আকাশবাণী উর্দু সার্ভিসের নাশিদ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সিকান্দার। টেবিলে টোকা পড়তেই চমকে উঠল। চোখ রগড়ে দেখল হোটেলের নতুন গেস্ট দাঁড়িয়ে। ২০১ নম্বর রুমে উঠেছে। হাই তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই লোকটা হাসিমুখে বলল, ‘ঘুম ভাঙালাম নাকি? সকালের নাশতা এনে দিতে পারবে?’
সিকান্দার তড়াক করে উঠে বলল, ‘জি সাব। খুব পারব। ক্যায়া চাহিয়ে?’
কী আনতে হবে, সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল লোকটা। লোকটা বলা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। তার বয়স মোটেই আটাশ-ত্রিশের বেশি হবে না। লম্বা, দোহারা শরীর। মাথাভর্তি ঢেউখেলানো চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। গায়ের রং শ্যামলা। তা ছাড়া চোখ, দাঁত সবই উজ্জ্বল ঝকঝকে। সুপুরুষ যুবক বটে। একটাই সমস্যা, লোকটা উর্দু বলতে চায় না। উর্দু বললে বুঝতে পারে, বোঝা যায়। কিন্তু জবাব দেবার বেলায় দেবে বাংলায়। যেন উর্দু বললে নাক কাটা যাবে তার। খাঁটি কলকাত্তাইয়া বাংলা বলে লোকটা। কথা শুনে বোঝার উপায় নেই যে সে এ দেশের লোক নয়। লোকটা একবারও বলেনি, কিন্তু সিকান্দার জানে যে সে মাশরিকি পাকিস্তানের লোক, যাকে বাংলাদেশ নামে ডেকে ইদানীং খুব হল্লা জুড়ে দিয়েছে কিছু লোক।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সিকান্দার শুনল, আকাশবাণীতে খবর শুরু হয়ে গেছে। সাতটা পনেরোতে সকালের প্রথম সংবাদ। লক্ষ্ণৌর চোস্ত উচ্চারণে সংবাদপাঠক মাশরিকি পাকিস্তানের কী একটা সংবাদ পড়তে শুরু করেছে।
সিকান্দার যে হোটেলে বয়ের কাজ করে, তার একটা গালভরা নাম আছে, ‘দি মোহামেডান লজ’। রবীন্দ্র সরণির যে অংশে নাখোদা মসজিদ প্রকাণ্ড জাহাজের মতো নাক বাড়িয়ে আছে, তার পাশেই হোটেলটির অবস্থান। পুরোনো দোতলা ভবনের ওপরের তলায় সিঙ্গেল-ডাবল মিলিয়ে আটটি কক্ষ নিয়ে রেস্টহাউসটি বিরাজমান। নিচতলায় খাবারের হোটেল। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত খাবার পাওয়া যায়। ভালো গরুর মাংস পাওয়া যায় বলে দূরদূরান্ত থেকে এখানে খেতে আসে লোকে। দোতলার রিসেপশনে বসেন ম্যানেজার আবদুল গনি। বিহারি মুসলমান তিনি। আদিবাড়ি মুঙ্গের জেলায়। সিকান্দার করে বয়ের কাজ। সেও মুঙ্গেরের লোক। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় ঘরবাড়ি হারিয়ে কলকাতায়ই থিতু হয়েছে তার পরিবার।
নাশতা নিয়ে ফিরে এসে সিকান্দার দেখল, একচুল নড়েনি লোকটা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে খবর শুনছে আগের মতোই। নাশতার থালা হাতে লোকটার পেছনে দাঁড়িয়ে সিকান্দার বলল, ‘কোই বুরি খবর আছে নাকি সাব?’
লোকটা চমকে উঠল। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে হঠাৎ সিকান্দারের হাত থেকে নাশতার থালা ছোঁ মেরে নিয়ে বন্ধ করে দিল ২০১ নম্বর রুমের দরজা। লোকটার দুই চোখের কোণে অশ্রু টলমল করছিল। সিকান্দার সেটা দেখে ফেলুক, বোধ হয় চায় না সে।
আজ চার দিন হলো মোহামেডান লজে উঠেছে লোকটা। একবারও বাইরে যায়নি। তার খাবার, চা ও সিগারেট এনে দেয় সিকান্দার। প্রতিদিন একবার রুম পরিষ্কার করার নিয়ম। সিকান্দার তখন ঝাড়ু হাতে ক্লিনার বনে যায়। বালতি ভরে গোসলের পানি নিচের ইঁদারা থেকে এনে দেয়। লোকটা তখন পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। একটা কথাও বলে না।
চার দিনে দুজন ভিজিটর লোকটার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের একজন লোকটার দেশি, দুজনে পূর্ববঙ্গের বাংলায় তর্ক-বিতর্ক করেছে অনেকক্ষণ। আরেকজন ভারতীয়। তার মাথার কদমছাঁট চুল ও দীর্ঘ শরীর দেখে মনে হয়, সেনাবাহিনীর লোক। তারা দরজা বন্ধ করে নিচু গলায় আলাপ করেছে কিছুক্ষণ। একেবারে দরজার সামনে বসেও কিছুই শুনতে পায়নি সিকান্দার।
রহস্যে মোড়া লোকটার ব্যাপারে গনি সাহেবকে জানিয়েছে সিকান্দার। এটাই নিয়ম। কিন্তু কী মনে করে তাকে নাক গলাতে বারণ করেছে গনি। সিকান্দার তারপরও অদম্য কৌতূহল নিয়ে প্রতিনিয়ত লোকটাকে লক্ষ করে যাচ্ছে। সে কখন ঘুম থেকে ওঠে, সকাল-বিকাল-রাতে কী খায়, কোন ব্র্যান্ডের সিগারেট টানে—সবই সিকান্দারের জানা। কিন্তু লোকটা কে, কী জন্য এই সস্তার লজে এসে উঠেছে, তার কূলকিনারা এখনো করতে পারেনি।
মাশরিকি পাকিস্তান জায়গাটা সিকান্দারের অজানা নয়। তার জন্মের আগেই ছেচল্লিশের দাঙ্গায় সিকান্দারের পরিবারকে ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতায় আশ্রয় নিতে হয়। সাতচল্লিশে দেশভাগ হলে তারা ট্রেনে চেপে হাজির হয় মাশরিকি পাকিস্তানের নারায়ণগঞ্জে। সেখানেই ১৯৪৮ সালে সিকান্দারের জন্ম। ভালোই ছিল তারা। বাবা আদমজী কারখানায় ফোরম্যানের চাকরি করতেন। বড় দুই ভাই ড্রাইভিং শিখে ট্রাক চালাতে শুরু করল। কিন্তু সুখ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। ১৯৫৪ সালে আদমজী পাটকলে সাংঘাতিক দাঙ্গা লাগল বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে। চাকরি হারিয়ে বাবা হয়ে পড়লেন বেকার। ছোট্ট সিকান্দারকে নিয়ে সীমানা পেরিয়ে আবার কলকাতায় এসে আশ্রয় নিলেন। তার বড় দুই ভাই অবশ্য হিন্দুস্তানে ফিরে আসেনি। ওপারেই রয়ে গেছে। মাশরিকি পাকিস্তানের বাঙালিদের সেই থেকে ঘৃণা ও সন্দেহের চোখে দেখে আসছে সিকান্দারের পরিবার।
রেডিও শুনতে শুনতে খানিকটা ঝিমুনি এসে গিয়েছিল সিকান্দারের। হঠাৎ গনি সাহেবের তলব। ২০৩ নম্বর রুমে নতুন ভাড়াটে এসেছে। রিসেপশনে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুককে দেখে সিকান্দার বিস্মিত হলো। ফিনফিনে সাদা ধুতি ও গিলে করা পাঞ্জাবি পরা এক স্বাস্থ্যবান বাঙালি ভদ্রলোক হোটেলে থাকতে এসেছেন। ভদ্রলোকের বাঁ কাঁধে তিন সুতার পৈতার উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে। নির্ঘাত লোকটা বাঙালি ব্রাহ্মণ। কিন্তু তিনি কেন মুসলমানের হোটেলে থাকতে এসেছেন? হিন্দু হোটেলে জায়গা পাননি? চার বছরের কর্মজীবনে মোহামেডান লজে একজনও হিন্দু খদ্দের পায়নি সিকান্দার। হাঁ করে হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। গনি সাহেব তাড়া দিলে একটা স্যুটকেস কাঁধে নিয়ে লোকটাকে ২০৩ নম্বরে পৌঁছে দিল সিকান্দার। লোকটার বোধ হয় খুব পান খাওয়ার নেশা। শরীর থেকে জর্দার খুশবু ভুরুভুর করে বেরোচ্ছে। হাতের অ্যাটাচি কেস থেকে একটা টাকা বের করে সিকন্দারকে দিয়ে একগাল হাসল লোকটা।
সালাম দিয়ে বেরিয়ে সোজা গনি সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সিকান্দার। বলল, ‘সাহাব, মোহামেডান লজে আজতক কোনো ব্রাহ্মণ লোককে উঠতে দেখিনি। ইনি এলেন কী মনে করে?’
গনি সাহেব একটা উর্দু দৈনিক পড়ছিলেন। পত্রিকার পাতা থেকে চোখ না তুলে বললেন, ‘তাতে তোর কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি?’
থতমত খেয়ে গেল সিকান্দার। আমতা আমতা করে বলল, ‘ঠিক তা নয়। কিন্তু মুসলিম হোটেলে কোনো হিন্দু ভদ্রলোক থাকতে আসে বাপের জন্মে দেখিনি।’
গনি সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে গর্জন করে বললেন, ‘বয়স কত হয়েছে যে দেখবি? মনোযোগ দিয়ে কাজ করগে যা। কাজে মন নেই, সারা দিন আছেন উনি রেডিও নিয়ে। যত্তসব।’
সিকান্দার মুখ কালো করে বারান্দায় গিয়ে বসল। রেডিও বন্ধ করবে ভেবে হঠাৎ কী মনে করে রেডিও পাকিস্তান শোনার জন্য নব ঘোরাল। বিস্ময়ের ব্যাপার, রেডিও পাকিস্তানের জায়গায় অস্পষ্ট বাংলায় নতুন কোনো চ্যানেল শোনা যাচ্ছে। ঘোষক কাঁপা গলায় বলছে, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে আপনাকে স্বাগতম। খবর পড়ছি আমি বেলাল মোহাম্মদ।’
কোনো একটা গোলমাল হয়েছে ভেবে সিকান্দার রেডিও বন্ধ করে দিল। এমন সময় দড়াম করে খুলে গেল ২০১ নম্বর রুমের দরজা। মাশরিকি পাকিস্তানের লোকটা প্রায় দৌড়ে এসে রেডিও চালু করে বিড় বিড় করে বলল, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র? কালুরঘাট? নাকি অন্য কোথাও চলে গেছে ওরা?’
দাঁড়িয়ে পুরো খবরটা শুনল সে। কখনো নখ কামড়াল। কখনো আবার টেবিলে বসে পড়ল উত্তেজনায়। খবর শেষ হলে হাতের মুঠোয় একটা কিল মেরে বলল, ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমার দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।’
বিগত চার দিনে লোকটাকে একবারও হাসতে দেখেনি সিকান্দার। আজ প্রথমবারের মতো হো হো করে হাসল লোকটা। প্রায় নাচতে নাচতে সিঁড়ি গলে নিচে নেমে গেল। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল রবীন্দ্র সরণির ভিড়ে।
মাগরিবি পাকিস্তানের সঙ্গে মাশরিকি পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে লোকটার অত উল্লাস সিকান্দারের ভালো লাগল না। মাশরিকি পাকিস্তান তাদের জায়গা দেয়নি। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে একরকম পালিয়ে আসতে হয়েছে। সেই দেশ এখন স্বাধীন হবার বাসনায় বিভোর। কোনোমতে স্বাধীন হতে পারলে মাশরিকি পাকিস্তানের উগ্র বাঙালিরা বিহারি ভাইদের কচুকাটা করবে। শিউরে উঠল সিকান্দার। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে, তার দুই ভাই সীমান্তের ওপারে রয়ে গেছে। তাদের কখনো চোখে দেখেনি সে। ভাইসুলভ আবেগও হয়নি। আজ মাশরিকি পাকিস্তানে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর খবরে হঠাৎ করে সিকান্দারের বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠল।
ওপারের লোকটা নির্ঘাত সেই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। পাকিস্তান ভাঙার চেষ্টার অপরাধে মনে মনে লোকটাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বসল সিকান্দার। কখন, কী উপায়ে কাজটা হবে, সে ঠিক জানে না। তবে পাকিস্তানের বিরোধিতাকারী ব্যক্তির শাস্তি কেবল মৃত্যুই হতে পারে, এই কথা সিকান্দার আলবত মানে।
টেবিলে বসে এসব ভাবছিল সিকান্দার। এমন সময় ঝোড়ো বাতাসে ২০৩ নম্বর রুমের দরজা সশব্দ খুলে গেল। সিকান্দার চমকে উঠে দেখল, শিকারি বিড়ালের মতো ওত পেতে ব্রাহ্মণ ভদ্রলোকটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সিকান্দারকে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা চমকে গেল। উঠে এসে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল।
২০১ নম্বরের লোকটা ফিরল দুপুরের ঠিক আগে আগে। সিকান্দার গোসলের পানি আগেই তুলে রেখেছিল। লোকটা সিকান্দারকে ডেকে দশটি টাকা ধরিয়ে দিয়ে পাশের জগৎমাতা পাইস হোটেল থেকে দুপুরের খাবার এনে দিতে বলল। এত দিন মোহামেডান লজেরই খাবার খেয়েছে লোকটা। আজ কী মনে করে পাইস হোটেল থেকে খাবার আনতে বলছে। লোকটার মুড নিশ্চয়ই খুব ভালো।
নিতান্ত অনিচ্ছায় খাবার নিয়ে এল সিকান্দার। লোকটাকে তার সহ্য হচ্ছে না। খাবার আনতে আনতে ভাবল, এর খাবারে বিষ মিশিয়ে দিলে কেমন হয়? প্রহ্লাদ নামের এক উড়িয়া আবারিওয়ালা মসজিদের সামনে বসে ইঁদুর মারা সেঁকো বিষ বিক্রি করে। দেবে নাকি খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে? চিন্তা করেই সিকান্দারের খুব উত্তেজনা হলো। কিন্তু সে খুনি নয়। কারও বিশ্বাসের অমর্যাদা করে এভাবে কাপুরুষের মতো হত্যার পথ বেছে নেওয়া তার ধাতে নেই। খাবারের থালা হাতে সে যখন ২০১ নম্বর রুমে ঢুকল, লোকটা তখন গোসল সেরে ফেলেছে। ভেজা চুল গামছায় মুছতে মুছতে গুন গুন করে গান গাইতে লাগল।
রুমের দেয়ালে মশারি টাঙানোর পেরেকের সঙ্গে একটা লাল-সবুজ পতাকা টাঙানো। সবুজের জমিনে লাল বৃত্ত। তার মাঝখানে সোনালি রংয়ে মাশরিকি পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকা। সিকান্দার অবাক হয়ে পতাকাটার দিকে তাকাল। লোকটা তাই দেখে একগাল হেসে বলল, ‘আমাদের বাংলাদেশের পতাকা। কী সুন্দর দেখেছ? দেশ স্বাধীন হলে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব। যাবে আমার সঙ্গে?’
সিকান্দার জবাব দিল না। চোখমুখ শক্ত করে বসে রইল।
লোকটা আরেকবার বলল, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ হবে সবার দেশ। সব ধর্মের, সব জাতির মানুষ সেখানে স্বাধীনভাবে বাস করবে। জাত-ধর্মের কোনো বেড়াজাল থাকবে না।’
সিকান্দার অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেখানকার বিহারিদের কী হবে?’
লোকটা হেসে বলল, ‘কী আর হবে? ওরাও থাকবে বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পক্ষে যারা আছে, সবাই আমাদের ভাই।’
সিকান্দার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার দুই ভাই আছে মাশরিকি পাকিস্তানে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ওদের কোনো খবর পাইনি। মা-বাবা ওদের নিয়ে খুব চিন্তা করছে।’
লোকটার হাস্যোজ্জ্বল মুখ হঠাৎ কালো হয়ে উঠল। সে চিন্তিত গলায় বলল, ‘সারা দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ওরা যদি স্বাধীনতাকে বেছে নেয়, তাহলে কেউ ওদের ক্ষতি করবে না। যুদ্ধ শেষে আমি নিজে ওদের খুঁজে বের করব। তোমরা বিন্দুমাত্র ভেবো না।’
সিকান্দার ঘাড় নেড়ে সায় দিল। রাজনীতির অত জটিল হিসাব-নিকাশ সে বোঝে না। তবে লোকটাকে এখন আর অত মন্দ মনে হচ্ছে না। দেশের কথা এত গভীরভাবে ভাবে, এমন মানুষ তার দেশে বিরল হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের লোকটা এরপর নিয়মিত বাইরে বেরোতে লাগল। বাইরে থেকেও অনেক লোক আসে তার সঙ্গে দেখা করতে। তাদের মধ্যে ছাত্র-যুবার সংখ্যা বেশি। নিচু গলায় তারা কী সব সামরিক ব্যাপার নিয়ে আলাপ করে! বারান্দায় বসে রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে কিংবা চায়ের ফরমাশ নিয়ে রুমে ঢুকে সেসব আলোচনার খণ্ডাংশ সিকান্দারেরও কানে আসে। জয় বাংলা, মুক্তিবাহিনী, স্টেনগান, ল্যান্ডমাইন, মিত্রবাহিনী, বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, মাওলানা ভাসানীর মতো কিছু শব্দ সিকান্দার শোনে, কিন্তু পুরোটা বুঝে উঠতে পারে না। শুধু বোঝে, এরা অচিরেই কলকাতার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে সীমান্ত এলাকায় যাবে প্রশিক্ষণের জন্য।
আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করেছে সিকান্দার। তারই মতো কৌতূহল নিয়ে ২০১ নম্বরের লোকটাকে আরেকজন ব্যক্তি লক্ষ করছে। ২০৩ নম্বর রুমের ব্রাহ্মণ লোকটা। বাংলাদেশের লোকটা যখন বাইরে বের হয়, ব্রাহ্মণ লোকটাও তখন বেরিয়ে যায়। সে রুমে ফিরলে খানিক বাদে ব্রাহ্মণ লোকটাও ফিরে আসে। লোকটার সঙ্গে কে কে দেখা করতে আসে, তা–ও দরজার ফাঁক দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। মোড়ের এক ফার্মেসি থেকে ফোন করা যায়। প্রথম ব্যক্তিটি ফোন করতে গেলে দ্বিতীয়টিও সেখানে হাজির হয়। আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করে, ফোনে কী কথা বলছে।
এক শনিবারের রাতে ডিউটি সেরে চিৎপুরের বাসায় ফিরল সিকান্দার। দরজায় দাঁড়িয়ে শুনল, বাবা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। মা এসে দরজা খুলে দিল। এক রুমের ছোট্ট বাসা বিরিয়ানির গন্ধে ম–ম করছে। সিকান্দার অবাক হয়ে দেখল, বিছানায় বাবার পাশে বসে আছে সেই ব্রাহ্মণ। ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে আজ পাঞ্জাবি-সালোয়ার পরেছে। কাঁধে পৈতার লেশমাত্র নেই। ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল সিকান্দার। লোকটা তার বাসায় কী করছে?
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ‘সিকান্দার এসেছিস? দ্যাখ, সামশাদ সাহেব কত উপহার নিয়ে এসেছেন। আমিনিয়া রেস্তোরাঁর বিরিয়ানির খুশবুতে ঘরটা কেমন ভরে গেছে দেখেছিস?’
সামশাদ নামের লোকটা হাসল। মাগরিবি পাকিস্তানের টানে উর্দুতে বলল, ‘তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সিকান্দার। চলো খাওয়া শুরু করা যাক।’
বাবা ও সামশাদের সঙ্গে খেতে বসল সিকান্দার। পুরোটা সময় লাহোর-ঢাকা-কলকাতা নিয়ে বাবা ও সামশাদ মিলে অনেক গল্প করল। সামশাদ সাহেব বলল, ‘দিল্লাগি করছি না চাচাজান, সত্যি বলছি, সিকান্দারের মতো ছেলে হয় না। একেবারে একটুকরা রত্ন। মোহামেডান লজে আমার খুব যত্নআত্তি করছে। তাই চলে এলাম আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য। ভাবলাম, দেখে আসি এ যুগে এমন ছেলের জন্ম দিয়েছে কোন মা–বাবা।’
বাবার মুখ গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঘোমটার আড়াল থেকে মা বললেন, ‘সিকান্দারের পয়সায় আমাদের তিনজনের সংসার চলে। হোটেল থেকে কত টাকা আর পায়? যদি একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে দিতেন, তাহলে খুব উপকার হতো।’
সামশাদ হেসে বলল, ‘আপনারা এই দেশে পড়ে আছেন কেন? পাকিস্তানে চলুন না। দেখবেন মরুর বুকে কী সুন্দর শহর করাচি। লাহোরের গোলাপের বাগান, ইসলামাবাদের মসজিদের সুউচ্চ মিনার আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আপনারা শুধু হ্যাঁ বলুন, বাদবাকি আমি দেখব।’
বাবা বললেন, ‘যেতে চাই ঠিকই। কিন্তু চাইলেই কি যাওয়া যায়? একবার গিয়ে টিকতে পারিনি। আপনি বরং আমাদের সিকান্দারের জন্য একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে দিন।’
সামশাদ পকেট থেকে একতাড়া নোট বের করে গুনে গুনে পাঁচটি এক শ টাকার কড়কড়ে নোট বাবার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘চাকরি নিশ্চয়ই হবে। আপাতত টাকাটা রাখুন।’
বাবার চোখ কৃতজ্ঞতায় ভিজে গেল। সিকান্দার বাধা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু লোকটার ভ্রুকুটি দেখে আর মুখ খুলল না।
খাওয়াদাওয়া সেরে সামশাদকে বড় রাস্তায় এগিয়ে দিতে গেল সিকান্দার। একটা সাদা অ্যাম্বাসেডর লোকটার জন্য অপেক্ষা করছে। সামশাদ একটা খিলি পান মুখে পুরে বলল, ‘তুমি বুদ্ধিমান ছেলে সিকান্দার। বুঝতেই পারছ আমি কেন ছদ্মবেশ ধরে হোটেলে উঠেছি। পাকিস্তানের শত্রুরা দেশটাকে ভেঙে দুই টুকরা করার ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকা পর্যন্ত মাগরিবি পাকিস্তান থেকে মাশরিকি পাকিস্তানকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।’
সিকান্দার বলল, ‘আমাকে কী করতে হবে?’
সিকান্দারের কাঁধে হাত রেখে হালকা চাপ দিল সামশাদ। মধুর হাসি হেসে বলল, ‘২০১ নম্বরের লোকটা পাকিস্তানের শত্রু। ও বেঁচে থাকলে আমাদের অনেক ক্ষতি করবে। তুমি বরং এই জিনিসটা রাখো। কখন কী করতে হবে, আমি বলে দেব। খবরদার, কেউ যেন আমার কথা জানতে না পারে। তোমার বাড়ি ও মা–বাবাকে আমার চেনা রইল।’
লোকটা হাসল। সিকান্দার শিউরে উঠে দেখল, মানুষের জায়গায় যেন একটা দানব হেসে উঠল।
লোকটার বাড়িয়ে দেওয়া রুমালে মোড়ানো বস্তুটি একটা রিভলবার। সিকান্দারের পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করল। সামশাদ রিভলবারটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘কওমের জন্য একটা গাদ্দারকে খুন করবে তুমি। এটা অনেক বড় সম্মান। আশা করি, সম্মানের মর্যাদা তুমি রাখবে।’
অ্যাম্বাসেডর চলে গেল। বড় রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত পুরোটা রাস্তা সিকান্দার আতঙ্কে কাঁপল। ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল চৌকিতে। সারা রাত তার চোখে ঘুম এল না।
পরদিন ভোরবেলা লজের কাজে যোগ দিল সিকান্দার। ২০১ ও ২০৩ নম্বরের বাসিন্দারা তখনো ঘুমের অতলে। সিকান্দারের হৃৎপিণ্ড যেন লাফিয়ে গলায় উঠে এসেছে। সামশাদের আদেশ মোতাবেক রিভলবারটা কোমরে গুঁজে এনেছে। মারণাস্ত্রের ঠান্ডা স্পর্শ সিকান্দারের শিরদাঁড়ায় বারবার হিমেল প্রবাহ বইয়ে দিচ্ছে। এপ্রিলের গরমেও তার শীত লাগতে শুরু করল।
সামশাদই প্রথম ঘুম থেকে উঠল। দরজা খুলে একবার বারান্দা থেকে ঘুরে গেল। তাকে দেখে টেবিলে বসা সিকান্দার মূর্তির মতো জমে রইল। সামশাদ কিন্তু দিব্যি স্বাভাবিক। চোখাচোখি হলেও একটা কথা বলল না।
২০১ নম্বরের বাসিন্দা যথারীতি সাতটায় উঠে পড়ল। সাতটা পনেরোয় আকাশবাণীতে সংবাদ প্রচারিত হয়। ব্রাশ করতে করতে সে বারান্দায় এসে সিকান্দারের সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের খবর শুনল। আজ রোববার। সংবাদে বলছে, বাংলাদেশে গতকাল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে। নবগঠিত সরকার দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে বিশ্ববাসীর সহযোগিতা কামনা করেছে।
সিকান্দারকে হোটেল থেকে নাশতা এনে দেওয়ার ফরমাশ করে লোকটা রুমে চলে গেল। সিঁড়ি ভেঙে সিকান্দার নিচে নামছে, এমন সময় সামশাদ এসে তাকে আটকাল। ক্রুদ্ধ সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলল, ‘নাশতা নিয়ে সোজা ওর রুমে যাবে। খেতে বসলেই রিভলবারের এক গুলিতে খতম করবে। বুঝতে পেরেছ?’
সিকান্দারের মুখ ভয়ে কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। সামশাদ বলল, ‘রিভলবার চালাতে পারো তো? খুব সহজ। প্রথমে টার্গেট ঠিক করে হাতুড়িটা টেনে তারপর ট্রিগার টিপবে। সামান্য শব্দ হবে। তাতে ভয়ের কোনো কারণ নেই।’
সিকান্দার সম্মোহিতের মতো নিচে নামতে নামতে শুনল সামশাদ বলছে, ‘তোমার বাড়ি ও মা-বাবাকে আমার চেনা আছে। উল্টাপাল্টা কিছু করার আগে কথাটা মনে রেখো।’
বাঙালি লোকটি প্রতিদিন একই নাশতা করে। পরোটা, বুটের ডাল, ডিমের অমলেট আর চা। মেনুটা হোটেলের পরিবেশকদেরও মুখস্থ হয়ে গেছে। সিকান্দার কেবল ২০১ বলতেই দুই মিনিটের মধ্যে নাশতা রেডি হয়ে গেল। কাঁপা হাতে নাশতার থালা নিয়ে সিকান্দার পড়ল মস্ত বিপদে। কদিন আগেও বাংলাদেশি লোকটা ছিল তার দুই চোখের বিষ। সুযোগ পেলে তাকে খুন করার কথাও ভেবেছিল সে। আজ সেই সুযোগ এসেছে। কিন্তু লোকটাকে সে আর ঘেন্না করে না। তার দিকে রিভলবার তাক করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আর নেই। অথচ সামশাদ প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে রেখেছে। লোকটাকে হত্যা না করলে হয়তো সপরিবার সিকান্দারকে লাশ হতে হবে।
নিচতলা থেকে দোতলার পথটা অনেক কষ্টে উঠল সিকান্দার। সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ উঠতে গিয়ে দুই পায়ে প্রচণ্ড চাপ পড়ল। হৃৎপিণ্ড পুরোদমে ধকধক করছে। এত জোরে যে সিকান্দারের ভয় হলো, রিসেপশনে বসা গনি সাহেব বোধ হয় সিকান্দারের বুকের ধড়ফড়ানি শুনতে পাচ্ছেন।
২০১ নম্বর রুমের দরজা খোলাই ছিল। প্রায় টলতে টলতে ঘরের ভেতর ঢুকল সিকান্দার। লোকটা টেবিলে বসে কাউকে চিঠি লিখছে। তার সামনে নাশতার থালা রেখে মাটির কলসি থেকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি ঢেলে আনল সে। অন্য দিন সে সঙ্গে সঙ্গে বাইরে চলে যায়। আজ চুপচাপ লোকটার পেছনে দাঁড়িয়ে রইল।
লোকটা একমনে লিখেই যাচ্ছে। সিকান্দারের কোমরে রিভলবারটা বিষফোঁড়ার মতো প্রচণ্ড যন্ত্রণা করতে শুরু করেছে। দুই হাতের আঙুল কাঁপছে থরথরিয়ে। সে একবার লোকটার দিকে, আরেকবার দরজা গলে বাইরে তাকিয়ে রইল।
২০৩ নম্বরের দরজা খট করে খুলে গেল। পাল্লার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল সামশাদের মুখ। একরাশ ভ্রুকুটি নিয়ে সিকান্দারের দিকে তাকিয়ে আছে।
লোকটা চিঠিটা একটা হলদে খামে ভরে জিব দিয়ে চেটে বন্ধ করে দিল। একবার পেছন ফিরে সিকান্দারকে দেখে নাশতার থালায় হাত দিয়ে বলল, ‘কিছু বলবে?’
সিকান্দার চমকে উঠে কোমরে হাত দিল। কোমর থেকে বের করে আনল কোল্ট সিঙ্গেল অ্যাকশন আর্মি রিভলবারটি। লোকটা পরোটা মুখে পুরে ধীরে ধীরে চিবোচ্ছে। সিকান্দারের দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। ওদিকে সামশাদ শ্বাপদের মতো ধীরে ধীরে ২০১ নম্বরের দিকে এগোচ্ছে। সামশাদকে আসতে দেখে সিকান্দার লোকটার মাথা বরাবর রিভলবার তাক করল। হাতুড়ি টেনে ধরতেই সামশাদের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে চোখের ইশারা করে ঘাড়টা কাত করল একবার।
বিদ্যুৎগতিতে সিকান্দারের রিভলবারের নল ঘুরে গেল সামশাদের দিকে। সর্বশক্তি দিয়ে সে ট্রিগার চেপে ধরল সামশাদের কপাল বরাবর। প্রচণ্ড শব্দে লোকটা লাফিয়ে উঠল। বারান্দার দুটো কাক কা কা করে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাল। সামশাদের শরীর প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ল মেঝেতে। আর উঠল না।
লোকটা অস্ফুট স্বরে বলল, ‘এ কী করলি সিকান্দার?’
বাঁ হাতে কপালের ঘাম মুছে সিকান্দার বলল, ‘এক দুশমনকে খতম করলাম সাব।’