হানা-সাকা-জিজি সেই বৃদ্ধ, যিনি শুকনো গাছে ফুল ফোটাতে পারেন
অনেক দিন আগে গ্রামে এক বৃদ্ধ কৃষক দম্পতি বাস করত। চাষাবাদের জন্য ছোট একটা জমি ছিল তাদের। একটি সন্তানের আক্ষেপ ছাড়া তাদের জীবনে কোনো দুঃখ ছিল না।
তাদের একমাত্র পোষা কুকুরের নাম শিরো; বৃদ্ধ যুগলের সব মোহ নিবিষ্ট ছিল শিরোর ওপর। এমনকি নিজেদের জন্য রান্না করা সব সুস্বাদু খাবার শিরোর সঙ্গে ভাগ করে নিত তারা।
শিরো শব্দের অর্থ ‘সাদা’। গায়ের রং দেখেই ওর নাম রাখা হয়েছিল ‘শিরো’। ছোট নেকড়ের মতো দেখতে শিরো ছিল শুদ্ধ জাপানিজ কুকুর। মাঠের কাজ শেষে বৃদ্ধ দম্পতি যখন তাদের সীমিত রাতের খাবার শেষ করে অবশিষ্ট বেঁচে যাওয়া খাবার নিয়ে কটেজের বারান্দায় যেত, শিরোর তখন খুশির সীমা থাকত না। এই সময়টাই ছিল ওদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের সময়।
নিশ্চিতভাবে শিরো তার মনিব ও এই সান্ধ্য আমোদের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করত। বৃদ্ধ মনিব ‘চিঁ, চিঁ’ করে ডাকলে শান্ত হয়ে বসে খাবারের জন্য উত্সুক চোখে প্রার্থনা করত শিরো; তখন মনিব তাকে খাবার দিত।
এই বৃদ্ধ দম্পতির ঠিক পাশেই বাস করত আরেক বৃদ্ধ দম্পতি। তারা ছিল খুবই ধূর্ত ও দুষ্ট প্রকৃতির। তারা মনেপ্রাণে তাদের প্রতিবেশী ও শিরোকে ঘৃণা করত। যখনই শিরো ওদের রসুঁইঘরের দিকে তাকাত, ওরা হয় শিরোকে লাথি মারত, নয়তো কিছু ছুড়ে মারত; এমনকি জখমও করত!
একদিন শিরো তার মনিবের বাসার পেছনের জমিতে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে চিত্কার করছিল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক ভাবলেন, খেতের মধ্যে হয়তো পাখির দল শস্যদানা নষ্ট করছে, তাই এমন ঘেউ ঘেউ করছে শিরো। বয়স্ক মনিব তাড়াতাড়ি ঘরের বাইরে এসে দেখতে লাগল। তাকে দেখামাত্র কালবিলম্ব না করে সামনে এসে খুব উত্তেজিত হয়ে লেজ নাড়াতে লাগল শিরো। মনিবের পোশাক কামড়ে ধরে তাকে নিয়ে গেল একটা জামগাছের নিচে। শিরো খুব দ্রুত মাটি খুঁড়তে শুরু করল। আনন্দে নাচতে লাগল জিব বের করে। বুড়ো লোকটি শিরোর কাণ্ডকারখানা কিছুই বুঝতে পারল না। শিরো প্রাণপণে মাটি খুঁড়তে লাগল।
অবশেষে বৃদ্ধের মনে হলো যে মাটির নিচে বুঝি কিছু আছে; যার গন্ধ শুঁকে এমন করছে শিরো। বৃদ্ধ দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে একটা কোদাল নিয়ে এসে শিরোর সঙ্গে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণ মাটি খোঁড়ার পর কিছু মহামূল্যবান পুরোনো মুদ্রা দেখতে পায় বৃদ্ধ। আরও খুঁড়তে খুঁড়তে বৃদ্ধ মনিব খুঁজে পায় বিশাল স্বর্ণমুদ্রার ভান্ডার। গুপ্তধন পেয়ে বৃদ্ধ যারপরনাই খুশি হয়।
শিরো আনন্দে উত্ফুল্ল হয়ে ওঠে। আদুরে দৃষ্টিতে মনিবের দিকে তাকিয়ে আছে সে, যেন বলছে, ‘দেখো, সাধারণ কুকুর হলেও আমি আমার প্রতি তোমার নির্ভেজাল ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পেরেছি।’
বৃদ্ধ লোকটি দৌড়ে গিয়ে তার স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এসে দুজন মিলে গুপ্তধনগুলো ঘরে নিয়ে গেল। এভাবে বৃদ্ধ লোকটি এক দিনেই ধনী হয়ে গেল। শিরোর প্রতি তার কৃতজ্ঞতার অন্ত রইল না; এমনকি শিরোর প্রতি তার ভালোবাসা আরও বেড়ে গেল।
শিরো আর তার মনিবের এই গুপ্তধনপ্রাপ্তির দৃশ্য বেড়ার আড়াল থেকে দেখে ফেলে ধূর্ত প্রতিবেশী বৃদ্ধ। সে ভাবল, তারও এমন কিছু ভাগ্যে আছে। কিছুদিন পর সে তার প্রতিবেশী বৃদ্ধকে বাড়িতে ডেকে পাঠাল। বেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুদিনের জন্য ধার চাইল শিরোকে।
এমন অনুরোধে বেশ অবাক হলো শিরোর মনিব। সে ভালোভাবেই জানত যে তার প্রতিবেশী কখনোই শিরোকে ভালোবাসেনি, এমনকি রাস্তা পারাপারের সময় শিরোকে আঘাত করার সুযোগও কখনো ছাড়েনি তারা। তবু বৃদ্ধের কেন যেন দয়া হলো, সে তার প্রতিবেশীর কথায় রাজি হয়ে শিরোকে যেতে দিল প্রতিবেশীর কাছে।
ধূর্ত লোকটি মুখে কূট হাসি হেসে শিরোকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এল। স্ত্রীকে বলল, কত চালাকি করে সে সফল হবে। একটা কোদাল কাঁধে নিয়ে নিজের জমিতে গেল সে। শিরোকে বাধ্য করল গুপ্তধন খুঁজতে। একটা জামগাছের নিচে গিয়ে লোকটা শিরোকে বলল, ‘যদি ওই জামগাছের নিচে স্বর্ণমুদ্রা থাকে, তাহলে এখানেও তুমি আমার জন্য তা খুঁজতে পারবে। কোথায় আছে সেই গুপ্তধন? কোথায়? কোথায়?’
শিরোর ঘাড় ধরে মাটির সঙ্গে চেপে ধরল বৃদ্ধ। ধূর্ত মানুষটির কবজা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে মাটি আঁচড়াতে শুরু করল শিরো। খুঁড়তে শুরু করল গর্ত। শিরোকে মাটি খুঁড়তে দেখে লোভী বৃদ্ধ ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে নিজেই খোঁড়া শুরু করল। বেশ কিছু মাটি খোঁড়ার পরও কিছুই পেল না লোকটা। বরং উটকো গন্ধ বের হতে লাগল সেখান থেকে। বৃদ্ধ বুঝতে পারল যে সে সফল হয়নি।
যারপরনাই হতাশ বৃদ্ধ খুব রেগে গেল। নিজের চোখে প্রতিবেশী বৃদ্ধের গুপ্তধনপ্রাপ্তি দেখেছে সে; ভেবেছে তার বেলায়ও এমনটি হবে। সে শিরোকে ধার করে এনেছে; আর এখন কী হলো! দুর্গন্ধযুক্ত কাদামাটি ছাড়া কিছুই নয়! এক সকাল মাটি খুঁড়ে শেষ পর্যন্ত কিনা তার এই প্রাপ্তি! নিজের ভাগ্যকে মেনে নেওয়ার বদলে বৃদ্ধ তার এমন মন্দভাগ্যের জন্য দায়ী করতে লাগল শিরোকে।
লোভী বৃদ্ধ হাতে কোদাল তুলে নিয়ে সজোরে আঘাত করল শিরোকে। সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল কুকুরটা। বৃদ্ধ লোকটি শিরোর নিথর দেহকে তার খোঁড়া গর্তে চাপা দিয়ে দিল। অতঃপর শূন্য হাতে বাড়িতে ফিরে এল। মাঠে ঘটে যাওয়া ঘটনার কোনো কিছুই সে কাউকে বলল না, এমনকি তার স্ত্রীকেও নয়।
কিছুদিন অপেক্ষা করার পর প্রতিবেশী যখন শিরোকে ফেরত দিল না, তখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল শিরোর মনিব। শিরোকে ফিরিয়ে আনতে প্রতিবেশীর ঘরে গেল সে। ফেরত দিতে বলল শিরোকে। লোভী বৃদ্ধ লোকটি কোনো প্রকার লজ্জিত বা অনুতপ্ত না হয়েই বলল যে সে শিরোকে হত্যা করেছে। কারণ, শিরো তার সঙ্গে বাজে আচরণ করেছে। এমন মর্মান্তিক খবরে মুষড়ে পড়ল শিরোর মনিব। বৃদ্ধ ভদ্রলোক এতটাই ভালো ও দয়াবান যে সে তার খারাপ প্রতিবেশীর নিন্দা পর্যন্ত করল না।
তখন বৃদ্ধ দম্পতি বুঝল যে শিরোর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উপহার এটা তাদের জন্য। চালের গুঁড়া থেকে তৈরি করা কেক তারা পরখ করে দেখল। অবাক কাণ্ড, এই কেকের স্বাদ অন্য যেকোনো খাবারের চেয়ে অনেক ভালো। এর পর থেকে তাদের খাবারের জন্য কখনো চিন্তা করতে হয়নি।
শিরোকে জামগাছের নিচে পুঁতে রাখা হয়েছে। এটা শুনে লোভী প্রতিবেশীর কাছে জামগাছটি চাইল শিরোর মনিব, যেন শিরোকে স্মরণ করতে পারে তারা। বৃদ্ধের এমন অনুরোধ ধূর্ত লোকটি ফেলতে পারল না। জামগাছটি দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক গাছটি কেটে নিজের ঘরে নিয়ে এল। কাঠের টুকরাগুলো দিয়ে সে একটা হামানদিস্তা বানাল। বৃদ্ধের স্ত্রী তাতে কিছু চাল দিয়ে গুঁড়া করতে লাগল যেন শিরোর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করতে পারে।
তখন এক আজব কাণ্ড ঘটল। যখনই বৃদ্ধের স্ত্রী হামানদিস্তায় চাল দিল, হামানদিস্তাটি আপনাআপনিই কেক বানানোর জন্য চাল গুঁড়া করতে শুরু করে দিল। এমনকি যা চাল দিচ্ছে, তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি চালের গুঁড়া হতে লাগল। হামানদিস্তা থেকে এমনভাবে গুঁড়া তৈরি হতে লাগল যেন কোনো অদৃশ্য হাত এসে কাজগুলো করছে।
তখন বৃদ্ধ দম্পতি বুঝল যে শিরোর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উপহার এটা তাদের জন্য। চালের গুঁড়া থেকে তৈরি করা কেক তারা পরখ করে দেখল। অবাক কাণ্ড, এই কেকের স্বাদ অন্য যেকোনো খাবারের চেয়ে অনেক ভালো। এর পর থেকে তাদের খাবারের জন্য কখনো চিন্তা করতে হয়নি।
সেই লোভী প্রতিবেশীর কানে একদিন খবরটা পৌঁছাল। তৎক্ষণাৎ বৃদ্ধ দম্পতিকে ডেকে পাঠাল সে। তারা আসতেই লোভী বৃদ্ধ শিরোর মৃত্যুর জন্য খুব অনুতাপ করতে লাগল এবং কথায় কথায় সে হামানদিস্তাটি কিছুদিনের জন্য ধার চাইল, যেন সে নিজেও শিরোর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে।
এমন নির্দয় বৃদ্ধকে হামানদিস্তাটি ধার দেওয়ার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না বৃদ্ধ দম্পতির। কিন্তু তারা এতটাই সহজ সরল যে ‘না’ করতে পারল না। অতঃপর সেই ঈর্ষাপরায়ণ বৃদ্ধ হামানদিস্তাটি নিজের ঘরে নিয়ে এল।
কিছুদিন পর বৃদ্ধ দম্পতি তাদের হামানদিস্তাটি ফেরত নিতে গিয়ে দেখে যে পাষাণ-নিষ্ঠুর বৃদ্ধ প্রতিবেশী একটা আগুনের স্তূপের পাশে বসে আছে। কিছু কাঠ দাউ দাউ করে জ্বলছে। বৃদ্ধ দম্পতির বুঝতে বাকি রইল না যে কাঠের টুকরাগুলো তাদের সেই হামানদিস্তার। এর কারণ জানতে চাইলে অসৎ বৃদ্ধ অহংকারী দৃষ্টিতে বলল, ‘তুমি কি হামানদিস্তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছ? আমি ওটা ভেঙে টুকরা টুকরা করে ফেলেছি আর ভাঙা টুকরাগুলো এখন জ্বালিয়ে ফেলছি। আমি যতবারই কেক বানানোর চেষ্টা করেছি, ততবারই দুর্গন্ধযুক্ত কিছু একটা তৈরি হয়েছে!’
ভালো বৃদ্ধ লোকটি বলল, ‘আমি এ জন্য সত্যিই দুঃখিত যে তুমি কেক বানাতে পারোনি। তবে আফসোস এই যে তোমার কেকের প্রয়োজন হলে তুমি তা আমাকে বলোনি। তোমার যত কেক দরকার, আমিই দিতাম। এখন দয়া করে আমাকে কিছু ছাই দাও যেন তা আমি শিরোর স্মরণে রেখে দিতে পারি।’
ধূর্ত বৃদ্ধটি একপলকেই রাজি হয়ে গেল এবং বৃদ্ধ দম্পতি এক বস্তা ছাই নিয়ে ফিরে এল।
একদিন বৃদ্ধ লোকটি মনের অজান্তেই তার ঘরের আঙিনায় থাকা বাগানে সেই হামানদিস্তার কিছু ছাই ছড়িয়ে দিল। তখন খুব বিস্ময়কর এক ঘটনা ঘটল। সময়টা শরত্কালের; সব গাছের পাতা ঝরে গেছে। কিন্তু যখনই ছাইগুলো উড়ে গিয়ে গাছের ডাল ছুঁতে লাগল, তখন জামগাছ, বরইগাছসহ সব গাছে ফুল ফুটতে লাগল, ফল ধরতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই বৃদ্ধের বাগান ফুলে–ফলে ভরে উঠল যেন এটা পূর্ণ বসন্তকাল। বৃদ্ধের মন খুশিতে ভরে উঠল এবং সে বাকি ছাইগুলো যত্ন করে সংরক্ষণ করল। এই চমত্কার ঘটনার গল্প দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এমন বিস্ময়কর দৃশ্য দেখতে দলে দলে মানুষ ভিড়তে লাগল তাদের উঠানে।
এ ঘটনার কিছুদিন পর বৃদ্ধ লোকটি শুনতে পেল, কে যেন তাদের দরজার কড়া নাড়ছে। সে খুব অবাক হলো যখন দরজা খুলে দেখল, এক বিশেষ পোশাক পরিহিত দূত বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দূত তাকে জানাল যে সে এক গুরুত্বপূর্ণ বিদ্বান প্রশাসকের অধীন। সে জানাল যে তার মনিবের একটা প্রিয় চেরিগাছ আছে; কিন্তু গাছটা কোনো অজ্ঞাত কারণে একেবারেই শুকিয়ে গেছে। প্রশাসকের অধীন সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারেনি। সেই বিশেষ দূত জানাল যে প্রিয় চেরিগাছের এমন দশায় তার মনিব যে পরিমাণ অসন্তুষ্ট, তাতে সে খুবই বিভ্রান্ত। সৌভাগ্যক্রমে ঠিক তখন তারা শুনতে পেল যে এখানে এক আশ্চর্য বৃদ্ধ লোক থাকে যে কিনা শুকিয়ে যাওয়া গাছ ফুলে–ফলে ভরিয়ে তুলতে পারে। তাই তার মনিব তাকে পাঠিয়েছেন যেন সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে তার কাছে নিয়ে যায়।
দূত আরও বলল, ‘যদি আপনি এখনই একবার আমার সঙ্গে যান, তাহলে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।’
বৃদ্ধ ভদ্রলোক দূতের কথায় ভীষণ খুশি হলো এবং তার সঙ্গে সেই বিদ্বান ব্যক্তির বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো।
বিদ্বান ব্যক্তিটি বৃদ্ধ ভদ্রলোকের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তাই বৃদ্ধ লোকটিকে আসতে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি সেই বৃদ্ধ, যে কিনা খরার দিনেও শুকনো গাছে ফুল ফোটাতে পারে?’
বৃদ্ধ ভদ্রলোক বিনীত হয়ে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, আমিই সেই বৃদ্ধ লোক!’
তখন বিদ্বান ব্যক্তিটি বললেন, ‘তাহলে তুমি নিশ্চয়ই তোমার সেই আশ্চর্য ছাই দিয়ে আমার বাগানের ওই মৃত চেরিগাছে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারবে? আমি তা দেখতে চাই।’
বিদ্বান ব্যক্তিটি সদলবল বৃদ্ধ লোকটিকে নিয়ে বাগানে গেলেন।
বৃদ্ধ লোকটি তখন তার পোশাক ঠিকঠাক গুছিয়ে একটা কৌটার মধ্যে সেই আশ্চর্য ছাই নিয়ে গাছে উঠতে শুরু করল। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে।
শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ লোকটি গাছের এমন জায়গায় উঠল, যেখান থেকে দুটি প্রকাণ্ড শাখা দুদিকে বেঁকে গেছে। গাছের শাখায় বসে কৌটা থেকে ছাই বের করে সারা গাছে ছিটিয়ে দিতে লাগল বৃদ্ধ, কখনো ডানে তো কখনো বাঁয়ে।
ফলাফল সত্যিই বিস্ময়কর! মুহূর্তেই শুকিয়ে যাওয়া গাছটি ফুলে-ফলে ভরে উঠল। দেখে প্রশাসক ভদ্রলোক আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন, যেন তিনি পাগলই হয়ে যাবেন। তিনি বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে গাছ থেকে নেমে আসার অনুরোধ করলেন। অতঃপর নিজ হাতে গ্লাসভর্তি কোমল পানীয় এনে বৃদ্ধ লোকটিকে আপ্যায়ন করলেন এবং প্রচুর সোনা, রুপা ও অন্যান্য মহামূল্যবান জিনিস দিয়ে তাকে পুরস্কৃত করলেন।
প্রশাসক জানালেন যে এর পর থেকে সবাই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ‘হানা-সাকা-জিজি’ বলে সম্বোধন করবে; যার অর্থ ‘সেই বৃদ্ধ লোক, যে শুকনো গাছে ফুল ফোটাতে পারে’। আগত সবাই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে নতুন নামে ডাকতে শুরু করে এবং তাকে সসম্মান বাড়িতে পৌঁছে দেয়।
পূর্বের মতো এবারও প্রতিবেশী ধূর্ত বৃদ্ধের কানে খবরটি পৌঁছায়। সে শুনতে পায় প্রতিবেশী বৃদ্ধের সৌভাগ্যপ্রাপ্তির কথা, মূল্যবান ধনসম্পদ লাভের কথা। শুনে সে নিজের মনের হিংসা লুকিয়ে রাখতে পারে না। তার মনে পড়ে যায় যে সে কীভাবে গুপ্তধন খুঁজে পেল না আর মজাদার কেক বানাতে পারল না। সে ভাবল, এবার নিশ্চয়ই প্রতিবেশী বৃদ্ধকে অনুকরণ করে কৃতকার্য হবে, যে কিনা শুকনো গাছের মধ্যে শুধু ছাই উড়িয়ে বেড়ায়। এর চেয়ে সহজ আর কিছুই হতে পারে না।
ভাবনা আসামাত্র লোভী বৃদ্ধ কাজে লেগে গেল। সে তার উঠানে পড়ে থাকা হামানদিস্তার অবশিষ্ট কিছু ছাই কুড়িয়ে নিল। ছাইগুলো সঙ্গে করে সে বেরিয়ে পড়ল এই ভেবে যে কোনো দয়াবান ব্যক্তি নিশ্চয়ই তাকে কাজ দেবে। পথে যেতে যেতে সে চিত্কার করে বলতে লাগল, ‘এসে গেছে! সেই বিস্ময়কর মানুষ এসে গেছে যে কিনা শুকনো গাছে ফুল ফোটাতে পারে; এসে গেছে! সেই বৃদ্ধ মানুষ এসে গেছে যে কিনা শুকনো গাছে ফুল ফোটাতে পারে।’
প্রাসাদে থাকা প্রশাসক এই চিত্কার শুনতে পেয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই “হানা-সাকা-জিজি” এসেছেন; আমার করার কিছুই নেই; আজ আরেকবার তার কীর্তি দেখা যাক। এমন আশ্চর্য ঘটনা দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।’
অধস্তন লোকেরা বাইরে গিয়ে বৃদ্ধ লোকটাকে প্রাসাদে নিয়ে এল। এমন পরিস্থিতিতে ধূর্ত বৃদ্ধ লোকটির মন যে কতটা খুশি, তা অনুমান করাই যায়।
প্রশাসক জানালেন যে এর পর থেকে সবাই বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ‘হানা-সাকা-জিজি’ বলে সম্বোধন করবে; যার অর্থ ‘সেই বৃদ্ধ লোক, যে শুকনো গাছে ফুল ফোটাতে পারে’। আগত সবাই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে নতুন নামে ডাকতে শুরু করে এবং তাকে সসম্মান বাড়িতে পৌঁছে দেয়।
তবে বিদ্বান প্রশাসকের কিছুতেই মনে হচ্ছিল না যে সামনের বৃদ্ধ লোক আর পূর্বের বৃদ্ধ লোক একই ব্যক্তি। তাই তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তুমি কি সেই ব্যক্তি, যাকে আমি “হানা-সাকা-জিজি” উপাধি দিয়েছিলাম?’
‘জি, হুজুর; আমিই সেই ব্যক্তি।’
‘এটা অদ্ভুত ব্যাপার; আমি ভেবেছিলাম যে পৃথিবীতে একজনই “হানা-সাকা-জিজি” আছেন; কিন্তু এখন তো দেখছি তার শিষ্যও আছে!’ বিস্ময়ে বললেন বিদ্বান প্রশাসক।
‘আমিই আসল “হানা-সাকা-জিজি”; এর আগে যে এসেছিল, সে আমার শিষ্য ছিল।’ উত্তরে বৃদ্ধ লোকটি বলল।
‘তাহলে তুমি নিশ্চয়ই অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী। দেখাও তোমার কীর্তি; আমি দেখতে চাই।’
তারপর সেই হিংসাপরায়ণ বৃদ্ধ, বিদ্বান প্রশাসক ও তার সঙ্গীরা মিলে বাগানে গেল। সেখানে গিয়ে একটা মৃত গাছের ডালে তার সঙ্গে করে নিয়ে আসা ছাইগুলো ছিটিয়ে দিতে শুরু করল। এতে কোনো লাভই হলো না। ফুল তো দূরের কথা, ফুলের একটা বোঁটাও গজাল না গাছে। তখন বৃদ্ধ লোকটি ভাবল, হয়তো ছাই কম ছিটানোয় এমনটা হয়েছে। তাই শুকনো গাছটায় মুঠোভর্তি ছাই নিয়ে ফুঁ দিল। তাতেও কোনো কাজ হলো না। কয়েকবার চেষ্টা করার পরও যখন কিছু হলো না, সে পালানোর উদ্দেশ্যে অবশিষ্ট ছাইগুলো প্রশাসকের চোখের সামনে উড়িয়ে দিল। এতে প্রশাসক ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে তার অধীনদের আদেশ দিলেন নকল ‘হানা-সাকা-জিজি’কে গ্রেপ্তার করতে এবং এই প্রতারককে হাজতে দিতে। এই শাস্তি থেকে ধূর্ত বৃদ্ধ লোকটি আর কখনোই মুক্তি পায়নি। এভাবেই সে তার পূর্ব কৃতকর্মের সাজা ভোগ করল।
অপর দিকে সত্যিকারের ‘হানা-সাকা-জিজি’, যে শিরোর মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া বিপুল গুপ্তধন ও প্রশাসকের দেওয়া মূল্যবান রত্নের মাধ্যমে শেষ বয়সে এসে ধনী হয়ে উঠল এবং সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় পরবর্তীকালে সুখী জীবন যাপন করতে লাগল।