নাশতার টেবিলে বসে আজ খেল খিচুড়ি আর ডিমভাজা...সাথে বেগুনভাজি, গরুর মাংসর ভুনা।
আজ কোথায় বেড়াবি?
তুমি বলো।
চল, লাউয়াছড়া ঘুরে আসি।
বেশ।
জানিস তো, লাউয়াছড়ায় অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ ছবিটার কিছু অংশ শুটিং হয়েছিল।
হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনেছিলাম।
তুই বইটা পড়েছিস?
হ্যাঁ, বইটা আমাদের বাসায় আছে, দুবার পড়েছি। কোন অংশটার শুটিং হয়েছিল, তুমি জানো মামা?
জানি তো।
কোন অংশটার?
ওই যে একটা হিন্দু বিধবা মেয়েকে সহমরণে পোড়াতে নিয়ে নিয়ে যায়, তখন গল্পের নায়ক তাকে উদ্ধার করেন। ওই ঘটনাটা এখানে শুটিং হয়েছিল। কত বছর আগে চিন্তা করতে পারিস?
ঠিক তাই।
চা–নাশতা শেষ করে মামার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল তানিম। লাউয়াছড়া কাছেই, সেখানে পৌঁছে টিকিট কেটে দুজনে ঢুকে পড়ল। একজন গাইড অবশ্য নেওয়া হলো। গাইড ছাড়া ঘুরলে এখানে হারিয়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। লাউয়াছড়ায় ঢুকতে যাবে তখন গেটের কাছের পাশেই একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে দেখে সেই লোকটা বসে, সেই বুড়োটা। ট্রেনের বুফে কারের সেই লোকটা। তানিমের দিকে কেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কোনো কারণ ছাড়াই; কেমন যেন বুকটা ধক করে উঠল তানিমের। এই লোকটা এখানে কেন। সে কি তাকে কোনো কারণে ফলো করছে? প্রশ্নই ওঠে না। সে কি করেছে যে তাকে ফলো করতে হবে। আর লোকটার সঙ্গে তার তেমন কিছু কথাবার্তাও হয়নি ট্রেনে।
সত্যি কথা বলতে কি লাউয়াছড়া ঘুরতে ঘুরতে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ হলো তানিমের। এই বনের নামই শুনেছে শুধু; এই প্রথম আসা হলো। অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ-এর শুটিংয়ের সেই জায়গাটা দেখল, রেললাইনের পাশে বিশাল এক সাইনবোর্ড তাতে বিস্তারিত সব লেখা আছে—
লাউয়াছড়া বনে অস্কারজয়ী হলিউড মুভি
Around the World in 80 days
এর শুটিং স্পট (রেললাইন)
পরিচালক: Michael Todd
শুটিং সন: ১৯৫৫ ইং, মুক্তির সন: ১৯৫৬ ইং
তানিম সাইনবোর্ডের একটার ছবি তুলল।
তানিমের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। তারা মুখপোড়া হনুমান দেখতে পেল, সবাই নাকি দেখতে পায় না। একসঙ্গে বেশ কয়েকটা। তারা কেমন শব্দ করতে করতে এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফিয়ে যাচ্ছিল। মামা এদের সম্পর্কে মজার একটা তথ্য বললেন। এদের অন্য একটা প্রজাতিকে ইংরেজিতে বলে গ্রিন মাংকি। এদের কাছাকাছি গিয়ে কেউ যদি আড়াল থেকে চিত্কার করে বলে ওঠে। ‘ই য়াক! ই য়াক!!’ তাহলে এরা দ্রুত গাছ থেকে নেমে আসবে মাটিতে। আবার যদি বলা হয় ‘কে য়াক! কে য়াক!!’ তাহলে ওরা লাফিয়ে গাছে উঠে পড়বে (অবশ্য শব্দগুলো ওদের ভাষায় বলতে হবে)।
কেন মামা?
কারণ হচ্ছে ‘ই য়াক! ই য়াক!!’ (Yi aakh! Yi aakh!) অর্থ আকাশে ইগল দেখা গেছে, সাবধান!! তখন তারা সাবধানতার জন্য নিচে নেমে পড়ে
আর ‘কে য়াক! কে য়াক?’
আর ‘কে য়াক! কে য়াক!!’ (k yak! k yak!!) অর্থ মাটিতে সিংহ বা বাঘ দেখা গেছে, সাবধান!! তারা তখন লাফিয়ে গাছে উঠে পড়ে। ব্যাপারটা মজার না?
অনেক মজার।
মামার কাছ থেকে এ রকম খুচরা জ্ঞান অর্জন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেল তানিম। খাসিয়াপাড়া নামে ছোট্ট একটা পরিচ্ছন্ন আদিবাসীদের কমিউনিটি ঘুরে বাসায় ফেরার পথ ধরল। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা।
সে রাতে খাওয়া হলো তন্দুর রুটি আর গরুর মাংস। বেশ লাগল। খাওয়াদাওয়ায় মামা বেশ শৌখিন, বেশির ভাগ তিনি নিজেই তৈরি করেন, বাকি কিছু আইটেম বাইরে থেকে আসে। রান্নাবান্নার তার কিছু অ্যান্টিক তৈজসপত্রও আছে। সবশেষে মামার সেই অসাধারণ কফি। প্রথম দিকে তানিমের কেমন কাঠপোড়া কাঠপোড়া একটা গন্ধ লাগত, এখন আর তা লাগছে না। মনে হচ্ছে ঢাকায় গিয়ে তাকে কফি ধরে ফেলতে হবে। খুব টায়ার্ড লাগছিল বলে আজ আর বই পড়া হলো না। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে তানিম জানে না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল একটা ফরফর শব্দে। আজ সে লাইট জ্বালিয়েই ঘুমিয়েছে। দেখে শব্দটা একটা পলিথিনের। একটা সাদা বেশ বড় পলিথিন ফ্যানের বাতাসে ঘরের চারদিকে গোল হয়ে উড়ছে। তারই ফরফর শব্দ। শব্দটা এই মধ্যরাতে বেশ ভীতিকর। একসময় পলিথিনটা ফ্যানের ব্লেডে জড়িয়ে গেল। তখন শব্দটা আরও বিশ্রীভাবে হতে লাগল। তানিম উঠে গিয়ে ফ্যানটা বন্ধ করল। ঘরের কোনায় একটা ছাতা ছিল। বিছানায় দাঁড়িয়ে সেটা দিয়ে পলিথিনটা নামিয়ে আনল। তারপর কোনার ঝুড়িতে ঢুকিয়ে রাখল পলিথিনটাকে। ওটা আসলে বেশ বড় সাইজের সাদা রঙের ছেঁড়া পলিথিন, ঘরের ভেতর কী করে এল কে জানে। নিশ্চয়ই আসে পাশেই ছিল ফ্যানের বাতাসে উঠে এসেছে।
তানিম ভাবল, পানি খাওয়া যাক। আজ আর তেমন ভয় করল না। ঘর থেকে বাইরে এসে দেখে, ফ্রিজের সামনে মামা। মামাও কি পানি খেতে বের হয়েছেন? তখনই বুকটা ধক করে উঠল। ওটা মামা নন। অতি অবশ্যই মামা নন। এই বাসায় সে আর মামা ছাড়া কেউ নেই। এটা তৃতীয় কেউ। পেছন ফিরে লোকটা কিছু করছে ফ্রিজের দরজা খুলে। হঠাৎ লোকটা ঘুরে তাকাল তানিমের দিকে। তানিমের মনে হলো, সময় যেন থেমে গেছে। তার হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে আটকে গেছে, ধক ধক করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে! লোকটা আর কেউ নয়, সেই ট্রেনের বুড়ো লোকটা। তার গায়ে সাদা একটা পলিথিন জড়ানো, বর্ষাতির মতো করে জড়িয়ে রেখেছে শরীরে, যেন এখনই বৃষ্টি পড়বে, তাই সাবধানতা। লোকটা তানিমের দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসল। যেন বলছে, ‘কি, চিনতে পারছ না? আমি সেই লোক...যার চোখের পলক পড়ে না, সব সময় মাছের মতো তাকিয়ে থাকতে পারে।’ মানুষ যখন প্রচণ্ড ভয় পায়, তখন শরীরে অ্যাড্রেনাল হরমোনের নিঃসরণ হয়। ‘ফাইট অ্যান্ড ফ্লাইট’ অবস্থা তৈরি হয়। হৃৎপিণ্ড অতিরিক্ত রক্ত পাম্প করে দ্রুত শরীরের প্রতিটি পেশিতে পাঠানোর চেষ্টা করে, যেন ভয়ের বিষয়টাকে মোকাবিলা করবে, নইলে ভয়ের জায়গা থেকে পালিয়ে যাবে। ছুটে পালিয়ে যেতেও শক্তির প্রয়োজন হয় বটে। জীববিজ্ঞান ক্লাসে আকবর স্যার বিষয়টা তাদের সুন্দর করে বুঝিয়েছিলেন, তানিমের মনে আছে। তানিম বেশ বুঝতে পারছে যে সে এখন ‘ফাইট অ্যান্ড ফ্লাইট’ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। তার শরীরে নিশ্চয়ই অ্যাড্রেনাল হরমোনের নিঃসরণ হচ্ছে। সে চিত্কার করে উঠল। চিৎকারে কী যে বলল, তা সে নিজেও জানে না। সে যখন চিত্কার করে উঠল, তখন নিশ্চয়ই তার চোখ দুটো কয়েক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়েছিল। চোখ খুলতেই তানিম দেখল, সেখানে সাদা পায়জামা–পাঞ্জাবি পরা বুড়ো লোকটা নেই। ফ্রিজের দরজাটা খোলা। সেখানে লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে আছে ছটকু মামা। মামার দুচোখে বিস্ময়। ‘আমার নিশ্চয়ই হ্যালুসিনেশন হয়েছে,’ বিড়বিড় করে বলল তানিম।
—কিরে, আবার ভয় পেয়েছিস নাকি?
—ন-না না!
—কে যেন চেঁচাল মনে হলো!
—না তো। পানি খেতে এসেছিলাম।
—ও, তা–ই বল! বাইরে অবশ্য নাইটগার্ডরা কী সব যেন বলে চেঁচায়। এই নে পানি।
মামা একটা ঠান্ডা পানির একটা বোতল এগিয়ে দিল।
—কফি খাবি নাকি এক কাপ?
—না না, তুমি খাও।
—মাঝরাতে এক কাপ কফি না খেলে আবার আমার হয় না।
মামা কফি বানানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। তানিম পানির বোতলটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। কেন যেন বিষয়টা মামাকে বলতে ইচ্ছা করছে না। এক নিশ্বাসে পানির বোতলটা খালি করে ফেলল তানিম। তখনই তার নজর পড়ল, ঘরের কোনায় প্লাস্টিকের ঝুড়িটার ওপর। যেখানে পলিথিনটা থাকার কথা, সেখানে সেটা নেই। অথচ তানিমের স্পষ্ট মনে আছে, সে নিজের হাতে পলিথিনটা ভাঁজ করে ঝুড়ির ভেতর ঢুকিয়েছিল, যেন আবার ফ্যানের বাতাসে উড়ে না যায়।
বাকি রাত আর তানিম ঘুমাতে পারল না। জেগে রইল। শিবরাম চক্রবর্তীর হাসির বইটার একটা গল্প পড়ার চেষ্টা করল। কিন্তু একটা পাতাও এগোতে পারল না। কোনোমতে রাতটা পার করল সে।
পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে তানিম বলল, আচ্ছা মামা, ওই লোকটার বয়স কেমন ছিল?
—কোন লোক?
—এই যে তোমার ফ্রিজের ভেতর যে লাশটা ছিল!
—উফ! তোর মাথা থেকে এটা যাচ্ছে না, না?
—না এমনি একটু কৌতূহল!
—শুনেছি লোকটা বয়স্ক ছিল, ৬০–৬৫ হবে! ফ্রিজের ভেতর একটা বড় পলিথিনে প্যাঁচানো ছিল লাশটা। লোকটার চোখ দুটো নাকি খোলা ছিল, যেন তাকিয়ে আছে, মাছের চোখের মতো নিষ্পলক। অবশ্য এসবই শোনা কথা। বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আবার কে জানে, সত্যিও হতে পারে!
—মামা..
—বল।
—আমি আজই চলে যাব।
—কী বলছিস! এলি তো মাত্র দুদিন। ভয় পেয়েছিস নাকি?
—না না, ভয় না।
—তাহলে?
ঠিক তখন বাইরে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। কে যেন এসেছে। দেখা গেল, মামার ছোটবেলার বন্ধু রবিন। দুই বন্ধু পরস্পরকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে রীতিমতো হাউকাউ শুরু করে দিলেন।
—এত দিন কোথায় ছিলি?
—আমি তো এখানেই আছি। তুই কোথায় ছিলি, সেটা বল।
—আমি যেখানে থাকার সেখানেই ছিলাম।
—তারপর... আছিস কেমন? দেশে আছিস না বিদেশে?
—দুই জায়গায়ই আছি। এ কে?
—চিনতে পারিসনি? ছোটবেলায় দেখেছিস, আমার বড় বোন রেণু বুবুর ছেলে। ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছে।
—ও! মনে পড়েছে। তানিম না? এত বড় হয়ে গেছে বাব্বা! কেমন আছ তানিম? চিনতে পেরেছ?
তানিম অবশ্য চিনতে পারল না। তবে মামার যে খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তা বেশ বোঝা গেল। দুই বন্ধুর প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাওয়ার পর আবার নতুন করে চা–নাশতা চলে এল টেবিলে। আরেক দফা খেতে হল তানিমকেও। রবিন মামা দারুণ এক মিষ্টি নিয়ে এসেছেন, সেটাও খেতে হলো। আড্ডায় আড্ডায় তানিমের ঢাকায় ফেরার ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল।
একসময় রবিন মামা উঠে পড়লেন, তাঁকে ঢাকায় ফিরতে হবে। ঢাকায় জরুরি কিছু কাজ আছে। সেসব কাজ সেরে রাতের ফ্লাইটে সিঙ্গাপুরের দিকে ছুটতে হবে।
—সেকি রে! আজকের দিনটা অন্তত থাক। তোর আসা উপলক্ষে ভালোমন্দ কিছু খাই। আমার ভাগনেটাও পালাই পালাই করছে। তুই থাকলে বেশ হয়।
—কী? ভাগনে চলে যাবে? তাহলে আমার সঙ্গে চলুক।
—না না, ও আরও কটা দিন থাক।
—না মামা, চলে যাই।
—বুঝতে পেরেছি, তুই আসলে ভয় পেয়েছিস।
—ন-না না।
—সত্যি যাবি? তাহলে রবিনের সঙ্গেই নাহয় চলে যা, ওর গাড়িতে। রবিন, তুই নতুন গাড়ি কিনেছিস মনে হয়! আগেরটা তো এমন ছিল না।
—আগেরটার অবস্থা আর বলিস না। ওটার হর্ন ছাড়া আর সবই বাজত। হা হা...তোর জাদুঘরে রাখার মতো অবস্থা আরকি!
দুই মামা নিজেদের রসিকতায় হো হো করে হাসতে লাগলেন। দুজনের মধ্যে এতই ফুর্তি যে সামান্য কিছুতেই হো হো করে হাসছিলেন। আর হাসি যেহেতু ছোঁয়াচে, তাই তানিমও হাসছিল। রাতের সেই ঘটনা ভুলে থাকার জন্য এখন হাসিটাই যেন খুব বেশি দরকার।
চলবে...