প্রকৃতির সঙ্গে মিতালির অনেক সখ্য। তাই তো, প্রতিবছর সে গ্রীষ্মের ছুটির অপেক্ষায় থাকে। সে সময় ওর মা-বাবা ওকে নিয়ে ওর প্রাণপ্রিয় মামাবাড়িতে যায়। ওখানে ওর নানু ওকে অনেক আদর করেন। তবু সেখানকার প্রকৃতির অবিরাম দোলাচল মিতালিকে সবচেয়ে বেশি টানে। শহরের কোলাহল থেকে কয়েকটা দিন তো মুক্তি মেলে!
মিতালির মনে পড়ে, ওদের বাড়ির ধারে একটা অপূর্ব সুন্দর পুকুর ছিল, যার চারদিকে গাছগাছড়া, ঘাস, বুনো ফুল, লতা-গুল্ম, ফণিমনসা। পুকুরটার স্বচ্ছ জল টলমল করত। কখনো সেটা ছেয়ে থাকত কচুরিপানায়, কলমিলতায়, শাপলার পাতায়, শালুকের বিস্তারে; কখনো নাম না জানা ভাসমান সবুজ পাতায়। তখন মিতালি গিয়ে বসত সেই পুকুরপাড়ে। দু-একটা মাছরাঙা শিকারি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিল। ঝোড়ো বাতাস ওর চুল এলোমেলো করে দিচ্ছিল। প্রকৃতি তখন মৃদঙ্গের তালে মাতোয়ারা। কোনো দূরের বাড়ি থেকে ভাঙা গলায় ভজন শোনা যাচ্ছিল। ঝড় আসবে বোধ হয়। মিতালি তখন প্রকৃতির কোলে আচ্ছন্ন হয়ে পড়া বালিকা!
সেদিন খুব বৃষ্টি নেমেছিল। মিতালির জামাটা ভিজে চুপসে গিয়েছিল। ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল বৃষ্টির পানিতে। ও জানে, ভরা বৃষ্টি শেষে সন্ধ্যার অন্ধকার আরও জমাট বাঁধবে মমতাময়ীর আদরের মতো। তারপর আসবে সেই অতি আকাঙ্ক্ষিত হাজারো নক্ষত্রের জোনাকির পাল। কী সেই রং! কী সেই বাহার! এত সুন্দর বৃষ্টিভেজা জোনাকির আলো মিতালির সঙ্গ পেয়ে যেন আরও ঝলমল করে উঠত! মিতালি মুগ্ধতার আবেশে ডুবে থাকত। সন্ধ্যার আকাশে চাঁদের ধারে দুধের সরের মতো ভেসে বেড়াত বৃষ্টিস্নাত পুঞ্জ মেঘ। স্বপ্নালু চোখের সেই আলোময় সন্ধ্যা আজও মিতালির স্মৃতির রেখাপটে দাগ কেটে যায়।
চাকরির সুবাদে বহু বছর মিতালি দেশের বাইরে। দেশে এলেও সেই প্রকৃতির ছন্দ কোথায় যেন মলিন হয়ে গেছে। মামাবাড়ির পুকুরটা ভরাট হয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে বাসভবন। জোনাকিরা আজ আর আসে না। আজ নানুর কথা খুব মনে পড়ছে ওর। জোনাকনক্ষত্রের মতো নানুও যে তার জীবন থেকে বহু আগেই বিদায় নিয়েছেন...!
লেখক: শিক্ষার্থী, নবম শ্রেণি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা