দরজা খোলা যাবে না
ফোনের রিং শুনে ঘুম ভেঙে গেল ন্যান্সির। একটানা বেজেই চলেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে অবাক হলো সে, ওর বন্ধু গ্যাব্রিয়েলের নম্বর। এত রাতে কেন ফোন করেছে ছেলেটা?
‘হ্যালো, গ্যাব?’
‘ন্যান্সি, তুমি ঠিক আছ তো? উত্তর দাও!’ কেমন যেন অস্থিরতা গ্যাব্রিয়েলের কণ্ঠে।
‘হ্যাঁ, বাড়িতেই আছি,’ অবাক হলো ন্যান্সি, ‘এত রাতে…’
‘ন্যান্সি, মন দিয়ে আমার কথা শোনো। বাড়ির সব দরজা বন্ধ রাখবে…জানালা…ওগুলোও…’
—কেন?
—যা বলছি শোনো, যদি বাড়ির আশপাশে আমার মতো হুবহু কাউকে দেখতে পাও, তবে ভুলেও দরজা খুলবে না!
—কী! তোমার মতো কাউকে মানে?
—মানে যদি আমাকে দেখ, তবে দরজা খুলবে না।
—কী ভুলভাল বকছ? মাথা ঠিক আছে তো? যা–ই হোক, তুমি কি এদিকে আসছ?
—যদি দরজা খোল, তবে কিন্তু ভালো হবে না।
—কী হয়েছে তোমার? পাগলটাগল হলে নাকি?
—এটা তোমার ভালোর জন্যই। তুমি কি বাড়িতে একা?
—হ্যাঁ, মা-বাবা দাওয়াতে গেছেন। তুমি কি এদিকে আসবে নাকি?
—না না, তাড়াতাড়ি সব দরজা-জানালা লাগাও, আর যদি বাড়ির আশপাশে আমাকে দেখ, তাহলে পুলিশকে ফোন করবে।
—গ্যাব্রিয়েল দেখো, মজা করার সময় থাকে…এই মধ্যরাতে এসব ভালো লাগছে না।
—আমি মজা করছি না ন্যান্সি!
—তুমি এখন কোথায়?
—জানি না, সম্ভবত পুরোনো কোনো বাড়িতে। এখানকার সব জানালার পাল্লায় পেরেক মারা, দরজাগুলোও বন্ধ।
—ওমা! ওখানে কী করে গেলে?
—ঠিক মনে নেই, সম্ভবত গত রাতে...
—সন্ধ্যার দিকেই না ফোনবুথ থেকে ফোন করলে আমাকে?
—হায় ঈশ্বর! ওটা তোমাকে ফোনও করেছিল! ন্যান্সি…দরজা খুলবে না!
—তোমার হয়েছেটা কী গ্যাব্রিয়েল?
—সেসব জেনে কাজ নেই, আর আমি নিজেও জানি না…দয়া করে দরজা খুলবে না!
—আচ্ছা, মজা করছ, তা–ই না? হেসে উঠল ন্যান্সি, ‘ওই তো, তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, বাড়ির সামনে উঠানে দাঁড়িয়ে, কানে ফোন...আমাদের বাড়ির সামনে এসে আমাকেই ফোন করেছ?
—হায় ঈশ্বর!
—এবার বলো, ওটা তুমি নও?
—না! ওটা আমি না!
—অনেক হয়েছে গ্যাব্রিয়েল, আমি নিচতলায় নামছি। রাতবিরাতে এত কাহিনি করার দরকার ছিল না। সাহস করে বললেই পারতে!
—ন্যান্সি...নাআআআ...দরজা খুলো না!
—হয়েছে হয়েছে, নিচতলায় এসে গেছি।
—ঈশ্বরের দোহাই ন্যান্সি, দরজা খুলো না...ওটা খুব ভয়ংকর!
—দরজা নক করা বন্ধ করো, আমি আসছি। বাপরে বাপ, এত ঢং পারো তুমি। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।
—দরজা খুলো না ন্যান্সি!
—তো কী করব? তুমিই তো দরজায় নক করে যাচ্ছ।
—ওটা আমি নই।
—জানালা দিয়ে তোমাকে দেখতে পাচ্ছি গ্যাব।
—ওটা আমি নই, অন্য কিছু!
—কী?
—আমি জানি না, আমি তোমার বাড়ি থেকে বহু দূরে।
—তুমি কোথায়?
—বললাম না? পুরোনো একটা বাড়িতে।
—দরজা থেকে সরে গেলে কেন?
—মানে?
—দরজা থেকে সরে গিয়ে বাগানে দাঁড়িয়েছ তুমি, ফোন তো দেখি হাতে...কানে নেই! তাহলে আমার সঙ্গে কে কথা বলছে?
—ওটা আমি নই! বলেছি তো!
—আশ্চর্য, দেখতে হুবহু তোমার মতোই। কিন্তু...
—ন্যান্সি, বিশ্বাস করো, ওটা আমি নই। ও আমার মতো দেখতে, কিন্তু আমি নই...
—আমার দিকে তাকিয়ে আছে...হ্যাঁ ওটা তুমি নও! চোখ দুটো টকটকে লাল! অন্ধকারে জ্বলছে।
—তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে পুলিশকে ফোন করো।
—ও নিচু হয়ে কী করছে? প...পাথর তুলছে...
—তাড়াতাড়ি ওপরে গিয়ে পুলিশকে ফোন করো। তোমার ঘরে গিয়ে দরজা লাগাও...তাড়াতাড়ি!
—ও মনে হয় জানালায় পাথর মারবে! আমি ওপরে যাচ্ছি।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপরই জানালার কাচ ভাঙার শব্দ পেল গ্যাব্রিয়েল।
—ন্যান্সি...ন্যান্সি....ঠিক আছ তো?
—ঘরে চলে এসেছি, দরজা লাগালাম, ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল ন্যান্সি।
—পুলিশকে ফোন করো।
—লাইনে থাকো, ল্যান্ডফোন থেকে ওদের ফোন করছি, আমার ভয় করছে...
—ন্যান্সি...সাহস হারিয়ো না!
আবার সব চুপচাপ।
—হ্যালো গ্যাব্রিয়েল? পুলিশ বলল ওরা তাড়াতাড়ি আসছে। ও...ওটা ওপরে উঠে আসছে...
—হে ঈশ্বর!
—দরজা অনেক শক্ত, অত সহজে ভাঙতে পারবে না, কিন্তু গ্যাব্রিয়েল এসব কী হচ্ছে? ওটা কী?
—একটু একটু মনে পড়ছে, কাল রাতে ঘরে বসে পড়ছিলাম। তখনই খেয়াল করলাম, বাগানে কিছু একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখলাম ওটাকে। ফ্যাকাশে, হলদেটে। ওটা মানুষ নয়...অন্য জগতের প্রাণী! ওটা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আর ধীরে ধীরে বদলে গেল ওটার মুখটা...আমার মুখের মতো হয়ে গেল!
—হায় ঈশ্বর!
—ওটা হাসছিল...এত ভয়ংকর হাসি আমি কখনো দেখিনি।
—গ্যাব্রিয়েল আমি জানি, তুমি সত্যি বলছ। ওটা ওপরে উঠে এসেছে। দরজা ঝাঁকাচ্ছে। আমাকে মেরে ফেলতে চায়। ও কী...আআআআ...
—ন্যান্সি...ন্যান্সি...কথা বলো, ন্যান্সি...হে ঈশ্বর...ওহ ন্যান্সি, কেঁদে ফেলল গ্যাব্রিয়েল।
কিন্তু ওপাশ থেকে আর কোনো উত্তর এল না। সব চুপচাপ।
***
পুলিশ এসে ন্যান্সিকে আর খুঁজে পেল না। নিচের একটা জানালার কাচ ভাঙা আর ন্যান্সির ঘরের দরজাটা একদম টুকরো হয়ে ছিল।
নিচতলায় একটা সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল। সেটার ফুটেজে দেখা গেল, ২৭-২৮ বছর বয়সী এক যুবক জানালা দিয়ে বাড়িতে ঢোকে আর কিছুক্ষণ পর সে ন্যান্সির অচেতন দেহটা নিয়ে বেরিয়ে যায়।
ন্যান্সির মা-বাবা ভিডিও দেখে তাদের মেয়ের বন্ধু গ্যাব্রিয়েল রোজালেসকে শনাক্ত করলেন।
কিন্তু পুলিশ পড়ল বিপদে, কারণ, গ্যাব্রিয়েল রোজালেস আরও এক দিন আগে থেকে নিখোঁজ। ওর চাচা-চাচি ইতিমধ্যেই থানায় রিপোর্ট করেছেন।
ছোট শহর কেস্টভিলে এমন উদ্ভট ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি!
***
নিজের শরীরের সব শক্তি একত্র করে দরজায় লাথি মারল গ্যাব্রিয়েল। টুকরো টুকরো হয়ে গেল সেটা, যেন শোলার তৈরি!
অবাক হলো সে। ওর গায়ে এত শক্তি এল কোথা থেকে?
ধীরে ধীরে বাইরে এল ও, মুঠোফোনের চার্জ বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। বাড়িটা জঙ্গলের মাঝখানে অবস্থিত। জঙ্গলটা চেনে গ্যাব্রিয়েল। ওদের শহরের পাশের জঙ্গল এটা, স্কুলে থাকতে বেশ কয়েকবার ক্যাম্পিং করেছে এখানে।
এগিয়ে চলল গ্যাব্রিয়েল। কেমন যেন অপার্থিব শক্তি এসে ভর করেছে ওর শরীরে। প্রায় পাঁচ মিনিট হাঁটার পর একটা খামারবাড়ি দেখতে পেল। উঠানে দাঁড়িয়ে কী যেন করছে এক মহিলা।
আকাশে মস্ত বড় চাঁদ।
‘এই যে শুনছেন? শহরের রাস্তা কোনটা?’ জিজ্ঞাসা করল সে।
ওর দিকে তাকিয়েই আতঙ্কে বিস্ফোরিত হয়ে উঠল মহিলার দুই চোখ।
‘হ…হ্যারল্ড…তাড়াতাড়ি বন্দুক নিয়ে এসো,’ চিৎকার করল সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্দুক নিয়ে খামার থেকে বেরিয়ে এল এক মধ্যবয়স্ক লোক। অবাক চোখে সে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল গ্যাব্রিয়েলের দিকে। তারপর গুলি চালিয়ে দিল।
অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সরে দাঁড়াল গ্যাব্রিয়েল, লাফিয়ে পড়ে লোকটার হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নিল। তারপর ছুড়ে ফেলে দিল। অনেক দূরে গিয়ে পড়ল সেটা।
ততক্ষণে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে ওরা দুজন। মহিলা চিৎকার করেই চলেছে।
ঠিক তখনই গ্যাব্রিয়েলের চোখ পড়ল মাটির দিকে। বহু পুরোনো একটা আয়না পড়ে আছে সেখানে। ওটার দিকে তাকাতেই সে বুঝতে পারল, কেন মহিলা আর লোকটা ভয় পেয়েছিল।
ওই অদ্ভুত প্রাণী গ্যাব্রিয়েলের শরীর দখল করেছে আর বিনিময়ে গ্যাব্রিয়েলকে দিয়ে গেছে তার শরীর।
***
‘আমি সত্যি বলছি অফিসার, বিরাট আকৃতির বাদুড়ের মতো একটা জন্তু! এক হাত দিয়ে তুলে ফেলেছিল আমাকে...তারপর জিজ্ঞাসা করছিল, গ্যাব্রিয়েল রোজালেস কোথায় আছে?’ ফুঁপিয়ে উঠল ট্রেসি।
—হুম, একদম মানুষের ভাষায় কথা বলছিল ওটা? হাসলেন অফিসার ট্রেভর।
—হ্যাঁ, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, তা–ই না?
—ব্যাপারটা অমন নয়। গত কয়েক মাসে ওই বনে অনেকেই এই প্রাণী দেখার কথা বলেছেন। কিন্তু কারও সঙ্গে ওটা কথা বলেনি… ও হ্যাঁ হ্যাঁ… শুরুর দিকে জঙ্গলের পাশের এক খামারমালিক আমাকে জানিয়েছিলেন যে জন্তুটা তার স্ত্রীর কাছে মানুষের ভাষায় শহরের রাস্তা জানতে চেয়েছিল। আপনি দিয়ে দুজন হলো, যার সঙ্গে ওটা কথা বলেছে। আপনি ক্যাম্পিং করতে গিয়েছিলেন, তা–ই না? আপনার বন্ধুরা কেউ ওটাকে দেখেছে?
—না, ওরা দূরে ছিল। ফোনের নেটওয়ার্ক খুঁজতে খুঁজতে আমি খানিকটা দূরেই এসেছিলাম। আচ্ছা, এই গ্যাব্রিয়েল রোজালেস সেই লোকটা না যে কয়েক মাস আগে নিজের বান্ধবীকে অপহরণ করে নিখোঁজ হয়েছিল?
—হ্যাঁ, এখনো ওদের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
—অদ্ভুত ব্যাপার! দানবটা ওকে কেন খুঁজছে?
—হুম, সেটাই ভাবার বিষয়, দেখি…শেরিফের সঙ্গে কথা বলে ওই বনে ক্যাম্পিং করা কয়েক মাসের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। আর শহরের মানুষকেও জানিয়ে দিতে হবে যেন রাতে সবাই দরজা-জানালা ভালোমতো বন্ধ করে ঘুমায়। গভীর রাতে কেউ নক করলে দরজা খোলা যাবে না…’