ঘরে বসে গল্পের বই পড়ছিল কিশোর, এই সময় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঢুকল মুসা ও রবিন।
‘এইমাত্র ওটাকে দেখে এলাম, কিশোর! সেই ভূতটাকে, রিচমন্ড কলেজে আস্তানা গেড়েছে যেটা!’ উত্তেজনায় গলা কাঁপছে মুসার। ‘দেখেই তোমাকে জানাতে ছুটে এলাম।’
‘মুসা তো দেখেই আরেকটু হলে চোখ উল্টে দিয়েছিল,’ রবিন যোগ করল। ‘দুজনে মিলে আলোচনা করে ছুটে এলাম তোমার কাছে, রহস্যটার সমাধান করার জন্য।’
মিট মিট করে জ্বলে উঠল কিশোরের চোখের কালো মণি। আগ্রহী ভঙ্গিতে বলল, ‘খুলে বলো সব।’
ঘটনাটা জানাল রবিন আর মুসা। স্টোনভিলের কাছে রিচমন্ড কলেজে একটা ড্যান্স পার্টি দেখতে গিয়েছিল ওরা। সঙ্গে ওদের আরও কয়েকজন বন্ধু ছিল। হঠাৎ ভূতটাকে চোখে পড়ে ওদের। কলেজের সীমানার বাইরে বনের কিনারে ধীরে ধীরে হেঁটে বেড়াচ্ছিল ওটা।
‘ধূসর একটা হুডওয়ালা আলখেল্লা পরে ছিল ভূতটা,’ মুসা জানাল। ‘একজন মহিলার ভূত। বেঁচে থাকতে নাকি ওই পোশাকটাই পরত ও।’
ভূতটা প্রফেসর লরা ওয়াইল্ডারের। একসময় রিচমন্ড কলেজে বিজ্ঞান পড়াতেন। পাঁচ বছর আগে, এক ঝড়ের রাতে, পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় গাড়ি নিয়ে খাদে পড়ে যান তিনি। পাথরের ওপর আছড়ে পড়ে তাঁর গাড়ি। দরজা খুলে গিয়ে গাড়ি থেকে ছিটকে পড়েন তিনি নিচের খরস্রোতা নদীতে। হারিয়ে যান। তাঁর লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যান। আর তার পর থেকেই তাঁর ভূতটাকে বনের কিনারে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।
‘মাঝে মাঝে নাকি রাতের বেলা কলেজের ল্যাবরেটরিতেও মোমের আলো জ্বলতে দেখা যায়,’ রবিন বলল। ‘ওই কলেজের দুজন ছাত্র দেখেছে এই ঘটনা, আমাকে বলেছে। বড়ই অদ্ভুত!’
পার্টি ফেলে চলে এসেছে মুসা আর রবিন। খবরটা জানিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ টেলিভিশনের সামনে বসে রইল কিশোর। কিন্তু মন বসাতে পারল না। মগজজুড়ে রয়েছে আজব ভূতের গল্প, যেটা এইমাত্র জানিয়ে গেছে ওর দুই বন্ধু।
অবশেষে আর থাকতে না পেরে ঘড়ি দেখল কিশোর, সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, পায়ের কাছে শুয়ে থাকা বুল টেরিয়ার কুকুরটাকে বলল, ‘এই টিটু, ওঠ, মাত্র এগারোটা বাজে। নিজের চোখেই দেখে আসিগে, ভূতটা এখনো আছে কি না।’
ইয়ার্ডের একটা গাড়ি নিয়ে টিটুকেসহ বেরিয়ে পড়ল কিশোর। রাত হয়েছে, তাই যানবাহনের ভিড় খুব কম। স্টোনভিলে পৌঁছতে সময় লাগল না। বনের কিনারের রাস্তা ধরে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাল। কিন্তু পরিষ্কার চাঁদের আলোয়ও ভূতটুত কোনো কিছুই চোখে পড়ল না।
‘নাহ্, টিটু,’ পাশের সিটে বসা কুকুরটাকে আলতো করে চাপড়ে দিয়ে কিশোর বলল, ‘ভাগ্য আজ আমাদের সহায় হলো না।’
খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, কিছুই না দেখে, কলেজের দিকে গাড়ি ঘোরাল ও। রিচমন্ড কলেজের সায়েন্স বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থামল। হঠাৎ করেই হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল ওর। দোতলার একটা জানালায় মৃদু, কাঁপা আলো দেখল বলে মনে হলো।
দ্রুত আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আস্তে আস্তে এগোল কিশোর। কোনো একজন গার্ডকে খুঁজছে। হঠাৎ একজন ইউনিফর্ম পরা গার্ডকে চোখে পড়ল।
জানালার আলো দেখিয়ে তাকে প্রশ্ন করতেই গার্ড জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ, ওটাই প্রফেসর ওয়াইল্ডারের ল্যাবরেটরি ছিল।’
গার্ডকে নিয়ে তাড়াতাড়ি দোতলায় উঠতে শুরু করল কিশোর। সিঁড়ি বেয়ে আগে আগে উত্তেজিত ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে যাচ্ছে টিটু। ল্যাবরেটরির দরজার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। তালা খুলল গার্ড। দরজার পাল্লা ঠেলে খুলল। ভেতরে গাঢ় অন্ধকার।
সুইচ টিপে আলো জ্বালল গার্ড। ওয়ার্ক বেঞ্চে রাখা কিছু টেস্ট টিউব আর গবেষণার অন্যান্য সরঞ্জাম। যেন কেউ কাজ করার জন্য তৈরি হচ্ছিল। অথচ কাউকে দেখা গেল না।
‘দেখে তো মনে হচ্ছে, এইমাত্র কেউ কাজ করতে এসেছিল!’ মাথা চুলকে বলল গার্ড। ‘কিন্তু ঢুকল কীভাবে? রাতের বেলা ল্যাবরেটরি তালা দেওয়া থাকে। কোনো ছাত্র বা প্রফেসর নাইট গার্ডকে না জানিয়ে ঢুকতে পারবে না।’
দরজার তালা পরীক্ষা করে কিশোর বলল, ‘এখানেও কোনো দাগটাগ নেই, জবরদস্তি করে তালা খোলার কোনো চিহ্নই নেই।’
পরদিন সকালে, নাশতার টেবিলে চাচাকে সব খুলে বলল কিশোর। ওর চাচা রাশেদ পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে পুরোনো মাল বেচাকেনার ব্যবসা করেন। পাশাপাশি শখের গোয়েন্দাগিরিও করেন। রহস্য সমাধান করতে ভালো লাগে তাঁর। এটা তাঁর অবসর সময়ের বিনোদন। বাতিল মালের ব্যবসাটার বেশির ভাগ দায়িত্ব তাঁর স্ত্রী মারিয়া পাশার ওপর থাকায় গোয়েন্দার কাজ করার সুযোগ পান তিনি।
কিশোরের মুখে সব শুনে বিস্মিত হলেন রাশেদ পাশা। ‘আশ্চর্য! একেবারেই তো কাকতালীয়। একটু আগে প্রফেসর লরা ওয়াইল্ডারের একটা কেস নিতে অনুরোধ করা হয়েছে আমাকে।’
রাশেদ পাশা জানান, মৃত্যুর আগে আগে ফ্লোরিয়াম পেনটোজ নামের একটা রাসায়নিক পদার্থ আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছিলেন প্রফেসর ওয়াইল্ডার। ‘দুর্লভ এক উদ্ভিদের মধ্যে পাওয়া যায় এই পদার্থ। ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে এই রাসায়নিক পদার্থ আবিষ্কারকে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কারই বলা যেতে পারে।’
একটা সায়েন্স ম্যাগাজিনে তাঁর এই আবিষ্কারের ব্যাপারে প্রবন্ধ লিখেছিলেন লরা। কিন্তু সে সময় এটা কোনো সাড়া ফেলতে পারেনি। ‘এখন, পাঁচ বছর পর,’ বললেন রাশেদ পাশা, ‘আমার এক পুরোনো মক্কেল, রিগবি ড্রাগ কোম্পানি, তাদের উৎপাদিত একটা ড্রাগে ফ্লোরিয়াম প্যানটোজ ব্যবহার করতে তৈরি হয়েছে। লরার সঙ্গে এ ব্যাপারে আগেই চুক্তি হয়েছে ওদের। লরার ফমুর্লা ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে তারা এই রাসায়নিক বানাতে চায়। প্যাটেন্টও করে ফেলেছে ওরা। কিন্তু কোন অনুঘটক বা ক্যাটালিস্ট ব্যবহার করতে হবে, সেটা লিখে রেখে যাননি প্রফেসর, অসমাপ্ত রয়ে গেছে। কিংবা ইচ্ছা করেই কিছু কিছু জায়গা মুছে রেখে দিয়েছেন। সমস্যাটা হলো, চুক্তি অনুযায়ী এর জন্য রয়্যালটি দিতে হবে কোম্পানিকে। দিতে কোনো আপত্তি নেই তাদের, কিন্তু কাকে দেবে? লরার কোনো বংশধরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই, যাকে এই রয়্যালটিটা দিতে পারে কোম্পানি। তা ছাড়া সত্যিই প্রফেসর ওয়াইল্ডারের মৃত্যু হয়েছে কি না, সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়নি এখনো।
‘কাল রাতে যা দেখেছিস, সেগুলো মূল্যবান তথ্য, তাতে কোনো সন্দেহ নেই,’ বললেন রাশেদ পাশা, ‘কিন্তু কোন অনুঘটক ব্যবহার করে রাসায়নিকটা বানানো হয়, সেটা জানা না গেলে এসব তথ্য কোনো কাজেই লাগবে না। আবিষ্কারটা যেহেতু করেছেন, কোথাও না কোথাও ক্যাটালিস্টের কথা অবশ্যই লিখে রেখে গেছেন তিনি। সেটা কোনো নোটবুকে হতে পারে, কিংবা কাগজে লিখে ফাইলে ভরে।’
অনেকক্ষণ কথা বলে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বুকটাকে হালকা করলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘ভাগ্য খারাপ, প্রফেসর ওয়াইল্ডারের লাশটাও পাওয়া যায়নি। তাতে বৈধভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, এই ঘোষণা করার বিষয়টাও জটিল হয়ে গেছে।’
‘তোমার কথা বুঝতে পারছি, চাচা,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। ‘তুমি কী চাও, তোমার এই রহস্য সমাধানে সাহাঘ্য করি আমি?’
হেসে, হাতের কফির কাপটা পিরিচে নামিয়ে রাখলেন তিনি। ‘তাহলে তো ভালোই হয়। জানিসই তো, অনেকগুলো মাল আনতে যেতে হবে আমাকে, আমি এখন ভীষণ ব্যস্ত। কেসটা আপাতত হাতে নেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তুই কাজটা নিলে খুশি হয়েই আমার মক্কেলকে হ্যাঁ বলে দিতে পারি। যদি এই রহস্যের সমাধান করতে পারিস, কিংবা জরুরি কোনো তথ্য জোগাড় করতে পারিস, সেটাও আমার জন্য মস্ত উপকার হবে।’
ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন মেরি চাচি। এতক্ষণ অফিসে ছিলেন। কাজের চাপ বেশি। তাই কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি এঁটো বাসন-পেয়ালাগুলো টেবিল থেকে সরিয়ে ফেলতে লাগলেন।
নিজের ঘরে চলে এল কিশোর। কাপড় পরে তৈরি হয়ে আবার বেরোল। গাড়ি নিয়ে রওনা হলো রিচমন্ড কলেজে। ওখানে পৌঁছে কলেজের সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান ডিন হ্যারল্ডের সঙ্গে দেখা করল। বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিলেন কিশোরকে তিনি।
সাদাসিধে, একজন অসুখী মহিলা ছিলেন লরা। ইগলের বাঁকা ঠোঁটের মতো নাক। মুখের একটা পাশ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল ছোটবেলার একটা দুর্ঘটনায়। বয়স যদিও মাত্র পঁয়ত্রিশ ছিল, আড়ালে কলেজের ছেলেমেয়েরা তাঁকে ‘বুড়ি ডাইনি’ বলে ডাকত।
‘আমার মনে হয়, এসব কারণেই কথাবার্তা খুব রুক্ষ ছিল লরার, কথায় কোনো রস ছিল না,’ ডিন জানালেন। ‘তবু আমরা তাঁকে ফ্যাকালটিতে রেখে দিয়েছিলাম। কারণ, খুব মেধাবী বিজ্ঞানী ছিলেন তিনি।’
জানালেন, লরার গবেষণার সব কাগজ আর ফাইল ল্যাবরেটরির একটা আলমারিতে রেখে দেওয়া হয়েছে।
‘কিন্তু ওগুলো আমরা রিগবি ড্রাগ কোম্পানির হাতে তুলে দিইনি,’ ডিন বললেন। ‘দিইনি, অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটা বড় কারণ, লরার মৃত্যুটা সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়নি। তাঁর কাগজগুলো আমিসহ আমাদের অনেক প্রফেসরই দেখেছেন, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে আসল জিনিসটারই উল্লেখ নেই—গবেষণার কাজে কোন অনুঘটকটা তিনি ব্যবহার করেছিলেন।’
‘নদীর খাঁড়িতে তাঁর লাশ খোঁজেনি পুলিশ?’ কিশোর জিগ্যেস করল।
‘খুঁজেছে, কিন্তু কোনো চিহ্নই পায়নি। প্রচণ্ড ঝড়ের রাত ছিল সেটা, নদী কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল, প্রবল স্রোত নিশ্চয় তাঁর দেহটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ভাটিতে।’
তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন বেঁচে আছে কি না, কলেজ জানে না।
‘কয়েক দিন আগে,’ ডিন বললেন, ‘টিনা হার্বার্ট নামের একটা মেয়ে এসে নিজেকে লরার বোনের মেয়ে দাবি করেছে।’
‘মেয়েটা কি এখনো এ শহরেই আছে?’
ভ্রুকুটি করলেন ডিন হ্যারল্ড। ‘মনে হয় আছে। আমার ধারণা, এখানকার কোনো হোটেলে উঠেছে। আমি মেয়েটাকে প্রফেসর জনসনের কাছে পাঠিয়েছিলাম। জনসন নিশ্চয় জানে, কোন হোটেলে উঠেছে টিনা।’ ডিন জানালেন, ফ্যাকাল্টিতে একমাত্র প্রফেসর রিড জনসনের সঙ্গেই কিছুটা খাতির ছিল লরার। একান্তে বসে আলাপ-আলোচনা করত। লরার কাগজপত্রের মধ্যে কোরি অ্যালেঙ্গার নামে এক মহিলার নাম উল্লেখ করা আছে, তবে কখনো ওই মহিলাকে লরার সঙ্গে দেখা করতে ফ্যাকাল্টিতে আসতে দেখা যায়নি