আর ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে চোখের ব্লাইন্ডফোল্ডটা খুলেই ফেললাম। নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা অচেনা ঘরে; খাটের পাশে একটা ইজিচেয়ারে বসা আমি। চিরপরিচিত সেই পারফিউমের সুবাসে টের পেলাম, রুমটা বন্ধু অমির হতে পারে। আগে কখনো আসা হয়নি ওদের বাসায়। ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত ৯টা বেজে গেছে। অর্থাৎ দেড় ঘণ্টা ধরে এই ধৈর্যের পরীক্ষায় টিকে আছি আমি। তাই শেষমেশ আর থাকতে না পেরে চোখ খুলে ফেলার দোষে অপরাধবোধ অনুভব করার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না। যতটুকু আন্দাজ করতে পেরেছি, আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় এখানে নিয়ে এসে বদ্ধ ঘরে বসিয়ে রেখে ওরা আমার জন্মদিনের সারপ্রাইজ পার্টির প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ হলো, কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। পুরো ঘর নিস্তব্ধ। হঠাৎ নিজের ফোনটা বেজে ওঠার আওয়াজে নিজেই চমকে উঠলাম। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে রিসিভ করতেই আলিনার কাঁপা গলা শোনা গেল,
—হ-হ্যালো আইরিন?
—দোস্ত সব ঠিক আছে তো?
—কী করব আমি?
আলিনা কাঁদো কাঁদো গলায় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কেটে গেল ফোনটা। একটা চাপা আতঙ্ক চেপে বসল আমার বুকে। ফোনে স্পষ্ট শুনতে পেলাম অ্যাম্বুলেন্স আর মানুষের কোলাহলের আওয়াজ। কী করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎ চোখ পড়ল রুমের এক প্রান্তে থাকা বড় জানালাটার দিকে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলেও রুমের লাইট জ্বালানো থাকায় ওই আলোয় জানালার বাইরে দাঁড়ানো অমিকে দেখতে পেয়ে একটু স্বস্তি বোধ করলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ছেলেটার সঙ্গে অনেক দিন হয়েছে দেখা হয়নি। তার চিরচেনা সুন্দর হাসিটা ঠিকই লেগে আছে মুখে, কিন্তু তবু কেন যেন একটা ফ্যাকাশে ভাব। সাধারণের চেয়ে আজ একটু বেশি ফরসা দেখাচ্ছে ওর গায়ের রং, যেন রক্তশূন্য। ওর দিকে এগিয়ে যাব, এমন সময় ফোনটা আবার বেজে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি করে রিসিভ করলাম, ‘হ্যালো আলিনা!’
কয়েক সেকেন্ড ওইপাশ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। এরপর আলিনা শীতল কণ্ঠে বলল, ‘দোস্ত, তুই আজকের রাতটা ওই ঘরেই থাক। সরি রে, আমি এই মুহূর্তে কাউকে ঘরের দরজা খোলার জন্য পাঠাতে পারছি না। কাল সকালে তোকে ওখান থেকে নিয়ে আসব। তখন সব বলব। তুই ভয় পাবি না।’
—তোরা কোথায়? কী হয়েছে?
—সব বলব, কিন্তু আপাতত তুই নিশ্চিন্তে একটা রাত একটু ওখানে থাক।
—তুই কী বলছিস, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি তো এখন অমির সঙ্গে আছি। তোরা কোথায়?
—অমির সঙ্গে? আলিনার কণ্ঠে অদ্ভুত এক বিস্ময় ফুটে উঠল।
—হ্যাঁ, একটু হাসলাম আমি। ‘ওই যে জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। গাধা একটা।’ অমি হাসিমুখে জানালার বন্ধ কাচে টোকা দিয়ে আমাকে জানালা খোলার জন্য ইশারা করল।
—আইরিন, তুই এই মুহূর্তে আমার নতুন ফ্ল্যাটে আছিস। বিল্ডিংয়ের ১২ তলায়, আইরিন।
ভয়ার্ত কণ্ঠে কোনোরকমে শব্দগুলো বের হলো আলিনার মুখ থেকে। সে আর কিছু বলল না, অথবা হয়তো বলার সুযোগ পেল না। কিছু মানুষের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি ওপাশ থেকে। জানালার দিকে তাকালাম। অমিকে আরও বেশি অন্য রকম দেখাচ্ছে। সে অনেকটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। হাতের তালু দিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো আঘাত করে চলেছে জানালার কাচে। আমার শরীরটা জমে আসছে। হাত–পা কাজ করছে না। ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল মেঝেতে। এখনো ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে আর্তনাদ আর কান্নার আওয়াজ আসছে। একটা কণ্ঠ আমার অনেক চেনা। অমির মা। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ফোনটা কেটে যাওয়ার পর একটা নোটিফিকেশন ভেসে উঠল স্ক্রিনে। রিমার মেসেজটা পড়লাম একটু চোখ বুলিয়েই, ‘এই, অমি নাকি রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে? জানিস কিছু? জানলে আমাকে একটু বল না কোথায় আসব?’
আমার হাত–পা শীতল হয়ে এল। অমির চোখে পানি। সে অনবরত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে জানালার কাচে। তার মতো অসহায় মানুষ যেন এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই।...মানুষ?