আচাভুয়ার বোম্বাচাক

কীর্তিমারী সদর থানার ইন্সপেক্টর রইসের রুমে ঢুকেই কামাল বুঝল, ঠিক সময়েই এসেছে। হোলস্টারে গোঁজা রিভলভার আর মাথার ক্যাপ ঠিক করতে করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে পরিপাটি গোঁফওয়ালা রাশভারী অফিসার রইস। বোঝাই যাচ্ছে, কোথাও যাওয়ার তোড়জোড় করছে সে। কামালকে দেখে রইস বলে উঠল, ‘ভালো করেছিস কামাল। এখনই কল দিতাম তোকে। একটা নতুন কেসে যাচ্ছি, চল। তোর কানে মনে হয় কিছু এসেছে ইতিমধ্যেই।’

একহারা গড়ন, এলোমেলো চুল আর তীক্ষ্ণ চাউনির কামাল পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে, কাজেই অনেক কিছুর ওপরে নজর রাখতে হয় তাকে, অনেক খবর জানতে হয়। এই মুহূর্তেই শহরের অন্তত আধডজন চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা বলতে পারবে ও, যেগুলোর খোঁজ সংবাদমাধ্যমও জানে না, সোশ্যাল মিডিয়াও না। এগুলোরই কোনো একটার তদন্তে যাচ্ছে রইস, সন্দেহ নেই। মুখে অবশ্য কিছু বলল না কামাল, কিছু জানতেও চাইল না বস রইসের কাছে। মাথা ওপর-নিচ করল একবার কেবল। ওর জানা আছে, দরকার হলে রইসই ওকে সময়মতো বলবে যা বলার।

পুলিশ ভ্যানে চড়ে থানা থেকে বেরোনোর পর ঠিক তা–ই করল রইস। ‘গোমস্তাপাড়ার শফিক চৌধুরীকে চিনিস তো?’

প্যাসেঞ্জার সিটে জড়োসড়ো হয়ে বসা কামাল ততক্ষণে বুঝে গেছে, আজকের কেস কোনটা। বলল, ‘জি স্যার, চিনি। সরকারি চাকরি করতেন, ৮–১০ বছর হলো রিটায়ার করছেন। ওনারা কীর্তিমারীর অনেক পুরানা খানদানি বংশ। গোমস্তাপাড়ায় ওনাদের বাড়িখান অনেক বড়, জমিদারবাড়ির মতন।’

‘উনি গতকাল সন্ধ্যা থেকে হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্তার আনিসের সঙ্গে কথা হলো একটু আগে। ওনারা সন্দেহ করছেন, পয়জনিংয়ের কেস। বিষ দেওয়া হয়েছিল শফিক সাহেবের খাবারে,’ রইস বলল। পুলিশ ভ্যান ততক্ষণে স্টেশন রোড ধরে ছুটতে শুরু করেছে কীর্তিমারী মেডিকেল কলেজের দিকে।

কামালের কাছে নতুন নয় এসব খবর। আবাসিক চিকিৎসক ডাক্তার আনিসের সঙ্গে অন্য রকম খাতির ওর। বেশ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি করার পরও শফিক সাহেব যে এখন বিপদমুক্ত আছেন, সেটা ইতিমধ্যে জেনে গেছে ও।

‘তোর কাছে এসব খবর যে চলে এসেছে, সন্দেহ নেই,’ গোঁফের তলে বিরল একটা মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল রইস। ‘বাকিটা নিজ চোখেই দেখব একটু পর। তবে নিশ্চিত থাক, খুব একটা সুখকর হবে না শফিক চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে মোলাকাতটা।’

ইন্সপেক্টর রইসের অনুমানে কোনো ভুল নেই। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তিনতলায় নির্দিষ্ট কেবিনে ঢোকার আগে শফিক সাহেবের বাজখাঁই কণ্ঠটাই এল ওদের কানে।

‘আমি বলছি, রায়হানই বিষ দিয়েছে আমাকে। কয়বার বলতে হবে তোমাদের...’ বিছানায় আধশোয়া হয়ে তুলকালাম কাণ্ড শুরু করেছেন শফিক সাহেব, আর সোফায় বসা দুজন ৩৫-৪০ বছরের ভদ্রলোক অস্বস্তির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করছেন নিজেদের মধ্যে। মাথার কাছে দাঁড়ানো ডাক্তার আনিস একটা মেডিকেল ফাইল দেখছে। বোঝাই যাচ্ছে, তার মতো ঠান্ডা মাথার যুবকও ধৈর্যের শেষ সীমায় চলে এসেছে। দরজা ঠেলে ইন্সপেক্টর রইস আর কামালকে ঢুকতে দেখে খানিকটা স্বস্তির ভাব ফুটল তার চেহারায়।

‘এই যে ইন্সপেক্টর, তোমরা এখনো ওই শয়তান রায়হানকে গ্রেপ্তার করোনি কেন বলো তো?’ রইসের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন শফিক সাহেব।

‘সবকিছুর একটা আইনি প্রক্রিয়া আছে, সাবেক আমলা হিসেবে আপনার সেটা ভালোই জানার কথা, স্যার,’ শান্ত কণ্ঠে বলল রইস। ‘রায়হান সাহেবকে থানায় রাখা হয়েছে কাল সন্ধ‌্যা থেকেই। অফিশিয়ালি গ্রেপ্তার করা হয়নি অবশ্য এখনো। আগে আপনার কাছ থেকে ঘটনার খুঁটিনাটি শুনতে এসেছি আমি।’

‘কী আর শুনবে খুঁটিনাটি! আমি মিথ্যা বলছি নাকি? ওই শয়তান রায়হান আমাকে চায়ের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে...,’ হুংকার ছাড়তে শুরু করলেন শফিক সাহেব।

‘এভাবে চেঁচাবেন না।’ গম্ভীর কণ্ঠে এবারে বলে উঠল ডাক্তার আনিস, ‘বিষের প্রভাব হয়তো কেটে যাচ্ছে, কিন্তু আপনার হাই প্রেশার আর ডায়াবেটিস এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন শফিক সাহেব, কিন্তু আর চেঁচালেন না। ঘরের সবাইকে খানিকটা স্বস্তি উপহার দিয়ে এবারে শুরু থেকে বলতে শুরু করলেন ঘটনাটা।

আরও পড়ুন

গুছিয়ে কথা বলতে জানেন শফিক সাহেব। পটভূমিটা বলে নিলেন তিনি আগেই। শফিক সাহেবের দাদার জমিদারি ছিল গ্রামে। কীর্তিমারী শহরের গোমস্তাপাড়ার বাসাটা তখনই করা, ব্রিটিশ আমলে। এ রকম পরিবারে যা হয় আরকি, বিষয়সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়েছিল শফিক সাহেবের বাবার আমলেই। জমিজিরাত নিয়ে তার বাবা আর ভাইদের ঝামেলা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে মামলায়-মামলায় জর্জরিত করছিলেন একে অপরকে। অথচ কীর্তিমারীর বাসায় একসঙ্গেই থাকতেন শফিক সাহেবের বাবা আর তার দুই ছোট ভাই। আলাদা খেতেন, কেউ কারও ছায়া মাড়াতেন না ভুলেও। উত্তরাধিকারসূত্রে সেই শত্রুতা পেয়েছেন শফিক সাহেব, চাচাতো ভাইদের সঙ্গ সাপে-নেউলে সম্পর্ক তার। কয়েকজন বিদেশে বা ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেশের অন্যখানে চলে গেলেও রয়ে গেছেন রিটায়ার করা দুই কাজিন—সাবেক আমলা শফিক সাহেব আর সাবেক প্রফেসর রায়হান সাহেব। আর রয়ে গেছে একে অন্যের বিরুদ্ধে করা বিষয়সম্পত্তিবিষয়ক গণ্ডাখানেক মামলা, বছরের পর বছর চলছে সেগুলো দেওয়ানি আদালতে।

‘বহুদিন পর সেদিন রায়হান দেখা করতে ডেকেছিল আমাকে,’ বলে চলেছেন শফিক সাহেব। ‘আমি থাকি বাসার একমাথায়, সে তার আজব জাদুঘর খুলে বসেছে বাসার আরেক মাথায়। বিয়েথা করেনি, সারা দিন কী সব হাবিজাবি পুরোনো জিনিস নিয়ে মেতে থাকে। তোমাদের, মানে আপনাদের না দেখালে বোঝাতে পারব না...।’

কেবিনের দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো কামাল সচরাচর যা করে, তা–ই করছিল, স্ক্রিন ফাটা সস্তা স্মার্টফোনটায় স্ক্রল করছিল কোনো একটা পিডিএফ বই। এবারে চোখ তুলে তাকিয়েছে সে, উত্তরবঙ্গের ভাষার টানে বলে উঠেছে, ‘আমি দেখছি, স্যার। উনি দুইখান ঘর নিয়া থাকে, দুইটাতেই অ্যান্টিক জিনিসপাতি দিয়া ভর্তি। চীন, মোগল, রোমান, আরব...সব রকম দেশের আছে, কোনোখানই ৩০০-৪০০ বছরের কম পুরোনো না। বেশির ভাগই অনেক দামি।’

‘বিয়েথা করেনি, চাকরির বেতন আর বই বিক্রির টাকা দিয়ে এগুলোই করেছে সারা জীবন,’ মুখ বাঁকিয়ে বললেন শফিক সাহেব। ‘যাহোক, ওই জিনিসের ভাগাড়ের ভেতর একটা আদ্যিকালের টেবিলে বসলাম কোনোমতে। ব্যাটা কী বলতে চায়, শুনতে ইচ্ছা হচ্ছিল। আমাকে ডেকে এনেছিল এই বলে যে, মামলাগুলো মিটিয়ে ফেলতে চায়। বিশ্বাস করা কঠিন, তবু দেখলাম সে লাইনেই কথাবার্তা শুরু করল রায়হান। “৫০ বছর আগের শত্রুতা জিইয়ে রেখে লাভ নেই, চলো সব ভুলে যাই,” কত রকম বয়ান! আজ কার মুখ দেখে উঠেছি, ভাবতে শুরু করেছিলাম। তখন রায়হান, চশমাপরা বুড়ো শয়তান বলে কী, “চা খাও একটু।” আমিও তেমন কিছু না ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। তখন কি আর জানি, কী সর্বনাশা ফাঁদে পা দিতে চলেছি আমি!

আরও পড়ুন

‘আদ্যিকালের দুটি চিনামাটির কাপ বের করল রায়হান। সে রকমই পুরোনো একটা কারুকাজ করা কেটলি থেকে চা ঢেলে দিল। সাদার ওপরে নীল কাজ করা কেটলি, মনে আছে। দুধ লাগবে কি না, জিজ্ঞেস করল। মানা করে দিলাম। রং–চা খাচ্ছি ওর হাত থেকে, তাতেই মনটা কুডাক ডাকছিল, দুধ মেশানোর সুযোগ ওকে দিতে চাইনি। একই কেটলি থেকে চা ঢালল দুটি কাপে, তাতেই একটু ভরসা পেয়েছিলাম।

‘চায়ে চুমুক দিতে দিতে আবার গল্প শুরু করল রায়হান। খেয়াল করলাম, একটু বদলে গেছে ওর হাবভাব। বলতে শুরু করল, ছোটবেলায় খুব নাকি জ্বালিয়েছি ওকে। সারাটা জীবন নাকি নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে চেয়েছে সে, পড়াশোনা আর গবেষণায় মেতে থাকতে চেয়েছে, আর আমি নাকি মামলা করে আর আমার সরকারি ক্ষমতা খাটিয়ে তার জীবনটা নরক বানিয়ে ছেড়েছি, এসব হচ্ছে তার নতুন আলোচনার বিষয়। আমি তো হতভম্ব। হাঁ করে শুনছি। একটু পরই টের পেলাম, বুকের ভেতরটা জ্বলতে শুরু করেছে আমার। প্রথমে ভাবলাম, রায়হানের ভোল পাল্টানো দেখে এমনটা লাগছে বোধ হয়। তারপর পুরো দুনিয়াটা ঝাপসা হতে শুরু করায় বুঝলাম আসল কাণ্ড। আমাকে বিষ খাইয়েছে রায়হান!’

নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে ঘরের ভেতর। চুপ করে শুনছে সবাই শফিক সাহেবের কথা। ৩৫-৪০ বছর বয়সী দুই ভদ্রলোক এমনিতেই আড়ষ্ট হয়ে বসে ছিলেন সোফায়, এবার তাদেরকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিয়ে শফিক সাহেব বলতে শুরু করলেন, ‘তোমরা তো বিশ্বাসই করতে চাইছিলে না, তোমাদের আলাভোলা জ্ঞানতাপস চাচা এমনটা করতে পারে। এবার শুনলে তো।’

‘রায়হান সাহেব কি হাতত কোনো আংটি পরেন?’

ঘরের সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল দরজার দিকে। ওখানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কামাল। রইস খেয়াল করল, জ্বলজ্বল করছে কামালের ক্ষুরধার চোখ দুটি।

‘কে হে তুমি ছোকরা?’ গমগমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন শফিক সাহেব।

‘কামাল। মানুষ কয় টিকটিকি কামাল, পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করি তো। এখন বলেন স্যার, রায়হান সাহেব কি হাতত আংটি পরেন?’ কামাল বলল।

রইস মুখ খুলেছে কিছু একটা বলে শফিক সাহেবের মেজাজ ঠান্ডা করার জন্য, কিন্তু তার দরকার হলো না। শফিক সাহেব উত্তর দিলেন, ‘না। হাতে কোনো আংটি পরে না। আর কিছু জানতে চাও, টিকটিকি কামাল?

‘আপনাকে যে কাপত করিয়া খাইতে দিছিল, সেটায় কি আগে থাকিয়াই কিছু ছিল, স্যার? হইতে পারে যে বিষ আগে থাকিয়াই রাখা ছিল।’ কামালের কণ্ঠ বিনয়ী, কিন্তু দৃঢ়।

‘কাপগুলো একটা তাকে উল্টো করে রাখা ছিল,’ শফিক সাহেব বললেন। ‘আর কাপ দুটি যখন সামনে এনে রেখেছিল, তখন আমি একটা কাপ হাতে তুলে নিয়েছিলাম, ডিজাইন দেখার জন্য। সেই কাপটাই এগিয়ে দিই চা ঢালার জন্য। যদি শুকনা কোনো বিষ আগে থেকে লাগিয়ে রেখেও থাকে, তাহলে তো ওর নিজেরও বিপদ ছিল। কারণ, কোন কাপটা আমি এগিয়ে দেব, সেটা তো জানত না সে।’ কামাল কী বলতে চাইছে, সেটা আঁচ করে ফেলেছেন শফিক সাহেব।

‘যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে,’ এবারে নিজের কর্তৃত্ব খাটাল ডাক্তার আনিস। ‘রোগী এখন বিশ্রাম নেবেন। আপনারা সবাই আসুন।’

***

থানায় জিজ্ঞাসাবাদের ঘরে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা রায়হান সাহেবকে দেখে বিশ্বাস করা কঠিন, পরিপাটি করে রুপালি চুল আঁচড়ানো সাবেক প্রফেসর এই ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে কাউকে বিষ খাওয়ানোর অভিযোগ থাকতে পারে। সত্যি বলতে কি, ভদ্রলোকের অসহায় চেহারা দেখে একটু খারাপই লাগলে ইন্সপেক্টর রইসের। যদিও এর মধ্যেই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের অনেকটা সেরে নিয়েছে সে।

‘আবারও বলছি, স্যার, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। কিন্তু আপনি যদি সত্যিটা আমাকে খুলে বলেন, তাহলে হয়তো ব্যাপারটা খারাপের দিকে না নিয়েই সমাধান করতে পারি আমরা। শফিক সাহেবের ছেলেরা মামলা করতে চান না।’ নরম কণ্ঠে বলছে রইস।

‘বিশ্বাস করুন, আমি কিছুই জানি না,’ কাঁপা কণ্ঠে বললেন রায়হান সাহেব। ‘আমরা চা খেতে খেতে গল্প করছি, হুট করে বুক চেপে ধরে পড়ে গেল শফিক। ওর তো হার্টের অসুখ আছে, হয়তো সেটারই কারণে অমনটা হয়েছে। ওর তো আবার রাগ বেশি।’

‘কীর্তিমারী মেডিকেল কলেজের নতুন ডায়াগনোস্টিক ল্যাবটা কিন্তু দারুণ, স্যার। শফিক সাহেবের শরীরে বিষের অস্তিত্ব পেতে সময় লাগেনি ওদের,’ রইস সরাসরি রায়হান সাহেবের চশমা-ঢাকা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল। ‘ওনাকে বিষ দিয়েছে কেউ, সেটা পরিষ্কার। সংগত কারণেই আপনি সন্দেহের তালিকায় প্রথম।’

আরও পড়ুন

‘তাহলে আমার কিছু হলো না কেন?’ এক সেকেন্ডের জন্য জ্বলে উঠেই আবার কাঁচুমাচু হয়ে গেল রায়হান সাহেবের চোখ। অবশ্য সেটা রইসের দেখার ভুলও হতে পারে। ‘একই কেটলি থেকে চা ঢেলেছি আমি। শফিক নিশ্চয়ই বলেছে আপনাকে।’

রইস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আসলেই তো, একই কেটলি থেকে ঢালা চায়ে একজন বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলো, আর আরেকজন দিব্যি সুস্থ। এটা কীভাবে সম্ভব? পুরো কেসের সবচেয়ে ঘোরালো ব্যাপার এটাই। ‘আমরা সেটাই বের করার চেষ্টা করছি, রায়হান সাহেব।’

‘আপনারা তো অলরেডি সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে ফেলেছেন, তা–ই না?’ রায়হান সাহেব যেন অন্যমনস্কভাবে বললেন। ‘দেখেন, আমার ঘর সার্চ করে—কেটলিটা এখনো বসার ঘরের টেবিলের ওপরই আছে—দেখুন, কিছু পান কি না।’

জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল কামাল। রইসের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল সে। সন্দেহ নেই, ইন্টারোগেশনের খুঁটিনাটি শোনার জন্য তর সইছে না ওর।

‘চল, রায়হান সাহেবের ঘর তল্লাশি করব এখন। যেতে যেতে সব বলছি তোকে। তবে ওই ব্যাপারই মন থেকে তাড়াতে পারছি না, চা তো একই কেটলি থেকে ঢালা হয়েছিল, দুজনই একই কথা বলছেন।’

‘আচাভুয়ার বোম্বাচাক।’ আনমনে বলল কামাল।

‘কী বললি?’ ভুরু কুঁচকে গেছে রইসের।

কামাল থতমত খেয়ে বলল, ‘একটা বাংলা বাগধারা, স্যার। কিছু মনে করিয়েন না।’

হাঁটতে শুরু করে একমুহূর্ত কী ভেবে যোগ করল রইস, ‘তবে হ্যাঁ, লোকটা দেখতে যেমন আলাভোলা, বাস্তবে বোধ হয় তেমন না।’

‘মানুষ চেনা দায়, স্যার,’ নিচু কণ্ঠে বলল কামাল।

***

শফিক সাহেব ভুল বলেননি। রায়হান সাহেবের বসার ঘরটা আসলেই একটা জাদুঘরের মতো। ঘরের চারপাশে তাক আর টেবিল, সেগুলো ভর্তি দুনিয়ার সব দেশের সব যুগের প্রত্নতত্ত্ব দিয়ে। গ্রিক ছাইদানি থেকে শুরু করে মাসাই মুখোশ, ভাইকিং তির থেকে শুরু করে মঙ্গোল তলোয়ার...কী নেই! আর আছে গাদা গাদা বই।

রইসের মনোযোগ অবশ্য শুধু ঘরের এক কোণের চা খাওয়ার ছোট টেবিলটার ওপরই স্থির। দুটি তাকের পাশে কোনোমতে জায়গা হয়েছে ওটার। চায়ের হাতলওয়ালা চিনামাটির কেটলি আর কাপ দুটি ছাড়াও আরো হাবিজাবি অনেক কিছুই আছে টেবিলটার ওপর। সেটার দিকে এগিয়ে গেল সে। কামাল রয়েছে ঠিক পেছনেই।

‘স্যার, এমন হইতে পারে না যে কেটলিটা বদলায় রাখছে রায়হান সাহেব? হয়তো এইটা পরীক্ষা করলে কোনো বিষ পাওয়া যাবার নয় ভিতরোত।’ কামাল বলল।

‘সম্ভাবনা কম। শফিক সাহেবকে তো দেখলিই, কেমন মানুষ। বিষের জ্বালা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চেঁচাতে শুরু করেন গলা ফাটিয়ে। শুক্রবার, তাই ওনার ছেলেরা বাড়িতেই ছিলেন। ছুটে আসেন ওনারা। রায়হান সাহেব এর পর থেকে মানুষের চোখে চোখেই ছিলেন। হয়তো মিনিটখানেক ফুরসত পেয়েছেন, কিন্তু তাতেও–বা কী আসে যায়?’ হাতে একটা রাবারের গ্লাভস পরতে পরতে বলল রইস। ‘একই কেটলির চা রায়হান সাহেবও খেয়েছেন। তার কিছু হয়নি।’

‘সেই জন্যই জিজ্ঞাস করছিলাম, রায়হান সাহেব আংটি পরেন কি না। অনেক আংটি আছে, তার মধ্যে বিষ লুকায়ে রাখা যায়। যদি তেমন বিষ হয়, এক ফোঁটা দিলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু উনি তো আংটি পরেন না।’ কামাল বলল।

আরও পড়ুন

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে কেটলির ঢাকনাটা তুলল রইস গ্লাভস পরা হাতে। কেটলির ভেতরে এখনো খানিকটা রং–চা দেখা যাচ্ছে। কামাল ঝুঁকে পড়ে কাছ থেকে দেখল কেটলির ভেতরটা। চোখ আবার জ্বলজ্বল করতে শুরু করেছে ওর।

‘ফরেনসিক ল্যাবের লোকজন চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই,’ রইস বলল।

‘ওনারা কিছু পাবার নয় এখানে, স্যার।’ কামাল বলল। ‘এই যে শফিক সাহেবের কাপটা, সেটায় বিষ পাইতে পারে। কিন্তু কেটলিতে কিছু পাবার নয়।’

‘কী উল্টোপাল্টা বলছিস, কামাল? এটা কীভাবে সম্ভব?’ রইস বিরক্ত হতে শুরু করেছে।

‘কেটলিটা খেয়াল করেন স্যার।’ কামাল যেন খেয়ালই করেনি রইসের বাড়তে থাকা অসহিষ্ণুতা।

‘করলাম। সাদা চিনামাটির কেটলি, নীল কাজ করা। কয়েক শ বছরের পুরোনো। আর কিছু?’ ভুরু কুঁচকে গেছে রইসের।

‘স্যার, এই কেটলি থাকিয়া চা ঢালে নাই রায়হান সাহেব।’ বলতে বলতে নিজেই একটা রাবারের গ্লাভস পরছে কামাল। কিন্তু টেবিলের ওপরের চায়ের কেটলিটার দিকে নয়, ওর হাত গেল টেবিলের পাশের তাকটার দিকে। গাদা করে রাখা প্রত্নতত্ত্ব সরাচ্ছে ও। খুঁজছে কী যেন।

‘কামাল, কী করছিস,’ রইস বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু তার আগেই একটা মালয়েশিয়ান বাঁশের ঝুড়ির ঢাকনা খুলে চেঁচিয়ে উঠেছে সে, ‘পাইছি, স্যার!’

রইসের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে একটা চিনামাটির হাতলওয়ালা কেটলি বের করে আনল কামাল। টেবিলের ওপর রাখা কেটলিটার মতো দেখতে, হুবহু।

‘দেখেন, স্যার।’ বলে লুকানো কেটলিটার ঢাকনা সরানোর চেষ্টা করল কামাল। অদ্ভুত ব‌্যাপার, ঢাকনাটা সরছে না। ঢাকনার মতো একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা আসলে পাত্রের সঙ্গে লাগানো।

‘স্যার, এই কেটলিটার নাম অ্যাসা...অ্যাসাসিনস টি–পট,’ বলল কামাল। ‘বইতে পড়ছি, আজ প্রথম দেখলাম। বহুত পুরানা কৌশল, কিন্তু খুব কাজের। এই একটা পাত্র থেকে ইচ্ছেমতো দুইটা তরল ঢালা যায়। এটার ভেতর দুইখান ঘর আছে, দুই রকম তরল ঢোকানো যায় তাতে। এই যে দেখেন স্যার,’ হাতলের কাছ একটা ছোট ফুটো দেখাল কামাল। আরেকটা ফুটো হাতলের নিচের দিকে। ‘এই দুইটা দিয়া তরল ঢুকানো যায় ভেতরে। দুই ঘর থাকিয়া দুইটা নল আলাদাভাবে বের হইছে কেটলির মুখ দিয়া ‘ আসলেই তা–ই, কেটলির মুখটা দেখলে একটা নলের মতো হলেও কাছ থেকে দেখলে বোঝা যাচ্ছে পাশাপাশি দুটি নল আছে সেখানে। ‘তারপর, যে ঘরের ফুটাটা আঙুল দিয়া চাপি ধরবেন, কেটলি কাত করলে কেটলির মুখ দিয়া সেই তরল পড়বে না। বাতাসের চাপে আটকি থাকবে। অন্য ঘরটার মাঝে বাতাসের চাপের বাধা নাই, সেই জন্য ওটা পড়বে। আবার যখন চাইবেন এই তরলটা না, অন্যটা পড়ুক, তখন এই ফুটা থেকে আঙুল সরায়ে অন্য ফুটায় রাখবেন।’

‘আর খুব ভালো করে না দেখলে বোঝাই যাবে না যে কেটলিতে দুটি ফুটো আছে, তার তাতে আঙুল রেখে চা ঢালছে খুনি।’ রইসের গোঁফের নিচে একটা বিরল হাসি ফুটল। ‘শাবাশ, কামাল। কোনো সন্দেহ নেই, ফরেনসিকের বিশেষজ্ঞরা এই কেটলির দুই প্রকোষ্ঠের দুই রকম চা পরীক্ষা করে একটাতে পাবে বিষ, আরেকটাতে পাবে নিরীহ রং–চা!’

‘চিনি ছাড়া রং–চা, স্যার,’ কামাল লাজুক হেসে বলল। ‘শফিক সাহেবের ডায়াবেটিস থাকলেও চিনির খুব ভক্ত উনি, সবাই কইল। চিনি না দেওয়া চা মুখেই তোলেন না! রায়হান সাহেবের দেওয়া চায়ে এক চুমুক দিয়া উনি এইটা বুঝেন নাই যে বিষ দেওয়া আছে কি না, কিন্তু চিনি যে নাই, সেটা পরিষ্কার টের পাইছেন। আর এক চুমুকও খান নাই, তাই বাঁচি গেছেন!’

‘কিন্তু তুই এই ঘরে ঢুকেই কীভাবে বুঝলি যে টেবিলের ওপর রাখা কেটলিটা আসল কেটলি না?’ রইসের শেষ প্রশ্ন।

টেবিলের ওপর ডামি কেটলিটার দিকে আঙুল তাক করল কামাল। ‘এই কেটলিটা দেখতে পুরোনার মতো, স্যার। কিন্তু আসলে নতুন জিনিস, সস্তা, অর্ডার দিয়া বানানো। ভালো করি দেখেন। নীল ডিজাইনটা খেয়াল করেন। প্রিন্ট করা জিনিস, মগের ওপর যেমনে ডিজাইন প্রিন্ট করে, তেমনে করা! ডিজাইনের কোনাটা থেবড়ানো, ভালোমতো প্রিন্ট করতে পারে নাই। কয়েক শ বছরের পুরোনা চিনামাটির পাত্রে এমনটা হইতেই পারে না, তখনকার দিনে পুড়ায়া বসাইত ডিজাইন, প্রিন্ট করার টেকনিক তো আর আছিল না!’ হাসল সে। ‘সবাই ঠিকই কইছে, মিনিটখানেকের বেশি সময় পান নাই রায়হান সাহেব। শফিক সাহেবের চিল্লাচিল্লির মধ্যে একফাঁকে পাশের তাকের এই ঝুড়ি থাকিয়া নকল কেটলিটা বাইর করছে, আর অ্যাসাসিনস টি-পটটা তার ভেতরে রাখছে! ১০ সেকেন্ডের বেশি লাগে নাই। ঘরের এত জিনিসের মধ‌্যে আসলটা কেউ খুঁজত না। আর খুঁজবেই–বা ক্যান? সবাই ভাবত, টেবিলের ওপরের এইটাই বিষের পাত্র! কিন্তু ল্যাবে পরীক্ষা করলে কোনো বিষ পাইত না।’

‘তাই তো বলি, এক কেটলি থেকে বিষসহ আর বিষ ছাড়া দুই চা বের হয় কীভাবে।’ রইসের হাসিটা এবার আরও চওড়া হয়েছে।

‘তার চেয়েও আজব, রায়হান সাহেবের মতো পড়াশোনা করা লোক কেমন করে কাউরে খুন করার কথা চিন্তা করতে পারে।’ কামাল বলল। ‘কে জানে, শফিক সাহেব ওনার নিরিবিলি জীবনটা মামলা দিয়া বিষায় তুলছিল দেখিয়াই তিনি হয়তো এমন কথা ভাবছিলেন। বুঝলেন স্যার, দুই রকম জিনিস বের হওয়া কেটলি আর এমন কী। আসল আজব চিজ হইলে মানুষের মন। কত রকম খেয়াল যে বাইর হয় এইটা থাকিয়া! সেই বাগধারাটার মতো, স্যার। আচাভুয়া বোম্বাচাক। মানে? অসম্ভব ব্যাপার। মানুষের মনের গতি আন্দাজ করা অসম্ভব ব্যাপার!’

আরও পড়ুন