ভূতের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলা
আমাদের ক্লাবের নাম প্রভাতি সংঘ। আমরা ব্যাডমিন্টন ম্যাচ খেলব উদয়ন ক্লাবের সঙ্গে।
শীতকাল। আমরা, পাইকপাড়ার তরুণেরা আমাদের প্রাইমারি স্কুলের মাঠে কোর্ট কেটেছি। দুই পাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতেছি। ব্যাডমিন্টনের নেট সেখানেই ফিট করাই থাকে। দিনের বেলা মাঠে গরু চরে। রাতের বেলা আমরা ব্যাডমিন্টন খেলি। পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি থেকে আমরা অবৈধ সংযোগ নিয়েছি। রাতের বেলা দুই পাশে ২০০ পাওয়ারের ১২টা লাইট জ্বলে। এটাকে আমরা বলি, ফ্লাডলাইট। রাতের বেলায় কোর্টটা একেবারে দিনের আলোর মতো ফকফকা দেখা যায়। আমাদের ফুর্তির সীমা নাই।
আমাদের প্রভাতি সংঘে আছেন উপজেলা চ্যাম্পিয়ন সাদেক ভাই। সাদেক ভাইয়ের গায়ের রং হলুদ, তার নাক চ্যাপটা, চোখ ছোট। আমাদের ধারণা, তিনি চীনা বংশোদ্ভূত। এই কারণে তিনি এত ভালো ব্যাডমিন্টন খেলেন।
সিঙ্গেলসে তো আমরা জিতবই। ডাবলসে কী হবে, বলা মুশকিল। কারণ, সাদেক ভাইয়ের পার্টনার বাবু তেমন ভালো খেলেন না। এর চেয়ে হায়দার ভাই ভালো খেলেন। সাদেক ভাই তাঁকে নেবেন না।
আমার নাম পাবলো। আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। আমি প্রভাতি সংঘের সাধারণ সম্পাদক। সভাপতি হিসেবে আমরা রেখেছি আমাদের প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরিতোষ হালদারকে।
আমি সাদেক ভাইকে বললাম, সাদেক ভাই, আপনার পার্টনার হিসেবে হায়দার ভাইকে নেন। তাহলে ডাবলসেও আমরা শিওর জিতে যাব।
সাদেক ভাই বললেন, হায়দারের অসুবিধা আছে।
কী অসুবিধা।
ও ডান পাশে ভালো। আমি বাঁ পাশে ভালো। আমার বাঁয়েরগুলো যদি আমি মারতে যাই, হায়দারের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি হবে। দুজন একই দিকে ভালো হলে সুবিধা। বাবু আর আমার মধ্যে বোঝাপড়া ভালো।
রাত আটটায় খেলা শুরু হবে। প্রথমেই ডাবলস। উদয়ন ক্লাব একজন নতুন খেলোয়াড় এনেছে। তার নাম ওরা দিয়েছে ডাবলু। উদয়ন ক্লাবের সেক্রেটারি সোহাগ বলল, ডাবলু মানে ডাবল ইউ। আনবিটেন আপার ক্লাস। তোরা পারবি না।
ডাবলুর সঙ্গে পার্টনার হয়েছে মোটকু মন্টু। ডাবল এম।
আমি সোহাগকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ডাবল এমকে নামালি কেন? ও তো কিছুই পারে না।
কী বলব। ওর বাবা আমাদের কুড়ি হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছেন। শর্ত একটাই, ডাবলসে ওকে নিতে হবে। আমরা বললাম, তাহলে আমরা নির্ঘাত হারব।
ওর বাবা আরও পাঁচ হাজার টাকা দেখিয়ে বললেন, হারলে এই পাঁচ হাজার দেব ক্ষতিপূরণ হিসেবে। আমার ছেলেটাকে খেলাধুলা করতে হবে। ডাক্তারের নির্দেশ। তা না হলে ওর ডায়াবেটিস হয়ে যাবে। ব্লাড প্রেশার হবে। আরও কী কী সব হবে।
রাতের বেলা ফ্লাডলাইট প্লাবিত কোর্টে আমাদের টুর্নামেন্ট শুরু হলো।
সাদেক ভাই গলদঘর্ম। এই শীতেও তিনি কুল কুল করে ঘামছেন। ডাবলু তো সেই রকম খেলে। সে লাফাচ্ছে না, যেন উড়ে যাচ্ছে।
আমি সাদেক ভাইকে বললাম, আপনি ডাবলুর দিকে কর্ক মারবেন না। আপনাকে মারতে হবে ওই ডাবল এমের দিকে। মোটকু মন্টুর দিকে।
তা-ই হলো। আমাদের সাদেক ভাই আর বাবু সব কর্ক পাঠাতে লাগলেন মোটকু মন্টুর দিকে। সেটাও পারলে ডাবলু এসে মেরে দেয়।
বহু কষ্টে একটা গেমে আমাদের ক্লাব জিতল।
পরেরটা ডাবল এম ঠিকঠাক জিতিয়ে দিল।
এখন রাত প্রায় এগারোটা বাজে। গ্রাম এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। মড়াঘাটির এই দিকটা বেশ নির্জন। দূরে শিয়াল ডাকছে। ঝিঁঝির ডাক তো আছেই। আস্তে আস্তে গাছগাছালির নিচে চলে এলাম। ঘন অন্ধকার। আকাশে তাকিয়ে দেখলাম, চাঁদের দেখা নেই। আজ কি অমাবস্যা নাকি?
মোটকু মন্টুর বাবা খেলা দেখতে এসেছেন। তিনি বললেন, আমার ছেলের দান তুমি মারো কেন। ওর কাছে যা আসবে, সে-ই ব্যাট চালাবে। পারলে পারবে, না পারলে পারবে না। খেলা হলো অংশগ্রহণের জন্য। সবে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। এই যে পাঁচ হাজার টাকা। তোমরা হারলে এটা সঙ্গে সঙ্গে পাবে।
ডাবলু বলল, আচ্ছা, তাহলে সিঙ্গেলসে যদি জিতি, তাহলে আমাকে কিন্তু আস্ত রুইয়ের মাথা দেবেন।
তা দেব। মন্টুর বাবা হেসে বললেন। তিনি পান চিবুচ্ছিলেন। পানের পিক ফেললেন কোর্টের মধ্যেই।
ডাবলসে আমাদের ক্লাব প্রভাতি সংঘ জিতে গেল। তা সম্ভব হলো ডাবল এম, মানে মোটকু মন্টুর অপদার্থতার জন্য।
এরপর হবে সিঙ্গেলস। আমাদের সাদেক ভাই বনাম ওদের ডাবলু।
ডাবল ইউ। আনবিটেন আপার ক্লাস।
সাদেক ভাই সার্ভ করেন, ডাবলু কোত্থেকে যেন উড়ে গিয়ে সেই কর্ক ফেরত পাঠিয়ে দেয়। সাদেক ভাইও চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়। এত সহজেই ছাড়ার পাত্র নন। একেকটা সার্ভিসের পর খেলা চলে মিনিট পাঁচেক ধরে। কেহ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান।
ফাইনালি আমাদের সাদেক ভাই হেরে গেলেন ডাবলুর কাছে। ডাবলুকে আমার মনে হলো অন্য কোনো গ্রহের একজন খেলোয়াড়।
ট্রফি বিতরণ হলো। প্রধান শিক্ষক পরিতোষ বাবু আর মন্টুর বাবা মিলিতভাবে ট্রফি তুলে দিলেন বিজয়ীদের হাতে।
আমার মনে কেমন যেন সন্দেহ হতে লাগল। কে এই ডাবলু। এর পরিচয় বের করতে হবে।
খেলা শেষে সবাই যার যার বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। আমি এবার ডাবলুর পিছু নিলাম। হালকা-পাতলা শ্যামলা বরণ একটা ছেলে। ও ধীরে ধীরে হেঁটে মড়াঘাটির দিকে হাঁটা ধরল। মড়াঘাটির দিকে এত রাতে? নদী মরে গেছে। শুকনা একটা খাল পড়ে আছে। তার পাশে আগে শ্মশান ছিল। তাই এর নাম মড়াঘাটি।
এখন রাত প্রায় এগারোটা বাজে। গ্রাম এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। মড়াঘাটির এই দিকটা বেশ নির্জন। দূরে শিয়াল ডাকছে। ঝিঁঝির ডাক তো আছেই। আস্তে আস্তে গাছগাছালির নিচে চলে এলাম। ঘন অন্ধকার। আকাশে তাকিয়ে দেখলাম, চাঁদের দেখা নেই। আজ কি অমাবস্যা নাকি?
নিজের গা দেখা যায় না, এমন অন্ধকার। সামনে চলেছে ডাবলু। পেছনে আমি।
কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না, এমন কালো আঁধারে পৃথিবী মোড়ানো। শুধু ডাবলুর পায়ের শব্দ শুনছি।
আমি আমার মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বালালাম। পথের ওপর ফেললাম। অনেক ঝোপঝাড়, কাঁটা, গুল্মলতায় ভরা একটা জায়গা।
আলো গিয়ে পড়ল ডাবলুর ওপর।
ডাবলু ফিরে তাকাল। তারপর বলল, কে রে?
আমি পাবলো। প্রভাতি সংঘের সেক্রেটারি।
কী চাও?
তোমাকে চাই। তুমি কি আমাদের হয়ে খেলবে? আমরা উপজেলা চ্যাম্পিয়ন। সামনে জেলায় যাব খেলতে।
খেলতে পারি। কিন্তু আমাকে রুই মাছের মাথা খেতে দিতে হবে।
দেব।
ঠিক আছে খেলব।
তাহলে তোমার মোবাইল নম্বর দাও।
আমার তো মোবাইল ফোন নাই।
তাহলে তোমার অ্যাড্রেস দাও।
আমি? আমি ওই শেওড়াগাছে থাকি।
কী বলছ তুমি?
কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার পা দুটো ভালো করে দেখো। কেডস উল্টো করে পরা। পেছন দিকে আমার পা।
আমি টর্চের আলো ফেলে দেখলাম, ঘটনা সত্য। ডাবলুর পায়ের পাতা সামনের দিকে নয়। পেছনের দিকে বাড়ানো। সেটা ঢেকে রাখার জন্য সে খুব ঢোলা প্যান্ট পরেছে।
এরপর ডাবলু নাকি সুরে বলতে লাগল, এঁই আঁমি রুঁই মাঁছের মাঁথা খাঁব। আমাকে রুই মাছের মাথা এনে দাও।
সঙ্গে সঙ্গে আমি উল্টো দিকে দৌড় ধরলাম। জ্ঞান যে হারাইনি, সে আমার ময়মুরব্বির দোয়ার বদৌলতে।
সোজা বাড়ি চলে এলাম। আমাদের বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার ঘরের দরজা বাইরে থেকে খোলার বুদ্ধি আমি করে রেখেছি। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে লাইট জ্বালিয়ে আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
ঘুম যখন ভাঙল, তখন বাজে ১০টা। বাইরে রোদ। মা এসে বললেন, এই ছেলে, আর কত ঘুমাবি। ওঠ।
আমি মা আর আলো দেখে চোখ রগড়ে বিছানা ছাড়লাম।
আজ একবার যেতে হবে মড়াঘাটির শেওড়াগাছের তলায়। ডাবলুর রহস্যটা কী, আমাকে বের করতেই হবে। কিন্তু যেই ডাবলুর পায়ের গড়ন মনে পড়ছে, অমনি ভয়ে সমস্ত শরীর শিউরে উঠছে। তাহলে কি আমরা কাল রাতে ভূতের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলেছিলাম?