আবু হোসেনের অদ্ভুত অসুখ

অলংকরণ: তনি সুভংকর

‘আমার কথা বোধ হয় আপনার বিশ্বাস হবে না।’ বলে লোকটা বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল।

আসাদ কথাটা কানে তুলল না। ড্রয়ার থেকে প্যাড বের করতে করতে বলল, ‘নাম কী লিখব?’

‘আবু হোসেন।’

‘বয়স?’

‘৩৬।’

‘আচ্ছা। কী সমস্যা?’

আবু হোসেনের মধ্যে একটু ইতস্তত ভাব। ‘আপনাকে বরং দেখাই...’ বলে কোলের ওপর রাখা ব্যাগ থেকে একটা পিস্তল বের করে টেবিলের ওপর রাখল সে।

আসাদের বুকটা ধক করে ওঠে। অজান্তেই হাত চলে যায় মোবাইলের কাছে।

‘ভয় পাবেন না। খেলনা।’ আবু হোসেন হেসে ফেলে। ‘দেখতে একদম আসলের মতো, তাই না! দাঁড়ান... আরও দেখাই।’

‘কয়েকটা ঘটনা বলি। তাহলে বুঝবেন। আমি এখানকার একটা এনজিওতে চাকরি করি। গত মঙ্গলবারের কথা। অফিস শেষে বাড়ি ফিরেছি। দেখি, পেনসিল বক্সটা বিছানার ওপর রাখা। অথচ এই জিনিস আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম ২৯ বছর আগে। আবার এই পিস্তলটা দেখেন।

ব্যাগ থেকে একে একে অদ্ভুত সব জিনিস বেরোতে থাকে। একটা দোতলা বাস আকৃতির পেনসিল বক্স, ক্যাসেট, কমিকসের বই, একটা মৌটর, দামি ফাউন্টেনপেন, মানিব্যাগ...

আসাদ নড়েচড়ে বসে। চড়াইঘাটা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার পোস্টিং হয়েছে মাস দুই হলো। আসার পর থেকে অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা হচ্ছে।

গ্রামের অধিকাংশ লোক আসাদকে ডাকে ‘ভাতিজা’। আসাদ প্রথমে ভেবেছিল, এটাই এখানকার চল। পরে বুঝেছে, ব্যাপারটা তা নয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাব–অ্যাসিস্টেন্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের নাম চান মিয়া। দীর্ঘদিন এ অঞ্চলে ডাক্তার ছিল না। চান মিয়াকেই সবাই বড় ডাক্তার বলে চেনে। আর আসাদকে চেনে তার ভাতিজা হিসেবে। লোকে ভাবে, চাচার সঙ্গে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বসে সে-ও টুকটাক ‘ডাক্তারি’ শেখার চেষ্টা করছে। বেশির ভাগ রোগী তাই চান মিয়াকেই খোঁজে। আসাদের রুমে উঁকি দিয়েই বলে, ‘ভাতিজা, ডাক্তার সাব নাই?’ আসাদ সাধারণত কথা না বাড়িয়ে সামনের ঘরটা দেখিয়ে দেয়। প্রথম দিকে সে নিজের পরিচয়টা বলার চেষ্টা করত। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। দাড়ি–গোঁফ ছাড়া একটা চ্যাংড়া ছেলেকে কেন যেন গ্রামের লোকেরা ডাক্তার হিসেবে ঠিক মানতে চায় না।

সকাল সকাল আবু হোসেন যখন পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে বলেছে, ‘ডাক্তার সাহেব, আসব?’ আসাদ একটু খুশিই হয়েছিল। কিন্তু এখন অবস্থা ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না।

টেবিলের ওপর একগাদা জিনিস সাজিয়ে আবু হোসেন ম্লান হাসি হাসে। ‘আপনি বোধ হয় একটু অবাক হচ্ছেন। আচ্ছা বুঝিয়ে বলি।’ পিস্তলটা হাতে নেয় সে। ‘এই যে পিস্তলটা দেখছেন, এইটা আমাকে দিয়েছিল ছোট মামা। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। কী যে প্রিয় ছিল এটা। এত প্রিয় যে বন্ধুদেরও দেখাতাম না। লুকিয়ে রাখতাম। আর এই যে পেনসিল বক্স। এটা ক্লাস টুয়ের। বাণিজ্য মেলা থেকে কিনেছিলাম। আমাদের পুরো ক্লাসে এ রকম পেনসিল বক্স শুধু একটাই ছিল, যেটা আমার। আর এই মোটরটা দেখেন। একটা খেলনা গাড়ি থেকে...’

আরও পড়ুন

আসাদ এবার থামায়, ‘ভাই, ভাই, এক মিনিট। আপনার বোধ হয় কোনো ভুল হচ্ছে। এগুলো শুনে আমি কী করব? আপনার সমস্যাটা বলেন...’

‘সেটাই তো বলছি।’ আবু হোসেন যেন একটু আশাহত হয়। বলে, ‘এগুলা সব আমার খুব প্রিয় জিনিস। মানে একসময় প্রিয় ছিল। কিন্তু জানেন তো, প্রিয় জিনিসগুলা কীভাবে কীভাবে যেন হারিয়ে যায়...’

আসাদের এবার একটু মায়া হয়। লোকটার সমস্যা মনে হচ্ছে মানসিক। এই অদ্ভুত রোগীগুলোই কেন তার ভাগ্যে জোটে! কেন তারা চান মিয়ার কাছে যায় না!

কদিন আগে এক বৃদ্ধা এসেছিল। তার সমস্যাটাও অদ্ভুত। ২০২০ সালে করোনা হয়েছিল। এরপরের কথা নাকি তার আর মনে নেই। করোনার অনেক রকম সাইড ইফেক্টের কথাই আসাদ শুনেছে, এটা নতুন। আসাদ তাকে সদরের হাসপাতালে রেফার করেছে।

আবার কদিন আগে এসেছিল গ্রামের এক সাবেক চেয়ারম্যান। সঙ্গে তার ভাই, চাচাতো ভাই, শালা, দুই ছেলে—বিরাট দল। আসাদ যতই বলে, ‘রোগী কে? সমস্যা কী?’ তারা উত্তর দেয় না। পাল্টা প্রশ্ন করে—‘ভাতিজার বাড়ি কই? বাড়িতে কে কে আছে? বেতন পাও কত? বিদ্যাশ–টিদ্যাশ যাওয়ার ইচ্ছা আছে?’ ইত্যাদি।

আসাদ পরে শুনেছে। চেয়ারম্যান নাকি এসেছিল তার মেয়ের জন্য পাত্র দেখতে। কী যন্ত্রণা! চাকরিটা ছেড়ে দেবে, সে উপায়ও নেই।

‘আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?’ আবু হোসেন জানতে চায়।

‘না। তা না। তবে বাইরে আরও রোগী আছে (আসলে নেই)। আপনি যদি একটু দ্রুত বলেন, ভালো হয়।’

‘ঠিক আছে। সোজাসুজিই বলি।’ আবু হোসেন সোজা হয়ে বসে। ‘কয়েক দিন ধরে আমার প্রিয় জিনিসগুলা সব ফিরে আসতে শুরু করেছে।’

‘মানে? ঠিক বুঝলাম না।’

‘জানতাম, বুঝবেন না। সে জন্যই একটু ডিটেইলে বলেতে চাচ্ছিলাম। থাক। বাদ দেন।’ আবু হোসেনকে আশাহত দেখায়। টেবিলের ওপরের জিনিসগুলো ব্যাগে ভরতে শুরু করে সে।

আরও পড়ুন

‘আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। বলেন। আমি শুনছি। কিন্তু একটু বুঝিয়ে বলেন। কী ফিরে আসছে, কোথায় ফিরে আসছে?’ আসাদ এবার মনোযোগ দেয়।

‘কয়েকটা ঘটনা বলি। তাহলে বুঝবেন। আমি এখানকার একটা এনজিওতে চাকরি করি। গত মঙ্গলবারের কথা। অফিস শেষে বাড়ি ফিরেছি। দেখি, পেনসিল বক্সটা বিছানার ওপর রাখা। অথচ এই জিনিস আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম ২৯ বছর আগে। আবার এই পিস্তলটা দেখেন। গত সপ্তাহের ঘটনা। ঘুম থেকে উঠে দেখি, পিস্তলটা বালিশের পাশে রাখা। এটাও হারিয়ে গিয়েছিল। তা-ও বছর বিশেক আগে। খুব মন খারাপ করেছিলাম। এই যে মানিব্যাগটা। প্রথম চাকরির বেতন পেয়ে কেনা। একদিন গুলিস্তান থেকে বাসে উঠেছিলাম, পকেটমার নিয়ে গেল। অথচ হঠাৎ সেদিন দেখি, মানিব্যাগটা রান্নাঘরের তাকের ওপর রাখা। এই সব...সব আবার ফিরে আসছে।’

আবু হোসেন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। আসাদ কী বলবে, ঠিক বুঝে পায় না।

‘কবে থেকে এমনটা হচ্ছে?’

‘এই তো, এক মাস হবে।’

‘এমনও তো হতে পারে, জিনিসগুলো ঘরেই কোথাও ছিল। আপনার চোখে পড়েনি।’

‘আপনার কী মনে হয়? পকেটমার বাড়িতে এসে এই মানিব্যাগ রেখে গেছে?’

‘তা-ও ঠিক। আচ্ছা, আপনি কি ইদানীং খুব স্ট্রেসের মধ্যে আছেন? অফিসে খুব চাপ যাচ্ছে?’

‘চাপ তো থাকেই। কিন্তু...আমি আসলে জানি না কী হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, কথাগুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করি। এই এলাকায় তো শিক্ষিত মানুষ খুব বেশি নেই। কাউকে বললে আবার কি–না–কি ভাববে। তাই আপনার কাছে আসা। কিছু মনে করবেন না। আপনার সময় নষ্ট করলাম। সরি। আজকে উঠি।’ আবু হোসেন তার জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে।

‘আপনি যদি চান, আমি আপনাকে আমার একজন স্যারের নম্বর দিতে পারি। তার সঙ্গে নাহয় কথা বলে দেখলেন।’ আসাদ সাহায্য করতে চায়।

‘নাহ। থাক। কাউকে বলে আসলে লাভ নেই।’

আবু হোসেন উঠে দাঁড়ায়। কেমন যেন ইতস্তত করে। যেন আরও কিছু বলতে চায়। ‘আচ্ছা ভাই, আসি।’

দরজা পর্যন্ত গিয়েও লোকটা থমকে দাঁড়ায়।

‘কিছু বলবেন?’ আসাদ বলে।

আবু হোসেন ঘুরে দাঁড়ায়। আমতা–আমতা করে। ‘আমি আসলে আপনার কাছে আসতে চাইনি। মা খুব করে বলল আপনার কথা। তাই...।’

‘আপনার মা আমাকে চেনেন?’

‘হ্যাঁ। কিছুদিন আগেই আপনাকে দেখিয়ে গেছেন। আসলে... মানে... আমার মা ২০২০ সালে মারা গিয়েছিলেন, করোনায়। কিন্তু গত ১২ তারিখ, শুক্রবার, দুপুর বেলা গোসল করে বের হয়ে দেখি, মা বিছানায় বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, “আবু! তুই এত শুকিয়ে গেলি কবে?”’

আসাদকে আবু হোসেন আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না। ঝট করে বেরিয়ে যায়।

আরও পড়ুন