কুকুরের প্রদর্শনীতে

হঠাৎ নিজের দু দুটি বন্ধুকে হারানো যে কী কষ্টের তা যদি জানতে। পুরনো চেনা মানুষটার কাছ দিয়ে যাবার সময় নির্বিকার ভাব ফোটানো যে কী কঠিন! আরো খারাপ এই যে দ্বিতীয় বন্ধুটি গেল নিজের দোষেই।

বন্ধুটি যে কী চমৎকার ছিল তা যদি জানতে! তার সঙ্গে প্রথম দেখা পাইওনিয়র শিবিরের পেছনে ভলগুশা নদী যেখানে হাঁসুলির মতো বাঁক নিয়েছে সেই তীরে। চান করতে গিয়েছিল বরকা, ফিরল একটা ভেজা, কম্পমান কুকুরের বাচ্চাকে গেঞ্জিতে জড়িয়ে। কুকুরছানাটা নিজেই নদীতে পড়ে গিয়েছিল নাকি নির্দয় গৃহস্বামী তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল কে জানে। ন্যাকড়ার মতো নরম কান আর সুবোধসুশীল স্বভাবের জন্যে ছেলেরা ওর নাম দিয়েছিল তিয়াপা। বরকার ভয় ছিল, কুকুরছানাটা উচু জাতের নয় বলে বাবার হয়ত ভালো লাগবে না, কিন্তু স্মেলভ কর্তা বললেন রাস্তার কুকুরই সবচেয়ে মানুষের নেওটা।

বেড়ে উঠল তিয়াপা, মুখটা খানিকটা লম্বাটে হয়ে উঠল: বোঝা গেল ওর পূর্বপুরুষদের কেউ ছিল স্পিৎস জাতের কুকুর। কানদুটো কোনাচে হয়ে খাড়া হয়ে উঠল, নরম ঢেউ দেখা গেল তার গায়ের শাদা লোমে। সে যে কী সুন্দর! ভারি সূক্ষ্ম বোধ ছিল কুকুরটার - অচিরেই বুঝে ফেললে রান্নাঘরে গিন্নির পায়ে পায়ে ঘোরা বারণ, বরকা যখন সবুজ বাতিটার সম্মুখে বই নিয়ে বসে তখন তার কাছে গিয়ে ভর করা উচিত নয়। তার যদি কিছু দরকার হত তাহলে প্রভুর মুখের দিকে সে জ্বলজ্বলে গাঢ় বাদামী চোখে চেয়ে থাকত, মনোযোগ আকর্ষণ করত।

এ বাড়িতে ওর ছিল নিজের বিছানা, নিজের পেয়ালা। সংসারের সবকিছু, খুশির উপলক্ষ সে জানত। পিয়ন যখন 'সৈন্যবাহিনী, বিনামূল্য' ছাপ দেওয়া নীল খামটা এনে দিত, তখন লফি ঝাঁপ শুরু করে দিত তিয়াপা, ঘেউ ঘেউ করে ছুটোছুটি লাগাত করিডরে, কিন্তু কেউ তাকে বকত না। সবাই গিয়ে জুটত বড়ো ঘরখানায় আর ইয়ারোস্লাভ ইভানভিচ চশমা চোখে দিয়ে জোরে জোরে পড়ে শোনাতেন বড়ো ছেলে সের্গেইয়ের চিঠি।

আর রবিবার দিন! কী একটা চেনা লক্ষণ দেখে ঠিক বুঝে নিত সে। রবিবার দিনের যেন আলাদা কী একটা গন্ধ, আলাদা একটা ধ্বনি, আলাদা একটা মোহন রঙ।

শীতকালের রবিবার সে যে ঝরঝরে ঝনঝনে এক একটা দিন বরকার স্কিদুটো তখন বরফের আস্তর কেটে পিছলে পিছলে ছুটত ঠান্ডা সূর্যের দিকে, আর আগে আগে ছুটত তিয়াপা, আনন্দের ডাকে তার গলা বাঁজে আসত, গড়াগড়ি দিত যতক্ষণ না স্কি এসে আবার তার সঙ্গ ধরত। তখন লাফ দিয়ে উঠে স্কি'র পাশাপাশি লাফালাফি ছুটোছুটি শুরু হত তার, তাকিয়ে থাকত বরকার চোখের দিকে।

গ্রীষ্মে ইঞ্জিনের ফোঁস ফোঁস, নয়ত ইলেকট্রিক ট্রেনের গুঞ্জন। কোলাহলে ভরা ভিড়াক্রান্ত কামরার মধ্যে সকলের সঙ্গে তিয়াপাও হুড়োহুড়ি করে ঢুকত, শহরতলির স্টেশনে এসে নামত কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, তারপর ছাড়া পেয়েই ছুটত ঝাঁকড়া গোমড়া ফার বনের দিকে।

এখানে সে ছুটোছুটি করত, ডাকত, ভয় দেখাত কাঠবিড়ালী আর পাখিগুলোকে, নয়ত বরকার ছোড়া বলের সন্ধানে নাক গাঁজে বেড়াত ঘাসের মধ্যে।

সকলেই বুঝত তার এত আনন্দ কেন, কার না ভালো লাগে, খোলা হাওয়ায় ফুর্তিতে মাততে।

রাস্তাঘাটে, স্কুলের কাছে বরকাকে দেখতে পেয়ে কী আনন্দেই না পায়ের কাছে কোঁ কোঁ করে একটা শাদা পাটলির মতো লুটোপুটি খেত তিয়াপা। সারা গায়ে আঁচড় কামড়ের দাগ, জায়গায় জায়গায় লোম উঠে গেছে দেখে বেশ বোঝা যেত, ভয়াবহ সব রাস্তাঘাটে, পরের বাড়ির আঙিনার গেটে বড়ো বড়ো কুকুরের মুখে পড়েও যে ঘোরাঘুরি করতে ছাড়েনি, তার জন্যে কতই না সাহস দরকার...

আহ বরকা, তিয়াপার ওপর মায়া ছিল না তোর, আর এখন রাস্তায় রাস্তায় একা একা ঘুরছিস, খেয়ালই নেই যে শরৎ এসে গেছে। চারিদিক রোদে ভরা, পায়ের নিচে মুড়মুড় করে উঠছে পাতা, বাতাসে ঠান্ডা আমেজ, তরমুজ ছালের গন্ধ। কোনটা যে কার চেয়ে বেশি ঝলমলে রঙ্গিন বলা কঠিন: গাছগুলোর মাথা নাকি ফলের দোকানগুলো, নাকি পার্কে পার্কে শেষ মরশুমের ফুল।

রাস্তায় শুধু কুকুরের দিকেই বরকার যত নজর। অদ্ভুত এক জিনিস আবিষ্কার করলে ও। শাদা, কালচে, বাদামী সব কুকুরই সেদিন শিকল বাঁধা হয়ে মনিবদের পাশে পাশে চলেছে কেবল একই দিকে: ট্রাম লাইনের ওপাশের পার্কটায়। "এত কুকুর এল কোত্থেকে?” ভাবলে বরকা।

পাশ দিয়ে গেল একটা বিশালকায় গরবী গ্রেট ডেইন কুকুর, গলায় একটা চ্যাম্পিয়নের সোনার মেডেল ঠুন ঠুন করে বাজছে। কুকুরটাকে নিয়ে চলেছে একটি মোটাসোটা গিন্নি, সঙ্গে একটা বেতের ঝুড়ি যা নিয়ে বাজারে যায় লোকে। তাদের কাছ থেকে একটা সসম্ভ্রম দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে রাস্তার লোকেরা, চারপেয়ে এই আশ্চর্য জন্তুটার প্রতিটি পেশী নিয়ে আলোচনা করে চলেছে তারা। কুকুরটাকে দেখে বরকা এতই তন্ময় হয়ে ছিল যে নজরই করেনি কখন পার্কে এসে হাজির হয়েছে কুকুরের প্রদর্শনীতে।

খোলা মাঠের ওপর পতপত করছে একটা সাদাসবুজ পতাকা, তাতে পাখি আর হরিণের মুণ্ডু আঁকা, নানা গলার ঘেউ ঘেউ ডাক উঠছে চারিদিক থেকে। চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠল বরকার: ইস্ কত কুকুর! টেবলের ধারে বসে আছে বিচারকেরা, তাদরে সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে লম্বা-ঠেঙে বাঁকা চেহারার রুশী শিকারী-কুকুর। একবার ছাড়া পেলেই হয়, তীরের মতো শন শন করে ছুটে যাবে বাতাস কেটে, শিয়াল, খরগোস, নেকড়ে - নাগাল ধরতে পারে সবারই। নাম করা এই রুশী শিকারী-কুকুরকে সমীহ করে কুকুর বিলাসীরা নাম দিয়েছে কুকুর তীরন্দাজ, এদের প্রতিটি কুকুরের ঠিকুজী, তাদের প্রপ্র-পিতামহ পিতামহীদের গোত্র পরিচয় সব এদের নখাগ্রে।

আরও পড়ুন

হয়ত এই কুকুর বিলাসীরা সবাই শিকারী। ওদের ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে এগুতে এগুতেই কুকুর বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠল বরকা। শিকারী-কুকুরের পরে ঝাঁকড়া লোমো বে'টে পায়ের যে কুকুরটাকে দেখে মনে হচ্ছিল হুমড়ি খেয়ে খেয়ে পড়ছে, তার নাম স্প্যানিয়েল, এই নিচু চেহারার স্পেন দেশী কুকুরটার কান ঝুলে পড়েছে একেবারে মাটি পর্যন্ত, অনবরত ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো নড়ে চলেছে খাটো লেজ।

চক্রের মধ্যে দিয়ে চলে গেল আগুনে-লাল আয়ল্যান্ডের কুকুর 'সেটার' আর স্পোর্টসম্যানের মতো পেশীবহুল 'পয়েন্টার'। টুক টুক করে গেল কুড়লের মতো দেখতে ছোটো ছোটো ক্ষিপ্র সাহসী কুকুর ফক্সটেরিয়ার। আর ন্যাড়া কালো যে ড্যাকস্হাউণ্ডগুলোকে বরকা ভাবত অকম্মা বিদঘুটে বলে, সেগুলো বাঁকা বাঁকা কিন্তু শক্ত পা ফেলে কী গম্ভীর চালেই না গেল। বিচারক মন্ডলীর কাছে লম্বা লম্বা তালিকা দাখিল করল তাদের মনিবেরা। জানোয়ারের প্রতি হিংস্র এই কুকুরগুলো কত: নেউল আর শেয়ালকে গর্ত থেকে টেনে বার করেছে, নয়ত তাড়া করে দিয়েছে শিকারীর গুলির মুখে।

সত্যি ড্যাকস্হাউন্ডগুলোকে দেখে অবাক লাগল বরকার।

কিন্তু এস্কিমো কুকুরকে দেখে মন খারাপ হয়ে গেল তার। খাড়া খাড়া কান আর প্রায় পিঠের ওপর কুণ্ডলী-পাকানো-লেজওয়ালা শাদা শাদা কুকুরগুলোকে দেখে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল তার। মনে পড়ে গেল তিয়াপার কথা।

বরকার ভাবনায় বাধা পড়ল একটা বুড়োর কথায়। মাথায় তার একটা সেকেলে বিবর্ণ টুপি। বলছিল, 'এসব আর কী, শিকারী মণ্ডপে ঐ যে ভালুক দাঁড়িয়ে আছে সেই হল দেখবার মতো। দেখবি, চল যাই।' বলে বুড়ো বরকাকে টেনে নিয়ে এল শিকারীদের সাজপোষাকের মন্ডপে।

দেয়ালে ঝুলছে দুই নলা বন্দুক, লম্বা লম্বা ছোরা, টেবলের ওপর রবারের হাই বুট, ফাঁদ, শিকার করা পাখির জন্যে থলে, দরজার কাছে স্টাফ করা মস্ত এক কালচে বাদামী ভালুক। অমনি ঝাঁকড়া ভয়াবহ মূর্তিতে ভালুকটা গুহা থেকে রুখে এসেছিল শিকারীর দিকে, কিন্তু আঙুল তখন তার ট্রিগারের ওপর।

'লম্বায় পুরো দু মিটার,' মাপার ফিতে দুলিয়ে সগর্বে ঘোষণা করল বুড়ো, 'আর নখটা একেবারে ছয় সেন্টিমিটার। একেই বলে দেহ। তোমার ঐ সব ফুচকে যত কুকুর কোথায় লাগে।'

'কিন্তু এ ভালুকটাকেও যে কুকুরেই ধরেছে,' বরকা বললে। 'ভালুককে মেরেছে শিকারী,' মাস্টার মশায়ের সুরে জবাব দিলে বুড়ো।

'এই যে প্ল্যাকার্ডে লেখা রয়েছে,' কুকুরের মান রক্ষায় বললে বরকা, 'মস্কো শিকারী সঙ্ঘের সদস্য স্মেলনিকভের হাতে এস্কিমো কুকুর জুভঙ্কায়া আর দুজনায়ার সাহায্যে ভালুকটি মারা পড়েছে নভগরদের কাছে।'

'লেখা যখন আছে তখন তোর কথাই ঠিক,' হার মানলে বুড়ো, 'তবে আসল কুকুর তুই দেখিসনি। ঐ দ্যাখ পাহারাদার কুকুর কুকুর বটে, চোখে দেখেই - মালুম।'

পাহারাদার কুকুরদের অংশটায় মাপার ফিতে দিয়ে একটু মেপে নেবার সুযোগ মেলেনি এই কুকুর-উৎসাহীর। এখানে সবকিছুই ছুটন্ত চলন্ত। ধুমসো তালার মতো ভারি আর মজবুত চোয়াল 'বকসার' কুকুরগুলো অতখানি ওজন নিয়েও আশ্চর্য অনায়াসে ব্যারিয়ার টপকে যাচ্ছে। কাঠের ওপর দিয়ে দিব্যি ছুটে যাচ্ছে ওরা, ঝাঁপিয়ে যাচ্ছে ট্রেঞ্চের ওপর দিয়ে, লাফিয়ে উঠছে উঁচু বেড়ার ওপর, দুই মিটার উচু থেকে গ'ত্তা দিয়ে লাফ দিচ্ছে আর সহর্ষে চেচিয়ে উঠছে দর্শকরা।

একটু দূরে বেড়া ঘেরা জায়গাটায় লম্বা হাতা মোটা তুলোর জামা পরা একটা মূর্তিকে নড়তে দেখা যাচ্ছিল। বেতের ঝুড়িওয়ালা যে গিন্নিটিকে বরকা রাস্তায় দেখেছিল, সে হুকুম দিলে 'ফাস্!' আর বাছুরের মতো দেখতে কুকুরটা কয়েক লাফেই গিয়ে 'দুর্বৃত্তকে' ধরাশায়ী করে বিজয়ীর ভঙ্গিতে গিয়ে ভারী থাবা রাখল তার ওপর। সকলের কাছেই পরিষ্কার হয়ে উঠল যে এ কুকুরের গলায় আরো একটা সোনার মেডেল ঝুলবে।

সেকেলে টুপি মাথায় বুড়ো যেই শুনলে যে বরকা ঘরোয়া কুকুরদেরও দেখতে চায় অমনি সে ছেড়ে গেল তাকে।

'যত বাজে সব, কুকুর না চুনোপুঁটি,' তাচ্ছিল্যে হাত নেড়ে সে চলে গেল।

আরও পড়ুন

গোল মন্ডপটার মধ্যে থেকে কুকুরের ডাক আসছিল ঘণ্টার মতো। খোলা দরজার সামনে লাফালাফি করছিল একদল বাচ্চা, খিল খিল করে সমস্বরে তারা গাইছে:

আহা মরে যাই, কুকুর দ্যাখো ভাই, হাতের মধ্যেই বসে, জল ভরা এক ডিশেই ডুবে মরবে বুঝি! হাহা, হিহি, হাহা! কুকুর নাকি মাছি?

একটুও বাড়িয়ে বলেনি ছেলেগুলো। মণ্ডপের মাঝখানে বিচারকদের টেবলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক, তার হাতের তালুর মধ্যে ক্ষুদে এক মেক্সিকান কুকুর, ঢ্যাপা ঢ্যাপা চোখ। কিন্তু মেঝের ওপর নামিয়ে দিতেই সে কী লাফ। ঠিক যেন শেকলে বাঁধা মাছি। কেবল বিচারকরা অমন ভারিক্কী মুখ করে বসে থাকতে পারছে কেমন করে সেইটেই আশ্চর্য'!

তারপর এল অদ্ভুত এক জীব, এমন লোমে ঢাকা যে কোনটা মাথা কোনটা লেজ বলা কঠিন। চাপা গর্জন করে উঠল জীবটা, হাঁ করল, তখন দেখা গেল তার আবার জমকালো দাড়ি গোঁপও আছে। অসঙ্কোচে হোহো করে হেসে উঠল বরকা আর তৎক্ষণাৎ তাকে বার করে দেওয়া হল দরজার ওপাশে। মিনিট খানেকের মধ্যেই দেখা গেল সেও ছোটাছুটি লাগিয়েছে মণ্ডপের আশেপাশে, ঘরোয়া কুকুরের চ্যাম্পিয়ন নির্বাচনের কাজে রীতিমত বাধা সৃষ্টি করে যোগ দিয়েছে ফুর্তিবাজ গায়ক দলের সঙ্গে:

নাপিতকে আন ডেকে

স্বচক্ষে যাক দেখে

কুকুর বেচারী

গজিয়েছে দাড়ি,

দোপাট্টা এক গোঁপ!

হাহা, হিহি, হাহা!

দুনিয়া আজব!

আরও পড়ুন

'হেসো না কিন্তু,' কে যেন বললে বরকার পেছন থেকে, 'এ কুকুরের গায়ে জোর কম নয়, কষ্ট সইতে পারে খুব।'

বরকা ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। টেরিয়ার কুকুরের যে পক্ষ নিয়েছিল তাকে এক নজরেই কলেজ ছাত্র বলে চেনা যায়; রোগাটে চেহারা, শার্টের গলার বোতাম খোলা, চশমার পুরু, কাচের নিচে আমুদে চোখ। তার সঙ্গিনীর চেহারাটি কিন্তু গোলগাল, লালচে, গায়ে একটা গ্রীষ্মের শাদা বর্ষাতি। একে দেখেও কেমন যেন মনে হয় কলেজ ছাত্রী।

তাহলেও বুকে লাল ফিতে বাঁধা বিচারকটি ওদের সঙ্গে যে রকম দহরম মহরম করছে, তাতে মনে হয় খুব সম্ভব ছাত্র নয়।

'সত্যি এই ছেলেগুলো! যত ঘোরাঘুরি কেবল এখানে।' অভ্যাগতদের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বললে বিচারক, 'বলুন আরো এগিয়ে যাই, আরো চিত্তাকর্ষক কিছু আপনাদের দেখাব।'

'অত না ভেবেচিন্তে আমি কিন্তু টেরিয়ারটাকেই কিনতে রাজী,' মেয়েটির দিকে চেয়ে অনুচ্চ স্বরে বললে তরুণটি, 'কিন্তু আমাদের টাকায় কুলবে না। এটাকায় চারটে কুকুর কেনার ভার। ইস, আমাদের অ্যাকাউন্টেন্টটি এমন কড়া।'

কথার টুকরোগুলো বরকার এক কান দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে গেল, আগের মতোই সে ফের ছোটাছুটি লাগাল মন্ডপটার চারপাশে। এই যে লোকগুলো তার পাশ দিয়ে চলে গেল, তারা কে, তার হারানো বন্ধুর জীবনে কী ভূমিকা এরা পালন করবে সেকথা যদি সে জানত! কিন্তু লোকগুলোর কথা পরমুহূর্তেই ভুলে গেল সে। লাফালাফি আর রগড় করতে লাগল আগের মতোই।

কুকুরের মনিবরা কিন্তু টের পেয়েছিল এ দুটি লোক সাধারণ দর্শক নয়। বিচারক নিজে ওদের দেখিয়ে বেড়াচ্ছে মেডেল পাওয়া আর চ্যাম্পিয়ন সব কুকুর।

'এই যে এটাকে একবার দেখবেন নাকি,' সঙ্গীদের বিচারক নিয়ে এল একটা শান্ত হয়ে বসে থাকা ভেড়া-খেদানো কুকুরের কাছে। 'খাঁটি জাতের কুকুর। পাঁচটা সোনার আর একটা বড় রূপোর মেডেল পেয়েছে।'

চশমা পরা ছেলেটি তার ক্ষীণদৃষ্টি চোখে নামজাদাটির দিকে চেয়ে তারিফ করলে, 'চমৎকার কুকুর। কিন্তু পরীক্ষার জন্যে বড়ো কুকুর ঠিক চলবে না।'

'হ্যাঁ, হ্যাঁ,' বিচারক বললে, 'বলেছিলেন বটে আপনাদের বড়ো সড়ো দরকার নেই। এটা শুধু এমনি, দেখাবার জন্যে। আচ্ছা স্প্যানিয়েল হলে চলবে।'

'সেও একটু বড়োই হল...'

'তাহলে ফক্স। বড়ো নয়, খুব বাধ্য, সজাগ। দেয়ালের ওপাশের বাসিন্দে খবরের কাগজ খুললেও ও ঠিক শুনতে পেয়ে মিঠে গলায় ডেকে উঠবে।'

'না, না,' চূড়ান্ত স্বরে বললে মেয়েটি, 'আমাদের দরকার আরো সাধাসিধে গোছের, কষ্ট সইতে পারে এমন...'

সেই মুহূর্তে তার সঙ্গী থামিয়ে দিল তাকে।

'ভালিয়া, দেখুন তো? চলবে ওটা?'

'চলবে!'

অভ্যাগত দুজনে মন স্থির করে এগিয়ে গেল বেড়ার দিকে। হলদে পাতার স্তূপের মধ্যে সেখানে একা একা শুয়ে আছে একটা নোংরা কুকুর। স্পিৎসের মতো লম্বা মুখটা কামড় খাওয়া, গায়ের লোম এককালে বেশ শাদা আর নরম ছিল বোঝা যায়, এখন তা কেমন জট পাকিয়ে ঝুলছে।

বিচারক সাবধান করে বললে, 'এটা আমাদের কুকুর নয়, হাঘরে রাস্তার কুকুর। কামড়ে দিতে পারে কিন্তু।'

কিন্তু কামড়াবার কোনো উদ্যোগ তার দেখা গেল না, বরং ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে পালাল রেলিঙের নিচ দিয়ে।

'আহা, ভড়কে দিলেন কেন?' জিজ্ঞেস করল চশমা পরা লোকটা।

'ঠিক এমনি কুকুরই আমাদের দরকার,' বললে মেয়েটি।

নিচু হয়ে ডাকলে, 'চুচু, এই গুবরে, টেপী, ধবলী...'

আরও পড়ুন

'আশা করি আমাদের প্রদর্শনীতে ও ধরনের কুকুর আর নেই। অন্য কোনো জায়গায় আপনাদের খোঁজ

করতে হবে।'

এই বলে বিচারক তার বুকের ওপরকার লাল ফিতেটা ঠিক করে নিয়ে ফিরে গেল নিজের স্প্যানিয়েল

আর ফক্সটেরিয়ারদের কাছে।

'এবার তাহলে কী করা যায় ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ?' হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করল ভালিয়া।

'কাল আমি নির্ঘাৎ কথা বলব অ্যাকাউন্টেন্টের সঙ্গে,' ভুরু কুচকে বললে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ, 'আমাদের যে টাকা উনি দিয়েছেন তাতে ভালো জাতের কুকুর কেনা চলে না! কিন্তু ব্যাপারটা কি দেখেছেন ভালিয়া? এটাকাও খরচই বা করব কী করে? কষ্টসহিষ্ণু জাতের যত কুকুর এসেছে সবই বড়ো বড়ো, আমাদের তাতে চলবে না। যত প্রদর্শনী আর নার্সারি, পি'জরাপোল সব জায়গায় হানা দিয়ে তো দেখলাম, যত বন্ধুবান্ধবের কুকুর আছে

কাউকে বাদ দিইনি। কিন্তু কিছুই ফল হল না।' 'শুধু আপনি নন,' সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলে ভালিয়া, 'আমাদের সব সহকর্মীরাই তো খুঁজে বেড়াচ্ছে, তারাও কিছু পায়নি।'

'আর যাদের খুঁজছি তারা ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরের রাস্তায়,' বেশ নিশ্চিত ভাব করে বললে ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ, 'যেমন ধরুন এইটে যেটা পালাল। কিন্তু আমি তো আর গিয়ে ধরতে পারব না। নির্ঘাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ব-আর চশমাটি ভাঙবে। তবে এবার আমি ঠিক বুঝেছি: আমাদের উদ্ধার করতে পারে কেবল সাধারণ হাঘরে কুকুর। খাঁটি রাস্তার কুকুরগুলো।'

আরও পড়ুন