বিকেলবেলা স্কুল ছুটির পর আমি ঠিক করলাম ফজলের বাড়ি যাব। তার কাছে আরও মূল্যবান পয়সা আছে কি না দেখে আসব। আজকাল স্কুল ছুটির পর ছেলেমেয়েরা বাসায় ফিরে না এলে দুশ্চিন্তায় বাবা-মায়েদের পেটের ভাত চাল হয়ে যায়। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের জন্য এত দুশ্চিন্তা করতেন না। পথেঘাটে তখন এত বিপদ ছিল না। ছেলেপিলে বাসায় না এলে ধরে নিত কোথাও গেছে, আবার চলে আসবে।
আমি তাই ফজলের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে তার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। তার বাড়ি নদীর ওপারে, রেলওয়ে ব্রিজ দিয়ে নদী পার হয়ে ওপারে আসতেই পুরো এলাকাটার মাঝে একটা গ্রাম গ্রাম ভাব চলে এল। মাটির রাস্তা, রাস্তার পাশে গাছ। গাছপালা, ছনের বাড়ি। বাড়ির সামনে গরুর গোয়াল, কোমরে তাবিজ বাঁধা ছোট ছোট ল্যাংটা ছেলেমেয়ে। বেশ খানিক দূর যাওয়ার পর গাছপালা ঢাকা একটা বাড়ির সামনে ফজল দাঁড়িয়ে গেল। আমি জিগ্যেস করলাম, ‘এইটা তোর বাড়ি?’
ফজল মাথা নাড়ল। জিগ্যেস করলাম, ‘বাড়িতে কে কে আছে?’
‘কেউ নেই। খালি নানি।’
নানি যে আছে সেটা তখনই আমি টের পেলাম, শুনলাম ভেতর থেকে খনখনে গলায় কে যেন বলল, ‘ফজইল্যা! আইছস!’
ফজল বলল, ‘হ্যাঁ’।
‘এখন আবার দৌড় পাড়বি?’
ফজল কোনো কথা বলল না। নানি খক খক করে খানিকক্ষণ কাশল, তারপর বলল, ‘তোর সঙ্গে কেডা?’
‘আমার স্কুলের ছাত্র।’
‘তোর মতোন পাগল? মাথা খারাপ?’
ফজল একটু রেগে উঠল, বলল, ‘পাগল কেন হবে?’
‘তুই তো পাগল।’
ফজল কোনো কথা বলল না, তার মুখটা কেমন যেন শক্ত হয়ে গেল। আমি বললাম, ‘তোর নানি তোকে পাগল ডাকে কেন?’
‘আমি জানি না। চোখে দেখে না সেই জন্য—’
ঘরের ভেতর থেকে নানি বলল, ‘কে কইছে চোখে দেখি না? সবই দেখি। তুই রাইতে একলা একলা মাঠে দৌড়াস না? তোর মাথা খারাপ হইছে না?’
আমি ফজলকে ফিসফিস করে বললাম, ‘কী বলে?’
ফজল আমার হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে গেল। নিচু গলায় বলল, ‘বুড়ি মানুষ, তার মাথার ঠিক নেই।’
‘বলল যে তুই রাত্রে একলা একলা মাঠে দৌড়াস—’
ফজল মুখ শক্ত করে বলল, ‘আমি মোটেও একলা মাঠে দৌড়াই না। সবাই যখন আসে তখন খেলি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘সবাই আসে? সবাই কে আসে?’
‘ওই তো—’ বলে ফজল অন্য কথা বলার চেষ্টা করল। আমি আবার বললাম, ‘রাতে কে আসে?’
‘পোলাপান।’
‘কোন পোলাপান?’
‘এই তো এইখানকার পোলাপান।’
‘কেন?’
‘খেলতে আসে। কথাবার্তা বলে।’
‘রাতে কেন আসে? দিনে আসে না কেন?’
ফজল হঠাৎ রেগে উঠল, ‘আমি কী জানি দিনে কেন আসে না?’
আমি তখনো ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না কিন্তু মনে হলো ফজল আর এটা নিয়ে কথা বলবে না। আমি তাই আর তাকে ঘাঁটালাম না। ফজল আমাকে নিয়ে বাড়ির পেছনে গেল, গাছপালা ঢাকা সুন্দর ছিমছাম একটা বাড়ি। বড় বড় গাছ, পুরোটা ছায়া ছায়া করে রেখেছে। ভেতরে বড় উঠান, সেখানে শুকনো মরিচ শুকাতে দেওয়া আছে।
আমি ফজলকে জিগ্যেস করলাম, ‘তোর সেই মূল্যবান পুরান পয়সাগুলো কই?’
ফজল বলল, ‘এই যে এইখানে।’
বাড়িটার বারান্দা মাটি দিয়ে তৈরি, তার এক কোনায় বিশাল একটা মটকা। ফজল ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে একটা ছোট ঝুড়ি বের করে আনল। আমি ঝুড়িটার ভেতরে তাকিয়ে একটু চমকে উঠলাম, ভেতরে হাড়গোড়, রঙিন পাথর, তাবিজ—এইসব। জিগ্যেস করলাম, ‘কই? পয়সা কই?’
‘আছে মনে হয় এইখানে। আর এইগুলাও মূল্যবান।’
আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘এই হাড্ডিগুড্ডি মূল্যবান?’
‘হ্যাঁ। অনেক মূল্যবান।’
‘তুই কেমন করে জানিস?’
ফজলের মুখ শক্ত হয়ে গেল, বলল, ‘আমি জানি।’
আমি সাবধানে একটা হাড় ধরে দেখার চেষ্টা করলাম, অবাক হয়ে দেখলাম, হাড়টা পাথরের মতো ভারী। বললাম, ‘কী আশ্চর্য! এত ভারী?’
‘হ্যাঁ। পাথরের মতো ভারী।’
‘কেন?’
‘অনেক পুরান। সেই জন্য।’
তখন আমি ছোট, তাই হাড়গোড় যে ধীরে ধীরে ফসিল হয়ে যায়, সেটা জানতাম না। এখন বুঝতে পারি, সেগুলো আসলে ফসিল ছিল, তখন শুধু অবাক হচ্ছিলাম ফজল এগুলো কোথায় পায়। তাকে অনেকবার জিগ্যেস করায় বলল, ‘রাতের বেলা যে পোলাপানেরা আসে, তারা আনে।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘পোলাপানেরা আনে? তারা কোথায় পায়?’
‘সেইটা আমি জানি না।’
ফজল আবার তার মুখ শক্ত করে ফেলল, আমি বুঝতে পারলাম এইটা নিয়ে সে আর কথা বলবে না।
বাসায় কিছু না বলে স্কুল ছুটির পর আমি এখানে চলে এসেছি, তাই আমার একটু তাড়া ছিল। আমি তাই বাসায় রওনা দিলাম। বের হওয়ার সময় আমি ফজলের নানিকে দেখলাম, ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসেছে। থুত্থুড়ে একজন বুড়ি, মাথায় একেবারে শণের মতো পাকা চুল। তোবড়ানো গাল, গায়ের চামড়া কুঁচকে আছে। আমাকে দেখে বলল, ‘কেডা? ফজলের বন্ধু?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘তুমিও ফজলের মতন পাগল? রাত্রে একলা একলা মাঠের মাঝে দৌড়াও?’
আমি কিছু বলার আগে ফজল রেগে উঠে বলল, ‘আমি মোটেও একলা একলা দৌড়াই না।’
‘তয় আমি কেউরে দেখি না কেন?’
‘তোমার চোখ কানা সেই জন্য দেখো না।’
ফজলের নানি পিচিক করে বাইরে থুতু ফেলে বলল, ‘আমার চোখ ঠিকই আছে। আসলে তোর মাথা পাগল। তোর বাপও পাগল ছিল। তোরা পাগলের বংশ।’
ফজল আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল, ‘শোন, তুই কাউরে কিছু বলবি না।’
কাউকে কী বলব না বুঝতে আমার কোনো সমস্যা হলো না। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, বলব না।’
‘খোদার কসম?’
আমি বললাম ‘খোদার কসম। কিন্তু—’
‘কিন্তু কী?’
‘আমাকে সবকিছু বলতে হবে।’
ফজল মুখ শক্ত করে বলল, ‘সবকিছু আবার কী?’
‘এই যে রাতের বেলা পোলাপানেরা আসে, তারা কোথা থেকে আসে, বাবা-মায়েরা তাদের রাতের বেলা কেন আসতে দেয়, তারা এই হাড্ডিগুড্ডি, তাবিজ, পাথর এইগুলো কোথায় পায়। এই সব।’
‘আমি এই সব জানি না।’
‘জিগ্যেস করিস না কেন?’
ফজল চুপ করে রইল। আমি আবার জিগ্যেস করলাম। তখন বলল, ‘জিগ্যেস করলেও বলে না। যখন বলে তখন সব কথা বুঝি না।’
‘ঠিক আছে। আমাকে একদিন নিয়ে আসিস, আমি কথা বলব।’ ফজল তার বিড়ালের মতো চোখ দিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘তুই রাতের বেলা আমার বাড়িতে থাকবি?’
বাসা থেকে আব্বু-আম্মু থাকতে দেবে কি না তখনো জানতাম না। কিন্তু ফজলকে আর সেটা বললাম না, মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ। থাকব।’
ফজল একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। কেন এত লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল আমি বুঝলাম না।
আমি ভেবেছিলাম স্কুল থেকে বাসায় না এসে ফজলের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটায় আম্মু-আব্বু বেশি দুশ্চিন্তা করবেন না—কিন্তু ফিরে আসতে আসতে একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল, তাই সবাই খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। প্রথমে এক চোট বকাবকি করা হলো, শাসন না করায় কী রকম বখে যাচ্ছি সেইটা নিয়ে লম্বা বক্তৃতা দেওয়া হলো। তারপর আব্বু জানতে চাইলেন কোথায় গিয়েছিলাম।
আমি সরল মুখ করে বললাম, ‘ফজলের বাড়ি। আমার যে বন্ধুর স্কুলের বেতন দেওয়ার পয়সা নেই, তার বাড়ি।’
আম্মু বললেন, ‘যেতে চাইলে যা। কিন্তু বলে যাবি না?’
‘ভেবেছিলাম কাছে থাকে। আসলে অনেক দূর। তা ছাড়া—’
‘তা ছাড়া কী?’
‘বাড়িতে কেউ নেই। শুধু একজন বুড়ি নানি। সেই নানিরও মনে হয় মাথা খারাপ। ফজল বেচারার মনে অনেক দুঃখ—’ ফজল যদিও কখনোই বলেনি তার মনে দুঃখ কিন্তু আমি সেভাবেই বললাম। আগেও দেখেছি দুঃখ-টুঃখ বললে আব্বু-আম্মুর মন তাড়াতাড়ি নরম হয়ে যায়।
আম্মু জানতে চাইলেন, ‘কেন, দুঃখ কেন?’
‘একা একা থাকে। কথা বলার কেউ নেই। কেউ তার সঙ্গে মেশে না, তার বাড়ি যায় না। আমি গিয়েছিলাম তাই অনেক কথা বলল, সেই জন্য দেরি হয়ে গেল।’
এই বারে আব্বু-আম্মু দুজনেরই মন নরম হয়ে গেল। আব্বু বললেন, ‘সম্পর্ক রাখিস ছেলেটার সঙ্গে। বাড়ি যাস মাঝে মাঝে।’
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, ‘যাব’। তারপর সুযোগটা নষ্ট করলাম না, বললাম, ‘একদিন রাতে কি ফজলের বাড়ি থাকতে পারি আম্মু?’
‘রাতে?’ আম্মু অবাক হয়ে বললেন, ‘রাতে কেন?’
‘এই তো মানে ইয়ে—’ ঠিক কী কারণে রাতে থাকা দরকার বুঝিয়ে বলতে পারলাম না। আব্বু বললেন, ‘দরকার হলে থাকিস, কিন্তু দরকার তো দেখছি না।’
‘লেখাপড়ায় ভালো না তো—পাটিগণিত বুঝতে চায়।’
‘আমাদের বাসায় নিয়ে আসিস। এখানে বুঝিয়ে দিবি।’
কাজেই ফজলের বাসায় রাতে থাকার কোনো বুদ্ধি বের করতে পারলাম না। কিন্তু আমার বুদ্ধি ছাড়াই সুযোগটা এসে গেল কিছুদিনের মধ্যে। তবে একটু অন্যভাবে।