খেয়েদেয়ে ঘুমানোর জন্য শুয়েছি, ফাটাফাটি একটা অ্যাডভেঞ্চার বই পড়ছি, নায়ক খুবই বিপদের মধ্যে, পাহাড় থেকে ঝুলছে, ভিলেন মাথায় রিভলবার ধরে অট্টহাসি হাসছে। বইটা রাখতে পারছি না আর আম্মু এসে একটু পরপর বলছেন, ‘লাইট নিভিয়ে দিচ্ছি, ঘুমা’ আর আমি বলছি, ‘আর এক মিনিট আম্মু’ ঠিক তখন হঠাৎ করে দড়াম দড়াম করে দরজার মাঝে ধাক্কা। আজকালকার সব বাসায় কলবেল থাকে—আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন মনে হয় কলবেল আবিষ্কারও হয়নি। দরজার সামনে তালা লাগানোর জন্য গোল গোল কড়া থাকত, কেউ বাসায় এলে সেই কড়া নাড়ত। কিন্তু যেই এসে থাকুক সে কড়া দেখেনি কিংবা কড়া নাড়ার বিষয়টাই জানে না। কাজেই বাসায় আমরা সবাই চমকে উঠলাম। মোটামুটি দৌড়ে সবাই বাইরের ঘরে গেলাম, তখনো দড়াম দড়াম শব্দ। আব্বু জিগ্যেস করলেন, ‘কে?’
বাইরে থেকে কোনো গলার আওয়াজ নেই শুধু দড়াম দড়াম শব্দ। মনে হচ্ছে কেউ একজন দরজা ভেঙে ঢুকে যাবে। আব্বু দরজা খোলার জন্য এগিয়ে গেলেন, আম্মু ভয় পাওয়া গলায় বললেন, ‘আগেই খুলো না! বাইরে কে এসেছে কে জানে?’
কিন্তু আর দেরি করার সময় নেই। মনে হচ্ছে বাইরে যে-ই থাকুক সে দরজা ভেঙে ঢুকেই যাবে। আব্বু দরজা খুললেন আর সঙ্গে হুড়হুড় করে ছোট একটা ছেলে ঢুকল, আমরা সবাই দেখলাম ছেলেটা ফজল।
এমনিতে ফজল আমাদের বাসা চিনত না, কিন্তু তার বাড়িতে যাওয়ার পর এক-দুইবার তাকে আমি আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলাম। আব্বু-আম্মুকে যদিও পাটিগণিতের কথা বলেছিলাম কিন্তু আসলে তার পাটিগণিতে কোনো উৎসাহ নেই। বাসায় এসে সোফায় বসে শুধু এদিক সেদিক তাকায়। যাওয়ার সময় একটা গল্পের বই নিয়ে যায়, তার বই পড়ার একটা শখ আছে।
ফজল ঢুকে কেমন জানি ভয় পাওয়া চোখে এদিক সেদিক তাকাল, তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘নানি নানি নানি...’
আব্বু জিগ্যেস করলেন, ‘কী হয়েছে নানির?’
ফজল বলল, ‘নানি নানি নানি...’
আম্মু ফজলকে ধরে বললেন, ‘কী হয়েছে তোমার নানির?’
ফজল বলল, ‘মরে যাচ্ছে! নানি মরে যাচ্ছে।’ তারপর আবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
আম্মু অনেক কষ্ট করে ফজলকে থামালেন। বললেন, ‘তুমি একটু কান্না থামাও। কান্না থামিয়ে বলো কী হয়েছে তোমার নানির।’
ফজল যেটা বলল তার সারমর্ম এ রকম। রাতের বেলা নানি বলেছে তার খিদে লাগেনি, খাবে না। তাই নানি সকাল সকাল বিছানায় শুয়ে পড়েছে। নানির ঘুম খুব কম। বলতে গেলে সারা রাতই জেগে থাকে, জেগে একা একা কথা বলে। ফজল রাতে একা খেয়েছে, খেয়ে মনে হলো তার নানি একটু বেশি চুপচাপ। তাই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে মুখ হাঁ করে চোখ উল্টিয়ে পড়ে আছে। মুখের দুই পাশ দিয়ে কশ পড়ছে। ফজল প্রথমে ভেবেছিল মরেই গেছে, তখন শুনল নানি গোঁ গোঁ শব্দ করছে। সে কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে নানিকে ডেকে তোলার চেষ্টা করেছে, কোনো লাভ হয়নি। তখন হঠাৎ নানির বুকের ভেতর থেকে ঘড় ঘড় শব্দ বের হতে শুরু করেছে। ফজল তখন কী করবে বুঝতে না পেরে দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের বাসায় চলে এসেছে। কথা শেষ করে ফজল আবার হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
আব্বু বললেন, ‘তুমি কেঁদো না। আমার বন্ধু একজন ডাক্তার আছে। গোপেন ডাক্তার, সে খুবই ভালো ডাক্তার, তাকে নিয়ে আমি এখনই তোমার বাড়ি যাব। দেখবে তোমার নানি ভালো হয়ে যাবে।’
আব্বুর কথা শুনে ফজলের হাউমাউ করে কান্না বন্ধ হলো, সে তখন শুধু ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে কাঁদতে লাগল।
আজকাল ডাক্তাররা কারও বাসায় যায় না। রোগী যত দুর্বলই হোক, তার অবস্থা যত খারাপই হোক, তাকে টেনেহিঁচড়ে ডাক্তারের কাছে নিতে হয়। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন ডাক্তাররা রোগীর বাসায় আসতেন। সব ডাক্তারের একটা চামড়ার পেট মোটা ব্যাগ থাকত, সেই ব্যাগে চিকিৎসার সবকিছু থাকত। ডাক্তাররা দরকার হলে সেই ব্যাগ থেকে যন্ত্রপাতি বের করে ছোটখাটো সার্জারি পর্যন্ত করে ফেলতেন।
আব্বু শার্ট-প্যান্ট পরে ফজলকে নিয়ে রওনা দিলেন, তখন আমি বায়না ধরলাম আমিও যাব। আব্বু রাজি হয়ে গেলেন। আমাদের কারও বাসায় টেলিফোন নেই তাই গোপেন ডাক্তারকে আগে থাকতে খবর দেওয়ার উপায় নেই। আমরা সোজাসুজি তাঁর বাসায় হাজির হলাম। গোপেন ডাক্তার আব্বুর বন্ধু, তাই আব্বুর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পেট মোটা ব্যাগ নিয়ে রওনা দিলেন। খানিকটা রিকশায়, নদীর কাছে এসে নৌকায় নদী পার হয়ে মাটির পথ ধরে আমরা হেঁটে হেঁটে রওনা দিলাম। গোপেন ডাক্তারের কাছে একটা টর্চলাইট ছিল, সেটা দিয়ে পথ দেখে দেখে আমরা ফজলের বাড়ি হাজির হলাম। অন্ধকার বাড়ি, সেখানে কোনো জীবিত মানুষ আছে মনেই হয় না।
আমরা ফজলের পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলাম। গোপেন ডাক্তার তাঁর টর্চলাইট জ্বালিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে ফজলের থুত্থুড়ে বুড়ি নানি শুয়ে আছে। ফজল এদিক সেদিক খুঁজে একটা কুপিবাতি আনল—আব্বুর কাছে একটা ম্যাচ ছিল, সিগারেট খেতেন বলে সব সময় ম্যাচ থাকে। সেটা দিয়ে কুপিবাতিটা জ্বালাতে চেষ্টা করলেন। প্রথমবার জ্বালাতে পারলেন না, তখন আমি আব্বুর কাছ থেকে ম্যাচটা নিয়ে কুপিবাতিটা জ্বালালাম। আব্বুকে ম্যাচটা দেওয়ার আগেই আব্বু সরে গেলেন বলে ম্যাচটা আমার কাছে রয়ে গেল।
গোপেন ডাক্তার ফজলের নানিকে টিপে-টুপে পরীক্ষা করলেন, স্টেথিস্কোপ কানে লাগিয়ে বুকের ভেতরের শব্দ শুনলেন, হাতের মাঝে চেপে ধরে পালস গুনলেন, চোখের পাতা টেনে সেখানে টর্চলাইট ফেলে দেখলেন, তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন।
আব্বু জিগ্যেস করলেন, ‘কী অবস্থা?’
গোপেন ডাক্তার নিচু গলায় ইংরেজিতে আব্বুকে কিছু একটা বললেন, যেটা আমি ভালো বুঝতে পারলাম না। তবে আব্বুর মুখ দেখে মনে হলো যেটাই বলে থাকেন, সেটা খুব ভালো কথা না। ফজল অবশ্য সেটা বুঝতে পারল না, সারাক্ষণই সে কুপিবাতিটা হাতে ধরে তার নানির দিকে ভয় ভয় চোখে তাকিয়েছিল।
গোপেন ডাক্তার তাঁর ব্যাগ খুললেন, ভেতর থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করলেন, সেখানে সুঁই লাগালেন তারপর একটা ওষুধের শিশি থেকে কী একটা ওষুধ টেনে বের করে ফজলের নানির হাতে একটা ইনজেকশন দিলেন। আমার মনে হলো ইনজেকশন দেওয়ার পর ফজলের নানির বুকের ঘড় ঘড় শব্দটা একটু কমে এল, মনে হলো একটু শান্তভাবে ঘুমাতে লাগলেন।
গোপেন ডাক্তার তাঁর ব্যাগ বন্ধ করে ফজলকে জিগ্যেস করলেন, ‘এখানে বড় মানুষ কে আছে?’
ফজল বলল, ‘কেউ নাই।’
‘রোগী দেখার জন্য বড় মানুষ লাগবে।’
ফজল কোনো কথা না বলে গোপেন ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রইল। ‘তোমাদের আত্মীয়স্বজন নেই? পাড়াপড়শি? গ্রামের লোক?’
‘আমাদের বাড়িতে কেউ আসে না।’
‘কেন আসে না।’
ফজল কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ‘ভয় পায়।’
গোপেন ডাক্তার অবাক হয়ে বললেন, ‘ভয় পায়? ভয় পাবে কেন?’
ফজল নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানি না।’
গোপেন ডাক্তার কেমন যেন হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে।’
‘হাসপাতালে?’ বলে ফজল আবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আজকাল সবাই যেমন কথায় কথায় হাসপাতালে চলে যায়—তখন মোটেও সে রকম কেউ হাসপাতালে যেত না। হাসপাতালে যাওয়া একটা অনেক বড় ব্যাপার ছিল, সত্যি কথা বলতে কি হাসপাতালে যাওয়া আর কবরস্থানে যাওয়া মোটামুটি একই রকম শোনাত। তাই নানিকে হাসপাতালে নিতে হবে শুনে ফজল যে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, সেটা দেখে আমরা মোটেও অবাক হলাম না। আব্বু ফজলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কী হলো? তুমি কাঁদছ কেন? তোমার নানি হাসপাতাল থেকে ভালো হয়ে ফিরে আসবেন।’
গোপেন ডাক্তার বললেন, ‘বাড়িতে বড় কোনো মানুষ নেই, এ রকম সিরিয়াস রোগীর সেবা করবে কে?’ হাসপাতালে নিতেই হবে।’
আব্বু বললেন, ‘আজকাল হাসপাতালে খুব ভালো চিকিৎসা হয়। তাই না গোপেন?’