কিন্তু সবই বড় বড় বাসা। ছোট বাসা নেই বললেই চলে। খুঁজে পেতে রাফি একটা বাসা পেল দুই রুমের, ছোট্ট একটা বাসা। ভাড়া সাত হাজার। বাড়িওয়ালা জিজ্ঞেস করল,
‘কে ভাড়া নেবে?’
‘আমরা।’
‘আমরা মানে?’
‘মানে আমি আর আমার আপু।’
‘তোমার মা-বাবা কই?’
‘তাঁরা মারা গেছেন।’
‘তোমার আপু কী করে?’
‘অ্যাঁ...ইয়ে চাকরি করে।’
‘কোথায় চাকরি করে?’
‘একটা অফিসে...’
‘অফিসে তো সবাই চাকরি করে, অফিসের নাম কী?’
‘আপু জানে।’
‘তোমার আপুর বিয়ে হইছে?’
‘অ্যাঁ ইয়ে হ্যাঁ না...’
‘এমনে হইব না। তোমার আপুরে নিয়া আইসো। আর তিন মাসের অ্যাডভান্স নিয়া আসবা...যাও।’
হতাশ হয়ে বের হয়ে এল রাফি। উফ্! লোকটা এত প্রশ্ন করে। বেশ ক্ষুধাও লেগেছে রাফির। রাস্তার পাশের একটা দোকানে গরম গরম শিঙাড়া ভাজছিল। পাঁচ টাকা করে, একটা কিনল সে। শিঙাড়া অর্ধেকটাও বোধ হয় খেয়ে শেষ করেনি, হঠাৎ কে যেন খপ করে তার আধখাওয়া শিঙাড়া ধরা হাতটা চেপে ধরল। শিঙাড়াটা ছিটকে পড়ল হাত থেকে। তাকিয়ে দেখে আপুর সেই বদ দেবর—বরকত। বুকটা ধক করে উঠল। এখন কী হবে!
‘পাইছি তোরে। তোর বইন কই?’
‘কেন?’
‘বাসায় চল। তারপর তোর কেনর জবাব পাবি। চল হারামজাদা।’
‘হাত ছাড়েন।’
‘চল কইতাছি।’
একটা হেঁচকা টান দিয়ে দোকানের বেঞ্চ থেকে রাফিকে উঠিয়ে বাইরে আনে বরকত।
‘হাত ছাড়েন বলছি।’ চেঁচিয়ে ওঠে রাফি।
‘একটা থাপ্পড় দিমু কইতাছি।’
হাত ওঠায় বরকত। তখন আগুপিছ কিছু না ভেবে রাফি হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ছেলেধরা! ছেলেধরা!’ সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমে যায় ওদের চারপাশে। একটা মুশকো টাইপের লোক বরকতের কলার চেপে ধরে। কে যেন পাশ থেকে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসে বরকতকে। হকচকিয়ে যায় বরকত, ছেড়ে দেয় রাফিকে। সে এখন নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু আশপাশ থেকে চড়থাপ্পড়ের কারণে বলতে পারছে না। ওই ফাঁকে রাফি ছুটে বেরিয়ে গেল। একছুটে সোজা ওদের হোটেলের সামনে এসে হাঁপাতে থাকে।
হোটেলে ওদের রুমে ঢুকে দেখে আরেক অবাক কাণ্ড। ওদের রুমে আপুর সঙ্গে তার বান্ধবী ইসমাত বসে আছে।
রাফিকে দেখে আপু বলল,
‘দেখ রাফি, ইসমাত আমাদের খুঁজে বের করেছে।’
‘তিন দিন ধরে প্রতিটা হোটেলে খুঁজছি আমি তোদের। এখন চল।’
‘কোথায়?’
‘এবার আমার মায়ের বাসায় উঠবি তোরা।’
‘না রে, এখানেই ভালো আছি। তোদের আর বিরক্ত করতে চাচ্ছি না।’
‘আমি কোনো কথা শুনব না। ওই দিন যেটা ঘটেছে, সেটা নিয়ে পরে কথা বলব। এখন তোদের আমি নিয়েই যাব। আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে।’
‘না রে ইসমাত, প্লিজ...!’
‘একটা বিশেষ কারণে যাবি আমার সঙ্গে।’ এবার মনে হলো, ইসমাত আপু খুবই গম্ভীর।
‘কী কারণ?’
‘তুই তো নিশ্চয়ই হোটেলে হোটেলে জীবন কাটাবি না। আমি তোর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি। সেই কারণে তুই আমার সঙ্গে যাবি।’
শেষ পর্যন্ত ইসমাত আপুর গাড়িতে করে ওনার বাবার বাসায় এসে হাজির হলো ওরা। ইসমাত আপুর বাবা নেই। মা আছেন। তাঁকে খুবই কর্মঠ মহিলা বলে মনে হলো। খাওয়াদাওয়া বিশ্রামের পর সরাসরি কাজের কথায় এলেন উনি।
‘তোমার সম্পর্কে ইসমাত আমাকে সব বলেছে।’
‘জি।’
‘আমি তোমার জন্য একটা চাকরি ঠিক করেছি। সেটা অবশ্য ঢাকায় নয়। ইদ্রাকপুরে। সোমনাথ নদের পাশে একটা ছোট্ট মফস্সল শহর। ওখানে আমার একটা এনজিও আছে। ওখানে তুমি কাজ করবে। আপত্তি আছে?’
‘জি না, কোনো আপত্তি নেই। এনজিওটার নাম কী?’
‘উইমেন কনসার্ন ফাউন্ডেশন। আমরা সাধারণত বিপদগ্রস্ত মেয়েদের নিয়ে কাজ করি।’
‘জি। অবশ্যই আমি কাজ করব আপনার সঙ্গে।’
‘ভেরি গুড। কাল আমি ওখানে যাব। তোমরা দুজনও আমার সঙ্গে যাবে।’
রাফি তাকিয়ে দেখে, আপুর মুখে বেশ খুশি খুশি ভাব। তাহলে কি তাদের বিপদের দিন শেষ হতে যাচ্ছে? ঢাকায় না থাকাই বরং ভালো। এখানে থাকলে আবার যদি বরকতের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়? ওহ আপুকে তো বরকতের কথা বলাই হয়নি!
ইদ্রাকপুরে ‘উইমেন কনসার্ন ফাউন্ডেশন’ এনজিওতে রাফির আপু এখন কাজ করে। সে এখানে আপাতত একজন প্রোগাম অফিসার। বেশ ভালো একটা পোস্টেই আছে আপু। বেতনও বেশ ভালোই। তারা একটা ছোট্ট বাসায় থাকে। বাসাটা ইসমাত আপুর মা-ই ঠিক করে দিয়েছেন। রাফি ভর্তি হয়েছে মফিদুল বয়েজ হাইস্কুলে। ফাহাদ, মহিন্দ্র, ফজলু , রনি মোটামুটি তার বেস্ট ফ্রেন্ড, স্কুলের মাঠে তারা প্রায়ই অন্যদের সঙ্গে ভলিবল খেলে। যেদিন সিনিয়ররা বল নিয়ে যায় ফুটবল খেলতে, সেদিন তারা টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলে। নইলে সোমনাথ নদের পাড়ে আড্ডা দেয়। মাঝেমধ্যে খালি মাঠে ফাহাদ ওদের কারাতের কিছু টুকটাক কৌশল শেখায়। ওরা আগ্রহ নিয়ে শেখে। সময়টা খারাপ কাটে না ওদের।
সেদিন ছিল সোমবার। মহিন্দ্র আর রনি দুজনই বাসায় চলে গেছে, মহিন্দ্র কোচিং করে। আর রনি বাবার সঙ্গে কোথায় যেন যাবে। ফাহাদ রাফিকে বলল, ‘চল, আজ অন্য একটা জায়গায় যাই।’
‘কোথায়?’
‘গেলেই দেখতে পাবি।’
‘চল।’
একটা মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে ওরা, পাশের সেগুনবাগান থেকে শরশর শব্দে বাতাস ধেয়ে আসছে, বেশ সুন্দর পরিবেশ।
‘পাশের গাছগুলো দেখ, এটা সেগুনবাগান। সরকারি প্রজেক্ট। গাছগুলো কী বিশাল দেখেছিস!’
‘হু, সত্যি কি সুন্দর।’ রাফি সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যায়।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ফাহাদ।
‘কী হলো?’ রাফি জিজ্ঞেস করে।
‘তুই কখনো মারামারি করেছিস?’
‘কেন? এ প্রশ্ন করছিস কেন?’
‘আহ, বল না।’
‘করেছি। স্কুলে আমাদের একটা অ্যান্টিপার্টি ছিল। ওদের সঙ্গে প্রায়ই মারামারি লাগত।’
‘ভালো। শোন, সামনে দেখ, চার-পাঁচটা ছেলে বড় গাছটার আড়ালে ঘাপটি মেরে আছে। শুঁটকাটা হচ্ছে ওদের নেতা। তুই ওর পায়ে আঘাত করবি।’
‘কীভাবে?’
‘কেন, সেদিন শেখালাম না? হঠাৎ বসে পড়ে কীভাবে ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ডান পা দিয়ে ডান পায়ের হাঁটুতে আঘাত করতে হয়। মনে আছে?’
‘আছে, একটু একটু।’
‘ওই একটু একটুতেই হবে। ওই ছোড়ার বেশি শক্তি নেই। কদিন আগেই ওদের পিটিয়েছিলাম, এরা টেম্পার অ্যাকশন ক্লাবের সদস্য। পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সব কটাকে; এখন মনে হচ্ছে, জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে।’
রাফির বুকটা ধক ধক করছে। পারবে তো সে?
তবে পুরো ব্যাপারটা খুব দ্রুতই ঘটে গেল। যথারীতি ওরা চার-পাঁচজন ঘিরে ধরল ওদের। ফাহাদ একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে সহজ গলায় বলল,
‘কী রে, আবার মার খেতে এসেছিস?’ তারপর শিসের মতো একটা শব্দ করল।
সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ে পা চালাল রাফি, এমনটাই কথা ছিল। তবে একটু ভুল হয়ে গেল। ডান পা দিয়ে আঘাত করল বাঁ পায়ে, ঠিক ৩৬০ ডিগ্রিও হলো না, তবে আঘাতটা ঠিক জায়গায় লাগল। তাতেই কাজ হলো। শুটকা ছেলেটা হুমড়ি খেয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ল। খুব সম্ভবত ওর ওই পায়ে সমস্যা ছিল, ফাহাদ সেটা জানে। আর বাকি তিনজনকে মুহূর্তে পেড়ে ফেলল ফাহাদ একাই। ফাহাদ যে এত দুর্দান্ত কারাতে জানে, রাফি এই প্রথম স্বচক্ষে দেখল আর জানল। তবে বাকি তিনজনই খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনোরকমে পালাল। পথের ওপর পড়ে রইল ওদের তিনটা ছুরি। ফাহাদ শুটকাটাকে ধরে পাশের সেগুনবাগানের ভেতর ঢুকে পড়ল। ওর বেল্ট দিয়ে একটা গাছের সঙ্গে আটকে ফেলল। শুটকার অবস্থা তখন কেরোসিন।
‘কী রে, জামিনে ছাড়া পেলি কবে?’
‘গত সপ্তাহে।’ চিঁ চিঁ করে বলল শুটকা।
‘জামিনে বের হয়েই আবার শুরু করে দিয়েছিস? শিক্ষা হয়নি তোদের?’
‘আর করব না। কথা দিচ্ছি।’
‘আচ্ছা বল তো, তোদের পেছনে কে আছে?’
‘কেউ না...আর করব না এসব।’
‘বল, তোদের পেছনে কে কে আছে?’ বলে একটা গাছের ডাল তুলে নিল ফাহাদ। ‘জলদি বল।’
‘জগলুল ভাই।’
‘এলাকার কাউন্সিলর?’
‘হুঁ।’
‘সে তোদের দিয়ে চাঁদাবাজি করায়?’
‘হুঁ। পার্সেন্টেজ দিতে হয়।’
‘কে কাকে পার্সেন্টেজ দেয়?’
‘উনি দেন।’
‘কাউন্সিলর?’
‘হুঁ।’
‘আর কী করে সে?’
‘ড্রাগের ব্যবসা আছে। পাথরের ব্যবসা আছে। নদী থেকে পাথর তোলেন...’
এই পর্যায়ে ফাহাদ শুটকার পকেট থেকে ওর মুঠোফোনটা নিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে। ভেতরে ভয়ংকর সব ছবির মধ্যে হঠাৎ একটা মেয়ের ছবি। ছবি না, ভিডিও! মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও।’
‘আরে, এ তো পলি।’ আঁতকে ওঠে ফাহাদ।
‘মেয়েটাকে চিনিস?’ রাফি বলে।
‘চিনি। ঢাকায় আমাদের পাশের বাসায় কাজ করত, ব্যারিস্টার আফসান চৌধুরীর বাসায়। ওকে অনেকবার দেখেছি। এই পলির ছবি এখানে কেন?’
‘কাল বিকেলে ওরে ধরছে ওরা।’
‘মেয়েটাকে কী করবে?’
‘মনে হয় পাচার করবে।’
‘ওরা কারা?’
‘ওই যে, জগলুল আঙ্কেলের লোকজন। আমারে কইল ভিডিও তুইলা রাখতে।’
‘এই মেয়ে এখন কোথায়?’
‘জানি না। গত পরশু ধরছে ওরে। মেয়েটা ঢাকা থাইকা আসতেছিল...’
শেষ পর্যন্ত শুটকাকে দিয়ে একটা বেশ বড়সড় মুচলেকা লেখানো হলো। কাগজ রাফির পকেটেই ছিল। কলম ছিল ফাহাদের পকেটে। মুচলেকাটা হলো এ রকম -
‘আমি রফিকুল আলম, ওরফে চিন্টু। আর কখনো টেম্পার অ্যাকশন ক্লাবের হয়ে কোনো খারাপ কাজ করব না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি আমার ক্লাবের দলবল নিয়ে সবাই ভালো হয়ে যাব। যদি আবার কোনো খারাপ কাজ করি, তাহলে এই মুচলেকাপত্র থানায় জমা দেওয়া হবে...’ ইত্যাদি, ইত্যাদি...
ফাহাদ একটা কাজ করল। পলিকে ওরা কোথায় ভিডিও করেছে, কোথায় পাওয়া যেতে পারে মেয়েটাকে, কোথায় পাচার করবে…সব জেনে নিল যতটা পারে। আর ফোনটা রেখে দিল প্রমাণ হিসেবে।
‘সত্যি কইতাছি আমি ভালো হয়া যাব। ফোনটা দিয়া দাও। বসে ফোন দিতে পারে।’ বলল শুটকা।
‘কোন বস?’
‘ওই যে, জগলুল আঙ্কেলের লোকজন।’
‘না, ফোন দেব না। আগে দেখি, তুমি ভালো হতে পারছ কি না। আর শোনো…’
‘কী?’
‘পলিকে যেভাবে হোক আমি উদ্ধার করবই। যদি এর মধ্যে তুমি ঝামেলা করো...’
‘না, আমি ঝামেলা করব না। আমি খালি ভিডিও করছি, আর কিছুই জানি না। ওরে কোথায় নিছে কী করছে...’
চলবে...