আমি তখন খুব ছোট, মফস্বল শহরের একটা স্কুলে পড়ি। আজকালকার মফস্বল শহরও অনেক আধুনিক, বাসায় ইলেকট্রিসিটি থাকে, ঘরে কম্পিউটার থাকে, পকেটে মোবাইল ফোন থাকে। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন সে রকম কিছু ছিল না। স্কুল মানে কয়েকটা ঘর, কিছু শিক্ষক আর বেশ কিছু ছাত্র। তবে সব স্কুলেই একটা বড় খেলার মাঠ ছিল, আমরা ছোটাছুটি করে সেই মাঠে খেলতাম। স্কুলের ঘণ্টা পড়লে মন খারাপ করে ক্লাসঘরে ঢুকতাম। স্যারেরা বেশ যত্ন করে পড়াতেন। ক্লাসে আমরাও মনোযোগ দিয়ে স্যারদের কথা শুনতাম তার কারণ, ক্লাসে ঢোকার সময় স্যারেরা চক-ডাস্টারের সঙ্গে সঙ্গে লম্বা একটা বেত নিয়ে ঢুকতেন। যেই স্যারের বেত যত লম্বা, সেই স্যারের মর্যাদা তত বেশি!
স্কুলের একটা দিন আলাদা করে রাখা ছিল স্কুলের ফি নেওয়ার জন্য। সেদিন ক্লাসটিচারই একজন একজন করে সব ছাত্রের কাছ থেকে স্কুলের ফি নিতেন। কোন মাসে কত টাকা ফি আগে থেকে বলে দেওয়া হতো—আমরা সেটা নিয়ে আসতাম। লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম বলে আমার স্কুলের বেতন মাফ করে দেওয়া ছিল, তাই আমাকে খুব কম টাকা দিতে হতো। আমার বেতন মাফ না হলেও সমস্যা ছিল না। আমার বাবা নিশ্চয়ই স্কুলের বেতন দিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু যাদের স্কুলের বেতন মাফ হলে লাভ হতো, তাদের বেতন কখনো মাফ হতো না, কারণ তারা লেখাপড়াও করত না। ক্লাসে এসে পেছনের বেঞ্চে উদাসমুখে বসে থাকত। স্যারেরা যখন কিছু জিগ্যেস করতেন, তারা কেমন যেন অবাক হয়ে স্যারদের দিকে তাকাত। স্যারেরা যখন গরুর মতো পেটাতেন, তারা আরও অবাক হয়ে স্যারদের দিকে তাকিয়ে থাকত। স্কুলের ফি নেওয়ার দিন তাদের অনেকের সঙ্গে ক্লাসটিচারের সমস্যা হতো, তারা হয় স্কুলের ফি আনত না কিংবা যত আনার কথা তার থেকে কম আনত। ক্লাসটিচার তাদের হুমকি-ধমকি দিতেন, বাড়িতে খবর পাঠাতেন। খুব একটা লাভ হতো বলে মনে হয় না।
যে ছেলের সঙ্গে ক্লাসটিচার স্যারের প্রায় নিয়মিত গোলমাল হতো, তার নাম ছিল ফজল। হালকা-পাতলা শ্যামলা রঙের একটা ছেলে। খালি পা, ময়লা শার্ট-প্যান্ট। মাথায় উষ্কখুষ্ক লালচে চুল। সবকিছু অন্য দশজন ছেলের মতো হলেও তার চোখ দুটো ছিল অন্য রকম। ঠিক কী কারণ জানা নেই, মনে হতো মানুষের চোখ নয়, বিড়াল কিংবা অন্য কোনো প্রাণীর চোখ।
স্কুলের ফি নেওয়ার সময় ক্লাসটিচার স্যারের সঙ্গে ফজলের গোলমালটা হতো একটু অন্য রকম। যদিও আমাদের ব্যস্ত রাখার জন্য স্যার একটা বড় ট্রানস্লেশন লিখতে দিয়ে বসিয়ে রাখতেন কিন্তু আমরা তার পরও স্যার কী বলতেন শুনতাম। ফজলকে জিগ্যেস করতেন, ‘বেতন কই?’
ফজল কোনো কথা না বলে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকত। আমরা টের পেতাম, তার বিড়ালের মতো চোখ দেখে স্যার কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতেন। স্যার আবার ধমক দিয়ে জিগ্যেস করতেন, ‘বেতন কই?’
ফজল বলত, ‘নাই।’
স্যার বলতেন, ‘বেতন নাই তো স্কুলে এসেছিস কেন?’
ফজল কিছু বলত না। স্যার অন্যদের যে রকম বলেন, ‘তোর বাবাকে দেখা করতে বলিস’—ফজলকে সেটা বলতে পারতেন না, কারণ আমরা সবাই জানতাম, তার বাবা নেই। মারা গেছেন সে জন্য নেই, নাকি কোথাও চলে গেছেন সে জন্য নেই, সেটাও কেউ ভালো করে জানত না। তবে তার মা খুব ছেলেবেলায় মারা গেছেন, সেটা সে আমাদের বলেছে। তার মা দেখতে কী রকম সেটাও সে জানত না। থাকত বুড়ি নানির সঙ্গে। ফজলের কথা শুনে অবশ্য মনে হতো তার বুড়ি নানি তাকে দেখেশুনে রাখে না, উল্টো তাকেই তার বুড়ি নানিকে দেখেশুনে রাখতে হয়।
কাজেই স্কুলের ফি দেওয়ার সময় স্যার আর ফজলের মধ্যে সব সময়ই একটা ছোটখাটো নাটক হতো। নাটকের শেষে স্যার বলতেন, তোকে আর স্কুলে আসতে হবে না। বুঝেছিস?’
ফজল মাথা নেড়ে বলত, সে বুঝেছে। স্যার বলতেন, ‘বেতন ছাড়া স্কুলে পড়ার নিয়ম নেই, বুঝেছিস?’
ফজল মাথা নেড়ে জানাত, এটাও সে বুঝেছে। কিন্তু তার পরেও সে স্কুলে আসত—খুব যে নিয়মিত আসত তা নয়—কিন্তু আসত। পেছনের বেঞ্চে বসে থাকত, না হলে ডেস্কে মাথা রেখে ঘুমাত। ঘুমানোর ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল শেষের দিকে, এর মাঝে যে একটা রহস্য আছে, আমরা তখন কেউ সেটা জানতাম না।
ফজলের সঙ্গে আমার পরিচয় কিংবা বন্ধুত্ব হওয়ার কথা ছিল না কিন্তু তার সঙ্গে আমার একধরনের বন্ধুত্ব হয়েছিল, সেই ঘটনাটা এত বিচিত্র যে কেউ সেটা বিশ্বাস করবে না। আমি সেটা তাই কাউকে বলার চেষ্টা করিনি।
তার সঙ্গে পরিচয়ের ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল স্কুলের ফি নেওয়ার দিনে। অন্যবারের মতো সেদিনও ফজল তার বিড়ালের মতো চোখ নিয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো একটু লাল। স্যার যখন তাকে ডেকে নিয়েছেন তখন সে ডেস্কে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিল। স্যার বললেন, ‘বেতন কই?’
অন্য দিন সে বলে ‘নেই’, আজকে সেটা না বলে বুকপকেটে হাত দিয়ে কী একটা বের করে স্যারের হাতে দিল। স্যার অবাক হয়ে সেটা হাতে নিলেন, জিনিসটা কী পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না, মনে হলো একটা ফুটো তামার পয়সা। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এইটা কী?’
ফজল কিছু বলল না। স্যার ধমক দিলেন, ‘এইটা বেতন?’
ফজল মাথা নাড়ল, বলল, ‘বেতন থেকে মনে হয় বেশি হবে।’
স্যার হঠাৎ করে খেপে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, ‘আমার সঙ্গে মশকরা?’ তোর এই তামার পয়সা বেতন থেকে বেশি? তারপর হাতের পয়সাটা নিচে ছুড়ে ফেলে বললেন, ‘দূর হ এখান থেকে, তোকে যদি আর কোনো দিন স্কুলে দেখি, খুন করে ফেলব।’
স্যার যে ইচ্ছা করলেই খুন করে ফেলতে পারেন, সেটা প্রমাণ করার জন্যই মনে হয় টেবিলে রাখা বেতটা দিয়ে ফজলকে গরুর মতো পেটালেন। ফজল চুপ করে মার খেল। তারপর নিচু হয়ে মেঝে থেকে তার তামার ফুটো পয়সাটা নিয়ে পকেটে রেখে তার জায়গায় ফিরে গেল। স্কুলের বেতন থেকেও মূল্যবান ফুটো তামার পয়সাটা আমার দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ফজলের সঙ্গে আমার সে রকম জানাশোনা নেই, তাই তাকে এখন এটা নিয়ে কিছু বলতে পারলাম না।
বেতন দেওয়ার এই গল্পটা বেশ মজার। তাই রাতে খেতে খেতে আমি সবাইকে সেটা বললাম। কিন্তু আমার আব্বু কিংবা আম্মু কেউ-ই গল্পটা শুনে হাসলেন না। কেউ যে একটা ফুটো তামার পয়সা দিয়ে স্কুলের বেতন দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে, এর মাঝে যে বিশাল হাস্যকর ব্যাপার আছে, সেটা তাঁদের চোখেই পড়ল না। আব্বু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘এই ফজল ছেলেটার বাবা-মা নেই?’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘না।’
‘বেতন দিতে পারে না বলে এখন লেখাপড়া বন্ধ?’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘হ্যাঁ।’
‘তোদের বেতন কত?’
আমার বেতন দিতে হয় না, তবু আমি কত বেতন সেটা জানতাম। আব্বুকে বললাম, আব্বু শুনে বললেন, ‘মাত্র এই কয়টা টাকার জন্য একটা বাচ্চার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে?’
ফজলের জন্য আব্বু-আম্মুর মায়া হচ্ছে অনুমান করে আমি তখন গল্পটার হাস্যকর দিকটার দিকে আর জোর না দিয়ে তার দুঃখের দিকে জোর দিলাম। বললাম, ‘যখন বেতন দিতে পারেনি, তখন স্যার বেত দিয়ে পিটিয়েছেন।’
আম্মু মাথা নেড়ে বললেন, ‘আহা রে! এইটুকুন বাচ্চাকে কেউ পেটায়?
আমি বললাম, ‘শুধু ফজল না, স্যারেরা সবাইকে পেটায়।’
আব্বু মুখ শক্ত করে বললেন, ‘দেশে আইন করে ফিজিক্যাল পানিশমেন্ট তুলে দেওয়া উচিত।’
আমি গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লাম।