পান্না-রহস্য (শেষ পর্ব)

অলংকরণ: আরাফাত করিম
কাহিনি রচনা: কাজী শাহনূর হোসেন | তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর: শামসুদ্দীন নওয়াব

নয়

অন্ধকারাচ্ছন্ন অফিসে পা রাখলেন ড. ক্রুক। হিরু চাচার ডেস্কের উদ্দেশে পা টিপে টিপে এগোচ্ছেন।

হঠাৎই ফ্লাশলাইটের সুইচ জ্বাললেন। ধীরে ধীরে ঘুরে, গোটা ঘরে আলো বোলালেন।

জেমসের অফিসে দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেল কিশোর। শ্বাস চেপে রেখেছে। ওর পাশে অনুভব করল, কাঁপছে মুসা আর রবিন।

সাহস করে আবারও উঁকি দিল কিশোর। ফ্লাশলাইটটা এখন ডেস্কের ওপর শোয়ানো। মাছের ট্যাংকে হলদেটে গোল এক রশ্মি ছড়িয়েছে ওটার আলো।

ড. ক্রুক ঝুঁকে পড়ে ট্যাংকটার দিকে চেয়ে।

হঠাৎই গালি দিয়ে উঠলেন। থাবা মেরে ফ্লাশলাইট তুলে নিয়ে উন্মাদের মতো ঘরের চারধারে বোলাচ্ছেন।

কিশোর কাঠপুতুল হয়ে গেল। আবার যখন উঁকি দিল, ড. ক্রুক ফ্লাশলাইটের আলো ফেলেছেন মেঝেতে, পায়ের কাছে।

ঝুঁকে বসে মেঝেতে কী যেন স্পর্শ করলেন।

কিশোরের মনে হলো, রবিনের ফেলা পানির ফোঁটা পরখ করছেন।

অন্ধকার অফিসঘরে আবারও ফ্লাশলাইটের আলো বোলালেন ড. ক্রুক। আলো পড়ল জেমসের দরজায়।

‘কে ওখানে?’ ড. ক্রুক জিজ্ঞেস করলেন।

চোখ বুজে ফেলল কিশোর। শরীর ঠান্ডা হয়ে এসেছে। সভয়ে শ্বাস চাপল রবিন।

এবার পদশব্দ কানে এল কিশোরের। ওদের গুপ্ত জায়গার দিকে এগিয়ে আসছেন ড. ক্রুক!

এখান থেকে পালাতে হবে, ভাবল কিশোর। দেয়ালে হেলান দিল ও, কিন্তু হঠাৎই উধাও হয়ে গেল দেয়াল!

শক্ত এক হাত ওর বাহু চেপে ধরেছে। আরেকটা হাত মুখ চাপা দিয়েছে। যুঝছে, কিশোর অনুভব করল, ওকে পেছন দিকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

‘কথা বোলো না!’ কর্কশ এক কণ্ঠ ফিসফিস করে ওর কানে বলল। ‘এসো আমার সঙ্গে!’

বাধা দেওয়ার শক্তি পেল না আতঙ্কিত কিশোর। হাত বাড়িয়ে মুসা আর রবিনকে খুঁজল, পেল না। ওরা কোথায়?

‘জলদি নেমে পড়ো!’ কণ্ঠটা বলল।

পায়ের নিচে সিঁড়ি। টলতে টলতে নেমে যাচ্ছে, পরিচিত গন্ধ নাকে এল।

‘উনি যখন আপনাকে দ্বিতীয় কারও মত নিতে বললেন, তখন নকল পান্নাটা বসানো সারা। আসলটা সরিয়ে ফেলেছেন তিনি,’ বলল রবিন।

সিঁড়ির গোড়ায়, খুলে গেল এক দরজা। আলো দেখতে পেল কিশোর। পেঁয়াজের গন্ধ।

মিশেলের কিচেনে রয়েছে ও!

এবার ওর গায়ে ধাক্কা খেল রবিন আর মুসা। মিশেল ওর বাহু ছেড়ে দিয়ে দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। ওই সরু দরজাটাই আগে ওঁকে বন্ধ করতে দেখেছিল কিশোর।

‘এসো,’ বলে ঠোঁটে একটা আঙুল ছোঁয়ালেন মিশেল।

রেস্তোরাঁর সামনের দিকে ওদেরকে একরকম তাড়িয়ে নিয়ে এলেন তিনি।

‘চোর এখনো ওখানে আছে। বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিই। ও তাহলে আটকা পড়বে,’ বললেন।

আরও পড়ুন

এক্সিটের দিকে পড়িমরি এগোলেন কিন্তু দেখা গেল, ড. ক্রুক ইতিমধ্যেই হনহনিয়ে রেস্তোরাঁর জানালার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছেন।

‘চলে গেল! ওকে আর ধরা যাবে না!’ হাহাকার করে উঠলেন মিশেল।

‘অসুবিধা নেই। আমরা ওঁকে ভিডিওতে ধরে রেখেছি,’ বলে হাসল কিশোর।

‘ভিডিও? বুঝলাম না!’

‘হিরু চাচার অফিসে গোপন ক্যামেরা আছে,’ ব্যাখ্যা করল ও।

মুসা আর রবিনের দিকে চাইল।

‘লুকানোর আগে রিওয়াইন্ড বাটন টিপেছিলাম, মনে আছে? তার মানে শুরু থেকে আবারও রেকর্ডিং চালু হয়েছে। তারপর তো ড. ক্রুক ঢুকলেন।’

‘শুধু তা–ই নয়, লেটার ওপেনারে ওঁর ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যাবে,’ বলে উঠল মুসা।

‘লেটার ওপেনার?’ ওদের দিকে চেয়ে সবিস্ময় বললেন মিশেল।

‘ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি আমি,’ বলে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। ‘বাতি নেভানো হলে উনি লেটার ওপেনার দিয়ে জাগুয়ারের পান্নাটা খসান। তারপর ঝটপট নকল পাথরটা জায়গামতো বসিয়ে আসলটা ফেলে দেন মাছের ট্যাংকে।’

‘কিন্তু ক্যামেরা আর ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে কী হবে, যদি পান্নাটাই ওর কাছে থেকে থাকে?’ বললেন মিশেল।

‘তা নেই!’ বলল রবিন। মুঠো খুলে পান্নাটা দেখাল মিশেলকে। ‘এটা মাছের ট্যাংকে ছিল। উনি হাত করার আগেই তুলে নিয়েছি!’

আরও পড়ুন

‘বাহ্‌, চমৎকার!’ বলে রবিনকে জড়িয়ে ধরলেন মিশেল।

‘এখন কী করব আমরা?’ মুসার প্রশ্ন।

দেয়ালফোনের কাছে হেঁটে গেলেন মিশেল।

‘পুলিশ ডাকব!’ বললেন।

দশ

জাঁ পিয়েরে পানির গ্লাস তুলে ধরলেন।

‘টোস্ট হয়ে যাক,’ বললেন।

হিরু চাচা আর মিশেল তাঁদের গ্লাস তুললেন।

‘তিনজন দুর্দান্ত সাহসী আর বুদ্ধিমান ছেলের উদ্দেশে!’ তিন বন্ধুর দিকে চেয়ে বললেন জাঁ পিয়েরে।

‘তোদের জন্যই একটা শয়তান জেলে গেল আর অমূল্য এক রত্ন রক্ষা পেল,’ বলল হিরু চাচা।

‘তুমি কুকিটার কথা বলাতেই তো সবকিছু খোলাসা হলো,’ বলল কিশোর।

মৃদু হাসল হিরু চাচা।

‘তোর ওপর আমার বিশ্বাস ছিল। তাই চাবিটা দিয়ে গেছিলাম।’

‘রবিনের কুকিতে ছিল, অপ্রত্যাশিত জায়গায় গুপ্তধন পাবে ও। তা–ই পেয়েছে!’ বলল মুসা।

‘আর মুসা লক্ষ করেছিল লেটার ওপেনারটা সরানো হয়েছে,’ বলল রবিন।

‘হ্যাঁ। আর কিশোর বইয়ের পেছনে ভিডিও রেকর্ডারটা খুঁজে পেয়েছিল,’ বলল মুসা।

আরও পড়ুন

মিশেলের দিকে চেয়ে স্মিত হাসল কিশোর।

‘ভাগ্যিস আপনি আমাদের উদ্ধার করেছিলেন!’

‘তোমাদের আরও কুকি দিতে এসে দেখি তোমরা নেই,’ বললেন মিশেল। ‘তারপর দেখি ডক্টর লোকটা নিচের দরজার কাছে ছোঁক ছোঁক করছে। তাই পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠে যাই আমি!’

‘আপনাদের এখানে গোপন দরজা কেন?’ হিরু চাচাকে প্রশ্ন করল রবিন।

‘বহু বছর আগে পোর্টার জাদুঘর ছিল প্রাইভেট বাসা। মিস্টার ও মিসেস পোর্টারের কাজের লোকেরা পেছনের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করত। এটা জাদুঘর হয়ে গেলে আর্কিটেক্টরা ঠিক করলেন, যেমনকে তেমন রাখবেন,’ ব্যাখ্যা করল হিরু চাচা।

‘ভাগ্যিস রেখেছিল!’ বলল মুসা।

‘আমি যখন থাকি না, মিশেল আসে মাছগুলোকে খাবার দিতে,’ বলল হিরু চাচা।

মৃদু হাসলেন মিশেল।

‘তোমরা ভেবেছিলে আমিই চোর, তাই না?’

লাল হয়ে গেল কিশোরের মুখের চেহারা।

‘হ্যাঁ, কিন্তু সেলিনা হায়েককে বিল্ডিংয়ে ঢুকতে দেখে ভেবেছিলাম, কাজটা তাঁরই।’

হেসে উঠল হিরু চাচা।

‘ও একটু আগে ফোন করে এর ব্যাখ্যা দিয়েছে। ছাতা ফেলে গিয়েছিল, সেটা নিতে এসেছিল।’

‘হিরু চাচা, পুলিশকে তুমি ক্যামেরা আর ভিডিওর কথা বলোনি কেন?’ জিজ্ঞেস করল কিশোর।

হা হা করে হেসে উঠল হিরু চাচা।

‘ভুলে গিয়েছিলাম। জেমস এটা ইনস্টল করেছে, ওরও মনে ছিল না।’

‘একটা কথা বুঝলাম না,’ বলল মুসা। ‘ড. ক্রুক অত তাড়াতাড়ি নকল পান্নার সঙ্গে আসল পান্না পাল্টাপাল্টি করলেন কীভাবে? তা-ও আবার আঁধারের মধ্যে!’ বলল মুসা।

‘নিশ্চয়ই বারবার প্র্যাকটিস করেছিল,’ বলল হিরু চাচা। ‘আর ভেতরে ঢুকে মনে হয় আমার লেটার ওপেনারটা স্পট করেছিল।’

‘সে জন্যই উনি চেয়েছিলেন, আমরা যাতে জাগুয়ারটাকে ডেস্কে, মাছের ট্যাংকের কাছে রাখি,’ বলল কিশোর। ‘আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন, পান্নাটা পানিতে ফেলবেন।’

মাথা ঝাঁকাল হিরু চাচা।

‘হ্যাঁ, যাতে পরে এসে নিয়ে যেতে পারে।’

‘উনি যখন আপনাকে দ্বিতীয় কারও মত নিতে বললেন, তখন নকল পান্নাটা বসানো সারা। আসলটা সরিয়ে ফেলেছেন তিনি,’ বলল রবিন।

‘ঠিক, আরেকটু হলেই পার পেয়ে যেত লোকটা,’ বলল হিরু চাচা। সবার দিকে চেয়ে হাসল। ‘কিন্তু ও তো জানে না, তিনটে দুঁদে গোয়েন্দা লুকিয়ে আছে জেমসের অফিসে!’

আরও পড়ুন

ঠিক এ সময় রেস্তোরাঁর বাইরে ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল।

‘আমাদের রাইড এসে গেছে!’ বলে উঠে দাঁড়াল হিরু চাচা।

‘কিসের রাইড? আমরা তো হেঁটেই তোমার অ্যাপার্টমেন্টে যেতে পারি,’ বলল কিশোর।

‘আমরা এক্ষুনি ফিরছি না। আয়!’ বলল হিরু চাচা।

সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে এল সে। বাইরে মস্ত বড় এক সাদা ঘোড়া দাঁড়িয়ে। ঘোড়াটা বাগির সঙ্গে জোড়া। হার্নেসের চামড়া জুড়ে ছোট ছোট বাতি আর ঘণ্টা।

খাটো এক লোক নেমে এল চালকের আসন থেকে। পরনে ধূসর স্যুট। মাথায় কালো টপ হ্যাট।

‘হ্যালো, আমি আলফি। আর এই সুন্দর ঘোড়াটা হচ্ছে প্রিন্স,’ বলল লোকটা।

‘উঠে পড়!’ বলল হিরু চাচা।

‘খাইছে! কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ বাগিতে উঠে বলল মুসা।

‘কে পরোয়া করে,’ বলে ওর পাশে বসল নথি।

হিরু চাচা কিশোরকে উঠতে সাহায্য করে ওর পাশে বসল।

‘আমরা রাতের নিউইয়র্ক শহর ঘুরে দেখব। ট্রাফিক জ্যাম আর পান্না চোর ছাড়াও যে নিউইয়র্কের সৌন্দর্য আছে, সেটা তোদের জানা দরকার।’

বাগির পেছনে টোকা দিলেন তিনি।

‘আমাদের নিয়ে চলো, আলফি!’

‘আউ রেভয়া!’ সাইডওয়ক থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন জাঁ পিয়েরে আর মিশেল। ‘কাল দেখা হবে!’

প্রিন্সের উদ্দেশে জিবে শব্দ করল আলফি, নড়ে উঠল বাগিটা। ধীরে ধীরে রাস্তায় খটাখট শব্দ তুলে রওনা হয়ে গেল।

কিশোর আরাম করে বসে চোখ মেলে দিল আকাশের দিকে। লক্ষ তারা ঝিকমিক করছে। একটা তারা অন্যগুলোর চেয়ে বড়। সবুজ এক রত্নের মতো দেখাচ্ছে ওটাকে।

সবুজ নক্ষত্রটা মিটমিট করে উঠে মিলিয়ে গেল।

হেসে উঠল কিশোর।

‘এত হাসি কিসের?’ মুসা প্রশ্ন করল।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

‘কিছু নয়, চোখ আবারও আমাকে ধোঁকা দিল।’

শেষ...

আরও পড়ুন