সূর্যঘড়ির সূত্র (শেষ পর্ব)

বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল তিনজন। সরাসরি পুকুরের দিকে গেল না। একটু ঘুরপথে, গাছপালার আড়াল দিয়ে এগোল। অয়নের কথাই ঠিক, একটু সময় লাগলেও প্রতিপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে পুকুরের উত্তর দিকে পৌঁছে যেতে অসুবিধা হলো না। বড়সড় একটা ঝোপের পেছনে গিয়ে বসল ওরা, পাতা সরিয়ে উঁকি দিল সামনে।

সিডারগাছের গোড়ার অংশটা দেখা গেল পরিষ্কার, বেলচা দিয়ে পাগলের মতো তার পাশে মাটি খুঁড়ছে ডিকন। ছোটখাটো একটা স্তূপ জমিয়ে ফেলেছে। মাঝেমধ্যে থেমে কপালের ঘাম মুছছে সে, তারপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিপুল বিক্রমে। কোনো দিকে নজর নেই।

অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল অয়ন-জিমি। লোকটা পুরোপুরি বেসামাল না হওয়া পর্যন্ত হামলা চালানো ঠিক হবে না।

হঠাৎ ঠং করে একটা আওয়াজ হলো। ধাতব কিছুর গায়ে বাড়ি খেয়েছে বেলচার ডগা। উত্তেজিত হয়ে পড়ল ডিকন, বেলচা ফেলে হাঁটু গেড়ে বসল, দুই হাতে সরাতে শুরু করল মাটি। খানিক পরেই উঠে দাঁড়াল একটা মাঝারি আকারের স্টিলের বাক্স নিয়ে।

‘পেয়েছি!’ আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল সে।

বাক্সটা মাটিতে নামাল, বেলচার এক বাড়িতে ভেঙে ফেলল তালা। তারপর ডালা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে মুখের হাসি মিলিয়ে গেল তার। হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল এক টুকরা কাগজ। সেটায় চোখ বুলিয়ে হাহাকার করে উঠল।

‘না-আ! এ হতে পারে না!’

বিহ্বল হয়ে গেছে লোকটা। যেন চলে গেছে ঘোরের মধ্যে। সুযোগটা চিনতে অসুবিধে হলো না অয়নের। জিমিকে একটা খোঁচা দিল, তারপরেই দুই বন্ধু ছিটকে বেরিয়ে এল ঝোপ ভেদ করে। ছুট লাগাল দুষ্ট উকিলের দিকে।

পায়ের শব্দ শুনে পই করে ঘুরল ডিকন, ভূত দেখার মতো চমকে উঠল অয়ন-জিমিকে দেখে। তাড়াতাড়ি হাত ঢোকাল কোটের ভেতর, পিস্তলটা বের করে আনতে চায়। তবে তার আগেই নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে অয়ন। বয়ামের মুখটা খুলে নিয়েছিল আগেই, এবার ছাইটা সজোরে ছুড়ে মারল লোকটার দিকে।

ধূসর একটি মেঘ যেন গিয়ে আছড়ে পড়ল ডিকনের চোখেমুখে। নাকেও ঢুকে গেল খানিকটা। কাশতে শুরু করল সে। নিজের অজান্তেই পিস্তলের বদলে হাত চলে গেল চোখে, কচলাতে শুরু করল। কিছু দেখতে পাচ্ছে না, আক্ষরিক অর্থেই এ-মুহূর্তে সে অন্ধ।

লোকটার একেবারে কাছে চলে গেল জিমি, মনের সুখ মিটিয়ে সর্বশক্তিতে লাঠির ঘা বসাল মাথায়। আর্তনাদ করে উঠল ডিকন, তালগোল পাকিয়ে পড়ে গেল মাটিতে। জ্ঞান হারিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে।

ঝোপের আড়াল থেকে এবার বেরিয়ে এলেন হলি, অবিশ্বাসের চোখে পালা করে তাকালেন অয়ন, জিমি আর ডিকনের দিকে। তাঁর দিকে ফিরে একগাল হাসল অয়ন। বলল, ‘লাঠি আর ছাইয়ের কেরামতি দেখলেন তো, ম্যাম? একটা দিয়ে অচল করলাম ব্যাটাকে, অন্যটা দিয়ে বেহুঁশ!’

‘তা-ই তো দেখছি!’ হতভম্ব গলায় বললেন হলি।

ডিকনের কোটের ভেতর থেকে পিস্তলটা বের করে নিল দুই বন্ধু, পকেট থেকে উদ্ধার করল নিজেদের সেলফোন। সবশেষে জুতার ফিতাগুলো খুলে নিল, সেগুলো দিয়েই কষে বাঁধল লোকটার দুই হাতের কবজি আর দুই পায়ের গোড়ালি। জ্ঞান ফিরলেও আর পালাতে পারবে না।

ততক্ষণে স্টিলের বাক্সটা তুলে নিয়েছেন হলি, ভেতরে উঁকি দিয়ে বিস্ময়ের সুরে বললেন, ‘এ কী! বাক্সে তো কিছুই নেই।’

‘এই কাগজটা ছিল,’ মাটিতে পড়ে থাকা কাগজের টুকরাটা তুলে নিল জিমি। চোখ বোলাল ওতে। ‘হুম, ব্যাটা ষাঁড়ের মতো চেঁচাল কেন, বোঝা যাচ্ছে এবার।’

‘কী লেখা?’ জিজ্ঞেস করল অয়ন।

‘নিজেই দেখ।’

কাগজটা হাতে নিল অয়ন। সেটায় অল্প কয়েকটা কথা লেখা।

‘দুঃখিত। ধাঁধার অর্থ বুঝতে পারোনি। বিদায়।’

উঁকি দিয়ে হলিও পড়লেন লেখাটা। হতাশায় মাথা দোলালেন তিনি। ‘কোনো মানে হয়? এত খাটাখাটনির পর এভাবে কেউ ধোঁকা দেয় কাউকে?’

‘ধোঁকা?’ প্রশ্নবোধক সুরে বলল অয়ন।

‘নয়তো কী?’ ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন হলি। ‘এখন বুঝতে পারছি, বাবা আসলে ক্ষমা করেননি আমাকে। তাই রত্ন উদ্ধারের নামে খাটিয়ে মারলেন। শাস্তি দিলেন আর কী। ওগুলো জীবনেও আর পাব না আমি।’ তাকালেন অচেতন উকিলের দিকে। ‘মাঝখান থেকে এই গাধাটা অযথা লোভ করতে গিয়ে ধরা খেল।’

‘আসলেই!’ জিমির চেহারাতেও মেঘ জমেছে। ‘এ ধরনের ধোঁকাবাজির কোনো মানে হয় না। তা–ও আবার নিজের মেয়ের সঙ্গে।’

‘সত্যিই কি ধোঁকা দিয়েছেন?’ অয়নের কণ্ঠে দ্বিধা। কাগজটায় আবার চোখ বোলাল ও। ‘লেখাটার মধ্যে একটা গোলমাল দেখতে পাচ্ছি আমি।’

‘কিসের কথা বলছিস?’

‘মেয়েকে যদি রত্নগুলো না-ই দিতে চান, সেটা সরাসরি লিখলেই কি চলত না? ধাঁধার অর্থ না-বোঝার কথা লিখলেন কেন?’

‘মানে?’

জবাব না দিয়ে আশপাশে তাকাল অয়ন। ঠোঁট কামড়াচ্ছে গম্ভীর ভঙ্গিতে। হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। বলল, ‘মিস হলি, আপনার বাবা ধোঁকা দেননি। সত্যিই ধাঁধার অর্থ বুঝতে পারিনি আমরা।’

‘কী বলতে চাও?’ ভুরুজোড়া কুঁচকে গেল হলির।

‘অবিলিস্কের ধাঁধাটায় বলা হয়েছিল, ফাইন্ড দ্য ফলেন জায়ান্ট। এখানে সেই জায়ান্ট নেই।’

‘নেই মানে?’ গাছের গোড়াটা দেখাল জিমি। ‘ওটা তাহলে কী?’

‘ওটা স্রেফ গোড়া। আমাদের দরকার গাছটা...পুরো গাছটা।’

‘পাগল হলি? সেই কবে কাটা হয়েছে, এখন সে-গাছ পাবি কোথায়?’

হলির দিকে তাকাল অয়ন। ‘গাছটা কোথায়, ম্যাম? কী করা হয়েছিল কেটে ফেলার পরে?’

‘যদ্দুর মনে পড়ে, বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল...’ বলতে বলতে থমকে গেলেন হলি। চোখের মণি উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর। ‘না, খানিকটা কাঠ রেখে দিয়েছিলেন বাবা। সেই কাঠ দিয়ে নিজের হাতে বানিয়েছিলেন একটা ফার্নিচার। লিভিংরুমের ওই রকিং চেয়ারটা!’

‘তাহলে ওটার কথাই বুঝিয়েছেন,’ হাসিমুখে বলল অয়ন। ‘চলুন, দেখে আসি।’

‘একে ফেলে যাবে এখানে?’ ডিকনের দিকে ইশারা করলেন হলি।

‘যেভাবে বেঁধেছি, সহজে ছুটতে পারবে না। জ্ঞানও ফিরবে না সহসা। ফোন তো পেয়ে গেছি, পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিলেই হলো। ওকে নিয়ে ভাবনা নেই। চলুন এখন।’

বাড়ির ভেতরে ফিরল তিনজন। লিভিংরুমে ঢুকে রকিং চেয়ারটা পরীক্ষা করল অয়ন। বসার জায়গাটা বেশ পুরু—ছয় ইঞ্চির কম নয়। অত পুরু কাঠের তক্তা ব্যবহার করলে চেয়ারের ওজন অনেক বেশি হওয়ার কথা, অথচ তা নয়। তক্তার গায়ে টোকা দিতেই ফাঁপা আওয়াজ পেল। বুঝল, পুরু তক্তা ব্যবহার করা হয়নি; ওপর-নিচে দুই সারি তক্তা বসানো হয়েছে, মাঝখানটা ফাঁকা। ব্যাপারটা জানাল সঙ্গীদের।

‘ওখানে কিছু লুকিয়ে রাখা আছে ভাবছ?’ জিজ্ঞেস করলেন হলি।

‘জানার উপায় তো একটাই,’ বলল অয়ন। ‘ঘরে কোনো টুলবক্স আছে?’

‘গ্যারাজে পাবে।’

‘আমি যাচ্ছি,’ বলে চলে গেল জিমি। ফিরে এল খানিক পরে। টুলবক্সটা মাটিতে নামিয়ে অয়নকে বলল, ‘সরবি একটু? খাটাখাটনির কাজ যেহেতু, আমাকেই তো করতে হবে।’

মুচকি হেসে সরে গেল অয়ন।

রকিং চেয়ারটা উল্টে ফেলল জিমি। টুলবক্স থেকে প্লায়ার্স, হাতুড়ি আর পেরেক ওঠানোর নেইল পুলার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। লম্বা লম্বা কয়েকটা তক্তা জোড়া দিয়ে বানানো হয়েছে নিচের অংশটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুলে আনল দুটি তক্তা। অন্ধকার একটা গর্ত দেখা গেল ওপাশে। গর্তে হাত ঢুকিয়ে দিল ও।

‘আছে কিছু?’ রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করলেন হলি।

জবাব না দিয়ে হাতটা বের করল জিমি, মুঠোয় ধরে রেখেছে বড়সড় একটা ভেলভেটের থলে। ভেতরে ঝুনঝুন করছে কী যেন। থলের মুখ খুলল ও, উপুড় করে ধরল মেঝের ওপর। ভেতর থেকে বৃষ্টির মতো বেরিয়ে এল রাশি রাশি দামি পাথর। কোনোটা লাল, কোনোটা নীল, কোনোটা স্বচ্ছ...রঙের মেলা বসেছে যেন। অপার্থিব দ্যুতি ছড়াচ্ছে রত্নগুলো।

‘মাই গড!’ কোনোমতে বললেন হলি। ‘সত্যিই পেলাম তাহলে!’

রত্নগুলোর সঙ্গে একটা ভাঁজ করা কাগজও বেরিয়ে এসেছে। সেটা খুলে একনজর দেখল অয়ন, তারপর বাড়িয়ে ধরল হলির দিকে। ‘এটা আপনার জন্য।’

হার্বার্ট হ্যালোরানের লেখা চিঠি ওটা। পড়তে শুরু করলেন হলি:

প্রিয় হলি,

আশা করি, তুমিই উদ্ধার করেছ রত্নগুলো। হয়তো একটু কষ্ট হয়েছে; কিন্তু নিতান্ত নিরুপায় হয়ে ওগুলো এভাবে লুকিয়ে রেখে যেতে হচ্ছে আমাকে। আমার উকিল উইলিয়াম ডিকনকে একদমই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার ধারণা, সুযোগ পেলেই রত্নগুলো চুরি করবে সে। তাকে ঠেকানোর জন্যই এমন পন্থা অবলম্বন করতে হলো। তুমিও ওর ব্যাপারে সাবধান থেকো।

সারা জীবন অনেক অন্যায় করেছি তোমার ওপর। অনেক রাগারাগি করেছি, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছি। শেষ সময়ে এসে বুঝতে পারছি, কাজগুলো ঠিক করিনি। সন্তানকে ঘরে বন্দী করে রাখা কোনো মা–বাবারই উচিত নয়। তাই সব আবার ফিরিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। যদিও জানি না, এই রত্ন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করা সম্ভব কি না। পারলে ক্ষমা করে দিয়ো আমাকে।

ইতি,

তোমার বাবা।

পড়তে পড়তে চোখ ছলছল করে উঠল হলির। কাঁদতে শুরু করলেন নিঃশব্দে। খানিক পর মুখ তুলে তাকালেন, ভেজা গলায় বললেন, ‘থ্যাংক ইউ, অয়ন-জিমি। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।’