‘বিশ বছর হতে চলল, বাড়িটা এভাবেই পড়ে আছে।’ হিন্দিতে কথাটা বলল রুম সার্ভিসের সাগর, ‘ভয়ে ওখানে কেউ ঢোকে না, স্যার!’
হোটেলের কামরার জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই বাড়িটা চোখে পড়েছিল সৌরভের। সঙ্গে সঙ্গে গা ছমছম করে উঠেছিল তার। শুধু সে কেন! অন্য কেউ এখানে থাকলে তারও গা ছমছম করে উঠত ভয়ালদর্শন পরিত্যক্ত বাড়িটার দিকে তাকিয়ে!
জানালা দিয়ে সৌরভ একনাগাড়ে তাকিয়ে ছিল পোড়োবাড়িটার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, রুম সার্ভিসের লোকটা যে খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে, সেটা টেরও পায়নি সে। সংবিৎ ফিরে পেল তখন, যখন লোকটা তাকে জানালা দিয়ে ওই বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কথাটা বলল। তার কথা শুনে পেছন ফিরে তাকাল সৌরভ। দেখল যে সাদা রঙের বিশাল একটা লম্বা তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। পেছন ফিরে তাকাতেই তোয়ালেটা বাড়িয়ে দিল সৌরভের দিকে। হাত বাড়িয়ে তোয়ালেটা নিল সে।
‘কিসের ভয়, সাগর ভাই?’ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল সে।
‘সবাই বলে যে বাড়িটার দোষ আছে।’ সাগর নামের রুম সার্ভিসের লোকটা বলল, ‘আর দোষ থাকবে না কেন, স্যার! যা ইতিহাস শুনেছি বাড়িটার, তাতে দোষ থাকাটা তো খুবই স্বাভাবিক!’
‘কী রকম ইতিহাস?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাগর। তারপর বলতে শুরু করল, ‘আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে ওই বাড়ির জায়গায় ছিল একটা কুঁড়েঘর। এত হোটেল বা রিসোর্ট কিছুই ছিল না আশপাশে, ছিল শুধু ঝোপঝাড় আর জঙ্গল। বাড়িটার পাশ দিয়ে যে রাস্তা গেছে দেখছেন, ওটাও কাঁচা ছিল। যা–ই হোক, কুঁড়েঘরটা ছিল গোবিন্দ পান্ডিয়ানের। স্ত্রী আর সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে থাকতেন তিনি, আর কাছেই ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট চালাতেন।’
এ পর্যন্ত বলে একটু থামল সাগর। খানিকটা তাড়া দিল সৌরভ, ‘থামলেন কেন? বলে যান!’
‘হ্যাঁ স্যার, বলছি।’ মাথা ঝাঁকিয়ে সাগর আবার বলতে শুরু করল, ‘পান্ডিয়ানের মেয়ের বয়স যখন আট কি নয় বছর, তখন মেয়েটাও রেস্টুরেন্টের কাজে হাত লাগানো শুরু করেছিল। তার পর থেকেই ফুলে–ফেঁপে উঠতে শুরু করে পান্ডিয়ানের ব্যবসা। শুনলে অবাক হবেন, অন্য কোনো কিছুর জন্য না, শুধু মেয়েটার হাতে বানানো চায়ের জন্য! এত দারুণ চা বানাতে পারত মেয়েটা! মানুষ কেবল চা খেতেই রেস্টুরেন্টে আসত। শুধু তা–ই না, প্রচুর মানুষ বিভিন্ন বেলার খাওয়াদাওয়া ওই রেস্টুরেন্টে করতে শুরু করল; খাওয়াদাওয়া শেষে মেয়েটার বানানো চা খাওয়ার আশায়! কত রকম চা যে বানাতে পারত মেয়েটা!’
‘তারপর?’
‘ওদিকে পান্ডিয়ান একটু একটু করে নিজের রেস্টুরেন্টটাকে বড় করতে থাকল, আর এদিকে পাকা করে ফেলল নিজের বাড়িটা। এরই মধ্যে পান্ডিয়ান পরিবারে একটা ছেলেরও জন্ম হলো। বেশ সুখে–শান্তিতেই ছিল তাদের পরিবার।’ সাগর বলে যাচ্ছে, ‘কিন্তু কিছু মানুষ তাদের এই উন্নতিকে ভালো চোখে দেখল না। পান্ডিয়ান পরিবারের রাতারাতি উন্নতি করা নিয়ে নানা কথাবার্তা বলাবলি শুরু করল তারা। সবচেয়ে বেশি যেটা চাউর হয়েছিল, সেটা হচ্ছে, এই পুরো পরিবার ওভেনেনোর পূজারি!’
‘ওভেনেনো?’ অবাক হলো সৌরভ, ‘সে আবার কে?’
‘এখানকার স্থানীয় লোককথায় প্রচলিত বিষাক্ততার অপদেবতা, যার উপাসকেরা মানুষকে বিষপান করিয়ে হত্যা করে, তার উদ্দেশ্যে বলি দিত।’ উত্তরটা ভেসে এল দরজা থেকে। সাগর আর সৌরভ দুজনেরই দৃষ্টি ঘুরে গেল সেদিকে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন সৌরভের বড় ভাই শামস আর তাঁর স্ত্রী অন্তরা। সৌরভের কামরার পাশের কামরাতেই উঠেছেন তাঁরা। শামস আরও যোগ করলেন, ‘আর নামটা এসেছে পর্তুগিজ শব্দ “ও ভেনেনো” থেকে, যার অর্থ বিষ।’
‘ও আচ্ছা!’ বুঝতে পেরে মাথা দোলাল সৌরভ।
স্বামী-স্ত্রী ঘরের ভেতর প্রবেশ করে বিছানায় বসলেন। শামসের স্ত্রী অন্তরা সাগরকে বললেন, ‘তারপর কী হয়েছিল, সাগর ভাই?’
শ্রোতার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সাগরের গল্প বলার উৎসাহও যেন বেড়ে গেল। লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করল সে, ‘একদিন হলো কী, পান্ডিয়ানের রেস্টুরেন্ট থেকে চা খেয়ে ফেরার পথে হার্ট অ্যাটাক করে বসল এক লোক। সবাই মিলে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল তাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বাঁচানো গেল না! এরপর গুজব উঠল, এর আগে আরও তিনজন হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল এবং হার্ট অ্যাটাকের আগে প্রত্যেকেই চা খেয়েছিল ওই রেস্টুরেন্টে। ব্যস! আর পায় কে! প্রায় দেড়-দু শ লোক মিলে হইহই করতে করতে চলে গেল পান্ডিয়ানের রেস্টুরেন্টে আর পুরো রেস্টুরেন্টে আগুন লাগিয়ে দিল। সেই আগুনে পুড়ে বাবা আর মেয়ে...’
সৌরভ, শামস ও অন্তরা হাঁ করে তাকিয়ে শুনছে সাগরের গল্প। সাগর থেমে গেলে সৌরভ শুকনো গলায় জানতে চাইল, ‘আর পান্ডিয়ান সাহেবের স্ত্রী? ছেলে? ওদের কী হলো?’
‘ওরা তো বাড়িতেই ছিল। ছেলেটার বয়স তখন আট-দশ বছরের মতো হবে। কিছু লোক বাড়ির ভেতর ঢুকে মা-ছেলেকে পুড়িয়ে মারবে বলে দল বেঁধে চলে আসে এদিকে। কিন্তু বাড়ির ভেতর ঢুকে আর কাউকেই পায়নি তারা!’ সাগর বলল, ‘মা... মানে ছেলেটার মা খবর পেয়েছিল যে তার স্বামী আর মেয়ের সঙ্গে কী হয়েছে, আর তাদের দুজনের সঙ্গেও কী হতে যাচ্ছে! তাই লোকগুলো আসার আগেই তারা পালিয়ে গিয়েছিল। এর পর থেকে তাদের আর কেউ দেখেনি।’
‘আর এই বাড়িও তখন থেকেই খালি পড়ে আছে?’ প্রশ্নটা করলেন অন্তরা।
‘না ম্যাডাম, ওই ঘটনার ছয় মাস পরই এখানকার একটা পরিবার বাড়িটা দখল করে উঠে পড়েছিল। কিন্তু পাঁচ বছরের বেশি থাকতে পারেনি ওখানে।’
‘কেন?’
‘পাঁচ বছর পর থেকে হঠাৎ করেই গভীর রাতে বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিতে শুরু করেছিল গোবিন্দ পান্ডিয়ানের মেয়ে লক্ষ্মী পান্ডিয়ান।’
‘বলেন কী?’ তিনজন একসঙ্গে বলে উঠল বিস্ময়ঝরা কণ্ঠে। চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে তিনজনেরই।
‘হ্যাঁ।’ মাথা ঝাঁকিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে সাগর বলল, ‘প্রায়ই দেখা যেত, একটা কালো জামা পরা মেয়ে এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হেঁটে যাচ্ছে, হাতে একটা চায়ের কাপ। একদিন তো বাড়ির সবাই ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে ডাইনিংরুমে গিয়ে দেখে, পরিবারের কর্তা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ডাইনিং টেবিলের পাশে। আর টেবিলের ওপর রাখা দুটো চায়ের কাপ, যার একটা ছিল চায়ে ভর্তি। জ্ঞান ফেরার পর জানা গেল, সে রাতের বেলায় ডাইনিং রুমে এসেছিল পানি খেতে। এসে দেখে, কালো জামা পরা একটা মেয়ে বসে আছে টেবিলের এক পাশে। আর মেয়েটার সামনে রাখা দুটো চায়ের কাপ। হাতে একটা চামচ নিয়ে ধীরে ধীরে একটা কাপের চা নাড়ছে মেয়েটা, আর ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। মেয়েটার মুখ ছিল ফ্যাকাসে আর ঠোঁট রক্তের মতো টকটকে লাল! ওই চেহারা দেখে ভয়ে ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল লোকটা!’
‘কী ভয়ংকর!’ ঢোক গিলে বললেন অন্তরা।
শামস বললেন, ‘আর এই ঘটনার পরই বাড়িটা ছেড়ে দেয় ওই পরিবার, তাই তো?’
‘হ্যাঁ। তারপর পঁচিশ বছর হয়ে গেছে, বাড়িটা এভাবেই পড়ে আছে।’
‘হুমম।’ গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন শামস। একবার তাকালেন স্ত্রীর দিকে। তারপর ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যা–ই হোক, সৌরভ। গল্প তো শোনা হলো। এবার দয়া করে ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে, ভাই! দুপুরের মধ্যে ক্যাবো ডি রামা বিচ ঘুরে এসে অন্য বিচগুলোও তো ঘুরে দেখতে হবে। গোয়ায় তো আমরা ভূতের গল্প শুনতে আসিনি, তাই না?’
‘হ্যাঁ ভাইয়া, তা তো বটেই!’ মৃদু হাসল সৌরভ। পরক্ষণেই আবার গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। জানালার দিকে মুখ করে আবার তাকাল সেই পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে। বলল, ‘তবে ভাইয়া, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, বাড়িটা আমি আগেও কখনো দেখেছি। এমনকি বাড়িটায় আমি ঢুকেছিও!’
সৌরভের কথা শুনে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন শামস আর অন্তরা।
*
দক্ষিণ গোয়ার ক্যাবো ডি রামা বিচ ঘুরে এসে পালোলেমসহ আরও তিনটা বিচ হয়ে তাদের হোটেলে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। সারা দিনের প্রচণ্ড ক্লান্তিতে দুচোখ ভেঙে ঘুম আসছিল শামস-অন্তরা দম্পতির। একটু জিরিয়ে নিতে তাই হোটেলে ফিরেই সরাসরি নিজেদের ঘরে চলে গেছেন তাঁরা। সৌরভকেও বলে গেছেন একটু ঘুমিয়ে নিতে। ঘণ্টা দেড়-দুয়েক একটু জিরিয়ে নেওয়ার পর রাতের বেলায় উত্তর গোয়ার ভাগাতোর ও মর্জিম বিচ থেকে ঘুরে আসার পরিকল্পনা আছে তাঁদের।
সৌরভও কম ক্লান্ত নয়। কিন্তু ঘুম তার আসছে না। একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার চেষ্টা যে সে করতে পারত না, তা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে ঘুমানো কিংবা ঘুমানোর চেষ্টা করাটা তার কাছে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। ভাই আর ভাবি নিজেদের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর একমুহূর্ত সময় নষ্ট করল না সে। চলে গেল সেই জায়গায়, যেখানে তার মন পড়ে ছিল আজ সকাল থেকেই।
এই মুহূর্তে সে দাঁড়িয়ে আছে সেই পরিত্যক্ত বাড়ির দরজার সামনে।
আলতো করে একটা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজাটা। সেই খোলা দরজা দিয়ে পা টিপে টিপে ভেতরে প্রবেশ করল সৌরভ। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে আঘাত হানল তার নাকে। সেই গন্ধকে উপেক্ষা করে সে এগিয়ে চলল বাড়িটার ভেতরের দিকে। আর যত ভেতরে যেতে লাগল, ততই যেন বাড়তে লাগল গা ছমছমে ভাবটা!
বাড়িটার ভেতর ঢুকে প্রথমেই নিজেকে বসার ঘরে আবিষ্কার করল সৌরভ। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বেশ অবাক হলো। পুরোনো আমলের বেশ কিছু আসবাব এখনো রয়ে গেছে এখানে। অর্থাৎ এখানকার চোর-ডাকাতদের মনেও ভূতের ভয় এতটাই প্রবল যে চুরি-ডাকাতি করতেও কখনো এখানে ঢোকেনি তারা! ব্যাপারটা চিন্তা করে মনে মনে হাসল সৌরভ।
হেঁটে হেঁটে বাড়ির ভেতরটা ঘুরে দেখতে লাগল সে। জায়গায় জায়গায় ঘন মাকড়সার জাল! সে নিজের দুই হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে সেই জাল সরাতে সরাতে সামনের দিকে এগোতে লাগল।
হঠাৎ করেই একটা শব্দ ভেসে এল সৌরভের কানে। ধাতব চামচ দিয়ে সিরামিক বা কাচের কাপে টোকা দেওয়ার টুংটাং শব্দ! জিব শুকিয়ে গেল সৌরভের, ধুকপুক করতে লাগল বুক। কান খাড়া করে আবার শোনার চেষ্টা করল সে। কিন্তু না! আর শুনতে পেল না শব্দটা।
ধুর! সৌরভ মনে মনে হাসল। মনের ভুল আমার!
সৌরভ আবার বাড়ির ভেতরটা ঘুরে দেখায় মন দিল। বসার ঘর পেরিয়ে ভেতরের দিকের একটা ঘরে চলে গেল সে। একটা বড়সড় বেডরুম সেটা। সেখান থেকে যে ঘরে গেল, সেটা আরেকটা বেডরুম। তবে আগেরটার চেয়ে ছোট। এরপর সে চলে গেল ডাইনিংরুমে। সেখানে দেখার মতো তেমন কিছুই নেই। আছে শুধু রুমটার মাঝখানে পুরোনো আমলের একটা ম্রিয়মাণ গোলাকার ডাইনিং টেবিল আর সেটাকে ঘিরে চারটা চেয়ার।
আচ্ছা, আমার কেন মনে হচ্ছে যে কেউ আমাকে দেখছে? ঘুরে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল সৌরভ। আসলেই কি কেউ...
‘টুং টুং... টুং টুং টুং টুং...’
নিজের কাছে দ্বিতীয় প্রশ্নটা শেষ করতে পারল না সে, তার আগেই আবার শুনতে পেল শব্দটা! এবার আর শব্দটা থামছে না, বরং হয়েই চলেছে এবং শব্দটা আসছে ডাইনিংরুম থেকে!
একবার গিয়ে দেখব নাকি? ঘুরে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে ডাইনিংরুমের দরজাটার দিকে তাকিয়ে একবার ভাবল সৌরভ। ভয় যে তার লাগছে না, তা নয়। বুক দুরু দুরু করে কাঁপছে তার ভয়ে! আবার গিয়ে দেখার কৌতূহলও হচ্ছে!
ওদিকে শব্দটা হয়েই চলেছে!
একপর্যায়ে তার কৌতূহলী সত্তার কাছে হার মানল ভীত সত্তা। পা বাড়াল সে ডাইনিংরুমের দিকে। পা টিপে টিপে গিয়ে দাঁড়াল ডাইনিংয়ের দরজাটার কাছে। তারপর ভেতরে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল তার। বেড়ে গেল বুকের কাঁপুনি! আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে!
বিস্ফারিত চোখে সৌরভ দেখল, ডাইনিং টেবিলটার এক পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে কালো রঙের পোশাক পরা একটা মেয়ে। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল আর মুখটা ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য! তার সামনে টেবিলের ওপর রাখা একটা চায়ের কাপ। একটা চামচ দিয়ে সেই কাপের ভেতর থাকা চা ক্রমাগত নেড়েই যাচ্ছে মেয়েটা। আর শূন্য দৃষ্টিতে একনাগাড়ে তাকিয়ে রয়েছে সৌরভের দিকে।
হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, টের পেল সৌরভ। মাথাটা যেন বনবন করে ঘুরছে। রীতিমতো হাঁপরের মতো লাফাচ্ছে তার বুক!
মেয়েটা নিজের হাতে ধরা চামচটা দিয়ে চা নেড়েই যাচ্ছে। একপর্যায়ে বরফশীতল কণ্ঠে মেয়েটা বলল, ‘চায়ে পিয়োগে, বাবু?’
*
‘দশ বছরে আমরা এ নিয়ে চারবার পুরো ঘটনা হুবহু রিপিট করলাম, ডাক্তার সাহেব!’ হতাশামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন শামস, ‘আমার মনে হচ্ছে, এবারও কোনো লাভ হবে না!’
মনোচিকিৎসক এরফান আহমেদ ফোনের অপর প্রান্ত থেকে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এখন কী অবস্থা সৌরভের?’
‘সৌরভ এখন ওর রুমে, ডাক্তার সাহেব। জ্ঞান ফেরেনি এখনো।’
‘আচ্ছা, হোটেলের যে বেয়ারা এবার ওকে ওই বাড়ির গল্পটা বলেছে, সে ঠিক ওইভাবেই বলেছে তো, যেভাবে সৌরভকে দশ বছর আগে বলা হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। দশ বছর আগে আমরা গল্পটা ঠিক যে রকম শুনেছিলাম, প্রতিবারের মতো এবারও আমরা ঠিক সেভাবেই বেয়ারাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। সে–ও ওভাবেই বলেছে গল্পটা।’
‘হুমম। গল্প শোনার পর সৌরভের রেসপন্স কী রকম ছিল?
‘নাথিং নিউ।’ হঠাৎ মনে পড়তেই শামস আবার বলে উঠলেন, ‘ওহ না না...ওর এবারের রেসপন্সটা আগের তিনবারের চেয়ে একটু আলাদা ছিল, ডাক্তার সাহেব! ও বলছিল, ওর নাকি মনে হচ্ছে বাড়িটা ও আগেও কখনো দেখেছে!’
‘এটাকে কিন্তু আমরা উন্নতির লক্ষণ হিসেবে ধরে নিতে পারি, শামস। যা–ই হোক, আমি আজ রাতের ফ্লাইটে কলকাতায় যাচ্ছি, এরপর ভোর পাঁচটার ফ্লাইট ধরে কাল দুপুর নাগাদ সোজা গোয়ায় চলে আসব। এসে দেখি তাহলে ওর কী অবস্থা, কেমন?’
‘ঠিক আছে, ডাক্তার সাহেব। রাখছি তাহলে এখন।’
‘ভালো থাকবেন।’