আহসান হাবীবের কিশোর উপন্যাস 'টেম্পার অ্যাকশন ক্লাব' (চতুর্থ পর্ব)

‘আপা, যাইবেন কই?’

‘আমাদের একটা ভালো হোটেলে নিয়ে চলেন।’

বেবি ট্যাক্সির লোকটা ভালো। সে সুন্দর একটা হোটেলের সামনে দাঁড় করায়। হোটেলের নাম ‘দ্য সাউদার্ন হোম’।

ভোরবেলায় পলিদের বাসটা একটা জায়গায় থামল। কন্ডাক্টর ঘোষণা দিল যে বাস এখানে আধা ঘণ্টা থামবে। সবাই চা, নাশতা, ভাত খেয়ে নিতে পারে। মোটামুটি সবাই নেমে পড়ল, পলি ছাড়া। ক্ষুধা তার একটু লেগেছে। কিন্তু কিছু খেলে টাকায় কম পড়ে যেতে পারে। তখন বাসের ভাড়া দিতে সমস্যা হতে পারে। কন্ডাক্টর সবার ভাড়া নিয়েছে, কিন্তু তারটা নেয়নি। বলেছে, ‘পরে দিয়ো, পরে দিয়ো...’ পরে নেওয়ার কারণটা ঠিক বুঝতে পারছে না পলি।

ফাঁকা বাসে হঠাৎ কন্ডাক্টর উঠে এল। পলির কাছে এসে বলল—

‘কি, নামবা না?’

‘না।’

‘নাশতা-পানি কিছু খাইবা না?’

‘না।’

‘খাইলে নামো।’

‘না।’

‘আরে নামো, আমি খাওয়ামু...’

লোকটা কেমন এক ভঙ্গিতে হাসে। ধক করে ওঠে পলির বুকটা। এবার পলি বুঝতে পারে, লোকটা তাকে নিয়ে কোনো একটা মতলব এঁটেছে। কিন্তু কী সে মতলব! লোকটা আরও এগিয়ে আসে। প্রায় ফিসফিস করে বলে, ‘ওই যে বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্টটা দেখছ না? ওইটা আমার চাচার হোটেল। ভালো খানা পাকায়। ওইখানে চইলা আসো, আমি নাশতা-পানি খিলামু তোমারে, টেকা লাগব না।’ বলে এক চোখ ছোট করে কেমন একটা ভঙ্গি করে।

‘আমাকে কেন আপনি খাওয়াবেন?’

‘আরে কী কও, বড়রা ছোটগো খাওয়ায় না?’

‘আচ্ছা, আপনি যান, আমি আসছি।’

‘জলদি আসো।’

পলি বুঝে ফেলে, এই বাসে তার পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব নয়। সে চট করে তার ব্যাগটা গুছিয়ে হাতে নিল এবং দ্রুত পেছনের দরজা দিয়ে নেমে পড়ল। দ্রুত রাস্তা পার হয়ে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়াল সে। দূর থেকে খেয়াল করল, কন্ডাক্টর লোকটা আবার বাসে উঠেছে। তাকে খুঁজছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। পলির বুকটা ধকধক করে, রাস্তার এপাশে এলেই তাকে দেখতে পাবে। আর তখনই দেখে, লোকটা রাস্তা পার হচ্ছে, মানে এ পারে আসছে। হায় হায়! এখন কী হবে! গাছের আড়ালে কতক্ষণ দাঁড়াবে সে? রাস্তা পার হয়ে লোকটা ঠিক গাছটার কাছে চলে এল। এখন তার থেকে লোকটার দূরত্ব পাঁচ-ছয় ফুট হবে। পলি গাছের গায়ে লেগে লেগে আরেকটু সরে এল, লোকটা যেন তাকে দেখতে না পায়। ঠিক তখনই একটা টেম্পো প্রায় গাছটা ঘেঁষেই দাঁড়াল। টেম্পোর পিচ্চি হেল্পার গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল, ‘ছাইড়া যায়, ছাইড়া যায়, কালিয়াকৈর, মেহেন্দীগঞ্জ, ট্যাপাপাড়া...একজন একজন।’

আরও পড়ুন

পলি দেরি করে না লাফ দিয়ে টেম্পোটায় উঠে পড়ে। মেহেন্দীগঞ্জ একদম তাদের বাড়ির কাছেই। একটামাত্র খালি সিট ছিল, সেটায় বসে পড়ল পলি। সঙ্গে সঙ্গে টেম্পোটা ভটভট করে ছেড়ে দিল। টেম্পোর ভেতর থেকে পলি দেখল, তখনো বাসের কন্ডাক্টর লোকটা ভ্রু কুঁচকে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। টেম্পোটার দিকেও তাকাল দুয়েকবার, তবে বুঝতে পারল না; ততক্ষণে অনেক দূর এগিয়ে গেছে ওদের টেম্পোটা।

‘পলি না?’ পলি তাকিয়ে দেখে, তাদের পাশের বাসার বদু চাচা তার উল্টো দিকে বসে আছে।

‘আরে বদু চাচা, আপনি?’

‘এইখানে বাজারে আসছিলাম। তুই কই থাইকা?’

‘আমি বাড়িতে যাই। বাসে যাচ্ছিলাম। বাস নষ্ট তাই।’

‘ভালো করছস।’

মুহূর্তেই মন থেকে ভয়ডর সব চলে গেল পলির। বাসের কন্ডাক্টরকে বেশ একটা শিক্ষা দেওয়া গেল। বাসের ভাড়াও দিতে হলো না। তার দোষ কী, সে তো দিতেই চেয়েছিল। কিন্তু লোকটা...কী সব শুরু করল।

আরও পড়ুন

পলি খেয়াল করল, টেম্পোর ভেতর বেশ আলোচনা হচ্ছে ওদের মেহেন্দীগঞ্জ নিয়ে। ওদের মেহেন্দীগঞ্জের একদল কিশোর চাঁদাবাজকে নাকি পুলিশ ধরেছে। এটা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। এদের অনেক আগেই ধরা দরকার ছিল...এরা সব কটা বদের বদ...কাউন্সিলরের প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে অনেক বার বেড়েছিল...শুনতে শুনতে ঘুম ধরে যায়, পলির দুচোখ বন্ধ হয়ে আসে, বাসে ভালো ঘুম হয়নি দুশ্চিন্তায়। এই সময় পিচ্চি হেল্পার চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মেহেন্দীগঞ্জ! মেহেন্দীগঞ্জ!’

পলি ভাড়া দিয়ে নেমে পড়ে তার রেক্সিনের ব্যাগটা নিয়ে। নামার সময় বদু চাচাকে দেখল না। উনি বোধ হয় আগেই নেমে গেছেন, কে জানে! আজ অবশ্য এখানে হাটবার, তাই আগেই হাটে নেমে গেছেন হয়তো। এখন এখান থেকে ডান দিকে কিছুদূর হাঁটলেই তাদের বাসা। মা কী ভাববেন তাকে হঠাৎ দেখলে? আর তখন কে যেন পেছন থেকে তার কাঁধটা চেপে ধরল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে, সেই বাসের কন্ডাক্টর! বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় পলির। লোকটার মুখটা হাসি হাসি।

‘বাসের ভাড়া না দিয়া কই যাও?’

ফাহাদ বেশ বুঝতে পারছে, সে ইংরেজি স্যারের ব্ল্যাকলিস্টে উঠে গেছে। তাকে নানাভাবে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছেন স্যার। এটা নিয়ে যে সে খুব চিন্তিত, তা অবশ্য বলা যাবে না। সত্যি কথা বলতে, ছোটখাটো বিপদ-আপদ মোকাবিলা করতে ফাহাদের ভালোই লাগে। সে তুলনায় ইংরেজি স্যারের বিপদ কোনো বিপদই নয়। মহিন্দ্র অবশ্য বলে—

‘স্যার তোকে কিন্তু ঝামেলায় ফেলবে দেখিস।’

‘কী রকম ঝামেলা?’

‘তা জানি না।’

‘আমার মনে হয়, স্যারের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা ফয়সালা করে ফেল।’ পাশ থেকে রনি বলে—

‘কী ফয়সালা?’

‘তা জানি না। চল আমরা সবাই মিলে যাই স্যারের কাছে।’

আরও পড়ুন

ফাহাদ অবশ্য এসব নিয়ে এত ভাবছে না। দেখা যাক না, স্যার শেষ পর্যন্ত কী করেন। ওরা গল্প করছিল মাঠের কোনায় বসে। আজ টিফিনের পর ছুটি হয়ে গেছে। তাই সবার হাতে চার পিরিয়ডের অফুরন্ত সময়। রনি বলল, ‘আমি যাই রে, বাসায় একটু কাজ আছে...বাবা আগে আগে যেতে বলেছে।’

‘যা।’

ওরা হাত নাড়ে। তখনই মহিন্দ্র গলা নামিয়ে ফিসফিস করে—

‘স্যারকে কাবু করার একটা ভালো বুদ্ধি আছে।’

‘কী বুদ্ধি?’

‘শোন বলি, আমার বাবার এক পার্টনারের নাম কবির চাচা, মানে আমি কবির চাচা বলে ডাকতাম। কবির চাচার ছেলেকে স্যার পড়াতেন। তো সেই সূত্রে চাচার সঙ্গে ভালোই সম্পর্ক ছিল স্যারের। স্যার একবার কবির চাচার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন। কিন্তু সেই টাকা আর ফেরত দিতে পারেননি। কবির চাচা কয়েকবার চেয়েছিলেন। কিন্তু স্যার এটা-সেটা বলে এড়িয়ে গেছেন।’

‘তারপর?’

‘তারপর কবির চাচা তাঁর ব্যবসা গুটিয়ে চাচি আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুইজারল্যান্ডে চলে গেছেন।’

‘ওই টাকা না নিয়ে?’

‘হ্যাঁ, ওনার অনেক টাকা। যখন বুঝতে পারলেন, ওই টাকা স্যার আর দিতে পারবেন না, তখন ওটার মায়া ছেড়েই চলে গেছেন।’

‘বুঝেছি, আর বলতে হবে না।’

‘কী বুঝেছিস?’

‘স্যার যখনই আমাকে আবার বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে, তখন আমি করুণ গলায় বলব, স্যার আমার কবির মামা সুইজারল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছেন। এখন ঢাকায় আছেন। আমি আপনার ছাত্র জেনে বলেছেন, আপনি ওই ৫০ হাজার টাকাটা দিতে পারবেন কি না।’

- ঠিক ঠিক! সত্যি তোর দারুণ বুদ্ধি! দুজনেই হো হো করে হেসে উঠল।

শিগগিরই স্যারকে বেকায়দায় ফেলার সুযোগ এসে গেল ফাহাদের হাতে।

দিনটা ছিল সোমবার। স্কুলের দপ্তরি আওলাদ ভাই এসে ফাহাদকে ডেকে নিয়ে গেল স্কুলের রেজিস্ট্রি অফিসে। কী ব্যাপার? ব্যাপার গুরুতর। সে প্রায় সব ক্লাসে অনুপস্থিত। এটা কীভাবে হলো? এখন তাকে জরিমানা দিতে হবে। নইলে সামনে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা দিতে পারবে না। কিন্তু সে তো রীতিমতো ক্লাস করেছে। সে সেটা বলল।

‘ক্লাস করলে অনুপস্থিত হয় ক্যামনে? তোমগো ক্লাস টিচার কে?’

‘বদরুল স্যার। ইংরেজি পড়ান।’

‘ও বুঝছি। স্যাররে খেপাইছ?’

‘না মানে...’

‘তাইলে তুমি শ্যাষ। স্যারের লগে দেখা করো জলদি...হেডস্যারে সাইন কইরা দিলে কইলাম আর হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা দিতে পারবা না।’

কী আর করা! ফাহাদ স্যারের রুমে গেল দেখা করতে। স্যার তার রুমে বসে পেপার পড়ছিলেন।

‘স্যার…’

‘কে?’

আরও পড়ুন

‘স্যার, আমি নাইনের ফাহাদ শরীফ।’

‘কী ব্যাপার?’

‘স্যার, আমার তো ক্লাস পার্সেন্টেজ নাই।’

‘ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে থাকব ক্যামনে?’

‘কিন্তু স্যার, আমি তো প্রতিদিনই আসছি।’

‘দেরি করে এলে আমার ক্লাসে অনুপস্থিত।’

‘কই দেরি করলাম, স্যার?’

‘আবার মুখে মুখে তর্ক! গেট আউট!’

কী আর করা। বাইরে চলে এল ফাহাদ। একটু পর দম নিয়ে ঢুকল আবার।

‘স্যার?’

‘আবার কী? বললাম তো, উপস্থিত হবে না। জরিমানা দিতে হবে।’

‘ঠিক আছে স্যার, জরিমানা দেব, অন্য একটা ব্যাপার।’

‘আবার কী ব্যাপার?’

‘স্যার, আমার কবির মামা সুইজারল্যান্ড থেকে ফিরেছেন। এখন ঢাকায় আছেন। আমি আপনার ছাত্র জেনে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে বলেছেন।’

ফাহাদ খেয়াল করল, মুহূর্তে স্যারের চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কোনোমতে বললেন—

‘ক..কী? কী জিজ্ঞেস করতে বলেছে?’

‘আপনি যে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন, সেটা এবার দিতে পারবেন কি না!’

ফাহাদ খেয়াল করল, স্যারের হাত থেকে পেপারটা মাটিতে পড়ে গেল। সেটা ওঠানোর চেষ্টাও করলেন না তিনি। কোনোমতে বললেন, ‘অ্যাঁ...ইয়ে ক-কবির তোমার মামা? আ-আমি ওনার সঙ্গে কথা বলব।’

‘ফোন নম্বর দেব, স্যার?’

‘না না, আমার কাছে আছে। তুমি যাও।’

ফাহাদ খেয়াল করল, স্যার তুই থেকে তুমিতে চলে এসেছেন। হঠাৎ স্যারের জন্য বেশ মায়া লাগল ফাহাদের। আহা বেচারা!

সেদিন বিকেলেই আরেকটা ঘটনা ঘটল। বেশ ভয়ংকর ঘটনাই বলা যায়। সেই টেম্পার অ্যাকশন ক্লাবের ছেলেরা তাদের স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। তার মানে এরা ছাড়া পেয়ে গেছে। এখন কী হবে? ওরা কি ফাহাদকে ধরার জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে ছিল?

‘এই হোটেলে আমরা কত দিন থাকব, আপু?’

‘তুই আশপাশে ছোট বাসাটাসা পাস কি না, খুঁজে দেখ।’

‘আচ্ছা আপু, আমরা তোমার বান্ধবীর বাসা থেকে চলে এলাম কেন?’

‘কেন, তুই শুনিসনি ওর বরটা ভেতরে গিয়ে কী বলল?’

‘শুনিনি তো।’

‘তাহলে আর শুনে কাজ নেই। ওর বর আমাদের হঠাৎ করে ওদের বাসায় যাওয়াটা পছন্দ করেনি। তাই ভাবলাম...বাদ দে। তুই খোঁজ লাগা, আশপাশে ছোটখাটো কোনো বাসাটাসা পাস কি না। আমিও চাকরি খুঁজব, মানে খোঁজা শুরু করেছি। কিছু একটা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।’

আপুর কথামতো রাফি একদিন বেরিয়ে পড়ে বাসার খোঁজে। এ গলি-ও গলি ঘুরতে থাকে। টু-লেট সাইনবোর্ড প্রতি মোড়েই আছে। এত এত টু-লেট দেখে একটা কৌতুক মনে পড়ে গেল ওর। ফিক করে হেসেও ফেলল একটু। গ্রামের এক লোক ঢাকা শহরে এসে দেখে বেশির ভাগ বাসায় টু-লেট সাইনবোর্ড ঝুলছে। তখন সে একজনকে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই, ঢাকা শহরের সব বাড়ি কি টু-লেট সাহেবের?...তিনি তো তাহলে অনেক বড়লোক।’

চলবে...

আরও পড়ুন