হেডস্যার লম্বা করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাকালেন ছোট চাচার দিকে। ‘ব্যারিস্টার সাহেব, এখন আপনিই বলুন আমার করণীয় কী?’ ছোট চাচা যে একজন ব্যারিস্টার, এটা এই প্রথম জানল রাফিন। ছোট চাচা মুখে চুক চুক করে শব্দ করলেন। ‘তার মানে আপনার স্কুলে বুলিং হয়...’
‘না না, কী বলছেন...এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’
ছোট চাচা এদিক–ওদিক মাথা নাড়লেন, তারপর তাকালেন রাফিনের দিকে। ‘তুই একটু বাইরে যা, অপেক্ষা কর!’
মিনিট দশেক পরেই ছোট চাচা বেরিয়ে এলেন। রাফিনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সেই পরিচিত মিষ্টি হাসি।
‘ক্লাসে যা। আর শোন, আমি আজ বিকেলেই রাজশাহী যাচ্ছি তিন দিনের জন্য। তুই একা থাকতে পারবি না?’
‘পারব।’
‘চাবি কোথায় থাকবে, জানিস তো?’
‘জানি।’
‘গুড। ফ্রিজে খাবার আছে, গরম করে খাবি। টাকা লাগলে আমার বালিশের নিচে আছে, নিয়ে নিবি। ওকে বাই।’ ছোট চাচা চলে গেলেন। হেডস্যারের সঙ্গে ভেতরে কী আলাপ হলো তাকে নিয়ে, সেটা আর জানা হলো না।
ফিফথ পিরিয়ডে ক্লাস ক্যাপ্টেন রাশনা স্যারের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। স্যার কাগজ হাতে নিয়ে বললেন,
‘রাফিন রিয়াজ, রোল ৩৪ কে?’ রাফিন একটু অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল।
‘তুই ক্লাসে বসে টিফিন খেয়েছিস?’
‘জি স্যার।’
‘স্ট্যান্ডআপ অন দ্য বেঞ্চ।’ রাফিন খেয়াল করল, রাশনা মেয়েটার মুখে মুচকি হাসি। রাফিনের মনটা একটু খারাপ হলো। তার ধারণা ছিল, ছেলেরা বিপক্ষে থাকলেও মেয়েরা হয়তো...
বাকি ক্লাস শেষ করে স্কুল ছুটির পর বের হলো রাফিন। সে খেয়াল করেছে, তার আশপাশে কেউ ঠিক ভিড়ছে না। শুধু কারাতে জানা চশমা পরা শুকনা ছেলেটা নিজ থেকে এসে কথা বলেছে...আশ্চর্য, ছেলেটার নামটা মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে! স্কুল গেটের কাছে ছেলেটা এগিয়ে এল।
‘আমার নাম মনে আছে তো?’
‘মনে থাকবে না কেন, কবীর।’ ঠিক সময়ে নামটা মনে পড়ায় নিজেকে ধন্যবাদ দিল রাফিন।
‘হেডস্যার কী বললেন?’
‘আসলে আমার ছোট চাচা এসেছিলেন, কথা তাঁর সঙ্গেই বলেছেন।’
‘ব্যারিস্টার আজমল?’
‘তুমি আমার চাচাকে চেনো?’
‘চিনব না কেন? উনি তো আমার দুটো বাসা পরই থাকেন। আমরা নেইবার।’
‘আশ্চর্য!’
‘আশ্চর্য কেন?’
‘না মানে, এত কাছে থাকো, জানতাম না।’ হাঁটতে হাঁটতে ওরা দুজন রাফিনের বাসার কাছে চলে এল।
‘আচ্ছা, যাই তাহলে।’
‘যাও।’
রাফিন একটু অপেক্ষা করল। কবীর চলে যেতেই সে বারান্দার টবটার নিচ থেকে চাবিটা বের করে দরজা খুলতে গিয়ে অবাক হলো। দরজা খোলা। চাচা কি ভুল করে দরজা লাগাতে ভুলে গেছেন? না, তালাটা ভাঙা, কেউ ভেঙেছে। ভেতরে ঢুকে চমকাল রাফিন। ড্রয়িংরুমের সোফা দুটোতে অচেনা লোক বসে আছে।
‘মি. রাফিন, স্কুল ছুটি হলো তাহলে?’
‘আপনারা কারা? চাচার কাছে এসেছেন?’
‘না, তোমার কাছেই এসেছি।’
‘তালা ভেঙেছেন কেউ?’
‘আমরাই, ভাঙিনি। মাস্টার লক দিয়ে তালা খুলেছি। এই এলাকার সব বাসায় ঢোকার অ্যাকসেস আছে আমাদের।’ বলে লোকটা হে হে করে হাসল।
‘আমার কাছে কেন এসেছেন?’
‘কেন আসছি, বোঝো নাই?’
‘না।’
‘তুমি আমগো বসের পোলার কোমর ভাঙছ।’
‘রমিজ বসের একমাত্র পোলা, তার কোমর ভাইঙ্গা দিলে চলে? ওরে এখন সিঙ্গাপুর নিতে হইব।’ সঙ্গের লোকটা বলল।
‘আমি ওর কোমর ভাঙিনি। ও পড়ে গিয়ে...’
‘ওই হইল, যেই লাউ সেই কদু। এহন আমরা আইছি তোমার কোমর ভাঙতে।’ বলে লোকটা উঠে দাঁড়াল। এতক্ষণ খেয়াল করেনি রাফিন, লোকটার হাতে একটা ছোট সাইজের হকিস্টিক। লোকটা কি সত্যিই তাকে মারবে? তার কোমর ভাঙতে এসেছে। রাফিনের মাথায় দ্রুত চিন্তা চলল। বাঁচতে হলে কিছু একটা করতে হবে। বাবার কথা মনে পড়ল। ‘...বিপদে পড়লে নিজেকে পঞ্চম মাত্রার মানুষ ভাবতে শুরু করবি। সময় ছাড়াও আরও একটা মাত্রা তোর সঙ্গে আছে, সেটা হচ্ছে স্পেস; ভাবলেই যে তুই পঞ্চম মাত্রার মানুষ হয়ে উঠবি, তা নয়। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে একটা কিছু ঘটবেই...কারণ, মহাবিশ্ব আসলে একটা কো–ইনসিডেন্টাল ইউনিভার্স। মনে রাখবি, পঞ্চম মাত্রার মানুষ সময়কে আগুপিছু করতে পারে...আরেকটা জিনিস ভালো পারে ওরা...টেলিকাইনেসিস।’
রাফিন খেয়াল করল, হকিস্টিক হাতে লোকটা এগিয়ে আসছে, ঠিক তার পেছনে বইয়ের শেলফের ওপর চাচার ভারী সিরামিকসের ফ্লাওয়ার ভাসটা। ওটার ওজন কত হবে? পারবে রাফিন? রাফিন তার মাথার ১০ বিলিয়ন নিউরনের একটা বিরাট অংশের এর সিন্যাপস কানেকশন করার চেষ্টা করল। তার হাতে সময় কম খুব কম...মাত্র এক সেকেন্ড সময় আছে ওর হাতে। এক সেকেন্ডে অনেক কিছু ঘটতে পারে...একটা কাঠঠোকরা সেকেন্ডে আঠারোবার ঠোকরাতে পারে, একটা মৌমাছি সেকেন্ডে ২০০ বার তার পাখা নাড়াতে পারে...এসবই বাবার কাছ থেকে শেখা!
লোকটা হকিস্টিকটা দুহাতে ওঠাতে যাবে, ঠিক তখন সেলফের ওপর থেকে ভারী সিরামিকসের ফ্লাওয়ার ভাসটা ছিটকে এসে লোকটার মাথায় পড়ল। তাল সামলাতে পারল না লোকটা, উপুড় হয়ে পড়ল।
দ্বিতীয় লোকটা হঠাৎ পকেট থেকে একটা চাকু বের করল। তখনই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। কিছু একটা বাইরে থেকে ছুটে এসে প্রথমে লোকটার ছুরি ধরা হাতে আঘাত করল, তার পরমুহূর্তে তার মুখে! লোকটার মাথাটা ঠুকে গেল পাশের দেয়ালে। রাফিন অবাক হয়ে দেখে, সেই শুকনা চশমা পরা ছেলেটা, যার নাম কবীর।
লোক দুটি কোনোমতে উঠে বসল। একজনের মাথায় রক্ত। তারা চোখে চোখে কী বলল কে জানে, হঠাৎ লাফিয়ে উঠে একরকম ছুটে বের হয়ে গেল দুজনই।
‘কবীর! তুমি?’ রাফিনের বিস্ময় যেন কাটে না।
‘তোমাকে বলেছিলাম না, তোমার খবর আছে? খবর কিন্তু শুরু হয়ে গেছে।’
‘কিন্তু তুমি কীভাবে এখানে এলে? তুমি না চলে গেলে?’
‘আমি আসলে যাইনি। তুমি টবের নিচ থেকে চাবি নিলে, দরজা খুলে ঢুকতে গিয়ে দেখলে দরজা খোলা। তখনই আমার মনে হয়েছে, কিছু একটা ভজকট ঘটবে। আমি তখন একদম দরজার কাছে চলে এসে তোমাদের কথাবার্তা শুনছিলাম। তারপর তো...’
‘তুমি তো দারুণ কারাতে পারো।’
‘আর তুমি?’
‘আমি আমি...আসলে...তোমার মতো কারাতে জানি না, তবে একটা জিনিস পারি।’
‘কী সেটা?’
‘টেলিকাইনেসিস পারি।’
‘টেলিকাইনেসিস মানে?’
‘সহজ করে বললে বলা যায়, দূর থেকে ভারী কিছুকে নাড়ানো।’
‘ও, তাই স্কুলে তুমি তোমার জুতা...’
‘হ্যাঁ, তা–ই।’
তারপর দুজন আরও কিছুক্ষণ গল্প করল। রাফিন চা বানিয়ে খাওয়াল কবীরকে। ও বুঝতে পারল, অল্প সময়ের মধ্যে ওরা দুজন বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে।
শুধু কবীর নয়, ক্লাসে আরও অনেকেই বন্ধু হয়ে উঠল রাফিনের। শুধু ওই চারজনের গ্রুপটা বন্ধু হলো না, আর রাশনা। ওরা দূরে দূরে থাকে। ওদের আসলে তেমন কিছুই হয়ওনি। কোমর ভেঙেছে বলে কিছুদিন ফাঁপর নিয়েছে। হাসপাতালেও যেতে হয়নি কাউকে। তবে ওরা যে ভেতরে–ভেতরে ঘোঁট পাকাচ্ছে, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। একদিন তো কবীর তাকে বলেই ফেলল,
‘বুঝলে রাফিন।’
‘কী বুঝব?’
‘ওরা কিন্তু কিছু একটা প্ল্যান করছে।’
‘কারা? রমিজ গ্রুপ?’
‘হ্যাঁ, ওদের দুজনের বাবা-চাচারা কিন্তু বেশ প্রভাবশালী। মনে হয় না সহজে ছেড়ে দেবে তোমাকে। তারা একটা কিছু করেই ছাড়বে, কাজেই সাবধান।’
‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ তুমি। কিছু একটা ওরা করবে, সেই অপেক্ষায় আছি আমিও, দেখা যাক।’
খুব শিগগির রাফিনের সেই অপেক্ষার পালা যেন শেষ হলো। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। স্কুলে হাফ পিরিয়ডের পর ছুটি। ছোট চাচা বলেছিল, স্কুল থেকে ফেরার পর পথে ওনার জন্য একটা বাঁধাই করা খাতা কিনে আনতে। স্কুলের কাছেই একটা স্টেশনারি দোকান আছে। ওদিকে যাচ্ছিল রাফিন। হঠাৎ তিনটা বেশ বড় ছেলে তাকে ঘিরে ধরল।
‘হাই, ম্যাজিক বয়?’
‘আমাকে বলছ?’
‘হ্যাঁ, তোমাকেই, তুমি নাকি দারুণ সব ম্যাজিক পারো?’
‘কে বলেছে?’
‘শুনেছি। আমরাও কিন্তু ম্যাজিক পারি। এই দেখো সাদা কাগজটা, একটা টোকা দিলাম।’ বলে ছেলেটা সত্যিই তার মুখের সামনে ধরে কাগজে একটা টোকা দিল। রাফিনের মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। ছেলেটা বলল,
‘তোমার ব্যাগটা দাও আমার হাতে।’ রাফিন দিয়ে দিল। আর ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগটা পাশের ড্রেনে ফেলে দিল। রাফিনের মনে হলো, ঠিকই আছে। ব্যাগ খামাখা ক্যারি করার দরকার কী? ড্রেনই ব্যাগের জন্য উত্তম স্থান।
‘সঙ্গে টাকা আছে?’
‘আছে।’
‘কত?’
‘দুটো ১০০ টাকার নোট।’
‘বের করে দাও।’ রাফিন বের করে দিল। সে যেন হঠাৎ করে দার্শনিক হয়ে উঠেছে। কিছুতেই কিছু যায়–আসে না। ওরা যা বলছে, তা–ই শোনা এখন তার একান্ত জরুরি কর্তব্য।
‘চলো এখন আমাদের সঙ্গে।’
রাফিন ওদের অনুসরণ করতে লাগল। মাথার ঝিমঝিম ভাবটা দূর হয়েছে। এখন কেমন যেন ফুরফুরে লাগছে ভেতরটা। মনে হচ্ছে, মাথার ভেতরটা ফাঁপা, কিছু নেই।
তারপর আর কিছু মনে নেই রাফিনের। সে কি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল? নাকি ঘুমিয়ে গিয়েছিল? হয়তো ঘুমিয়েই গিয়েছিল। ঘুম ভাঙার পর সব মনে পড়ল এক এক করে। তিনটা ছেলে একটা সাদা কাগজ তার মুখের সামনে ধরল...তারপর সে যেন পুতুল হয়ে গেল ওদের...ওরা রাফিনকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল, রাফিন কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিল না। মাঝে মাঝে ‘মানিব্যাগ ১০০ টাকা, মানিব্যাগ ১০০ টাকা, মানিব্যাগ ১০০ টাকা...’কে যেন চিত্কার করে বলছিল।
রাফিন তাকে আটকে রাখার ছোট্ট ঘরটা এবার খেয়াল করল। এটা আসলে একটা টয়লেট। হাই কমোডের ওপর ঢাকনাটা লাগিয়ে তার ওপর ওকে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। কত হবে, চার ফুট বাই পাঁচ ফুটের ছোট্ট টয়লেট। এখান থেকে বেরোতে হবে। কিন্তু কীভাবে? টয়লেটের এক কোনায় একটা পুটিংয়ের বড় কৌটা, দুটো রঙের ডিব্বা আর ব্রাশ, ছোট একটা বালতি ছাড়া আর কিছু নেই। ওপরের দিকে একটা বন্ধ জানালা। ওটা ভেঙে বের হওয়া এককথায় অসম্ভব। তাহলে?
চলবে
সংশোধনী: এই উপন্যাসটির নাম কিশোর আলোর মার্চ সংখ্যায় 'উড়তে জানা ছেলেটা' লেখা হয়েছে। অনাকাঙ্খিত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত।