গুড্ডুবুড়া বলে, আচ্ছা বল তো, কমলার রং কী?
কমলা। গুড্ডিবুড়ি বলে।
গুড্ডুবুড়া বলে, তাহলে সবুজ রঙের কমলাকে কি আমরা সবুজ বলে ডাকব?
গুড্ডিবুড়ি হাসে। বলে, বলো তো বেগুনের রং কী?
বেগুনি?
তাহলে সবুজ রঙের বেগুনকে কি আমরা সবুজ বলে ডাকব?
দুজনে খিলখিল করে হেসে ওঠে।
গুড্ডুবুড়া এখন চমৎকার চমৎকার গাড়ি বানায়। একটা চার কোনা বাক্স পেলেই হলো, সেটা বিস্কুটের প্যাকেট কিংবা জুতার বাক্স যা-ই হোক না কেন। শক্ত খাতার মোটা মলাট গোল করে কেটে চাকা বানায়। দুটো চাকার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় একটা পুরোনো বলপেন। এমনি করে চারটা চাকা কাগজের বাক্সে লাগিয়ে সে বানিয়ে ফেলে মোটরগাড়ি।
তবে তার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হলো চলন্ত নৌকা।
তাদের বাথরুমে একটা বাথটাব আছে। সেটার ওপরে সে ভাসাল একটা শোলার বাক্স। সেই শোলার বাক্সের মধ্যে রাখল এক বাটি পানি। তারপর একটা স্যালাইনের পাইপ কেটে সাইফন পদ্ধতিতে বাটির পানি ফেলতে লাগল বাইরে বাথটাবের পানিতে। সেই পানি পড়ছে, তার ধাক্কা লেগে তার শোলার নৌকা বিপরীত দিকে ছুটছে।
বাবা সেটা দেখে বললেন, এ হলো নিউটনের তৃতীয় সূত্র। প্রতিটা ক্রিয়ারই একটা সমান আর বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। তোমার শোলার জাহাজ থেকে পানি বেরিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে বাইরের পানিকে। তারই ধাক্কায় শোলা এগিয়ে চলেছে।
গুড্ডুবুড়ার বাবা লটারিতে পেয়েছেন। খুব বেশি টাকা নয়। পাঁচ লাখ টাকা। তা-ও আবার তাঁদের ব্যাংকের বার্ষিক প্রীতিভোজের লটারিতে। টাকাটা অবশ্য দেওয়া হয়েছে তাঁদের চারজনের পরিবারের থাইল্যান্ড ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। লটারিতে পাঁচ লাখ টাকার চেক পেয়ে গুড্ডুবুড়ার বাবা খুবই খুশি। মা অবশ্য তেমন খুশি না। তিনি বলেন, থাইল্যান্ড বেড়িয়ে টাকাটা নষ্ট করার দরকার কী! এর চেয়ে টাকাটা থাকুক। গঠনমূলক কোনো কাজ করা যাবে।
গুড্ডুবুড়া বলে, থাইল্যান্ড যেতে-আসতে এত টাকা লাগবে না। দুই লাখেই হয়ে যাবে। আমরা যাব। দুই লাখ টাকা খরচ করব। আর তিন লাখ টাকা রয়ে যাবে।
গুড্ডিবুড়ি বলে, বুদ্ধি খারাপ না। ভাইয়া তো ছোট মাছ চিবিয়ে খায়, এই জন্য তার মাথায় বুদ্ধি গিজগিজ করছে।
বাসার সামনে একটা ছোট্ট পরিসর। কানা গলিই বলা যায়। সেখানে গুড্ডুবুড়া রোজ ক্রিকেট খেলে। আশপাশের বাসা থেকে আরও আরও ছেলের দল বের হয়। বিকেলবেলা রোদ মরে এলেই জমে ওঠে তাদের খেলা। টেনিস বলে লাল রঙের টেপ লাগিয়ে নিয়ে তারা সেটাকেই ক্রিকেট বল বানিয়ে তোলে।
বিকেলবেলা গুড্ডুবুড়া নিচতলায় বাচ্চাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছে।
এই সময় দুটো আঠারো-বিশ বছরের ছেলে এসে দাঁড়াল সেই লনটার এক কোণে।
দুজনেরই পরনে ময়লা জিনস। একজনের গায়ে নীল টি-শার্ট, আরেকজনের গায়ে লাল রঙের জামা। তারাও মিশে গেল পিচ্চিদের খেলার দলে। তারা ফিল্ডিং করতে লাগল।
ব্যাট করছে গুড্ডুবুড়া নিজে। সে স্ট্রেইট ড্রাইভটা বেশ ভালো পারে। একেবারে কেতাবি ঢঙে ব্যাট চালায়, বোলারের পাশ ঘেঁষে বল চলে যায় সীমানার বাইরে।
আর ওই দুই তরুণ দৌড়ে দৌড়ে বল নিয়ে আসে রাস্তার ওপাশ থেকে।
এবার গুড্ডুবুড়া একটা হুক শট মারল। বল করছিল পাভেল। শর্ট পিচ ধরনের বল। মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল।গুড্ডুবুড়া জোরে ব্যাট চালাল। বল চলে গেল পাশের বাড়ির গাড়ির গ্যারাজের টিনের চালে। কে পাড়বে এই বল।
ওই অজানা দুই তরুণ তরতর করে দেয়াল বেয়ে উঠে গেল ছাদে। তারা মুহূর্তেই বল পেড়ে আবার ছুড়ে দিল ওদের হাতে।
লোক দুটো তো দারুণ।
এবার ওদের মধ্যে লাল শার্ট পরা লোকটা বলল, এবার আমি ব্যাট করি। কে বল করবে? পাভেল না তোমার নাম? তুমিই বল করো।
নীল টি-শার্ট পরা লোকটা বলল, গুড্ডুবুড়া, আসো, তুমি আর আমি ওই দিকটায় যাই। ও যা ব্যাট করে, নির্ঘাত একটা ছক্কা মেরে দেবে। ওই পাশটায় গেলে একটা ক্যাচ শিওর ধরতে পারব।
গুড্ডুবুড়া আর নীল শার্ট দূরে রাস্তার ওই পারে গিয়ে ফিল্ডিং করছে।
পাভেল বল করল।
লাল শার্ট সত্যিই একটা বিশাল মার মারল। এটা এমনকি স্টেডিয়ামের মাঠে হলেও নিশ্চিত ছক্কা।
বলটা দূরে পড়ল। গুড্ডুবুড়া ছুটছে বলের পেছনে। আর ছুটছে নীল শার্ট। তারা একটা নির্মাণাধীন ভবনের পেছনে চলে গেল। তারপর হাওয়া।
নীল শার্ট ওদের খুঁজতে চলে গেল ভবনটার পেছনে। সেও হাওয়া।
পাভেলসমেত অন্য ছেলের দল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর গেল ওই বিল্ডিংয়ের পেছনে। গিয়ে দেখল বিল্ডিংটার ওই পারটা মিশেছে একটা রাস্তার সঙ্গে। আর গুড্ডুবুড়া কিংবা লাল শার্ট কিংবা নীল শার্ট—কেউই ওখানে নেই।
ছেলেরা অনেক খোঁজাখুঁজি করল। কিছুক্ষণ খুঁজল বল। তারপর খঁুজল গুড্ডুবুড়াকে। তারপর খঁুজল লাল আর নীল শার্টকে। কারও কোনো চিহ্ন নেই। বিল্ডিংয়ের বুড়ো দারোয়ান বললেন, ওই পারের রাস্তায় একটা অটোরিকশা দাঁড় করানো ছিল। সেটায় চড়ে তিনজনই বিদায় নিয়েছে।
গুড্ডুবুড়াদের বাড়িতে গতরাত থেকেই কান্নার রোল। গুড্ডুবুড়া হারিয়ে গেছে। তার ক্রিকেট খেলার সাথিদের মতে, দুজন তরুণ তাকে অপহরণ করেছে। নির্মাণাধীন ভবনের দারোয়ানেরও সে রকমই মত। একটা অটোরিকশায় তুলে গুড্ডুবুড়াকে ধরে নিয়ে গেছে।
গুড্ডিবুড়ি কাঁদছে সবচেয়ে বেশি। সে বলছে, আমার বোকা ভাইটা হারিয়ে গিয়েছিল। কারণ, সে ছিল বোকা। এখন আমার চালাক-চতুর ভাইটা কেন হারিয়ে যাবে। মা, শোনো, তুমি কেঁদো না। বাবা, তুমিও কেঁদো না। ভাইয়া এখন অনেক বুদ্ধিমান। দেখো, সে ঠিক ফিরে আসবে। এমন বুদ্ধিমান একটা ছেলের সঙ্গে কিডন্যাপাররা পারবেই না।
আলতাফ হোসেন থানায় গেলেন। জিডি করলেন।
ছোট খালা ছুটে এলেন।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হলো।
গুড্ডুবুড়ার খেলার সাথি পাভেলের ছোট চাচা প্রতিমন্ত্রী। তাঁকেও জানানো হলো। তিনি পুলিশকে বিশেষভাবে বলে দিলেন। গোয়েন্দারাও সব তৎপর হয়ে উঠলেন।
কিন্তু তাতে কী। সারা রাত কোনো খোঁজ মিলল না গুড্ডুবুড়ার। কেউ চাঁদা পর্যন্ত দাবি করে ফোন করল না।
মা জায়নামাজে বসলেন। হে খোদা, হে রহমানুর রহিম, তুমি আমার ছেলেটাকে ফিরিয়ে দাও। তিনি তসবিহ হাতে নিয়ে দোয়া-দরুদ শরিফ পাঠ করতে লাগলেন।
এবার সত্যিকারের অপহরণকারীর কবলে পড়ল গুড্ডুবুড়া।
লোক দুটো তার নাকে একটা রুমাল ধরেছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই তার। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখা গেল, সে একটা বাসার ভেতরে আটকা। সে বিছানায় উপুড় হয়ে শোয়া। তার হাত দুটো পেছন থেকে বাঁধা। আর তার মুখে টেপ লাগানো।
ঘরটায় মৃদু আলো। সে অনেক কষ্টে ঘাড় ঘোরাল। সাধারণ একটা ঘর। এক কোণে একটা দড়িতে কিছু কাপড় ঝুলছে। এটা কারও একজনের থাকার ঘর। এইটুকুন মাত্র সে বুঝতে পারল।
খিদেয় তার পেট চোঁ চোঁ করছে। ইদানীং খাবারের প্রতি তার ভীষণ দুর্বলতা। ঠিক সময় না খেলে তার চলেই না।
এই সময় ঘরের দরজা খুলে গেল। ঢুকে পড়ল নীল শার্ট আর লাল শার্ট।
তারা বলল, কী খবর গুড্ডুবুড়া?
গুড্ডুবুড়ার তো মুখ টেপ দিয়ে আটকানো। সে কোনো কথা বলতে পারল না।
শোনো। তোমার আব্বুকে এখন আমরা ফোন করব। তুমি তাকে বলো, পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে সোজা আমরা যেখানে বলব, সেখানে চলে আসতে।
তারা গুড্ডুবুড়াকে উল্টিয়ে চিত করে শোয়াল। তারপর তার মুখ থেকে টেপগুলো খুলতে লাগল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল গুড্ডুবুড়া। টেপ খোলার সময় তার ঠোঁটে, নাকের নিচে চামড়ায়, রোমে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।
ব্যথায় তার দুচোখ দিয়ে জল এসে গেল।
তারা বলল, তোমার আব্বুকে ফোন করছি। কথা বলো। কী বলবে?
কী বলব?
বলবে, আব্বু আমাকে কিডন্যাপাররা ধরে নিয়ে এসেছে। পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে চলে আসেন। রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের পেছনে। আগামীকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। পুলিশকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। পুলিশ দেখামাত্র ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
ওরা ওর হাত খুলে দিল।
নিজেরাই গুড্ডুবুড়ার বাবা আলতাফ হোসেনের মোবাইল ফোনে কল করল। রিং হচ্ছে।
গুড্ডুবুড়ার বাবা আলতাফ হোসেন এরই মধ্যে পুলিশকে জানিয়েছেন যে তাঁর ছেলে হারিয়ে গেছে। ছোট খালার মারফতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও ব্যাপারটা জানানো হয়েছে।
পুলিশ ব্যাপারটাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আলতাফ হোসেন সাহেবের মোবাইল ফোনে কে কে ফোন করছে, সব পুলিশ রেকর্ড করছে।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে যেতে বলেছে। এই সেই জায়গা, যেখানে ১৯৭১ সালে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি আর তাদের দালাল রাজাকার-আলবদররা হত্যা করে ফেলে রেখেছিল। ষোলোই ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে সেখানে গিয়ে দেখা গেল ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-কবি-সাংবাদিক-শিক্ষকদের পিছমোড়া করে হাত বাঁধা লাশ। পড়ে আছে জলায় জঙ্গলে। সেই জায়গাটায় পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আলতাফ হোসেনকে যেতে হবে বিকেলে।
পুলিশ প্রস্ত্তত হচ্ছে। তারা ওই জায়গাটা তার আগেই ঘিরে ফেলবে। তাহলে যে টাকা নিতে আসবে, তাকে ধরা যাবে। কিন্তু গুড্ডুবুড়াকে জীবিত উদ্ধার করা যাবে কি?
পুলিশ মোবাইল ফোনটার উৎস বের করে ফেলেছে। কলটা এসেছে রামপুরা এলাকা থেকে। রামপুরা অনেক বড় এলাকা। ওখানে ঠিক কোন বাড়িতে গুড্ডুবুড়াকে আটকে রাখা হয়েছে, সেটা বের করা খুবই কঠিন।
গুড্ডুবুড়া বলল, আঙ্কেল খুব খিদে পেয়েছে। কত দিন যে কিছুই খাইনি।
লাল শার্ট বলল, কত দিন কিছু খাওনি মানে। তোমাকে কাল সন্ধ্যায় এখানে আনা হয়েছে। এখন বাজে রাত ১১টা। খুব বেশিক্ষণ না খেয়ে আছ, তা তো না।
নীল শার্ট বলল, আচ্ছা তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
একটু পরে নীল শার্ট পরা লোকটাই একটা প্লেটে পরোটা আর সবজি নিয়ে হাজির হলো। গুড্ডুবুড়া গোগ্রাসে গিলল খাবারটা। বলল, পানি।
তাকে একটা বোতল দেওয়া হলো।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে আবার তার মুখে টেপ সাঁটা হলো। হাত দুটো পেছন দিকে বেঁধে বিছানায় উপুড় করে ফেলে রাখা হলো। তারপর লোকগুলো জানালার পর্দা টেনে দিয়ে ঘর অন্ধকার করে বেরিয়ে গেল।
গুড্ডুবুড়া হিসাব কষে দেখল, আগামীকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজতে এখনো বেশ খানিকটা বাকি আছে। এর মধ্যেই তাকে উদ্ধার পেতে হবে।
প্রথম কাজ হবে তার হাতের বাঁধন খুলে ফেলা। সে জন্য তাকে আগে উপুড় থেকে চিত হতে হবে। পা খোলা থাকায় কাজটা করতে তার মোটেও বেগ পেতে হলো না।
এবার সে পায়ে ঠেলে ঠেলে উঠে বসল বিছানায়।
হাতের বাঁধন কিছুতেই খুলছে না।
দরজায় শব্দ হলো। অমনি গুড্ডুবুড়া আবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
কেউ একজন এল। বলল, গুড্ডুবুড়া, তুমি ঠিক আছ?
জি আঙ্কেল। ঠিক আছি। শুধু একটাই অসুবিধা। মশা ভয়ানক কামড়াচ্ছে। আমার হাত দুটো বাঁধা। আমি মশা মারতে পারছি না। আমার হাত দুটো কি খুলে দেওয়া যায়?
না, যায় না। হাত দুইটা খুইলা দিলে তুমি মুখের বাঁধন খুইলা ফেলবা। আর মুখের বান্ধন খুইলা ফেললে তুমি চিৎকার দিবা। তাইলে আমরা ধরা খাইয়া যামু।
তাহলে কি একটা কাজ করতে পারবেন। আমাকে একটা মশার কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে যাবেন ঘরের মধ্যে।
এই কাজটা করতে পারি। একটা কয়েল জ্বালায়া দিতে পারি।
দিন না প্লিজ। আমি বাবাকে কালকে ভালো করে বলব, যেন আপনাদের পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে দেন।
আর বলবা, পুলিশরে জানি খবর না দেয়।
জি, তা-ও বলব।
ওরা একজন এসে ঘরে একটা মশা তাড়ানোর কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে ফের ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
চারদিক নিশ্চুপ। দূরে রিকশার টুং টাং আর গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে। গুড্ডুবুড়া উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সে আবার চিত হয়ে শুল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসল। হাতটা নিয়ে সোজা চলে গেল কয়েলের কাছে। হাত দুটো পেছনে বাঁধা। জানালা দিয়ে আসা রাস্তার আলো দিয়ে দেখতে পেল একটা দেশলাইয়ের বাক্স পড়ে রয়েছে কয়েলের পাশেই। আর আছে একটা মোমবাতি। মোমবাতিটা নেভানো।
গুড্ডুবুড়া তার কর্তব্য ঠিক করে ফেলল। পিঠের দিকে বাঁধা হাতের আঙুল দিয়ে সে প্রথমে ধরল দেশলাইয়ের বাক্সটা। সেটা সে ঠিক জায়গায় রাখল। এরপর সে সোজা করে রাখল মোমবাতিটা। এটা একটু পরে কাজে লাগবে।
তারপর সে অতিকষ্টে দেশলাইয়ের কাঠি বের করল দুটো। দুটোই সে আঙুলের মাথায় একসঙ্গে ধরল। তারপর সেই কাঠি নিয়ে সে চলে গেল মশার কয়েলের কাছে।
অতিকষ্টে জ্বলন্ত কয়েলের আগুনের মুখে সে ধরল দেশলাইয়ের কাঠি দুটোর মুখ।
দপ করে কাঠি জ্বলে উঠল।
সে সেই কাঠি ধরল মোমবাতির মুখে।
ঠিকমতো হচ্ছে না। দেশলাইয়ের কাঠির আগুন তার হাতের আঙুল পুড়িয়ে ফেলতে চাইছে।
এমন সময় মোমবাতিটা জ্বলে উঠল।
গুড্ডুবুড়া হাতের দেশলাইয়ের কাঠি ফেলে দিল।
এবার সে তার হাতে বাঁধা নায়লনের দড়িটা ধরল মোমবাতির শিখায়। মুহূর্তে নায়লনের দড়ি গেল গলে। তার হাতে ফোসকা পড়ল। কিন্তু বাঁধন গেল খুলে।
এবার মুখের বাঁধনটা খুলতে পারে। প্রথম কাজ হলো, সে ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি দিল আটকে।
তারপর ঘরে খঁুজতে লাগল কোথায়ও কিছু পাওয়া যায় কি না, যা দিয়ে সে নিজেকে উদ্ধার করতে পারে।
অনেক খঁুজে সে পেল একটা লিপস্টিক। এই লিপস্টিকটা কে, কেন এখানে এনে রেখেছিল, আল্লাহ জানেন।
আর খুঁজে পেল কতগুলো সাদা নিউজপ্রিন্টের কাগজ। সেটা পাওয়া গেল আবার ইস্তিরি করে রাখা শার্টের ভেতরে ভেতরে।
লিপস্টিক দিয়ে কাগজে গুড্ডুবুড়া লিখতে লাগল,
আমার নাম ওয়াসিফ হোসেন ওরফে গুড্ডুবুড়া। আমাকে এই বিল্ডিংয়ের তিনতলায় কিডন্যাপ করে রাখা হয়েছে। আমার বাবার নাম আলতাফ হোসেন। তার মোবাইল নম্বর...। আপনারা যেই এই চিঠি পড়বেন, দয়া করে আমার আব্বাকে ফোন করে জানাবেন। না হলে কোনো পুলিশকে জানাবেন।
এভাবে সে অনেকগুলো কাগজে অনেকগুলো চিঠি লিখল।
দুটো চিঠি সে রাতের বেলাতেই জানালা দিয়ে মুঠো করে নিচে ফেলে দিল।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, বাইরে নির্জন পথ। লাইটপোস্টে আলো জ্বলছে। একটা দুটো রিকশা যাচ্ছে। দু-চারজন পথচারীও যাচ্ছে। কেউ তার চিঠির দিকে ফিরেও তাকাল না।
সারা রাত ছটফট করল গুড্ডুবুড়া।
ভোর হচ্ছে। মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে।
গুড্ডুবুড়া আবার বিছানা ছাড়ল।
নামাজ পড়তে যাচ্ছেন মুসল্লিরা। তাঁদের মাথায় টুপি। এইটাই সুযোগ।
সে জানালার ধারে গিয়ে মোমবাতি দোলাচ্ছে। যদি কেউ দেখে। দুজন মুরব্বি আসছেন এই পথে। তাঁদেরও মাথায় টুপি। তারাও নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছেন।
তাঁদের লক্ষ্য করে গুড্ডুবুড়া দলা পাকানো চিঠি ফেলতে লাগল।
তারপর সে ঘরের ভেতরে থাকা এটা-ওটা জিনিসপাতি ফেলতে লাগল রাস্তায়। লোক দুটো চমকে ওপরে তাকাল। গুড্ডুবুড়া তাঁদের মোমবাতি দিয়ে সংকেত দেখাল। আরেকটা চিঠি সে ফেলল।
একটা চিঠি ভাঁজ খুলে সে পড়ে ইঙ্গিত দিল চিঠিটা পড়ুন।
ভদ্রলোক দুজন একটা চিঠির দলা খুললেন এবং পড়লেন। তারপর তাঁরা মোবাইলে ফোন করতে লাগলেন।
তাঁরা হাত দিয়ে ইশারা করলেন—তুমি থাকো। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
তখনো পুরোপুরি সকাল হয়নি।
পুলিশ পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলল।
ধরা পড়ল অপহরণকারী দুজন।
দরজা ধাক্কার শব্দে পিলে চমকে উঠল গুড্ডুবুড়ার। এত জোরে কে ধাক্কা দিচ্ছে। কে? ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল গুড্ডুবুড়া। আমরা পুলিশ।
আমি তোর বাবা গুড্ডুবুড়া—বাবার গলাও শোনা গেল।
গুড্ডুবুড়া তাড়াতাড়ি দরজা খুলল। দেখল, ওই লাল শার্ট আর নীল শার্টকে পুলিশ আচ্ছা করে বেঁধেছে।
অপহরণকারীদের হাত থেকে নিজের বুদ্ধি দিয়ে বেঁচে ফিরে আসার গল্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভিড় করতে লাগল গুড্ডুবুড়ার বাসায়। তাদের নাশতা খাওয়াতে তো ছোট খালা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। এর মধ্যে তাঁকে বিউটি পারলার থেকে সেজে আসতে হয়েছে। টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে তো যেমন-তেমন সাজে যাওয়া যায় না!
সংবাদপত্রেও বের হলো গুড্ডুবুড়ার সাহস আর বুদ্ধির কাহিনি।
গুড্ডুবুড়া বলল, সাহস, বুদ্ধি, কৌশল যা-ই বলুন না কেন, তা যদি কেউ অর্জন করতে চায়, তাকে অবশ্যই ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে। আমি তো আগে ছিলাম বোকা। কারণ, তখন আমি খেতে চাইতাম না। এখন আমি খাই। এখন আমি খেলাধুলা করি। এখন আমার কিছু কিছু বুদ্ধি হয়েছে বটে।
তবে বুদ্ধি বাড়ানোর জন্য আরেকটা কাজও করতে হয়। প্রচুর গল্পের বই পড়তে হয়। আমি সেই কাজটাও করি।
গুড্ডিবুড়ি বলল, এই, তোমাকে বই পড়ার বুদ্ধিটা কে দিয়েছে। আমি না?
গুড্ডুবুড়া বলল, হ্যাঁ, আমার বোনটা কিন্তু আগে থেকেই ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করে আর বই পড়ে। ওর বুদ্ধির সঙ্গে আপনারা কেউ পারবেন না।