শিকারি
অনেক দিন পর থ্রি-পিস স্যুট পরেছি—মোটেও ফিট হয়নি গায়ে। বছরখানেক ধরে গায়ে না তোলা জামা এমনিতেই মাপমতো হওয়ার কথা নয়, তার ওপর আমি ঘরের বাইরে খুব একটা বেরোই না বহুদিন ধরে। ওজন বাড়তে বাধ্য। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে এই নিয়ে বোধ হয় চারবারের মতো কাঁধ নাড়া দিয়ে বুক-পিঠের আড়ষ্ট হয়ে চেপে বসা ওয়েস্টকোটটা হালকা করার চেষ্টা করলাম। প্যান্টের কোমরের সাঁড়াশি চাপের কথা আর বললাম না। একটু পর যখন মিটিংরুমে ঢুকব, তখন কোটের বোতাম লাগানোর পর কী অবস্থা হবে সেটা না ভাবাই ভালো।
তবে মুচকি হেসে ভাবলাম আমি, দরকার আছে এই অস্বস্তির। অন্য কেউ হলে প্রয়োজনে ধার করা জামা পরে আসত, কিন্তু আমি যা করি, তার পেছনে জোরালো কারণ থাকে সব সময়।
ফুরফুরে বাতাস বইছে ঢাকার রাস্তায়। দিনটা চমৎকার, তবে এই সৌন্দর্য দেখার কেউ নেই। আমি ছাড়া সবাই মনে হয় অফিস যাওয়ার ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। রাস্তা ধরে ছুটে চলেছে নিঃশব্দ ইলেকট্রিক বাস, মাথার ওপর মেট্রো। আমি নিজেও উঠে এসেছি পাতালের একটা মেট্রোস্টেশন থেকে, এখন আলস ভঙ্গিতে হাঁটছি ফুটপাত ধরে। আমিও যাচ্ছি একটা অফিসে, তবে সেটা আমার কর্মক্ষেত্র নয়, আর আমার অত তাড়াও নেই, চলে এসেছি কাছাকাছি।
মুখ থেকে মুচকি হাসিটা মুছিনি আমি। রাস্তায় কেউ আমাকে একা একা হাসতে দেখে পাগল ভাববে, সেই সম্ভাবনাও নেই, আশপাশের সবার চোখই নানা রকম স্মার্ট চশমায় ঢাকা। নিজের নিজের জগতে বুঁদ তারা, অফিসের কাজ করছে বা স্রেফ সিরিজ দেখছে। স্মার্ট চশমাই সাহায্য করছে কারও সঙ্গে ধাক্কা না লাগিয়ে পথ চলতে। কিন্তু পাশের লোকটার মুখের দিকে তাকানোর সময় তাদের নেই। দ্বাবিংশ শতকের আশীর্বাদ এটা, আবার অভিশাপও।
আমিই বোধ হয় একমাত্র লোক যে প্রকৃতির দেওয়া খালি চোখে রাস্তা দেখতে দেখতে হাঁটছি...দাঁড়ান দাঁড়ান, আরেকজনকে দেখা যাচ্ছে, ওই তো। লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে অবজ্ঞায় মুখ বাঁকালাম আমি। ওই চকচকে চোখ, ওই অতি মসৃণ ত্বক আর নিখুঁত চুল, সেই সঙ্গে মেপে মেপে হাঁটার ভঙ্গি দেখেই চিনে ফেলেছি: ও ব্যাটা আদপে কোনো মানুষই নয়, রোবট। যাকে বলে অ্যান্ড্রয়েড, মানুষের মতো দেখতে রোবট। স্মার্ট চশমা পরবে কী, ওর চোখই তো যান্ত্রিক!
রোবট আমার দুই চোখের বিষ, অ্যান্ড্রয়েড তো আরও বেশি। এই সব নকল মানুষকে কেন যেন ছোটবেলা থেকেই সহ্য করতে পারি না। এমন না যে আমি লোকটা সেকেলে, এমন না যে প্রযুক্তির উন্নয়নের বিরুদ্ধে। উল্টোটাই বরং। প্রযুক্তির লাইনেই তো আমার দক্ষতা, বড় বড় কলেজ-ভার্সিটিতে না পড়েও কেবল টেকনোলজির জ্ঞানের জোরে আর আপনাদের দোয়ায় আমি দুপয়সা রোজগার করতে শিখেছি। সে যাকগে, কিন্তু ওই নিখুঁত চুল-দাঁত-ত্বকের রোবটদের চেহারা, অঙ্গভঙ্গি, কথা বলার ধরন, হাসি সবই আমার অপছন্দ। কেমন সৃষ্টিছাড়া, কেমন বিজাতীয়, কৃত্রিম। বয়স যখন কম ছিল, দুঃস্বপ্ন দেখতাম যে আমার বিছানার পাশে ইম্যাকুলেট কোম্পানির নতুন মডেলের একটা রোবট দাঁড়িয়ে ঝুঁকে আছে আমার ওপর, মুখে একটা বিকট হাসি ঝুলিয়ে। ভয়ংকর।
এখনকার দিনে রাস্তাঘাটের বেরোলে অবশ্য রোবট আর অ্যান্ড্রয়েডদের মুখ না দেখে থাকার কোনো উপায় নেই। মেট্রোর টিকিট বিক্রি করছে অপটিমা কোম্পানির ‘তরুণী’ অ্যান্ড্রয়েড। এই যে এখনই পাশ দিয়ে গেল অপটিমা কোম্পানিরই এ-৩৫ মডেলের একটা। কাছেপিঠে কোনো ফাস্ট ফুডের দোকানে খেতে গেলে নকল আন্তরিকতা দেখিয়ে অর্ডার নিতে আসবে কোনো ই-৪৩১ মডেলের কেউ। উফ, অসহ্য! সাধে কি পারতপক্ষে বেরোই না আমি বাসা থেকে?
আমার গন্তব্যের একদম কাছাকাছি চলে এসেছি অবশ্য। সেটার দিকে চোখ পড়তেই হেসে ফেললাম আরেকবার, এবারে দাঁত কেলিয়ে। চারপাশে সব ৮০-১০০-১৫০ তলা ধাতব বা কাচের দালান, তার মাঝে কেমন বোকা বোকা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মোটে তলা দশেক উঁচু একটা কংক্রিটের আদ্যিকালের ভবন। নিচতলায় প্রবেশপথের ওপর একটা আরও বেশি প্রাচীন সাইনবোর্ডের ওপর লেখা: তদন্ত বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়।
সরকারের কাছ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করি আমি, আমার কাজের ধরনটাই অমন। তাদের নিয়ে বাড়তি কোনো আগ্রহও নেই সত্যি বলতে। এত দিন তাদের ব্যাপারে তেমন কোনো খবর রাখতাম না। তবে সপ্তাহ দুয়েক আগে যখন আমাকে জেরা করার জন্য তলব করল অর্থ মন্ত্রণালয়, তখন টনক নড়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত বিভাগ নিয়ে একটু ভালোমতো খোঁজখবর করতে গিয়ে হাসি পেয়েছে আমার। মাত্র অল্প কয়েকজন লোক কাজ করে, কাজকর্মের পরিধিও ছোট, কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বরাদ্দ নেয় প্রচুর এবং সেটা কেবল বাড়ছেই। এই যেমন গত বছর টাকা নিয়েছে আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ! বুঝুন অবস্থা। অর্থ মন্ত্রণালয় যে দুর্নীতির পসরা বসিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ করেও বিল্ডিংয়ের এই দশা—ভেবে আরেক দফা হেসে নিলাম আমি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলাম লবিতে। নির্লিপ্ত চেহারার এক সিকিউরিটি গার্ড মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে আমাকে চেক করার সময় খালি একবার ভুরু উঁচিয়ে জানান দিল যে সে রোবট নয়—যখন আমার কোটের পকেটের কাছে বিপ বিপ করে উঠল ডিটেক্টরটা। পকেটে স্রেফ একটা নিরীহ কলম আছে দেখে আবার ভাবলেশহীন চেহারায় ফিরে গেল সে।
রিসেপশন ডেস্কে বসে ঝিমোচ্ছিল এক টেকো বুড়ো। তাকে তলবের চিঠিটা দেখালাম স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। ‘পাঁচ তলায়, ৫০১ নম্বর রুম,’ ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠে বলল সে।
লিফটে করে চল এলাম পাঁচতলায়। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে নিতে ভুললাম না একবার, সময়মতোই এসেছি। করিডরের শুরুতেই ৫০১, দরজা খুলে ঢুকলাম। খুব বড় নয় ঘরটা, মাঝখানে পাতা লম্বা টেবিলটার ওপাশে বসে আছে স্যুট-টাই পরা তিন লোক। সন্দেহ নেই, এরাই জেরা করবে আমাকে।
মধুর একটা হাসি হেসে মামুলি সম্ভাষণবাক্য আওড়ালাম। আসল কাজ করছে আমার চোখ, মেপে নিচ্ছে লোক তিনটাকে। বাঁয়ের জন অতিরিক্ত ঢ্যাঙা, মাঝের জন অতিরিক্ত শুকনা; দুজনের মাঝে মিল হচ্ছে তাদের গোমড়া মুখ। ডানের জন মোটাও না শুকনাও না, ঢ্যাঙাও না বেঁটেও না; কিন্তু নির্বোধের মতো একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে মুখে। আমার সম্ভাষণ শুনে বাকি দুজন ভদ্রতা করে কেবল মাথা নাড়লেও ৩ নম্বর লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল ছেড়ে এসে একেবারে হ্যান্ডশেকই করে বসল আমার সঙ্গে। যাকে জেরা করার জন্য বসেছে তার সঙ্গে কেউ এমন করে নাকি? সন্দেহ নেই, লোকটা বোকাই।
টেবিলের এপারে একটাই চেয়ার পাতা, সেটায় বসতে বলা হলো আমাকে। বসলাম। ঢ্যাঙা লোকটা একটা ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে চোখ কুঁচকে, শুকনা লোকটার সামনে একটা অনেক তারটারওয়ালা জবরজং যন্ত্র। হাসি হাসি লোকটার সামনে কিছু নেই, করার মতো কিছু না পেয়েই বোধ হয় আমার মুখের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে সে।
‘জনাব বদরুল, আপনার বেশি সময় নেব না আমরা,’ শুকনা লোকটা বলতে শুরু করল। বেমানান ভারী কণ্ঠস্বর তার। ‘আমার নাম শরীফ, এনার নাম আলতাফ আর ইনি হচ্ছেন বাকের। আমরা আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব। আসলে আপনার ব্যাপারে তদন্ত করেছে পুলিশ, আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে। তাদের ধারণা, আপনি একজন বিরাট হ্যাকার, ক্রিপ্টোকারেন্সি হ্যাক করাই আপনার পেশা। আ...’
‘বানোয়াট অভিযোগ।’ বলে উঠলাম, ‘আমি একজন স্বাধীন প্রোগ্রামার, ঘরে বসে দেশ-বিদেশের ক্লায়েন্টকে কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে সাহায্য করি। কোনো হ্যাকিংয়ের ব্যাপারে কিছু জানা নেই আমার।’
‘আমরা আপনাকে অভিযুক্ত করছি না, জনাব বদরুল,’ শুকনা লোকটা; অর্থাৎ শরীফ বলল। ‘আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে কাজ করি যেহেতু, আপনার আর্থিক লেনদেনবিষয়ক কয়েকটা প্রশ্ন করব স্রেফ, সেটার ফলাফল পুলিশকে জানাব। আপনি সত্য না মিথ্যা বলছেন, সেটাই আমাদের একমাত্র চিন্তার বিষয়। সেখানে আমাদের সত্য-মিথ্যা নির্ণায়ক যন্ত্রের একটা ভূমিকা আছে।’
‘লাই ডিটেক্টর নাকি?’ অবাক হওয়ার ভান করলাম আমি। মিথ্যা নির্ণয়ের যন্ত্র। ওরা প্রশ্ন করবে, আমি উত্তর দেব আর যন্ত্রটা ধরার চেষ্টা করবে আমি সত্যি বলছি না মিথ্যা। ওর সামনে যে যন্ত্রটা আছে, ওটাই নিশ্চয়ই।
‘জি। এখন, আপনি কিছু মনে না করলে এই যন্ত্রের কয়েকটা টার্মিনাল আপনার শরীরে যুক্ত করব।’
‘বেশ।’ বললাম আমি। আমার হাতের আঙুলে একটা ইলেকট্রোড লাগাল শরীফ, আর বাহুতে একটা কাফ বাঁধল। ব্যস। আমি ভেবেছিলাম অনেক জবরজং যন্ত্র লাগিয়ে অতিষ্ঠ করে ফেলবে আমাকে।
‘আমরা আইনসংগতভাবে আপনাকে জানাতে বাধ্য যে’ বলতে শুরু করল ঢ্যাঙা লোকটা, আলতাফ নাম যার। আরেকটু হলেই হেসে ফেলেছিলাম আমি, অস্বাভাবিক মিহি লোকটার কণ্ঠস্বর। আইনের ধারা আওড়ানোর সুরে বলে চলল, ‘আপনি যা বলবেন সেটা সত্য না মিথ্যা, তা আমরা পরীক্ষা করছি যন্ত্র দ্বারা। আমরা সরকার দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান, যদি আমাদের সামনে মিথ্যে বলেন, তাহলে আমরা আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। আপনার বাসস্থান এবং আপনার ইলেকট্রনিক ডিভাইস তল্লাশি করা হবে তদন্তের সুবিধার্থে। আপনি অবগত আছেন? থাকলে হ্যাঁ বলুন।’
গৎবাঁধা সুরে বললাম, ‘অবগত আছি।’ গ্রেপ্তার আমি আগেও হয়েছি, সমস্যা নেই, কিন্তু ওই যেটা বলল; ইলেকট্রনিক ডিভাইস তল্লাশি, ওটাতেই ভয় আমার। কোনোভাবেই পুলিশের হাতে পড়তে দেওয়া যাবে না ওগুলো। তবে প্রস্তুতি তো নিয়েই এসেছি। দেখা যাক কী হয়।
জেরা শুরু হবে এখন। ল্যাপটপের স্ক্রিন দেখে দেখে প্রশ্ন করবে আলতাফ। শরীফ তাকিয়ে আছে তার সামনের জবরজং লাই ডিটেক্টরের ছোট্ট স্ক্রিনে। স্ক্রিনটা তার দিকে ফেরানো, আমার দেখার কোনো উপায় নেই। বাকের নামের লোকটা সেই আদ্যিকালের মতো একটা নোটবই আর কলম নিয়ে বসেছে বটে, তবে আমার দিকে হাসিমুখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার আর কোনো কাজ আছে বলে মনে হচ্ছে না।
আলতাফ বলতে শুরু করল, ‘বদরুল সাহেব, আপনাকে প্রথমে কয়েকটা সাধারণ প্রশ্ন করা হবে। এগুলো নিয়মের মধ্যে পড়ে। প্রথম প্রশ্ন: আপনার নাম কী?’
এই যে শুরুর এই অংশটুকু, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। এর জন্যই রিসার্চ করেছি সপ্তাহ দুয়েক ধরে, প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি।
লাই ডিটেক্টর কী করে? মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্তচাপ, হার্টবিট, ত্বকে ঘামের পরিমাণ মাপতে থাকে। মানুষ যখন সত্য কথা বলে, তখন এই জিনিসগুলো খুব একটা বদলায় না। কিন্তু মিথ্যা বলা একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, শ্বাস-প্রশ্বাসের গভীরতা থেকে শুরু করে হার্টবিট, সবই বাড়িয়ে কমিয়ে দেয়। লাই ডিটেক্টর এটাই ধরে ফেলে।
প্রথম দিকের এই অতি সাধারণ প্রশ্নগুলোর সময়ই যদি নিজের শরীরের এই ক্রিয়াকলাপগুলো বদলে দিতে পারি, তাহলে যন্ত্রের মাথাও বিগড়াবে। পরের দিকে আমার মিথ্যাগুলো ধরতে পারবে না বাছাধন। তা ছাড়া স্যুটের নিচে একটা ছোট্ট ইলেকট্রনিক চিপ আমার ত্বকের সঙ্গে লাগানো। কালোবাজার থেকে কেনা এই জিনিস নাকি দারুণ কার্যকর, লাই ডিটেক্টরকে বোকা বানাতে এর জুড়ি নেই।
এই যেমন এখন, আলতাফ প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের জিবের ওপর একটা কামড় বসিয়ে দিয়েছি আমি। অন্য সময় হলে ব্যথায় চেঁচিয়েই উঠতাম, কিন্তু এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক রেখেছি চেহারাটা। কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে বললাম, ‘আমার নাম বদরুল আনোয়ার।’
আড়চোখে শরীফের দিকে তাকালাম। ভুরু কুঁচকে লাই ডিটেক্টরের স্ক্রিন দেখছে সে। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসির ভঙ্গি করে বলল, ‘আপনি বোধ হয় একটু নার্ভাস বোধ করছেন। কোনো ভয় নেই। আপনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করুন।’
প্রায় ১০ বিলিয়ন ইউনিট ক্রিপ্টোকারেন্সি মুদ্রা হ্যাকিংয়ের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে, আর আমাকে কিনা বলছে ভয় নেই! ধরা পড়লেই কেচ্ছা খতম আমার, চাঁদে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেবে। সারা দিন পাথর খুঁড়তে হবে সেখানকার খনিতে। নাহ, কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না সেটা। মুখে বললাম, ‘আমি স্বাভাবিক আছি।’
‘আপনার জন্মতারিখ বলুন।’ পরের প্রশ্নে গেল আলতাফ।
বললাম। বলতে বলতেই আমার পকেটে ঢোকানো হাতের বুড়ো আঙুলটা দাবিয়ে ধরলাম বলপেনটার চোখা মাথায়। চিনতে পেরেছেন? এটা সেই বলপেন, যেটা সিকিউরিটি চেক করেছিল। হ্যাঁ, এই উদ্দেশ্যেই কলমটা এনেছি আমি সঙ্গে।
‘আপনার ঠিকানা বলুন।’ তার পরের প্রশ্ন। আমি শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিচ্ছি, আর একবার করে আঙুল দাবিয়ে ধরছি কলমের মাথায়। ব্যথার একেকটা ঢেউ বয়ে যাচ্ছে শরীরে, সেই সঙ্গে লাই ডিটেক্টরও পাচ্ছে ভুলভাল তথ্য। আর সেই ইলেকট্রনিক চিপ তো আছেই, আমার মিথ্যাকেও সত্যের মতো দেখাবে।
আরও কয়েকটা প্রশ্ন করে নড়েচড়ে বসল আলতাফ। বুঝলাম, বোকাটে প্রশ্নগুলো শেষ হয়েছে। এবারে আসল খেলা শুরু। শরীফ আমার চালাকির কিছুই টের পায়নি, লাই ডিটেক্টরের স্ক্রিনে চোখ আটকে আছে তার। বাকের? হাবার মতো তাকিয়েই আছে। মাঝে মাঝে কী যেন লিখছে নোটবুকে, তখনো আমার থেকে নজর সরাচ্ছে না।
‘আপনি কি সেই কুখ্যাত হ্যাকার, যার অনলাইনের ছদ্মনাম শিকারি ৯৯৯?’ এতক্ষণ ল্যাপটপ থেকে চোখ সরাচ্ছিল না, এবারে সরাসরি আমার দিকে তাকাল আলতাফ।
অম্লান বদনে বললাম, ‘জি না। এই নামের কাউকে চিনি না।’ পকেটে রাখা কলম থেকে আঙুল সরিয়ে নিয়েছি আমি। যন্ত্রকে বোকা বানানোর কাজ শেষ। হার্টবিট বেশি আমার এখনো—টের পাচ্ছি। তবে সেটাই স্বাভাবিক। সকালে রওনা দেওয়ার আগে টানা তিন কাপ কড়া এসপ্রেসো কফি খেয়ে এসেছি না? ইচ্ছে করেই।
আলতাফ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না, বাকি দুজনও না। লাই ডিটেক্টর নিয়ে জেরা করার ধরনটাই এই অবশ্য। যন্ত্রই যখন কাজ করছে, তখন নিজেরা খাটার দরকার কী। দ্বিতীয় প্রশ্ন: ‘তিন মাস আগে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রা চুরির ঘটনা কি আপনিই ঘটিয়েছেন?’
‘অবশ্যই না।’ চটজলদি জবাব আমার। পরের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতেও সময় নিলাম না। মুদ্রাগুলোকে মঙ্গল গ্রহের অমুক ব্যাংকে কি ট্রান্সফার করেছি আমি? না। এর আগে বিভিন্ন কোম্পানিকে বিপুল অঙ্কের ট্যাক্স ফাঁকি দিতে সাহায্য কি আমিই করেছিলাম? না। আমি কি টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হ্যাক করি? আমার নামে পুলিশের অনলাইন তথ্যভান্ডারের তথ্য কি আমিই হ্যাক করে মুছে দিয়েছি? শেয়ারবাজারে যে ধস নেমেছিল দুই বছর আগে, সেটা কি আমার পরিকল্পিত হ্যাকিংয়ের কারণেই নয়? না, না এবং না।
ভেবেছিলাম, কয়েক ঘণ্টা ধরে চলবে এই ক্লান্তিকর ইঁদুর-বিড়াল খেলা। আমাকে অবাক করে দিয়ে এই কটা প্রশ্নের পরই চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল আলতাফ। শরীফের ভাবভঙ্গিও ঢিলেঢালা। তবে বাকের ওই রকমই রইল, এতক্ষণ যেভাবে দেখেছি।
‘আপনার জেরা শেষ হয়েছে।’ মিহি কণ্ঠে বলল আলতাফ।
‘ধন্যবাদ। এবার কি আমি আসতে পারি?’ একটা মুচকি হাসি হেসে বললাম আমি।
জবাবে এবারে মিষ্টি করে হাসল শরীফ। ‘আপনাকে প্রথমে যা বলেছিলাম তা মনে আছে তো? আমাদের যন্ত্রে মিথ্যা ধরা পড়লে আপনাকে সোজা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে?’
‘হ্যাঁ,’ অধৈর্য কণ্ঠে বললাম আমি। এত দেরি কিসের? আমাকে ছেড়ে দিক, চলে যাই। লাই ডিটেক্টর যে বোকা বনেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার টেকনিকগুলো কাজে না লাগলেও ইলেকট্রনিক চিপ ভুল করতে পারে না।
আমার পেছনে দরজা খোলার শব্দ হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, দুজন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ অফিসার এসে ঢুকেছে ঘরে। চোখমুখ শক্ত করে রেখেছে দুজনই। একজন তার বেল্টে ঝোলানো হাতকড়াটা খুলে হাতে নিল এইমাত্র।
‘এসব কী হচ্ছে?’ রেগে উঠতে শুরু করেছি আমি, কণ্ঠস্বর চড়ে গেছে কয়েক পর্দা।
‘শুরুর প্রশ্নগুলো বাদে বাকি সব কটি প্রশ্নের জবাবে মিথ্যা বলেছেন আপনি, জনাব বদরুল ওরফে শিকারি ৯৯৯,’ শরীফ শান্ত কণ্ঠে বলল। ‘আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে এখন। আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক আপনার ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো তল্লাশি করলেই আপনার হ্যাকিংয়ের আলামত পাওয়া যাবে সব—আমাদের এটাই ধারণা।’
থ হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম আমি, তারপরই ফেটে পড়লাম। ‘অসম্ভব! আমাকে আপনারা গ্রেপ্তার করতে পারেন না কোনোভাবেই। আপনাদের যন্ত্র ভুল করেছে!’
মুচকি হাসল শরীফ। ‘মানে বলতে চাইছেন, আপনি তো যন্ত্রকে বোকা বানানোর সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন, তাই যন্ত্র আপনার মিথ্যা ধরতে পারার কথা নয়। কিন্তু পেরেছে, জনাব বদরুল।’
‘অসম্ভব!’ দাঁতে দাঁত পিষে বললাম আমি, একটা আঙুল তুললাম টেবিলের ওপর বসানো পুরোনো মডেলের জবরজং যন্ত্রটার দিকে। ‘এই যন্ত্রের বাপের ক্ষমতা নেই আমাকে টেক্কা দেওয়ার। এই আদ্যিকালের লাই ডিটেক্টর একটা বাতিল চিজ!’
এবারে স্পষ্ট বিস্ময় ফুটল শরীফের চেহারায়। ‘কোনটা লাই ডিটেক্টর? আমার সামনের এটা? এই যন্ত্র দিয়ে তো শুধু আপনার ব্লাডপ্রেশার আর হার্ট রেট মাপা হচ্ছে। এটাও আদালতের নির্দেশ, লাই ডিটেক্টর দিয়ে জেরা করার সময় সন্দেহভাজনের যেন কোনো শারীরিক সমস্যা না দেখা দেয়, সে জন্য করতে হয়।’
আমি ঘামছি এবারে কুলকুল করে। অসাড় মুখে বললাম, ‘এটা যদি লাই ডিটেক্টর না হয়, তাহলে...’
ঘরের সব কটি চোখ ঘুরে গেল টেবিলের কোনায় বসা বাকেরের দিকে। মুচকি একটা হাসি দিল লোকটা, যেন উপভোগ করছে সবার এই মনোযোগ।
‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত বিভাগের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে দামি সংযোজন, বাকের মডেলের এই অ্যান্ড্রয়েড রোবট কোনো সন্দেহভাজনের দিকে কেবল তাকিয়ে থেকেই মিথ্যা ধরে ফেলতে পারে। আদি যুগের লাই ডিটেক্টরের মতো হাতুড়ে পদ্ধতিতে নয়, মানুষের চোখ দেখে সরাসরি ব্রেইন ওয়েভ পড়ে ফেলতে পারে এ। কোনো আলাদা সেন্সরের প্রয়োজন হয় না, কারও চোখের দিকে টানা তাকিয়ে থাকলেই ধরতে পারে সত্য না মিথ্যা বলছে। তারপর সেটা সরাসরি পাঠায় আমার এই ল্যাপটপে।’ আলতাফ বলল তার অস্বাভাবিক মিহি গলায়।
চোখের ওপর হাত চাপা দিলাম আমি, বাকেরের থেকে আমার দৃষ্টি আড়াল করতে নয়, ক্লান্তিতে। আমার সব জারিজুরি তো ইতিমধ্যেই ফাঁস হয়ে গেছে। বিড়বিড় করে বললাম, ‘এই লাই ডিটেক্টর রোবট বানাতেই গত বছর অতগুলো টাকা বাজেট লেগেছে, তাই না?’ সেই খবরটার কথা ভাবছি আমি।
‘আপনার ধারণা সঠিক।’ শরীফ বলল। ‘আর আপনার সঙ্গে শুরুতে যে হ্যান্ডশেক করল, সেটাও বিনা কারণে নয়। আপনার ডিএনএ পরীক্ষা করে পরিচয় শনাক্ত করে ফেলেছে সে ততক্ষণে।’
পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে আমাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার আগে প্রথম আর শেষবারের মতো মুখ খুলল বাকের। ‘পুলিশ অফিসার সাহেব, ওনার ডান হাতের আঙুলে একটু আয়োডিন লাগিয়ে দেবেন। কলমের ডগায় খোঁচা দিতে গিয়ে ছড়ে গেছে আঙুলটা।’
উফ, কী মেকি সহানুভূতি! গরু মেরে জুতা দান। সাধে কি আর আমি রোবট দুচোখে দেখতে পারি না, বলুন!