আমিনুলের ঘরে ওটা কী

অলংকরণ: সাঈফ মাহ্‌মুদ

আমিনুলকে কোনো বিষয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। ছেলেটার বয়স খুব বেশি নয়। চেহারা, শরীর দেখে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বয়স ত্রিশের নিচে। হাসি–খুশি, উদ্যমী। সময়মতো গ্যারেজ ধোয়। ট্যাংক থেকে পানি উপচে পড়ার আগেই কল বন্ধ করে। আসতে–যেতে সালাম দেয়। বেশ চমৎকার লাগে আমার।

কিন্তু সন্দেহ বিষয়টা আসে একদম হুট করেই। আর একবার চলে এলে ধীরে ধীরে আরও ঘনীভূত হয়। আমার ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছে।

নয়টা-ছয়টা চাকরি করি, পরিবার নিয়ে ব্যস্ত জীবন কাটাই। আলাদা করে কাউকে নজরদারিতে রাখা আমার জন্য কঠিন। কিন্তু আমিনুল ঠিকই আমার মনোযোগ কেড়েছিল।

ঘটনাটা গত পরশু রাতের। বাচ্চারা জেদ করায় আইসক্রিম আনতে নিচে যাচ্ছি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেট খোলার সময় মনে পড়ল চাবি নিয়ে আসিনি। কিছুদিন থেকেই বাড়িওয়ালা এই তালা-চাবির নিয়ম করেছে। কিন্তু সিঁড়ি ভেঙে আবার সাততালায় উঠে চাবি আনার ক্লান্তিকর কাজ করতে ইচ্ছা করছে না। হঠাৎ মাথায় এল, আমিনুলকে ডাকলেই চলে। গেটের পাশে গ্যারেজের ভেতরই ওর রুম। ছেলেটার কাছেই গেটের চাবি পাওয়া যাবে।

গ্যারেজে ঢুকে দেখলাম, আমিনুলের রুমের লাইট বন্ধ। সবে সাতটা বাজে, এখনই ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে? তা–ও নিশ্চিত হওয়ার জন্য এগোলাম দরজার কাছে। ভাবছি, একবার ডাক দেব কি না। এমন সময় ভেতর থেকে শুনতে পেলাম আমিনুলের ফিসফিসানো গলা। কিছু একটা বলছে ও! খুব অস্পষ্টভাবে, কারও রাগ ভাঙানোর জন্য বলা আদুরে শব্দ। তবে কোন ভাষায় কথা বলছে, আমার জানা নেই। ওটা আর যা–ই হোক বাংলা না।

অশরীরী একটা শীতল অনুভূতিতে গা শিরশির করে উঠল।

কার সঙ্গে কথা বলছে ও? আপনমনে?

জবাবটা নিজ থেকেই এল। আমিনুলের কথার শেষে প্রচণ্ডভাবে রুমের ভেতর হিসহিস করে উঠল কিছু একটা। ভয়ে দুই পা পিছে এলাম। পা পড়ল মাটিতে থাকা রডের ওপর। ধাতব ঝংকার উঠল ফাঁকা জায়গায়।

ঘটনার প্রভাবে আমার চিন্তাশক্তি তখন লোপ পেয়েছে প্রায়। তাই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দরজা খুলে বের হয়ে এল আমিনুল। আমাকে দেখেই কাগজের মতো সাদা হয়ে উঠল ওর মুখ।

ঠিক তখনই সন্দেহটা জন্ম নিল, সেটাকে দৃঢ় করল ওর ফ্যাকাশে চেহারা। আমি বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলাম সন্দেহটাকে, ‘আমিনুলের ঘরে ওটা কী থাকে?’

২.

ব্যাপারটাকে সন্দেহ না বলে প্রশ্ন বলা উচিত। কারণ, আমার জানা নেই হিসহিস করে ওঠা ওই জিনিসটা কী! তা ছাড়া গতকালের ঘটনাটা আমার মনের ভুল হতেই পারে। হয়তো আমিনুল আপনমনে ফিসফিস করছিল। বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আসা একটা মানুষের জন্য এমন করা স্বাভাবিক। কিন্তু আমিনুলের ফ্যাকাশে চেহারা আমাকে মনে করাচ্ছে, হিসহিস শব্দটা সত্য, মনের ভুল নয়।

আমি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে শুরু করলাম, ওটা কী হতে পারে?

প্রথমেই মানুষকে বাদ দেওয়া যায়। এমন শব্দ কোনো মানুষ করতে পারে না। পশুপাখির কথা চিন্তা করলে পাখি বাদ। তাহলে হিসাবে থাকে হাতে গোনা কিছু প্রাণী। কুকুর, বিড়াল—এসব। কিন্তু একটা হিসাব কিছুতেই মিলছে না। সেটা হলো আমিনুলের আচরণ। গতকালের পর থেকে ও আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, গ্যারেজের দিকে গেলেই মনে হচ্ছে আগলে রাখছে রুমের দরজা। সঙ্গে ওই দিন রাতের ফ্যাকাশে চেহারা! না, না, এমন কেন করবে ও? কী এমন সমস্যা রুমে কুকুর, বিড়াল থাকলে?

সন্দেহের বাতিক বড় ভয়ানক। একমুহূর্ত শান্তি দেয় না। তাই পরের শুক্রবার সকালে আমিনুল যখন বাড়িওয়ালার বাজার আনতে বের হলো, আমি হাজির হলাম ওর রুমের সামনে। কান পাতলাম দরজায়।

কোনো সাড়াশব্দ নেই। বোঝাই যাচ্ছে না ভেতরে কিছু আছে। কিন্তু আমি কিছু একটার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছি, জ্যান্ত কিছু। কয়েকবার দরজায় টোকা দিলাম, শব্দও করলাম মুখ দিয়ে। তা-ও লাভ হলো না। এদিকে সময়ও হাতে বেশি নেই। ওই দিনের পর থেকেই আমিনুল রুম ছেড়ে কাজ বাদে বের হয় না। বের হলেও ফিরে আসে জলদি।

শেষমেশ একটা বুদ্ধি মাথায় এল, হাতের জোরের আওয়াজে প্রাণীটার টনক নড়ছে না। আরও জোরে শব্দ করা গেলে কিছু একটা হতে পারে। গ্যারেজ থেকে একটা চ্যালা কাঠ উঠিয়ে নিলাম। জোরে দম নিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে বাড়ি দিলাম দরজায়।

সপাট!

তৎক্ষণাৎ, হিসসসসসস শব্দ ভেসে এল ভেতর থেকে। সঙ্গে ঘড়ঘড় গোঙানি।

এই স্বর সতর্কতার, আদিমকাল থেকে সরীসৃপ প্রাণীদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। কাছাকাছি একটা প্রাণীর চেহারাই ভেসে এল আমার মনে।

সাপ!

আমিনুল সাপ পুষছে?

৩.

বিদেশে পোষা প্রাণী হিসেবে সাপ পোষা এখন অহরহ। আমাদের দেশেও সাপুড়েরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সাপ পোষে। কিন্তু আমিনুলকে দেখে আমার কখনোই সাপ পোষার মতো মানুষ মনে হয়নি। ওই দিন ছাদে বাচ্চারা কেঁচো পাওয়ার পর যখন আমিনুলকে ডাক দিল, তখন ওর চেহারায় আমি ঘৃণা দেখেছি। স্পষ্ট মনে আছে আমার। এই ছেলে সাপের সঙ্গে মৃদু গলায় কথা বলবে এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

দেরিতে হলেও আরেকটা ব্যাপার আমার নজরে পড়েছে। কখনো বাতি জ্বলে না আমিনুলের ঘরে। সব সময় নিজের ঘরকে ও অন্ধকার করে রাখে। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ওর ঘরের যে জানালা দেখা যায়, সেটাতেও দেওয়া থাকে পর্দা।

সাপ কি আলো সহ্য করতে পারে না? সহজলভ্য নিশাচর সাপের কথা আমি কখনো শুনিনি। এই প্রজাতি রোদ পোহাতে বেশ পছন্দ করে।

তাহলে সিদ্ধান্তে আসা যায়, প্রাণীটা সাপ নয়।

এরপর আসলে আমি ভাবার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। অস্বাভাবিক এই বিষয়টা আমাকে প্রায় অসহ্য করে তুলেছে।

প্রতিদিন সুযোগ বুঝে আমিনুলের রুমের সামনে যাই। এই আশায় যে কিছু জানা যাবে হয়তো। তেমন কিছু না জানলেও একটা জিনিস টের পেলাম।

এখন আর ওটা চুপচাপ থাকে না। ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে আমি তা অনুভব করি। কিছুদিনের মধ্যে বুঝলাম, প্রাণীটা অস্বাভাবিক হারে বড় হচ্ছে। নড়াচড়া, শব্দ—এসব শুনে বুঝতে পারছি। যদি এটা সাপ হয়, তাহলে পৃথিবীর কোনো সাপ এত দ্রুত বড় হয় কি না আমার জানা নেই।

কী করব জানি না, কিন্তু এতটুকু পরিষ্কার যে আমিনুলের রুমে বেড়ে ওঠা প্রাণীটা অশুভ। তিলে তিলে গড়া সন্দেহ তখন পূর্ণশক্তির ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে।

কিছুদিন পর আমিনুল নিজেই বলে দিল আমার করণীয় কী।

৪.

অফিসে মিটিং থাকায় বের হতে হতে নয়টা বেজে গেছে। রিকশা নিয়ে তড়িঘড়ি করে বাসায় আসতেই দেখি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমিনুল। সম্ভবত গেট খোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমি এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম, ওর দুই হাতে পাঁচ-ছয়টা দেশি মুরগি। ‘কক-কক’ করে ডাক ছাড়ছে মাঝেমধ্যে। কিছু না বললে খারাপ দেখায় বলে জিজ্ঞেস করলাম,

‘এই রাতে এত মুরগি?’

প্রশ্নটা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল ও। ভেঙে ভেঙে উত্তর দিল,

‘বাড়িওয়ালারা খাবেন বলে আমাকে দিয়ে আনালেন।’

আমি মাথা নাড়লেও জানি ও মিথ্যা বলছে। কিছুদিন আগে বাড়িওয়ালার স্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন, দেশি মুরগিতে ওনাদের সবার অ্যালার্জি।

আমিনুল মিথ্যা বলছে কেন?

গেট খুলে হাঁটতে শুরু করলাম ওপরের দিকে। আমিনুল দাঁড়িয়ে রইল গ্যারেজের সামনে। মনে হয় অপেক্ষা করছে আমার চলে যাওয়ার জন্য।

ওপরে ওঠার ভান করে আবার পা টিপে নিচে নামলাম। ব্যাপারটা না দেখে ওপরে যাওয়া ঠিক হবে না। এত মুরগি দিয়ে কী করবে ও? খাবে? ওর রুমে কোনো চুলা নেই। বাড়িওয়ালার বাসা থেকেই খাবার পাঠানো হয় ওর জন্য।

সিঁড়ি দিয়ে উঁকি দেওয়ার সময় দেখতে পেলাম, আমিনুল মুরগিগুলো নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে নিজের রুমে।

বেশ অবাক হলাম। কী করতে চায় ছেলেটা?

পরদিন সকালে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রতিদিন এই সময়ে আমি ময়লা ফেলি বিল্ডিংয়ের ডাস্টবিনে। আজকেও তা–ই করতে এসে চোখ গেল একটা স্বচ্ছ পলিথিন ব্যাগে। ওখান থেকে মুরগির অবশিষ্টাংশ উঁকি দিচ্ছে। জানি এই ব্যাগ এখানে আমিনুলই ফেলেছে। বুঝতে পারেনি কেউ কিছু টের পাবে। তবে আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। এক রাতে ছয়টা মুরগি সাবাড় করেছে জিনিসটা। আমিনুল নিজেই বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, আমার সব আন্দাজ ভুল। তাই পথ একটাই।

রুম খুলে দেখতে হবে ওটা আসলে কী।

৫.

আমিনুল কি আমার পরিকল্পনা টের পেয়েছে? মনে হয় না। কাজটা আমি বেশ গুছিয়েই করছি। একটু আগে ওকে ডেকে বললাম সদরঘাট যেতে, লঞ্চের টিকিট করার জন্য। জানিয়েছি সকালেই আমাদের বাড়ি যেতে হবে, ব্যাপারটা অনেক জরুরি।

সদরঘাট আসা–যাওয়া মিলিয়ে আমি ঘণ্টাখানেক সময় পেয়ে যাব। অতটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট।

কিন্তু যাওয়ার আগে এভাবে আমার দিকে তাকাল কেন ও? চোখ দেখে কি বুঝে গেছে মিথ্যা বলছি আমি? জানি না। এই মুহূর্তে জানার ইচ্ছাও নেই, প্রতিটা সেকেন্ড দামি।

ছেলেটা বেরিয়ে যেতেই প্রস্তুত হলাম। খুব বেশি কিছু দরকার নেই, একটা টর্চ হলেই আমার চলে। আর ছয়টা মুরগি এক রাতে যে জিনিস সাবাড় করতে পারে, তার থেকে সতর্ক হওয়া উচিত। গ্যারেজ থেকে কাঠ নিলে নিশ্চিন্ত হতে পারব। তবে কতটুকু বড় হয়েছে প্রাণীটা, আমার ধারণা নেই। ক্ষতি করার মতো বড় হয়নি আশা করি।

সব গুছিয়ে টর্চ হাতে নিচে নামলাম। জিনিসটা কোনো ঝামেলা বাধালে গ্যারেজে চলে আসা যাবে। এখানে ১০০ ওয়াটের ছয়টা বাতি সারা রাত ধরে জ্বলতে থাকে।

রুমটার সামনে যেতেই ওটার নড়াচড়ার আওয়াজ কানে এল। কোনো কিছু বহু কষ্টে নিজের ভারী শরীর টানছে। আরেকবার নিজেকে বললাম, ‘ব্যাপারটা বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না?’

কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে থামার জন্য। পকেট থেকে মাস্টার কি বের করে খুললাম তালা। ধাক্কা দিতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল দরজা। সঙ্গে সঙ্গে নাকে ধাক্কা দিল বোটকা গন্ধ। স্যাঁতসেঁতে ঘরে কটু গন্ধটায় বমি চলে এল। অন্ধকার ঘরে ওটার নড়াচড়ার শব্দ আর শুনতে পাচ্ছি না। গ্যারেজের লাইট থেকে আসা আবছা আলোতে রুমে খুঁজলাম প্রাণীটাকে। কিন্তু কোনো নিশানা নেই। অবশ্য, এত দ্রুত পাওয়ার আশাও করিনি। আমার হাত সামান্য কাঁপছে। বারবার মনে হচ্ছে, বিরাট ভুল করছি আমি। অসম্ভব অশুভ কিছু লুকিয়ে আছে এই পুরো ব্যাপারটায়।

রুমটাকে বিল্ডিংয়ের স্টোররুম বলা চলে। নানান বস্তুর ভিড়ে জায়গাটার আয়তন বিশাল। এখানে এক কোনায় খাট পেতে ঘুমায় আমিনুল।

তাই যেকোনো জায়গায় থাকতে পারে ওটা। লাইটের সুইচ খুঁজলাম আশপাশে, এখনই টর্চ ব্যবহারের ইচ্ছা নেই। জিনিসটা আমার থেকে ছিটকে সরে যেতে পারে।

পেয়ে গেলাম সুইচ বোর্ড, খাটের পাশেই লাগোয়া। এগিয়ে গিয়ে প্রথম সুইচ চাপতে গেলাম। ঠিক তখনই কারেন্ট চলে গেল। গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল রুমসহ পুরো গ্যারেজ।

এই প্রথম ভয় পেলাম আমি। জমে গেল পুরো শরীর। এমন সময় মনে হলো, আমার পেছন দিকে সরসর শব্দ করে সরে গেছে কিছু।

অন্ধকারেও জিনিসটা আমাকে দেখছে? তাহলে আশপাশেই আছে ও। পকেট থেকে টর্চটা বের করে জ্বালালাম। ঘড় ঘড় শব্দ শোনা গেল একটূ দূর থেকে।

আলো পছন্দ করে না ও। বিরক্ত হচ্ছে। কিছু একটা করে বসতে পারে। কিন্তু…গ্যারেজ থেকে কাঠ আনা হয়নি। এই প্রথম অসহায় মনে হলো নিজেকে। ঘাড় ঘোরালাম আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন কিছুর আশায়। কিচ্ছু নেই।

দরকার হবে না মনে হয়, আমি শুধু জানতে চাই, আমিনুলের সঙ্গে কী থাকে। একবার দেখা পেলেই চলে যাব।

তাই খুঁজতে শুরু করলাম। বোটকা গন্ধ আরও বেড়েছে, টর্চের আলো এক জায়গায় আলো দিলেও অন্য সব জায়গায় জমাট বাঁধছে অন্ধকার।

সরসর শব্দটা আসছে আঁধার থেকে। অবস্থা বুঝতে হুসসসসস করে শব্দ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে ফেরত এল প্রচণ্ড হিসহিস আওয়াজ। ভুল হলো, আমাকে শত্রু মনে করল না তো ওটা? কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। প্রথম আক্রমণ হলো হাতে, যেই হাতে টর্চটা ধরা ছিল। অন্ধকার থেকে টর্চ বরাবর ঝাঁপ মারল প্রাণীটা। শত শত ধারালো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল আমার হাত। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম। দাঁত বসে গেছে আমার মাংসে, স্রোতের মতো রক্ত বের হচ্ছে। ছিটকে মাটিতে পড়ে নিভে গেল টর্চ। আবারও অন্ধকার। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় শুয়ে পড়লাম মাটিতে। আরেক হাত দিয়ে প্রাণপণে প্রাণীটাকে ছোটাতে চেষ্টা করলাম। আঠালো শরীর আর মাংসল অংশ ছাড়া আলাদা করে কোনো অঙ্গ অনুভব করতে পারছি না। যতবারই ধরতে চাইছি পিছলে যাচ্ছে। দানবটার আকৃতি এই প্রথম টের পেলাম, ওটা সত্যি বড়, অনেক বড়।

যে হারে রক্ত যাচ্ছে, তাতে অজ্ঞান হয়ে যাব দ্রুত। অসহ্য যন্ত্রণায় নিজের অজান্তেই চিৎকার করছি পাগলের মতো।

বেঁচে থাকার আদিম প্রবৃত্তি থেকে শেষ চেষ্টা করলাম। পকেট থেকে ফোন নিয়ে সামনের বাটন ধরে জ্বালালাম আলো। বাড়ালাম ওই হাতের দিকে।

মুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠল ওই জিনিসটা। ছেড়ে দিল আমায়। আলোতে কিছুক্ষণের জন্য ওটার চেহারা দেখতে পেলাম। কোনো চোখ নেই, কান নেই, শুধু…শুধু আছে একটা চোষকের মতো মুখ, অনেকটা কৃমি বা জোঁকের মতো। ওই গোল চোষকের ভেতর অজস্র ধারালো দাঁত, যেগুলোতে এখন আমার রক্ত লেগে আছে। কাঁপছে ওর মাড়ির মাংসল অংশ। রক্তগুলোকে টেনে নিচ্ছে পেটের ভেতর। জোঁকের মতো বিরাট তেল চিটচিটে শরীর। খোলস ছাড়ানো তেলাপোকার মতো সাদা।

সামান্য সময় পেলাম আমি । টেনে নিজেকে দাঁড় করালাম। রক্তের স্বাদ পেয়েছে ওটা। এখন মুরগিগুলোর সঙ্গে আমার কোনো পার্থক্য নেই ওর কাছে।

দৌড়ে চলে এলাম গ্যারেজে। অন্ধকার অনেকটা সয়ে এসেছে। খাঁজকাটা গ্রিলের ফাঁকে গ্যারেজে গলে পড়ছে জোছনা। মেঝেতে একটা কাঠ পাওয়া গেল। ওটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম আমিনুলের রুম বরাবর। মুহূর্তে আমার সামনে এসে গেছে ওটা। দানবটা আকারে আমার প্রায় দ্বিগুণ। ফণা তোলার মতো শরীরটা মাটি থেকে ওপরে উঠাল ও।

হাঁ করে প্রস্তুত হচ্ছে আমাকে গিলে নেওয়ার জন্য। দাঁতের মাঝের অন্ধকার গহ্বরটা দেখতে পাচ্ছি আমি। কানে আসছে আমিনুলের আদুরে গলায় বলা ভাষাটা। আমাকে কিছু বলছে ও?

তবে বুঝতে পারলাম, এখন আর কিছু করার নেই। এই কাঠ দিয়ে আঁচড়ও কাটা যাবে না ওর গায়ে। বীভৎস ওই দাঁতগুলোর মাঝে নিজের মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছি। আমার চিৎকার শুনে কেউ এল না কেন বাঁচাতে? রুম থেকে শব্দ বাইরে যায়নি?

ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে জিনিসটা। তীব্রভাবে মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছি আমি।

এমন সময় পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল আমিনুল, ‘আমার মনা! আমার মনা!’

ওর দিকে ঘুরল প্রাণীটা। এই সুযোগে ওর মাথা বরাবর কাঠ হাঁকালাম।

আঘাত পেয়ে চিৎকার করে উঠল ও। আমিনুলকে পাশ কাটিয়ে প্রচণ্ড বেগে বের হয়ে গেল গ্যারেজ দিয়ে, যেই অংশ দিয়ে আমিনুল ঢুকেছে। ভয়ানক মোটা শরীরটাকে কষ্ট করে টেনে নিল। অজ্ঞান হওয়ার আগে এই আমার শেষ দেখা ওর সঙ্গে।

৬.

পরদিনই চলে গেছে আমিনুল। কাউকে কিছু না জানিয়ে। ফলে অজানা রয়ে গেছে অনেক প্রশ্নের উত্তর। আমার জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে, অল্পের জন্য রক্ষা পায় হাত। প্রায় এক মাস পর আমি একটা বই পাই শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে। বইটার নাম পৌরাণিক প্রাণীদের আদ্যোপান্ত। গাঁজাখুরি বই। তবে শেষের দিকের একটা ছবি দেখে স্তব্ধ হয়ে যাই আমি।

বিরাট কৃমির মতো শরীর, জোঁকের চোষকের মতো মুখ। যেখানে থাকা ধারালো দাঁতের মাঝে আটকে আছে একটা মানুষ।

এর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমিনুলের রুমে। তাই পড়তে শুরু করলাম। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরই আমি এখন জানি। আপনাদের জানানোটাও জরুরি। নর্স মাইথোলজিতে এই প্রাণীর দেখা মিলে। একে ডাকা হয় ইয়োরমুনঘান নামে। এদের জন্ম বীভৎসতা থেকে। বেড়ে ওঠা অন্ধকারে।

মাইথোলজির বই বলে, হারিয়ে যাওয়া এই প্রাণী একদিন ফিরে আসবে পৃথিবীতে, বিস্তার করবে নিজেদের, ঝংকার তুলবে গ্রহজুড়ে। আমি জানি, সেই একদিন চলে এসেছে। তবে জানি না, এত দিনে সংখ্যায় কত, আকারে কত বড়। তবে জানি ওরা ঘিরে ফেলবে আমাদের। এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি।

একজনের কাছেই পাওয়া যাবে সেগুলো—আমিনুল।

আজ রাতেই রওনা দিচ্ছি রংপুর। বাড়িওয়ালার দেওয়া তথ্যমতে ওটাই ছিল ঠিকানা। নিজের পোষা প্রাণীকে নিয়ে হয়তো সেখানেই ফিরে গেছে ও।