে দেশটার নাম মনে করতে পারল না জোজো।

ধারণাটা আরও বদ্ধমূল হলো ওর মনে। আসলেও কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কথা বলার মতো ওর যে কেউ নেই। স্কুলের কাউকে কিছু বলার তো প্রশ্নই আসে না। উল্টোপাল্টা কিছু বলে খ্যাপাতে শুরু করে দেবে নির্ঘাত। মাকে কী বলবে? কিছু বুঝে উঠতে পারছে না জোজো।

স্কুলে বাকিটা দিন স্বাভাবিকই গেল।

কিন্তু ওর জন্য আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল পরদিন। ওদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ছোট ছোট পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অনেকগুলো চা–বাগান। তাই সব সময় কেমন যেন চা–চা গন্ধ উড়ে বেড়ায় চারপাশে। স্কুলের যাওয়ার জন্য বের হয়ে পরিচিত পথটা ধরে কিছুটা এগোনোর পর হঠাৎই ওর মনে হলো কী যেন একটা নেই। কিছুক্ষণ খেয়াল করার পর বুঝতে পারল সেই পরিচিত ঘ্রাণটা নাকে আসছে না। পাহাড়গুলো যেদিকে, সেদিকে তাকাতেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। কোথায় পাহাড়, কোথায় কী? বিস্তীর্ণ মাঠ ওদিকে।

আশপাশে কোত্থেকে যেন খটখট একটা আওয়াজ ভেসেই আসছে অনবরত। দুই হাতে কান চেপে ধরে স্কুলের দিকে দৌড় দিল জোজো৷

আরও পড়ুন

******

জোজো এখন আর কিছুতে অবাক হয় না। স্কুল থেকে ফেরার পথে যখন পাহাড়গুলোকে আবারও আগের জায়গায় বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল, স্বাভাবিকভাবেই নিল সে ব্যাপারটা।

স্কুলে অবশ্য সবকিছু গতকালের মতোই আছে। কিন্তু ও বাদে অন্য কেউই নামের পরিবর্তন নিয়ে অতটা চিন্তিত নয়। এমনকি অত বড় একটা পুকুর রাতারাতি উধাও হয়ে যাওয়া নিয়েও কারও মাথাব্যথা নেই।

অর্থাৎ সমস্যাটা জোজোর নিজের।

শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে ফারশিদকে বলেছিল কথাটা, কিন্তু ওর দিকে এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিল, ছেলেটা যেন ভয় পাচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে কামড়ে দিতে পারে৷

পরদিন ওদের বাংলা শিক্ষক বদলে গেল।

এর পরদিন বদলে গেল বাবার গাড়ির রং।

তারপর তো বদলে গেল গোটা বাড়িই৷

একদিন ঘুম ভেঙে জোজো দেখে ওদের বাড়ির ধারে বিশাল এক নদী৷ কম করেও হলেও বিশটা নৌকা বাঁধা আছে ঘাটে৷

ইদানীং ও যা-ই করে না কেন, কেউ কিছু বলে না। সবাই কেমন যন্ত্রের মতো হয়ে গেছে। নির্বিকার। যেন সবকিছু অর্থহীন।

আরও পড়ুন

এসবের মধ্যে একটা জিনিসই কেবল ধ্রুব।

সেই খটখট শব্দ। একটানা হয়েই চলেছে। পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই৷

‘জোজো, খেয়ে নাও। ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?’ মা ডাক দিল এ সময়।

‘হ্যাঁ, মা। খা—’ বাক্যটা শেষ করতে পারল না জোজো৷ এটা কে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। পরনে ওর মায়ের শাড়ি, মায়ের স্যান্ডেল, চুল বাঁধার ধরনটাও একই, কিন্তু মানুষটা ভিন্ন।

‘না, না, না!’ বলে দৌড়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল জোজো। আর সবকিছু মেনে নিলেও এটা মেনে নিতে পারবে না কিছুতেই৷ তাই বলে কি ওর মা-ও বদলে যাবে?

কিন্তু বাড়ি থেকে একটু সামনে যেতেই থেমে গেল ও। আসলে থামতে বাধ্য হলো। কোথাও কিছু নেই যে। আক্ষরিক অর্থেই কোথাও কিছু নেই! চারদিক ধবধবে সাদা। শূন্য। যেখানে আকাশটা থাকার কথা, সেখানে খালি কাগজের মতো সাদা। যেখানে মাঠটা থাকার কথা সেখানেও খালি কাগজের মতো সাদা। তবে বাঁ পাশের গাছগুলো আছে এখনো।

না নেই!

না, না, আছে!

হচ্ছেটা কী?

গাছগুলো একবার উদয় হচ্ছে সামনে, আবার উধাও হয়ে যাচ্ছে পরক্ষণেই।

খটখট শব্দটা প্রবল হয়ে উঠল এ সময়।

একবার করে খট করে শব্দ হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে উধাও হয়ে যাচ্ছে গাছ।

এভাবে উধাও হয়ে গেল উড়তে থাকা ঘুঘু পাখিটা।

উধাও হয়ে গেল ঘুড়ি।

উধাও হয়ে গেল ওর ব্যাটটা।

বাড়ির দিকে ঘুরল জোজো। কোথায় বাড়ি? ওখানেও এখন শূন্য। ধবধবে সাদা। উধাও হয়ে গেছে ওদের বাড়িটা। মা, বাবা, কুট্টুস?

ঝাঁকড়া চুলের ছোট চাচার প্রিয় কবিতাটা মনে পড়ে গেল জোজোর।

‘পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার…’

শেষবার খট শব্দটা শোনার পর জোজোর চোখের সামনেও অন্ধকার ঘনাল।

আরও পড়ুন

******

‘কিরে, ও রকম মুখ লটকে বসে আছিস কেন? একটু আগে দেখলাম কি–বোর্ডের সঙ্গে যুদ্ধ করছিস।’

‘বাদ দে...’

‘খুলে বল আমাকে। কাজে আসতেও পারি।’

‘আরে একটা গল্প চেয়েছিল পত্রিকা থেকে। প্লটটাও গুছিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু ক্যারেক্টারটা দাঁড় করাতেই পারলাম না। অনেকভাবে চেষ্টা করলাম। অনেক কিছু বদলে দেখলাম।’

‘মুছে ফেলেছিস?’

‘হ্যাঁ।’

‘এক কাজ কর। বাইরে থেকে ঘুরে আয়। কড়া লিকারের চা খাবি এক কাপ। রাতে আবার বসিস।’

‘সেটাই করি তাহলে।’

‘জোজোর কাণ্ড’ লেখা ফাইলটা ডিলিট করে কম্পিউটারের সঙ্গে উঠে পড়ল নাবিল।