দ্বিতীয় পর্ব
রানির মুকুট রহস্য
মার্কিন লেখক ম্যাক বার্নেটের জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ ‘কিড স্পাই’। এই সিরিজের প্রধান চরিত্রের নামও ম্যাক বার্নেট। ছোট্ট ম্যাককে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ বিভিন্ন মিশন দেন, সেগুলো সম্পন্ন করে ম্যাক। এই সিরিজের প্রথম বই ‘ম্যাক আন্ডারকভার’-এ ইংল্যান্ডের রানির হারিয়ে যাওয়া রত্ন খুঁজবে ম্যাক। এই অ্যাডভেঞ্চারে তোমাদের স্বাগত!
অধ্যায় ২: স্পাই প্লেন
একমুহূর্ত আগে স্রেফ একটা বাচ্চা ছিলাম আমি, ঠিক পরের মুহূর্তেই হয়ে গেলাম ইংল্যান্ডের রানির গোপন এজেন্ট! আগের রাতে বাড়ির কাজ করছিলাম, কিন্তু আজ রাতে প্লেনে চড়ে যাচ্ছি লন্ডনের পথে, সঙ্গে একটাও বই নেই।
ক্যালিফোর্নিয়া থেকে লন্ডন যেতে অনেক সময় লাগে। আমরা সারা রাত আকাশে উড়ছিলাম। জানালার বাইরে আকাশ ছিল কালো। ডানার ওপর বিশাল এক জেট ইঞ্জিন গর্জন করছিল। ভাবছিলাম, এই মিশন কত দিনে শেষ হবে? আজ বুধবার, আর আগামী শনিবার ডেরেক লাফয়ের জন্মদিনের পার্টি। ওর পার্টির আগে ফিরতে পারলে ভালো হতো। অবশ্য ডেরেক আমাকে এখনো আমন্ত্রণই জানায়নি। সম্ভবত ক্লাসের একমাত্র ছেলে হিসেবে স্কুলের পরে কারাতে না করার কারণে ও আমাকে দাওয়াত দেয়নি। আমাদের ক্লাসের অর্ধেক মেয়েও কারাতে করত। সময়টা ছিল আশির দশক। তখন কারাতে ছিল বিশাল ব্যাপার!
আমার মা দেরিতে বাড়ি ফিরতেন। তাই স্কুল শেষে আমি একটা ডে কেয়ারে থাকতাম। ওটার নাম ছিল ‘এক্সটেন্ডেড অ্যাডভেঞ্চার আফটার-স্কুল ডে কেয়ার’। কিন্তু ওখানে কোনো অ্যাডভেঞ্চারই ছিল না! ডে কেয়ারে আমি সবার চেয়ে দুই ক্লাসের বড় ছিলাম। ওখানে গিয়ে প্রথমে হোমওয়ার্ক করতাম, তারপর ছোটদের সঙ্গে খেলতাম দাবা। যতক্ষণ না মা এসে নিয়ে যেতেন, ততক্ষণ ছোটদের সঙ্গে দাবা খেলতাম। কিন্তু এখন যেহেতু আমি রানির গোপন এজেন্ট, তাই ডেরেক হয়তো আমাকে পার্টিতে ডাকবে। আমি আশা করছি, এই মিশনে কারাতের কোনো প্রয়োজন হবে না।
চারপাশে যাত্রীদের দিকে নজর রাখছিলাম, খেয়াল রাখছিলাম কেউ আমাকে ফলো করছে কি না। হয়তো কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। (ভালো গুপ্তচরেরা সব সময় আশপাশের মানুষদের খেয়াল রাখে।) আচ্ছা, আমার পেছনের লোকটা কেন সানগ্লাস পরে আছে? এটা কি আমাকে লুকিয়ে দেখার জন্য? আমি তার চোখ দেখতে পাচ্ছি না ঠিকই, কিন্তু সে আমার দিকে নজর রাখছে। হয়তো খবরের কাগজ হাতে নিয়ে শুধু পড়ার ভান করছে, কিন্তু ঠিকই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আর ওই মহিলা কেন বারবার পারফিউম দিচ্ছে? তার বোতলে কি সত্যিই পারফিউম আছে, নাকি ওটা অজ্ঞান করার গ্যাস? আর ওই বাচ্চাটা? ও আমার দিকে প্রায় ১০ মিনিট একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে! ও কি আসলে কোনো সাধারণ বাচ্চা, নাকি কেজিবির হয়ে কাজ করা কোনো শিশু গুপ্তচর? কেজিবি এখন আর নেই, কিন্তু আমার ছোটবেলায় ওটা বেশ ভালোভাবেই ছিল। কেজিবি হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচর সংস্থা। অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নই এখন আর নেই!
কেজিবির পুরো নাম ছিল ‘Комитет государственной безопасности’। এটা একটা রুশ নাম। ইংরেজিতে কেজিবি মানে ‘কমিটি ফর স্টেট সিকিউরিটি’। কিন্তু এর আসল মানে সোভিয়েত স্পাই বা সোভিয়েত গোয়েন্দা। রাজপরিবারের হীরা চুরির মতো কাজ ওরাই করত। অর্থাৎ আমি হয়তো সরাসরি কেজিবির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি! যেন দাবার বোর্ডে এক বিপজ্জনক খেলা শুরু হয়েছে। কারাতে খেলায় ভালো না হলেও দাবায় কিন্তু আমি বেশ দক্ষ।
আসলে ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর হতে পারত। সানগ্লাস পরা লোকটা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল নকল নাক ডাকা। মহিলাটি আবার পারফিউম স্প্রে করল। গন্ধ আগের তুলনায় আরও খারাপ, যেন অজ্ঞান করার গ্যাসের মতো। বাচ্চাটা খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসিটা খুব মিষ্টি ছিল, কিন্তু কেমন যেন সন্দেহজনক! আমি এত উত্তেজিত ছিলাম যে ঘুমাতে পারছিলাম না। তাই মাথা ঠান্ডা করার জন্য সব সময় যা করি, তখনো তা–ই করলাম। গেম বয় বের করলাম, কানে হেডফোন লাগালাম, খেলতে শুরু করলাম আমার প্রিয় গেম স্পাই মাস্টার।
এই গেমের গ্রাফিকস হয়তো আরও ভালো হতে পারত, কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমি আশির দশকের কথা বলছি। অতএব বাস্তবতা মানতেই হবে। চাইলেও তখন ভালো গ্রাফিকসের গেম পাওয়া সম্ভব ছিল না।
স্পাই মাস্টার আমার সবচেয়ে প্রিয় গেম। একটি লেভেল শেষ করতে হলে কেজিবির হেডকোয়ার্টারে ঢুকে ওপরের তলা থেকে কিছু গোপন নথি চুরি করতে হবে, তারপর ছাদ থেকে প্যারাস্যুটের সাহায্যে নেমে আসতে হবে নিচে। পুরোটা সময় লিফটের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়া থেকে বাঁচাতে হবে নিজেকে। আবার কেজিবি কিছু এজেন্টকে রেখেছে অনবরত ডিনামাইট ফেলে আমাকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। সেসবের হাত থেকেও বাঁচতে হবে। দারুণ একটা গেম!
এই গেমের সেরা ১০টি স্কোরই ছিল আমার। গেমে তিন অক্ষরের নাম লেখা যেত। আমি ওখানে ম্যাক (MAC) লিখতাম। দেখতে খুব সুন্দর লাগত। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবগুলো নাম আমার। কারণ, গেমে শুধু সেরা ১০ জনের নামই দেখাত। আমি আমার আগের রেকর্ডটা ভাঙতে যাচ্ছিলাম, তখনই কেউ কাঁধে টোকা দিল।
একজন বিমানবালা। একটা বড় খাবারের ট্রলি ঠেলে আনছে। হাসিমুখে সে কিছু বলছিল, কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। কারণ, আমার কানে স্পাই মাস্টারের থিম সং বাজছিল। হেডফোনটা খুলে ফেললাম।
‘কিছু খাবেন, স্যার?’ জিজ্ঞেস করল বিমানবালা।
‘এক গ্লাস দুধ, প্লিজ,’ বললাম আমি।
সে আমাকে একটা প্লাস্টিকের কাপ দিল। হঠাৎ প্লেনটা একটু কেঁপে উঠল।
‘ওহ!’ বলল বিমানবালা। সে আমার সামনের সিটের পেছনে থাকা কাপ হোল্ডারে দুধের কাপটা রাখল। তারপর বলল, ‘সাবধান! নিশ্চয়ই দুধটা আপনার জিনসে ফেলতে চাইবেন না।’
‘ধন্যবাদ,’ বললাম আমি। ‘এটাই আমার একমাত্র জিনস।’
‘বাহ! খুব সুন্দর,’ সে বলল। ‘দারুণ ফিট হয়েছে।’
একটু হাসলাম আমি। সত্যিই, জিনসটা পুরোপুরি ফিট হয়েছে।
সে আমার দুধের কাপের পাশে একটি প্লাস্টিকের বাক্স রাখল।
‘এটা আপনার রাতের খাবার।’
খাবারের বাক্স থেকে টিনফয়েল সরিয়ে দেখলাম, পাস্তা, সবুজ বিন ও এক কাপ চকোলেট পুডিং। পাস্তা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এতে কি পনির আছে?’ কিন্তু বিমানবালা ইতিমধ্যে অন্য যাত্রীদের কাছে চলে গেছে।
প্রথমে পুডিং খেলাম, তারপর পাস্তা। সবুজ বিন ছুঁয়েও দেখলাম না। কিন্তু তারপরেই যেন সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে এল চারপাশ। পুডিংয়ে নিশ্চয়ই ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। পাস্তায় পনিরও থাকতে পারে। কারণ, খুব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলাম। আর প্লেনে হয়তো কোনো চোরও ছিল। কারণ, ঘুম ভাঙতেই দেখি, আমার গেম বয় উধাও!
* ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান রত্ন ও গহনার সংগ্রহকে ক্রাউন জুয়েলস বলা হয়। রাজপরিবারের ঐশ্বর্যের প্রতীক হিসেবে এগুলো ব্যবহৃত হয়। রাজমুকুট, রাজদণ্ড, রাজকীয় আংটিসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক রত্নের সংগ্রহকে ব্রিটিশরা ক্রাউন জুয়েলস বলে। [অনুবাদক]