ফিউচার অ্যাটাক
আজ নিয়ে তিন দিন।
জাহিরা নিশ্চিত যে মোটু আর পাতলু দুজনই পালাক্রমে তাকে ফলো করছে। কখনো কখনো একজনই। এদের নাম জানে না জাহিরা। একজন একটু মোটামতো বলে তাকে মোটু আর হ্যাংলাপাতালা লোকটির নাম সে দিয়েছে পাতলু। আহাদ থাকলে বলত, জাহিরার মাথা থেকে চাচা চৌধুরী, নন্টে-ফন্টেরা আর কোনো দিন বের হবে না। জাহিরা দৈনিক নতুন সূর্য পত্রিকার রিপোর্টার। সায়েন্স, টেকনোলজি—এসব তার বিট। সে জন্য কাজে চাপ একটু কম থাকে। মাঝেমধ্যে তাই চিফ রিপোর্টার অন্য কাজেও পাঠায় তাকে। সে রকম একটা কাজে তিন দিন হলো চট্টগ্রাম থেকে ফিরেছে ও। ফেরার পর থেকেই দেখছে, সব সময় এই দুই ব্যাটার একজন তাকে ফলো করেই যাচ্ছে।
আজ দুপুরে জাহিরা যখন সাবিহার সঙ্গে চা খেতে নিচে নামল, তখনই দেখল, দূরের টংদোকানে চা খাচ্ছে মোটু আর পাতলু। নিজেদের সঙ্গে আলাপ করলেও মাঝেমধ্যে জাহিরার দিকে তাকাচ্ছে। জাহিরা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বলে টের পেল। কিন্তু ব্যাটারা নির্বিকার। তখনই ও ঠিক করেছে, আজ সেগুনবাগিচায় বাসার কাছে কাবু করতে হবে দুইটাকেই। আহাদ ঢাকায় নেই দেখে একটু ঝামেলা হলো। কিন্তু কমান্ডার সুবাওয়ার্দী দুজন কমান্ডোকে পাঠিয়ে দেবেন বলেছেন।
আলো থাকতে থাকতে অফিস থেকে বের হলো জাহিরা। সঙ্গে সাইকেল বা স্কুটি কোনোটাই নেই আজ। ভাবল, হাঁটবে। আর ও যেমনটা ভেবেছে, সোনারগাঁও হোটেল পার হওয়ার পর থেকে দেখতে পেল, নিরাপদ দূরত্বে জাহিরার পেছন পেছন আসছে মোটু। আসুক। আজ ধরব ব্যাটাকে।
মৎস্য ভবন পাশ কাটিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেগুনবাগিচায় ঢুকে পড়েছে জাহিরা। মোটু আছে। পাতলু নেই। অফিস থেকে বের হওয়ার আগে মোটু ও পাতলুর বর্ণনা দিয়ে রেখেছে নৌবাহিনীর দুই কমান্ডোকে। বলেছে, ও যখন ওদের কানাগলিতে ঢুকবে, তারাও ঢুকবে নিশ্চয়। তখনই ধরতে হবে ওদের। ভাবতে ভাবতে সরকারি ভবন দুটি অতিক্রম করে নিজেদের কানাগলির সামনে চলে এল জাহিরা। চিনতে পেরেছে কমান্ডো দুজনকে।
গলির কাছাকাছি গিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল জাহিরা। কমান্ডো দুজনকে অতিক্রম করার সময় ফিসফিস করে বলল,
‘পেছন পেছন আসছে যে মোটুটা, ওইটাকে ধরেন।’
এটুকু বলে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়াল জাহিরা। একটা হুটোপুটির শব্দ শুনে পেছন ফিরে দৌড়ে কমান্ডোদের সামনে হাজির হলো সে। না। মোটু ওখানে নেই। দুই কমান্ডোই হতভম্ব।
‘গেল কই। ধরতে পারলেন না?’
হতভম্ব একজন কমান্ডো তার হাতের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আর একজন কোনোমতে যা বলল, তার মানে হলো, মোটা লোকটা আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা দুজন তাকে জাপটে ধরতে গেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য! ভোজবাজির মতো নাই হয়ে গেছে লোকটা। নাই তো নাই। এমনকি আশপাশেও আর দেখা গেল না তাকে।
এটা কি সম্ভব নাকি? একটা মোটা লোক ফুড়ুৎ করে নাই হয়ে যাবে? কমান্ডো দুজন জাহিরাকে তার ফুফুর বাড়ির সামনে পর্যন্ত এগিয়ে দিল। বলল, আরও কিছুক্ষণ খেয়াল রাখবে তারা।
বাড়িতে ঢুকে সোহানা ফুফুর উদ্দেশে চিৎকার করে বলল জাহিরা, ‘সোফু, আমার জন্য চা!’
তারপর চলে গেল নিজের রুমের দিকে।
ড্রয়িংরুমে একটা বই হাতে বসে ছিল সোহানা। মৃত ভাইয়ের সব বৈশিষ্ট্য পেয়েছে জাহিরা। মেয়েটার জন্য তার আলাদা একটা টান আছে।
২
দুই সপ্তাহ আগের কথা।
কী একটা ট্রেনিংয়ে দেশের বাইরে গেছে কমান্ডার আহাদ। জাহিরা তার সাইকেল আর স্কুটি নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে সোহানার সেগুনবাগিচার বাসায়, তার পুরোনো ডেরাতে।
সে রকম কোনো জরুরি অ্যাসাইনমেন্টও নেই। তাই একটু গড়িয়ে নিয়ে তারপর অফিসে যাবে ভেবে রেখেছে জাহিরা। কিন্তু মুঠোফোনের ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল ঘুমটা। পুরোনো দিনের ফোনের মতো এই রিংটোন শুধু টিপু ভাইয়ের জন্য সেট করা। টিপু ভাই জাহিরাদের চিফ রিপোর্টার। অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়া কখনো ফোন দেন না।
‘সালাম, টিপু ভাই। বলেন, কোথায় যেতে হবে?’
টিপু ভাই যা বললেন, তাতে মনে হলো, একটা খুনখারাবির কেস। সাবিহা ঢাকায় নেই বলে জাহিরাকে যেতে বলা হচ্ছে। আর যে বাসাতে ঘটনাটা ঘটেছে, সেটা সেগুনবাগিচাতেই। কোনোমতে তৈরি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এল জাহিরা। ঠিকানাটা দেখে বুঝল, ১৩/২ বাড়িটা ওদের পাশের গলিতে। নিচে পুলিশের গাড়ি দেখে বুঝল, ঠিক বাসাতেই এসেছে।
টিপু ভাইয়ের নোটে ফ্ল্যাট নম্বর দেওয়া ছিল। লিফটে উঠে হাজির হলো ১৩/ডি ফ্ল্যাটে। ঢোকার মুখে ডিবি ইন্সপেক্টর তারেকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
‘আপনি এসে পড়েছেন! জানলেন ক্যামনে?’
‘আমরা না জানলে আপনাদের সাফল্যের খবর দেশবাসী জানবে কেমনে?’ হাসতে হাসতে বলল জাহিরা।
ইন্সপেক্টর তারেকের সঙ্গে ফ্ল্যাটে ঢোকার দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল জাহিরা। ঢোকার মুখে বুঝল, দরজার তালা ভাঙা হয়েছে। জানা গেল, গতকাল রাতে বিল্ডিংয়ের কমিউনিটি ফ্লোরে একটা প্রোগ্রাম ছিল। এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ব্যাংকার আমজাদ সাহেব, তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলে সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন। রাত ১২টার দিকে অন্যদের মতো তাঁরাও নিজ নিজ ফ্ল্যাটে ফিরে যান।
সকালে যে ছুটা বুয়া ওই বাসাতে কাজ করেন, তিনি এসে অনেকবার বেল বাজালেও কেউ দরজা খোলেননি। ভয় পেয়ে কেয়ারটেকারকে ফোন দেন বুয়া। তাঁরাও অনেকক্ষণ বেল বাজিয়ে দরজা খোলাতে পারেননি। আমজাদ সাহেবকে ফোন করেছেন। কিন্তু সেটা বন্ধ। তখন তাঁরা পুলিশকে ফোন দেন।
রমনা থানার পুলিশ এসে দরজা ভেঙে আবিষ্কার করে, বাসায় কেউ নেই। জাহিরা বুঝল না, এই সিম্পল ক্রাইম কেসে ওকে কেন পাঠালেন টিপু ভাই।
রুমগুলো হেঁটে দেখল জাহিরা। তিনটা বেডরুম। সব রুমের বিছানা পরিপাটি করে সাজানো। তার মানে, ওরা কেউ রাতে বিছানাতে শোয়নি। দুই ছেলে মেহমুদ ও ফয়সলের ঘরে বড় করে আইনস্টাইনের ছবি লাগানো। ফয়সলের ঘরে অবশ্য স্টিফেন হকিং আর মেরিলিন মনরোর ছবিও আছে। জাহিরা বুঝল, ছোট ছেলে হকিংয়ের ভক্ত। দুই ছেলেকেই গোছানো মনে হলো। মাস্টার বেডরুমও পরিপাটি করে সাজানো। মনে হবে, সাজানোর পর এখানে কেউ আসেনি।
ড্রয়িংরুমে আবার ফিরে আসতেই চোখে পড়ল, একটা বড় বাঁধানো ছবি। ছবিটা দেখে কিছু একটা মনে পড়ল জাহিরার। ছবিটা কোনো একটা প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের। ওখানে পাশাপাশি ফয়সল আর মেহমুদকে দেখতে পেল। কী মনে করে ছবিটার একটা ছবি তুলে নিল জাহিরা।
ইন্সপেক্টর তারেক জাহিরার কাণ্ড দেখছিল। বললেন, ব্যাংকার সাদত সেলিমের স্ত্রী হাউস ওয়াইফ। সারাক্ষণই ছেলেদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যেতেন। ছেলে দুটোও বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে ভালো করেছে। কেয়ারটেকার জানিয়েছেন, গতকাল তাঁদের বাসায় কেউ আসেনি।
কেয়ারটেকার আরও জানালেন, ফ্ল্যাটে তাঁরা ভাড়া থাকতেন। ফ্ল্যাট মালিককে খবর দেওয়া হয়েছে।
‘একটা রুটিন কেস।’ টিপু ভাইকে মেসেজ পাঠাল জাহিরা। ‘বিকেলে আসাদ থানায় খোঁজ নিয়ে মনে করলে একটা স্টোরি করতে পারবে।’
তারপর বাসায় ফিরল জাহিরা। এখনো নাশতা করা হয়নি।
৩
দুই দিন পর। অফিসে কী মনে করে নিউজ রুমের নিচের ফ্লোরে হাজির হলো জাহিরা। ক্রাইম রিপোর্টার আসাদ বলেছে, ১৩/২ সেগুনবাগিচার কেসটার কোনো অগ্রগতি নেই। পুলিশ ধারণা করছে, এটি কোনো টাকাপয়সার সমস্যা। কিন্তু বদ্ধ ঘর থেকে চারজন লোক কেমন করে গায়েব হয়ে গেল, সেটা কেউ বলতে পারছে না।
গণিত অলিম্পিয়াডের জুয়েলকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে মেহমুদ আর ফয়সলের কথা মনে পড়ল। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে মেহমুদ আর ফয়সলের ছবি দেখাতেই চিনে ফেলল জুয়েল। ‘আরে, এই ছবি তো আমরা ছেপেছি। এবারের গণিত অলিম্পিয়াডের বিজয়ীদের ছবি।’ ফয়সল আর মেহমুদকে দেখাতেই চিনতে পারল। বলল, ওরা দুই ভাই। এই প্রথমবার দুই ভাইয়ের একজন প্রাইমারিতে আরেকজন জুনিয়রে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। জুয়েলের সাহায্য নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াডের ওয়েবসাইট থেকে ওদের দুজনের রেকর্ড বের করল। দুজনই সেন্ট যোসেফ স্কুলে পড়ে।
কেন খুঁজছে, এটা জানতে চাইল জুয়েল। কিন্তু কিছুই বলল না জাহিরা। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে নেমে গেল আরও এক ফ্লোর।
৪
‘মতিন ভাই, গত এক মাসের ক্রাইম রিপোর্টগুলো খুঁজে দেখবেন?’ ১০ তলার লাইব্রেরিতে হাজির হয়েছে জাহিরা।
‘খবর তো অনেক। আপনি কি বিশেষ কোনো খবর খুঁজছেন? তাহলে আমার খুঁজে পেতে সুবিধা হবে।’ লাইব্রেরি অ্যাসিস্ট্যান্ট আবদুল মতিন জানতে চাইলেন।
‘ধরেন। বাচ্চাকাচ্চা আছে, এমন মা–বাবা। হারিয়ে গেছে। মিসিং উইদাউট ট্রেস। ফ্যামিলিসুদ্ধ হারিয়েছে, এমন।’ জাহিরা বলল।
‘আচ্ছা। আপনার মেইলে দিয়ে দেব ঘণ্টাখানেকের মধ্যে।’
আবার ওপরে গিয়ে জুয়েলের কাছ থেকে গণিত অলিম্পিয়াডের ডেটাবেজের ড্যাশবোর্ডের অ্যাক্সেস নিল জাহিরা। জুয়েলকে বলল, এবারের বিজয়ীদের তালিকাটা যেন ওকে দেওয়া হয়।
৫
তালিকার দিকে তাকিয়ে আছে জাহিরা। মতিন ভাই ওকে এ রকম মোট ছয়টি পরিবারের খবর দিয়েছেন। সবচেয়ে পুরোনোটি দুই মাস আগের। আর সর্বশেষটি ফয়সল-মেহমুদদের। কোনো খবরে আসলে ছেলে-মেয়েদের নাম নেই। শুধু ময়মনসিংহের খবরে বলা হয়েছে, ‘তালুকদার সাহেবের একমাত্র সন্তান, বিদ্যাময়ী স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী এবারের গণিত অলিম্পিয়াডে বিজয়ী হয়েছে।’ জুয়েলের তালিকায় কাশফিয়ার নাম দেখে কামরান ভাইকে জানিয়েছে রাতেই। কামরান ভাই নিশ্চিত করেছেন, তালুকদার সাহেবের মেয়ের নাম কাশফিয়া। মাসখানেক ধরে ওই পরিবারের কোনো খবর নেই।
রাতেই টিপু ভাইকে বলে চট্টগ্রামের পথে রওনা দিয়েছে জাহিরা।
৬
চট্টগ্রাম অফিস থেকে শিহাবকে দেওয়া হয়েছে জাহিরার সঙ্গে। শিহাবের একটা রিপোর্ট দেখে সন্দেহ হয়েছে জাহিরার। যদিও নিউজে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কার্ডিওলজির সহকারী অধ্যাপক মালবিকা অধিকারী ও তাঁর কৃষি কর্মকর্তা স্বামীর উধাও হওয়ার রিপোর্টেও মেয়ের নাম লেখা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, তাঁদের মেয়েটিকেও পাওয়া যাচ্ছে না। জুয়েলের দেওয়া তালিকায় একজন অধিকারীকে দেখে জাহিরার সন্দেহ হয়েছে। সুরঞ্জনা অধিকারী। অলিম্পিয়াডের ডেটাবেজে ওর মায়ের নাম মালবিকা অধিকারী। ডা. খাস্তগীর স্কুলের ছাত্রী সুরঞ্জনা অধিকারী এবারের গণিত অলিম্পিয়াডে প্রাইমারি ক্যাটাগরির মেয়েদের মধ্যে সেরা হয়েছে। পেয়েছে জেবুন্নেসা হাশেম পুরস্কার।
জুয়েলের কাছ থেকে বিজয়ীদের আলাদা আলাদা ছবিও নিয়ে এসেছে জাহিরা। সেখানে ক্রেস্ট হাতে হাস্যোজ্জ্বল ছবিতে মাকেও দেখা যাচ্ছে সুরঞ্জনার পাশে। ছবি দেখে মাকে চিনেছে শিহাব। তারপরও ওরা এসেছে পাঁচলাইশ থানায়। দেখা গেল, থানার ওসি শিহাবকে ভালোই চেনেন।
কম্পিউটারে লগইন করে মিলিয়ে দেখলেন সবকিছু। জাহিরা তো জানতই, মিলবে সব।
থানা থেকে সুগন্ধায় সুরঞ্জনাদের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সেও গেল। এটা ওর দাদার বাড়ি। দোতলায় থাকত সুরঞ্জনারা। আর তিনতলায় ওর দাদারা। নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। শুধু বাড়ির কেয়ারটেকার বললেন, মাসখানেক আগে দুজন লোক এসে মালবিকা দিদির সঙ্গে দেখা করেছিল।
অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় একটা খাতা আছে। বেশির ভাগ অতিথি পূর্বপরিচিত, তাই সেটা কেউ ব্যবহার করেন না। তা-ও পাতা উল্টিয়ে দুইটা নামের প্রতি জাহিরার চোখ আটকে গেল, মোটু মিয়া ও পাতলু খান!
৭
চট্টগ্রাম থেকে ফেরার পরদিন থেকেই জাহিরার সন্দেহ, তাকে ফলো করছে মোটু আর পাতলু। গতকাল তাদের ধরার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তেমন লাভ হয়নি।
আজ সকালে বাসা থেকে বের হয়ে ১৩/২ নম্বর বাসায় হাজির হলো আবার। কেয়ারটেকারকে চেপে ধরার পরই ও স্বীকার করল, যেদিন থেকে আমজাদ সাহেবদের পাওয়া যাচ্ছে না, সেদিন সকালে একটা মোটা আর একটা পাতলা লোক তাঁদের বাসায় এসেছিল। তবে খাতাতে কিছু লেখেনি তারা।
১৩/২ থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করল জাহিরা। ভাবল, শিল্পকলা আর মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে তারপর রিকশা নেবে। ও এখন মোটামুটি নিশ্চিত, এই সাতটি অপহরণ করেছে যারা, তারা সবাই ‘বাচ্চা’গুলোকে অপহরণ করেছে। মা-বাবারা ফাউ। কিংবা কোনো কারণবশত নিয়েছে। তালিকার ৬ পরিবারের ৭ বাচ্চার মধ্যে প্রাইমারি ক্যাটাগরির ৪ জন এবং জুনিয়র ক্যাটাগরির ৩ জন এবং এই ৭ জনই এবারের গণিত অলিম্পিয়াডের সেরাদের সেরা বা সেরা পুরস্কার বিজয়ী।
ভাবতে ভাবতে একটু আনমনা হয়ে পড়ে জাহিরা। ওর পাশে যে একটা মাইক্রোবাস এসে থেমেছে, সেটা টেরও পায়নি। শুধু টের পেল, ওর মুখ কাপড় দিয়ে চেপে ধরেছে একটা হাত। তারপরই ওকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলে নিয়েছে মাইক্রোবাসে। জ্ঞান হারানোর আগে জাহিরা টের পেল, তার দুই পাশে দুইটা লোক।
একটা মোটা আর একটা পাতলা।
৮
চোখ খুলে জাহিরা বুঝল, একটা চেয়ারে বসে আছে ও। এখনো মাথা ঝিমঝিম করছে। সামনের দিকে একটা দেয়াল। ডানে ফিরেই দেখল মোটুকে। স্বপ্ন দেখছে মনে করে চোখ বন্ধ করে ফেলল জাহিরা।
বাঁ পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘তুমি স্বপ্ন দেখছ না। আর তোমার ভয়ের কিছু নেই।’ যান্ত্রিক মনে হলো কণ্ঠস্বরটা। জাহিরা বুঝল, এটা পাতলু। চোখ খুলে দেখল ওর অনুমান সঠিক।
চারদিকে তাকিয়ে বুঝল, কোনো একটা হলরুমের মধ্যে আছে ও। যে চেয়ারে সে বসে আছে, সেটা একটা হাতলওয়ালা চেয়ার। ক্লাসরুমে যেমন থাকে।
একটা চিৎকার দিতে চাইল জাহিরা। পরক্ষণে মনে হলো, ওর হাত–পা বাঁধেনি ওরা। তার মানে, ওর পালিয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেটা টের পেতেই একটা ঠান্ডা স্রোত একেবারে মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেল জাহিরার।
পাতলু তার চেয়ারসহ একটু এগিয়ে এসে জাহিরার মুখোমুখি হলো। মোটুও উঠে এসে একটা চেয়ার টেনে বসল।
পাতলুই শুরু করল, ‘তুমি অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমাদের পুলিশ যা বের করতে পারে নাই, তুমি সেটা বের করে ফেলেছ।’
অবাক হলো জাহিরা। ওরা ভাবছে জাহিরা চিনে ফেলেছে ওদের। কিংবা ওরা যে দেশের ৫টা শহরের ৭টা বাচ্চাকে অপহরণ করেছে, সেটা জেনে গেছে।
মোটু বলল, ‘তোমাকে ফলো করে আমরা টের পেয়েছি, তুমি ঢাকা, চট্টগ্রামের মিসিং কেসগুলোকে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছ। এটা কি ঠিক?’
‘শুধু দুইটা।’ জাহিরা চিৎকার করে উঠল। ‘তোমরা আমাদের সাত–সাতটা মেধাবী ছেলে–মেয়েকে তাদের মা–বাবাসহ কিডন্যাপ করেছ। আবার আমার কাছে জানতে চাচ্ছ? তোমাদের আমি পুলিশে দেব।’
হাসল মোটু-পাতলু। ‘তোমাদের পুলিশ কি আমাদের ধরতে পারবে? সেদিন তোমার বরের লোকেরা হাতের মুঠোতে পেয়েও তো আমাকে আটকে রাখতে পারেনি। তাহলে?’
তাই তো! ভাবল জাহিরা। ওরা কি আসলে মানুষ!
মোটু বলল, ‘দেখো, আমাদের হাতে সময় বেশি নাই। তোমাকে আমরা আসল খবরটা জানিয়ে দিই।’
‘তার চেয়ে বরং আমরা ওকে আগে দেখিয়ে দিই, ওরা কেমন আছে।’ পাতলু বলল।
তারপর হাতের একটা কিছু দেয়ালের দিকে তাক করল। দেয়ালটা আলোকিত হয়ে উঠল। জাহিরা বুঝল, একটা সিনেমার পর্দা হয়ে উঠেছে ওটা।
পর্দায় দেখা গেল, একটা পাহাড়ঘেরা এলাকা। ক্যামেরা জুম হয়ে একটা দুর্গের মতো বাড়ির ওপর স্থির হলো। পরক্ষণেই ঢুকে গেল একটা কক্ষের মধ্যে। তিনজন লোককে দেখা গেল ওই কামরায়, কেমন হাবলার মতো বসে আছে।
চমকে গেল জাহিরা। পর্দার দুই মেয়েকেই ও চেনে। সুরঞ্জনা অধিকারী ও তার মা মালবিকা অধিকারী। তার মানে লোকটি সুরঞ্জনার বাবা।
পর্দায় ওরা মিলিয়ে যেতেই হাজির হলো ফয়সল ও মেহমুদ। সঙ্গে ওদের মা–বাবা। হন্তদন্ত হয়ে কী জানি খুঁজছে।
তারপরই পর্দাটা মিলিয়ে গেল।
‘এর মানে কী? ওদেরকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ তোমরা?’
‘২০০ বছর পরে। ২২২৩ সালে।’ আস্তে আস্তে উচ্চারণ করল পাতলু। ‘মেহমুদরা মাত্র পৌঁছেছে। তাই হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারে নাই।’
‘মানে কী! আমাকে পাগল পেয়েছ? মানুষ ভবিষ্যতে যেতে পারে নাকি?’ জাহিরা অ্যাঁ অ্যাঁ করে একটা কিছু বলল, যার মানে অনেকটা এ রকম।
‘তোমরা পারো না, কিন্তু আমরা পারি। আমি আর মোটু ২২২৩ সাল থেকে এসেছি। আমরা ইচ্ছেমতো অতীতেও যেতে পারি, আবার নিজেদের সময়ে ফেরত যেতে পারি, যা তোমাদের জন্য ভবিষ্যৎ।’
জাহিরা বুঝে গেছে, কথা বলে লাভ নেই। পাতলুকে বলতে দেওয়াই ভালো।
‘আমরা নিজেদের ওয়েভ ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কাজেই ওয়ার্মহোল দিয়ে সহজে এক সময় থেকে অন্য সময়ে চলে যেতে পারি আমরা। গতকাল নেভির লোকেরা ওকে ধরতে পারে নাই; কারণ, ওরা ধরতে আসার সঙ্গে সঙ্গে ও নিজের ওয়েভফাংশন কলাপস করে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে ও অন্য সময়ে চলে যায়। তোমার লোকেরা বা তুমি তাকে আর খুঁজে পাওনি।’ পাতলু একটু থামল।
মোটু বলতে শুরু করল, ‘তুমি তো চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি এদের কথা জানো। ২০২১ সালে মানুষ জেনারেটিভ এআইয়ের মূল বিষয়টা ক্র্যাক করে। তার পরের ৫০ বছরে এআইয়ের ওপর অনেক কাজ হয়েছে। আর এ সময়জুড়ে মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দিয়েছে, ভিডিও বানিয়ে টাকা কামাইয়ের ধান্দা করেছে। অন্যদিকে মানুষের অজান্তে এআইগুলো নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক করে। এবং ২১১০ সালে নিজেরাই মানুষের ওপর কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়।’
‘কী যা তা বলছ। এগুলো সায়েন্স ফিকশনে মানায়।’
‘যে দেশগুলো ডিজিটালি বেশি উন্নত ছিল, তারা সবাই এআইয়ের দখলে চলে গেল। আর যে দেশগুলো প্রযুক্তিতে পিছিয়ে, সে রকম কিছু দেশে এআই তেমন কিছু করতে পারল না। তারা সে রকম চেষ্টাও করে নাই।’ পাতলু মনে হয় জাহিরার কথা শোনেনি। ‘পরের ১০০ বছরে পৃথিবী এআইয়ের অধীনেই থাকল। কয়েক বছর ধরে আমরা কয়েকজন মিলে পৃথিবীকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা শুরু করেছি।’
জাহিরা অবাক হয়ে শুনছে।
‘কিন্তু কাজে নেমে আমরা টের পেলাম, ২০৩০ সালের পর মানুষের ব্রেন আর বিকশিত হয়নি। এর কারণ হলো, মানুষ তখন কেবল ফেসবুকে ছবি দেওয়া আর যা-তা ভিডিও বানানোয় ব্যস্ত হয়ে যায়। ২০৩০ সালের মেধা দিয়ে ২২০০ সালের রোবটদের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন।’
একটানা কথা বলে গেল পাতলু খান।
রোবটদের সঙ্গে লড়ার জন্য মেধাবী ছেলে-মেয়ে দরকার। কারণ, সপ্তম মাত্রার এজিআই বা আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্ট রোবটের সঙ্গে পারার জন্য অনেক উন্নত গবেষণা করতে হবে। আর তার জন্য দরকার মেধাবী লোক। ‘শুরুতে আমরা কয়েকজন বিজ্ঞানীকে নিয়েছি। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। ওরা নতুন কিছু বের করতে পারেনি।’ হতাশ শোনাল মোটুর গলা।
‘তারপর আমরা ঠিক করি, অতীত থেকে কিছু মেধাবী ছেলে–মেয়েকে নিয়ে আসি। তা করলাম। শুরুতে আমরা শুধু ছেলে-মেয়েদের নিয়েছি। কিন্তু পরিবার ছাড়া ওরা নিঃসঙ্গ থাকে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।’ পাতলু বলে যাচ্ছে। ‘এবার আমরা তা–ই ঠিক করেছি, পরিবারশুদ্ধ ওদের নিয়ে যাব।’
‘কিন্তু বাংলাদেশ কেন?’ জানতে চাইল জাহিরা।
মোটু বলল, ‘আমাদের মধ্যে একজন জানাল, তার ঊর্ধ্বতম সপ্তম পুরুষ বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড করেছে। যারা গণিত অলিম্পিয়াডে ভালো করে, তারা শুধু মেধাবীই হয় না, বরং সমস্যা সমাধানে তারা একটা বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে। এই ছেলে–মেয়েরা অন্য রকম। তারা ফেসবুকে আসক্ত হয় না, ছাপা বই পড়ে, কোনো কোনো সমস্যা সমাধানে নাওয়াখাওয়া ভুলে তিন–চার দিন লেগে থাকে।’
পাতলু জানাল, ‘তাই আমরা ঠিক করি, বাংলাদেশ থেকে কয়েকজনকে নিয়ে যাব। বাবা-মাকে সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে যেন বাচ্চাগুলো লোনলি ফিল না করে। আগামীর পৃথিবীকে রোবটদের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য ওদের দরকার।’
পাতলু বলল, ‘আমরা দেখেছি, তোমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের ফলাফলে বিভিন্ন শহর থেকে ছেলে–মেয়েরা ভালো করে। আমরা ভেবেছি বিভিন্ন শহর থেকে কয়েকটা ছেলে–মেয়ে হারিয়ে গেলে কেউ টের পাবে না।’
‘কেউ সেভাবে টের পায়নি।’ যোগ করল মোটু। ‘খালি তুমি আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে গেছ।’
‘আমাকে ধরে এনেছ কেন?’ জানতে চাইল জাহিরা। মোটু–পাতলুর কোনো কথাই ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।
‘কয়েক দিন ধরে আমরা ভেবেছি, তোমাকে সবকিছু জানিয়ে দিই। আমাদের লিস্ট কমপ্লিট। কিন্তু তোমাকে বলার কোনো কায়দা করা যাচ্ছিল না। গতকাল তো তুমি আমাদের বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করেছ। তাই আজকে তোমাকে তুলে এনেছি সব জানিয়ে দেওয়ার জন্য। তাহলে তোমার কৌতূহল মিটবে। আর তোমার কর্মকাণ্ড দেখে আমরা এটাও আশা করছি যে তোমার পরের প্রজন্মের কেউ এমনিতেই রোবটদের বিরুদ্ধে লড়বে।’
এত কিছুর মধ্যে জাহিরার হাসি পেল।
মোটু বলল, ‘আমরা তোমাকে এই ঘরের বাইরে ছেড়ে দেব। দরজার বাইরে গেলেই তোমার ওয়েভফাংশন কলাপস করে তুমি তোমার সময়ে চলে যাবে। এই বিল্ডিংটা তুমি চেনো। আবাহনী মাঠের উল্টো দিকে। লিফট দিয়ে নিচে নেমে যেয়ো। আর ২০২৩ সালের জাহিরা ২২২৩ সালের আমাদের খুঁজে পাবে না।’
দুজনই উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে।
জাহিরাও উঠল। দেখল একটা কাচের দরজা। সেটা খুলে বের হয়ে এল জাহিরা। পেছনে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনল। তারপরই জাহিরা খেয়াল করল, দরজার ভেতরের ঘরটা একটা অফিস ঘরে পরিবর্তন হয়ে গেল। কাঁচের ভেতর দিয়ে পরিষ্কার দেখা গেল। ভেতরে কেউ নেই।
লিফটে উঠে টের পেল এই ভবনে সে অনেকবার এসেছে। এখানে একটা জাপানি রেস্তোরাঁও আছে। লিফট দিয়ে নামতে নামতে ওর মনে হলো ব্যাটাদের ধরে কয়েক বছর সামনে যেতে পারলে ভালো হতো। কিছু তথ্য জেনে আহাদকে সব সময় বোকা বানানো যেত।
৯
‘আপনি কি কোনো স্টোরি দেবেন?’ জাহিরাকে দেখে জানতে চাইলেন দৈনিক নতুন সূর্যর চিফ রিপোর্টার টিপু সুলতান।
‘আমি হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাদের মূল খবরটা বের করেছি। সেটা লিখতে চাই।’ জানাল জাহিরা।
‘কিন্তু পাঠক তো এসব গল্প বিশ্বাস করবে না জাহিরা। ভাববে আমরা এখন বেশি বেশি সায়েন্স ফিকশন পড়ছি বা নিজেরা পত্রিকাটাকে ফিকশন পত্রিকা বানাতে চাচ্ছি।’ বললেন টিপু সুলতান। ‘বাদ দেন। নতুন কিছু ভাবেন।’
চিফ রিপোর্টারের সামনে থেকে চলে এল জাহিরা। ভাবল, সাবিহাকে ডেকে নিচে যাবে চা খেতে।
ঠিক তখনই তার মনে হলো, আরে, টিপু ভাই কীভাবে জানল যে বাচ্চাদের স্টোরিটা সায়েন্স ফিকশন হবে? মোটু–পাতলু কি তাকে আগেই জানিয়ে গেছে?
এই প্রশ্নের উত্তর কোথায় পাবে জাহিরা? তার চেয়ে চা খেতে যাওয়া যাক।