বিস্মৃতি
‘স্মৃতি ব্যাপারটা খুব গোলমেলে, জানেন?’ অরুণ সরকার বলেন। বলতে বলতে তিনি গলায় মাফলার পেঁচিয়ে নেন ভালো করে।
শীত বিদায় নিয়েছে, তবে অরুণ সরকারের পোশাকে তার ছাপ নেই। কেননা তার অসময়ে সর্দি লেগেছে। একটু কাশিও আছে।
আমরা একটা পারানি নৌকায় বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে কেরানীগঞ্জে চলেছি। ওই পাড়ে ভুল্লামারির হাট নামে একটা মাছের বাজার আছে। পুকুর বা খাল-সেঁচা টাটকা মাছ পাওয়া যায়। আমরা দুজনে মাছ কিনব বলে একটু সকাল সকাল বেরিয়েছি। সদরঘাটে অলস পড়ে থাকা দৈত্যাকার স্টিমারের খোলের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আমাদের নৌকা মাঝনদীতে পড়তেই অরুণ সরকার অপ্রাসঙ্গিকভাবে স্মৃতির কথাটা তুললেন। সেটা এই পরিবেশ এবং আমাদের যাত্রার উদ্দেশ্যের সঙ্গে এমনই বেমানান যে আমি প্রথমে তার মন্তব্যটা বুঝতেই পারলাম না।
‘কী রকম?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘বলছি। কথা হলো, আপনি মানেন আর না মানেন, স্মৃতির ওপর ভরসা করা যায় না।’
‘আমরা ভুলে যাই, সেই জন্য?’
‘বিস্মৃতি তো আছেই। তবে এর চেয়েও খারাপ জিনিস আছে—ভুয়া স্মৃতি। আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত মিথ্যা স্মৃতি তৈরি করে। যা ঘটেনি, তার স্মৃতি তৈরি হয়ে বসে থাকে। পরে অনেক দিন পেরিয়ে গেলে আমরা আর আলাদা করতে পারি না, কোন ঘটনা সত্যি ঘটেছে, কোনটা আমাদের কল্পনাপ্রসূত। আমরা ভাবি, আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতির কুঠুরিগুলো একধরনের আর্কাইভের কাজ করে। ব্যাপার মোটেও তা না। আমাদের মস্তিষ্ক আসলে খুব ক্রিয়েটিভ এক লেখক-সাংবাদিক। সে একদিকে অনবরত নিউজ রিপোর্ট তৈরি করে, যা ঘটছে, যেভাবে ঘটছে, তার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ লিপিবদ্ধ করে, আবার একই সঙ্গে সে ফ্যান্টাসি বানায়, সেগুলোর উপকরণ মিশিয়ে দিয়ে রাখে বস্তুনিষ্ঠ নিউজ রিপোর্টের মধ্যে। ফলে আপনি ভরসা করতে পারবেন না স্মৃতির ওপর।’
কথাটা আমি আগেও শুনেছি। শুধু শুনেছি না, নিজের জীবনেও তার কিছু আলামত পেয়েছি। কিছুদিন আগে আমাদের স্কুল-বন্ধুদের একটা সমিতির পিকনিকে গিয়েছিলাম গাজীপুরের এক রিসোর্টে। দুপুরে ভরভেট খাওয়াদাওয়া শেষে আমরা যখন পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে কিশোরবেলার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন লক্ষ করলাম, অতীতের অনেক ঘটনার ব্যাপারে আমরা একমত হতে পারছি না। অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত ভাষ্য তৈরি হচ্ছে। অথচ ঘটনার সময় আমাদের অনেকেই চাক্ষুষ হাজির ছিলাম।
‘সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি দেখেন,’ অরুণ সরকার বলেন, ‘স্মৃতির ওপর ভরসা না করে আমাদের উপায় নেই। কারণ, এর বিকল্প নেই। স্মৃতির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ব্যক্তিসত্তা এবং বলতে কি, আমাদের পুরো সভ্যতা।’
‘তা কেন, রেকর্ডপত্র, দলিল-দস্তাবেজ, আর্কাইভ, নিউজ পেপার আছে না? আমরা তো শুধু স্মৃতির ওপর ভরসা করে অতীত নির্মাণ করি না,’ আমি তর্কের সুরে বলি।
আমি আলোচনায় যোগ দিয়েছি টের পেয়ে নড়েচড়ে বসেন অরুণ সরকার। এতক্ষণ তিনি স্বগতোক্তির মতো করে কথা বলছিলেন।
পারানি নৌকায় আরও লোকজন উঠেছে। সকালের দুধওয়ালা, ফেরিওয়ালা, অফিসগামী কেরানি। বাকিরা শ্রমিক। ওপারে বেশ কিছু ভবন নির্মাণের কাজ চলছে, এপার থেকে দেখা যায়। নদীর ধারে কিছু জাহাজ কারখানাও আছে। এগুলোরই শ্রমিক হবে। তারা সবাই যেন মনোযোগ দিয়ে অরুণ সরকারের কথা শুনছে বলে মনে হলো।
‘তাহলে আপনাকে স্মৃতিবিষয়ক কিছু আজিব কথা শোনাই,’ একটা আদার টুকরো মুখে পুরে সেটা চিবাতে চিবাতে বললেন অরুণ সরকার। আমি তার এ ভঙ্গি চিনি। তিনি ‘আজিব’ শব্দটা যখন প্রয়োগ করেন, তখন বুঝতে হয়, খুবই বিদঘুটে আর বিসদৃশ কিছু একটা তিনি বলতে চলেছেন।
অরুণ সরকার চাকরিবাকরি কিছু করেন না। পুরান ঢাকার হোসেনি দালান এলাকায় একটা চিলেকোঠায় একা থাকেন। নিজে রান্না করে খান। আমি মাঝে মাঝে তার ডেরায় গিয়ে হাজির হলে তিনি লেবু চা খাইয়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
কোনো কাজ না করে তার চলে কীভাবে, আমি কোনো দিনই তাকে জিজ্ঞেস করিনি। আমার অনুমান, পৈতৃক সূত্রে বা অন্য কোনোভাবে তিনি কিছু টাকাপয়সা পেয়েছিলেন কোনোকালে। সেই টাকা তিনি ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছেন। সেটার ইন্টারেস্ট দিয়ে তার চলে।
অরুণ সরকারের কিছু পরিমাণে সিজোফ্রেনিয়া আছে। তবে সেটা বিশেষ ধরনের। জগতের সর্বত্র তিনি ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পান। তার চারপাশটা সর্বদা ফিসফাসময়, অভিপ্রায়বহুল। সেখানে গলির মোড়ের বাদামওয়ালা লোকটা ঠোঙায় বাদাম ভরার ছলে এক ঘণ্টায় তিনবার তাঁর তিনতলার বারান্দার দিকে আড়চোখে তাকায়, একটা ঘুড়ি তার বাসার সামনে ইলেকট্রিক খুঁটিতে সন্দেহজনকভাবে ঠিক তার পড়ার টেবিল বরাবর লটকে থাকে, একটা অচেনা বিড়াল তার দরজার কাঠের পাল্লায় তাৎপর্যপূর্ণ আঁচড় কেটে যায়। একবার বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারের ওপর বসে থাকা একটা শালিক পাখিকে দেখে তিনি আমাকে বলেছিলেন, পাখিটা তিন ভবন পরের একটা বিশেষ কক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকছে। ওই কক্ষে মাস দুয়েক আগে এক অচেনা অতিথি এসে ভাড়া থাকতে শুরু করেছেন। আর পাখিটাও ঠিক মাস দুয়েক ধরেই এখানে আসছে।
অরুণ সরকার এসব বলে আমার বর্ণহীন একঘেয়ে জীবনটাকে পাল্টে দিতে পারেন। তার সান্নিধ্যে আমার কাছে জগৎ অত্যন্ত সচল আর চক্রান্তময় হয়ে ওঠে। আমি উপভোগ করি। সে জন্য ফাঁক পেলেই আমি তার ডেরায় চলে আসি।
নৌকায় অরুণ সরকার ‘আজিব’ শব্দটা বলামাত্র আমি নড়েচড়ে বসি, যাতে আমাকে মনোযোগী শ্রোতা মনে হয়। তবে লোকটা ভালো করে শুরু করার আগেই নৌকা ঘাটে ভিড়ে গেল এবং এতক্ষণের মনোযোগী শ্রোতাদের নামার হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। আমরা কাদাটে পাড় বেয়ে বাঁধের ওপর উঠে এলাম। একটা রিকশা ভাড়া করা হলো ভুল্লামারির হাট পর্যন্ত। রাস্তা এবড়োখেবড়ো। তার ওপর দিয়ে চাকা গড়িয়ে গেলে অরুণ সরকারের কণ্ঠস্বরে প্রতিধ্বনির মতো একটা আওয়াজ হচ্ছে, যেন আমার পাশে বসে একই সঙ্গে দুজন অরুণ সরকার কথা বলছেন।
‘যত দিন পর্যন্ত না কোভিড নামক একটা দুনিয়া-কাঁপানো মহামারি এসে আমাদের সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে, তত দিন পর্যন্ত স্মৃতির অথেনটিসিটি নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা তৈরি হয়নি। আমরা ভেবেছি, সামান্য কিছু কাল্পনিক উপকরণের মিশেল সত্ত্বেও আমরা স্মৃতি নামক এই ব্যবস্থার ওপর ভরসা রেখে আমাদের সমাজ ও সভ্যতাকে মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারি। আমাদের সেই বালুর বাঁধ ভেঙে গেছে। একটা হ্যাঁচকা টানে।’
‘কীভাবে?’
‘আপনি থিরুভাল্লুভার রামাস্বোয়ামির নাম শুনেছেন?’
‘না।’
‘না শোনারই কথা। উনি তামিল বংশোদ্ভূত এক সুইডিশ নিউরোলজিস্ট। তাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেননা তিনি অদ্ভুত একটা কথা প্রচার করতে শুরু করেছিলেন গত বছর থেকে। ওনার দাবি, কোভিড আসলে একটা ক্যামোফ্লেজ, একটা চোখে ধুলো দেওয়া, একটা আড়াল। ওই একই সময়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া আরেক অদৃশ্য মহামারিকে ধামাচাপা দিতেই এটা করা হয়েছে। আর সেই অদৃশ্য মহামারির নাম তিনি দিয়েছিলেন “ও–গ্র্যান্দে এসকেসিমেন্তো”। পর্তুগিজ নাম। ইংরেজিতে অর্থ করলে দাঁড়ায় “দে গ্রেট ফরগেটিং”।
‘ফরগেটিং কেন?’
‘বলছি। রামাস্বোয়ামি নেপাল, এস্তোনিয়া ও তাজিকিস্তানের সতেরোটি শহরে দৈবচয়ন ভিত্তিতে জরিপ চালিয়ে দেখিয়েছেন, কোভিডের সময় ভিন্ন আরেকটি রোগে এই শহরগুলোর সব নাগরিক আক্রান্ত হয়েছিলেন। সব নাগরিক। এমনকি জরিপে এই শহরে বেড়াতে আসা পর্যটকদের মধ্যেও একই রোগের উপসর্গ পাওয়া গেছে, যা থেকে বোঝা যায়, এ রোগে অন্য শহরের লোকেরাও আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি রোগটির জীবাণু বা প্যাথোজেন শনাক্ত করতে পারেননি। শুধু এটির রেখে যাওয়া পদচিহ্ন পেয়েছেন সবার মধ্যে। বয়স ও জেন্ডারনির্বিশেষে সবার মধ্যে একটা অভিন্ন উপসর্গ। আর তা হলো, ‘মেমোরিয়া ফালসা’ বা ভুয়া স্মৃতি। এক দিন–দুই দিনের নয়। পুরো দুই বছরের ভুয়া স্মৃতি কেউ ভরে দিয়েছে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে। আর রামাস্বোয়ামির জরিপ অনুযায়ী, আক্রান্ত ব্যক্তি মানে সবাই—পৃথিবীর সব শহরের সব বাসিন্দা, বা মোদ্দা কথায় পুরো মানবজাতি। তো পুরো মানবজাতি বা হিউম্যানিটি যদি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে, তার অর্থ বুঝতে পারছেন?’
‘পৃথিবীর সবার মধ্যে দুই বছরের মিথ্যা স্মৃতি তৈরি হয়েছে।’
আমাদের রিকশা থেমে গেল। ভুল্লামারির হাট এসে গেছে। আমরা বাজার ঘুরে খালের বেশ কিছু বিরল মাছ কিনলাম—দারকিনি, নানদিনা আর লোহাছুরা। অরুণ সরকার মাছ চেনেন ভালো। দরদামও ভালোই করেন। মাছ কেনার সময় আমি মাথায় গামছা পেঁচানো প্রৌঢ় মাছওয়ালাকে দেখিয়ে ফিসফিস করে জানতে চাইলাম, ‘এই লোকও কি আপনার ওই এসকেসিমেন্তো রোগে আক্রান্ত?’
‘হ্যাঁ। এই লোকও,’ গম্ভীর স্বরে বলেন অরুণ সরকার।
ফেরার পথে আমরা নদীর ঘাটে একটা চায়ের দোকানে পাতা বেঞ্চে বসি। সামনে বুড়িগঙ্গার দূষিত সবুজাভ পানির দিকে তাকিয়ে থেকে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘রোগের একটাই উপসর্গ?’
‘হ্যাঁ।’
‘তো, রোগের উপসর্গ যদি মিথ্যা স্মৃতি হয়, তাহলে রোগের নাম হবে “মেমোরিয়া ফালসা”। উনি রোগের নাম কেন রাখলেন “ও-গ্রান্দে এসকেসিমেন্তো” বা মহা বিস্মৃতি?’
অরুণ সরকারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, ‘ভালো প্রশ্ন করেছেন। আচ্ছা বলুন তো, ফলস টিথ কেন বসানো হয়? দাঁত না থাকা লুকাতে, তাই তো? এখন যদি কারও মুখে ফলস টিথ দেখেন, তাহলে আপনি কি অনায়াসে ধরে নিতে পারেন না যে লোকটা তার দাঁত হারিয়েছে? মানে, ধরে নিতে কোনো যৌক্তিক বাধা আছে? রামাস্বোয়ামির মতে, আমাদের ব্রেন ফলস মেমোরি তৈরি করে বিস্মৃতি ঢাকার জন্য। স্মৃতির মধ্যে যখন বড় বড় ফাঁক বা গর্ত তৈরি হয়, সেটা মস্তিষ্ক ভরাট করে রাখে ফলস মেমোরি দিয়ে। তার মানে লক্ষ করুন, কী ভয়াবহ একটা দাবি করে বসেছেন রামাস্বোয়ামি: তিনি বলছেন, দুই বছরের এক দীর্ঘ বিস্মৃতির ফাঁক তৈরি হয়েছে মানবস্মৃতিতে। আর সেই ফাঁক মস্তিষ্ক ভরে রেখেছে মিথ্যা স্মৃতি দিয়ে। ওই দুই বছর কী ঘটেছিল, আমরা কোনো দিনও জানতে পারব না। ওই দুটি বছর আমরা স্লিপিং বিউটি হয়ে ছিলাম। পুরো দুটি বছর আমাদের সবাইকে হয় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, নতুবা আমাদের দিয়ে ভিন্ন কিছু করানো হয়েছে। আর সেটা ঢাকতে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ভুয়া স্মৃতি। কোভিড নামক এক মহামারি হলো সেই ভুয়া স্মৃতির একটি উপাদান।’
‘মানে?’
‘মানে রামাস্বোয়ামি বলতে চান, কোভিড মহামারি একটা বানানো জিনিস। একটা ফলস মেমোরি। কোভিড নামে কোনো মহামারিই আসেনি কোনোকালে।’
আমি আর কোনো কথা বললাম না। নিঃশব্দে চা খাওয়া শেষ করলাম। নৌকায় উঠে ঘোলা পানির দিকে তাকিয়ে থেকে থম মেরে বসে থাকলাম। অরুণ সরকার আড়চোখে দুবার আমার দিকে তাকালেন। আমার মানসিক অবস্থা আঁচ করার চেষ্টা করছেন মনে হলো।
ওয়াইজঘাটে নেমে আমরা রিকশা নিলাম। বাহাদুর শাহ পার্ক পার না হওয়া পর্যন্ত মুখ খুললেন না অরুণ সরকার। তারপর বললেন, ‘রামাস্বোয়ামির দাবি কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। আরও আছে। শুনতে চান?’
‘বলুন।’
‘উনি পুরোনো দলিল-দস্তাবেজ, ইতিহাস, ভূতাত্ত্বিক রেকর্ড ইত্যাদি ঘেঁটে দেখালেন, মহাবিস্মৃতির এই অতিমারি নতুন কোনো ঘটনা নয়। এটা ঘুরে ঘুরে আসে। আগেও কয়েক দফা এ মহামারি এসেছে।’
‘যেমন?’
‘যেমন ধরুন, প্যালিওক্লাইমেটোলজি বলে একটা বিদ্যা আছে, জানেন তো?’
‘না। শুনি নাই।’
‘আছে। প্যালিওক্লাইমেটোলজিস্টদের কাজ হলো, অতীতকালের আবহাওয়ার খোঁজখবর নেওয়া। এই যে এখন বাতাসে কার্বন ডাই–অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে এত হই-হাঙ্গামা, গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে এত কথাবার্তা, এটা কি পৃথিবী গ্রহে এবারই প্রথম ঘটছে? মোটেও না। গ্লোবাল ওয়ার্মিং ঘুরে ঘুরে আসে, এসেছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দূর অতীতেও হু হু করে বেড়েছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে একেবারে নেড়ে হয়ে গেছে। মহাদেশগুলো ডুবে গেছে বারবার। এগুলো আমরা কীভাবে জানি? জানি পৃথিবী নামক এই গ্রহের স্মৃতিভান্ডার থেকে। পৃথিবী তার সব স্মৃতি জমা করে রাখে একাধিক ভান্ডারে—মেরু অঞ্চলের বরফের স্তরে, গাছের গুঁড়ির মজ্জায়, গুহার ভেতরে স্টেলাকটাইট আর স্টেলাগমাইটের মধ্যে, প্রবালদ্বীপের মধ্যে আর সমুদ্রের তলদেশে কাদামাটির স্তরে। প্যালিওক্লাইমেটোলজিস্টদের চোখে এগুলো হলো পুরো গ্রহের স্মৃতির ভাঁড়ার। কবে এ গ্রহের জ্বর হয়েছিল, কবে সর্দি-কাশি হয়েছে, সব লেখা আছে পাথরের গায়ে, প্রবাল প্রাচীরে। জিওলজিস্টদের কাছে ভূত্বকের সেডিমেন্ট বা পলির স্তর এক একটা বইয়ের পৃষ্ঠার মতো। ইলাস্ট্রেটেড বই। এখন কথা হলো, মাঝে মাঝে তারা এই বইয়ের একটা-দুটা পৃষ্ঠা, এমনকি পুরো অধ্যায় গায়েব দেখতে পান। কেউ যেন ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। জিওলজিস্টরা এগুলোকে বলেন, ‘আনকরফরমিটি’। এ রকম একটা খোঁড়লের নাম তাঁরা দিয়েছেন ‘দ্য গ্রেট আনকরফরমিটি’। খুব বিখ্যাত একটা খোঁড়ল। ১৬০ কোটি বছর থেকে শুরু করে ৬০ কোটি বছর পর্যন্ত পৃথিবীর ১০০ কোটি বছরের কোনো হিসাব নেই, কোনো রেকর্ড নেই কোথাও। পৃথিবী থেকে কে যেন হুট করে মুছে দিয়েছে একটা এত বড় একটা সময়ের সব স্মৃতিচিহ্ন। গাছের গুঁড়িতে কোনো চিহ্ন নেই, প্রবালের গায়ে কিছু লেখা নেই, এমনকি কোনো আলামত নেই কাদামিটির স্তরে। এটা কে করল? কেন করল? কীভাবে করল? এ এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য। প্যালিওক্লাইমেটোলজিস্ট এবং জিওলজিস্টদের এক সার্বক্ষণিক মাথাব্যথা এটা। আজও।’
পুরো নর্থসাউথ রোডে আজ তীব্র যানজট। আমাদের রিকশা বেচারাম দেউড়ির দিকে গলিতে ঢুকে গেল। আমি রিকশায় বসে কোনো কথা বলছি না। পলিথিনে মাছ রাখা পায়ের কাছে।
‘এ রকম বহু বিস্মৃতির ফাঁক থেকে গেছে এই গ্রহজুড়ে। আমাদের রামাস্বোয়ামি বলেন, এই ফাঁকগুলো তা–ও মন্দের ভালো। আমাদের কালেকটিভ অ্যামনেশিয়া এগুলো। কিন্তু যে বিস্মৃতিগুলো আমরা দেখতে পাই না, যেগুলো চাপা দেওয়া হয়েছে, ফলস মেমোরি দিয়ে ভরে দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কী হবে?’
‘মানে?’
‘মানে আমাদের জিওলজিক্যাল রেকর্ডের অর্ধেকই তৈরি করা। বানানো। ফলস। ফেক। কেউ আলতো করে বসিয়ে দিয়ে গেছে। হয়তো ডাইনোসররা ছিলই না কোনোকালে। মেক্সিকো উপসাগরে ধূমকেতুর আঘাতের ক্ষতচিহ্ন একটা ছেলেভোলানো সান্ত্বনামাত্র। আমাদের ভুলিয়ে রাখার জন্য।’
‘কে তা করবে? কী উদ্দেশ্যে?’
আমার এই প্রশ্নের কোনো জবাব দেন না অরুণ সরকার। বেচারাম দেউড়িতেও প্রচণ্ড যানজট। রিকশার পেছনে রিকশা দাঁড়ানো। কিছুই নড়ছে না।
আমরা রিকশা থেকে নেমে গেলাম। ঢুকে গেলাম আরও চিকন একটা গলিতে। দুপাশে পুরোনো দরদালানের কোনো কোনোটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। সিটি করপোরেশন লোকজনকে জোর করে সরিয়ে ইভ্যাকুয়েশন নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে। এ রকম নোটিশ লাগানো কিছু ভবনে দেখলাম ঝুলবারান্দার তারে শুকাতে দেওয়া লুঙ্গি, তোয়ালে, শাড়ি। বোঝা যায়, কেউ লুকিয়ে এগুলোয় বসবাস করছে। তাদের জানের মায়া নেই। আবার হয়তো এখানে কেউ থাকে না। এই সব কাপড় আগে বসবাসকারীদের স্মৃতি বহন করছে। ফলস মেমোরি।