‘তোমরা কি অয়ন-জিমি?’
প্রশ্নটা করছেন মাঝবয়সী এক সুন্দরী মহিলা, সাদা রঙের একটা সেডান গাড়িতে বসে আছেন তিনি। বিকেলে ফুটবল খেলতে গিয়েছিল অয়ন হোসেন আর জিমি পারকার, খেলা শেষ করে বাসায় ফেরার পথে পেছন থেকে উদয় হয়েছে গাড়িটা, হর্ন বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, উল্টো ঘুরতেই ড্রাইভিং সিটে বসা ভদ্রমহিলা ছুড়ে দিয়েছেন প্রশ্নটা।
মুখ দিয়ে কথা ফুটল না দুই বন্ধুর, চিনতে পারছে না মহিলাকে, শুধু মাথা ঝাঁকাল।
‘কী কপাল, পথেই পেয়ে গেলাম তোমাদের,’ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন ভদ্রমহিলা। ‘বাসা পর্যন্ত যেতে হলো না।’
গলা খাঁকারি দিল অয়ন। ‘মাফ করবেন, আপনাকে আমরা ঠিক...’
‘চিনতে পারছ না, এই তো?’ হাসলেন ভদ্রমহিলা। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল ঝকঝকে দাঁতের সারি। ‘আমার নাম হলি হ্যালোরান। তোমাদের টিচার, হ্যারিয়েট কারস্টেনের বান্ধবী আমি, একসঙ্গে কলেজে পড়েছি। ও-ই খোঁজ দিল তোমাদের।’
মিসেস কারস্টেনের কথা শুনে মুখে হাসি ফুটল দুই বন্ধুর। ওদের প্রিয় শিক্ষিকা তিনি, স্কুলে ইতিহাস পড়ান। দুই পা এগিয়ে অয়ন বলল, ‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, ম্যাম। আমি অয়ন, ও জিমি। আপনি কি বিশেষ কোনো কারণে খুঁজছেন আমাদের?’
‘ঠিক ধরেছ। জটিল একটা সমস্যায় পড়েছি। তোমাদের সাহায্য দরকার।’
‘কী সমস্যা?’
‘সময় লাগবে বলতে। কোথাও বসা যায় না?’
‘বাসায় চলুন। এমনিতেই তো যাচ্ছিলেন। চা-নাশতা খেতে খেতে কথা বলা যাবে।’
‘না, না, চা-নাশতার প্রয়োজন নেই। এখানেই কোথাও বসা যায় না?’
পাশেই ছোট্ট একটা পার্ক। সেদিকে ইশারা করে জিমি বলল, ‘পার্কে যাবেন? বসার জায়গা আছে ভেতরে।’
‘ভালো প্রস্তাব।’
রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করলেন হলি। তারপর অয়ন-জিমিকে নিয়ে ঢুকে পড়লেন পার্কে। ফাঁকা একটা বেঞ্চি খুঁজে নিয়ে বসল তিনজনে।
‘এবার বলুন, কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে?’ জানতে চাইল অয়ন।
‘সমস্যাটা আমার বাবা, হার্বার্ট হ্যালোরানকে নিয়ে,’ বললেন হলি। ‘এক মাস আগে মারা গেছেন তিনি।’
‘সরি ফর ইয়োর লস,’ সহানুভূতি জানাল অয়ন।
‘ধন্যবাদ। তবে বাবার সঙ্গে বিশেষ বনিবনা ছিল না আমার, শেষ দিকে তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগও ছিল না। আসলে হয়েছে কি, ছোটবেলা থেকেই আমি খুব স্বাধীনচেতা মেয়ে। মা মারা গেছেন ছয় বছর বয়সে, আমার কোনো ভাইবোনও নেই, বাবা আমাকে সব সময় ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে চেয়েছেন। ব্যাপারটা ভালো লাগত না আমার। গ্র্যাজুয়েশন শেষ হতেই বাবার অমতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তাতে খুব রেগে গিয়েছিলেন বাবা, আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শুরুতে কিছুদিন তাঁর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লাভ হয়নি, বাবা খুব খ্যাপাটে আর রগচটা স্বভাবের মানুষ ছিলেন, একপর্যায়ে আমিও যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। কিন্তু মাসখানেক আগে, হঠাৎ উকিলের চিঠি পেয়ে জানলাম, বাবা মারা গেছেন। ক্যানসার হয়েছিল, আমাকে খবর পর্যন্ত দেননি।’
এটুকু বলে চুপ হয়ে গেলেন হলি। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন, চেষ্টা করছেন নিজেকে সামলাতে। কী বলবে ভেবে পেল না অয়ন-জিমি। এ পরিস্থিতিতে কাউকে কীভাবে সান্ত্বনা দেওয়া যায়, জানা নেই ওদের। চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে হলো।
কয়েক মিনিট পর ধাতস্থ হলেন ভদ্রমহিলা। ‘সরি, ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম, কিছু মনে কোরো না।’
‘বাবাকে খুব ভালোবাসতেন আপনি, তাই না?’ জিজ্ঞেস করল জিমি।
মাথা ঝাঁকালেন হলি। ‘বাবাও প্রচণ্ড ভালোবাসতেন আমাকে। মারা যাওয়ার পর সেটা টের পেয়েছি। বাড়ি ফিরে জানলাম, নিজের সব সহায়সম্পত্তি আমাকে উইল করে লিখে দিয়ে গেছেন।’
‘উইল করলেন কেন?’ ভুরু কোঁচকাল অয়ন। ‘একমাত্র সন্তান হিসেবে সবকিছু কি আপনারই পাওয়ার কথা নয়?’
‘রগচটা মানুষ ছিলেন বাবা, বলেছি না? রাগ করে আমাকে ত্যাজ্য করেছিলেন তিনি। রীতিমতো দলিল বানিয়ে আমাকে বঞ্চিত করেছিলেন সবকিছু থেকে। আমি অবশ্য পরোয়া করিনি। টাকাপয়সার লোভ নেই আমার, বিয়েও করিনি, একা মানুষ। একটা চাকরি করি, তাতে নিজের বেশ ভালোমতোই চলে যায়। যাহোক, আমাকে সব আবার ফিরিয়ে দিয়েছেন বাবা; সে জন্যই নতুন উইল করে আগেরটা বাতিল করেছেন।’
‘হুম। আপনার বাবা কি বেশ ধনী ছিলেন?’
‘তা বলতে পারো। স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবসা করতেন তিনি, রিটায়ার করার আগে প্রচুর টাকা কামিয়েছেন।’
‘বাহ, তাহলে তো আপনিও এখন ধনী।’
‘না, অয়ন,’ মাথা নেড়ে বললেন হলি। ‘ধনী হতে পারিনি। কারণ, বাবা যা রেখে গেছেন, তার মধ্য থেকে শুধু উডল্যান্ডস হিলে আধা একর জমি আর পৈতৃক বাড়িটা আমার হাতে আছে। সেগুলো খুব দামি নয়। আর কিছুই নেই।’
‘আর কী কী থাকার কথা ছিল?’
‘রত্ন...বিভিন্ন ধরনের দামি পাথর আর হীরা। ওসব সংগ্রহের ঝোঁক ছিল বাবার, বিশাল কালেকশন ছিল তাঁর। কিন্তু ফিরে এসে বাড়িতে ওগুলো আর পাইনি আমি।’
‘গায়েব হয়ে গেছে?’ জিমির চোখ বড় হয়ে গেল।
‘গায়েব হয়নি, বাবা নিজেই লুকিয়ে রেখে গেছেন,’ বললেন হলি। ‘উইলে বলে গেছেন সে কথা। আরও বলেছেন, রত্নগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে সূর্যঘড়ির সূত্র অনুসরণ করলে।’
‘এ আবার কেমনতরো কথা! কিসের সূর্যঘড়ি? কিসের সূত্র?’
‘বাড়িতে একটা সূর্যঘড়ি রেখে গেছেন বাবা। ওটার গায়ে অদ্ভুত কিছু কথা লেখা আছে...অনেকটা ধাঁধার মতো। আমার ধারণা, ওই ধাঁধা সমাধান করলে পাওয়া যাবে রত্নগুলো।’
‘এভাবে লুকিয়ে রাখার কারণ কী?’ প্রশ্ন করল অয়ন।
‘আমি জানি না,’ অস্বস্তিভরে বললেন হলি। ‘তোমাদের তো বলেছি, বাবা একটু খ্যাপাটে মানুষ ছিলেন। হয়তো একটু রসিকতা করে গেছেন আমার সঙ্গে...হাজার হোক, আমি তো তাঁর অবাধ্য হয়েছিলাম। সমস্যা হলো, ওই ধাঁধার অর্থ বের করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। কয়েক দিন অনেক মাথা ঘামিয়েছি, কোনো তল খুঁজে পাইনি।’
‘তার মানে আপনি চাইছেন, আমরা সমাধানটা খুঁজে দিই। এই তো?’
‘যদি তোমাদের কোনো আপত্তি না থাকে।’ বিব্রত দেখাল হলিকে। ‘আসলে...আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। কার কাছে যাব, তা–ও বুঝতে পারছিলাম না। তা ছাড়া বিশ্বস্ত মানুষও দরকার। শেষমেশ হ্যারিয়েটকে খুলে বললাম ব্যাপারটা। ও-ই বলল তোমাদের কথা। অনেক প্রশংসা করল। শুনলাম, শখের গোয়েন্দাগিরি করো তোমরা, আগেও ধাঁধার সমাধান করে অনেক লুকানো জিনিস খুঁজে বের করেছ। তাই ছুটে এসেছি। ইয়ে...তোমরা কি সাহায্য করবে আমাকে?’
‘নিশ্চয়ই করব, ম্যাম,’ বলল অয়ন। ‘সূর্যঘড়িটা কোথায়? একটু দেখাবেন?’
‘ওটা তো বাসায় রেখে এসেছি। দেখতে যেতে চাও?’
ঘড়ি দেখল অয়ন। ‘এখন সম্ভব নয়। সন্ধ্যা হলো বলে। স্কুলের লেখাপড়া আর হোমওয়ার্ক করতে হবে আমাদের। তবে আপনার যদি সময় হয়, আগামীকাল স্কুল ছুটির পর যেতে পারি।’
‘সময় হবে না কেন? নির্দ্বিধায় চলে যেয়ো। কয়টায় যাবে?’
‘এই ধরুন, চারটায়।’
‘ঠিক আছে, আমি অপেক্ষা করব।’ উঠে দাঁড়ালেন হলি। ‘কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব তোমাদের...’
‘রত্নগুলো খুঁজে পাই, তারপর না হয় ধন্যবাদ দেবেন,’ মুচকি হাসল অয়ন।
‘কিচ্ছু ভাববেন না, ওগুলো আমরা খুঁজে বের করবই,’ আশ্বাস দিল জিমি।
‘স্বস্তি পাচ্ছি তোমাদের কথা শুনে।’ উঠে দাঁড়ালেন হলি। ‘এখন তাহলে আসি। আগামীকাল দেখা হবে।’
বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে বিদায় নিলেন তিনি।
বন্ধুর দিকে ফিরল জিমি। অয়নের মুখে মিটিমিটি হাসি লক্ষ করে বলল, ‘কী রে, হাসছিস কেন?’
‘হাসব না?’ বলল অয়ন। ‘নতুন ধাঁধা...নতুন রহস্য! একজন গোয়েন্দাকে খুশি করার জন্য আর কী চাই?’
চলবে...