‘আমি ভেবেছিলাম এই প্রশ্ন তুই আরও অনেক আগে করবি বা করা উচিত ছিল। এত পরে কেন করলি জানি না। তবে সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় হয়েছে। প্রশ্ন করারও কিন্তু একটা পরিবেশ লাগে। পঞ্চম মাত্রা আসলে একেক সময় একেকটা, কখনো আলো, কখনো স্থান, কখনো...তবে মাত্রা হিসেবে স্থানকে বেছে নেওয়াই উত্তম। ভেবে দেখ...তোকে তো আগেও বোধ হয় বলেছি, সময়ের চেয়ে স্থান যেন আরও বেশি প্রহেলিকাময়; একটা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রন ঘোরে, সেই নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রনের দূরত্ব কতটুকু বলতে পারবি?’
‘না, কত দূরে?’
‘নিউক্লিয়াসটা যদি ঢাকার জিরো পয়েন্টে থাকে, তাহলে তার ইলেকট্রন ঘুরছে গাজীপুরের রেডিয়াস নিয়ে...ভাবতে পারিস এটা কতটা ফাঁকা! কতটা স্পেস চারদিকে...তাহলে এবার মহাবিশ্বের কথা চিন্তা কর...।’
বাবা কথা শেষ করতে পারলেন না। থেমে গেলেন। তাঁর চোখ দুটি খোলা রইল কিন্তু ঠোঁট দুটি একটু ফাঁক হলো। খুব সম্ভব রাফিনের বাবা সেই মুহূর্তে মারা গেলেন।
রাফিনের বাবার মৃত্যুর দুই দিন পর তার ছোট চাচা আলাদিন খান এসে হাজির হলেন। রাফিন এই চাচাকে খুব বেশি দেখেনি। দেখতে তার বাবার মতোই সুন্দর এই চাচা। দীর্ঘদেহী। লালচে চুলের কারণে তাঁকে হঠাৎ হঠাৎ বিদেশি বলে মনে হয়। চাচার হাসিটা সুন্দর। মন ভালো করা হাসি। চাচা হাসলেন।
‘রাফিন?’
‘জি চাচা।’
‘তোমার ব্যাগ গোছাও। এখানে তোমার পাট চুকে গেছে।’
‘কোথায় যাব?’
‘আমার সঙ্গে। আমি যেখানে থাকি, সেখানে আমার সঙ্গে থাকবে তুমি। ওখানে ভালো স্কুল আছে। বড়দার সঙ্গে কথা ছিল এ রকমই।’
‘কী কথা?’
‘তাঁর কিছু হলে আমি যেন তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাই। চিঠিটা দেখাব তোমাকে?’
‘কোন চিঠি?’
‘যে চিঠিতে বড়দা এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।’
‘না, দরকার নেই...’
সেদিনই রাতের বাসে রাফিন রওনা হলো ছোট চাচার সঙ্গে। তার নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে। বিদায় কেশবপুর গ্রাম...বিদায়।
আবার সেই রাফিনের প্রথম ক্লাসে ফিরে আসি। জুতাটা পায়ে গলাল রাফিন। স্যার হুংকার দিলেন,
‘আনসার মি! হুজ শু ইট ইজ? অ্যান্ড হু ডিড ইট?’
উঠে দাঁড়াল রাফিন।
‘স্যার, আমার জুতা।’ পুরো ক্লাস যেন স্তব্ধ। একটা ছেলেকে নিয়ে প্রথম দিনেই এত ঘটনা। ঠিক তখন ঢং করে ঘণ্টা বাজল। মানে প্রথম ক্লাস সমাপ্ত। স্যার তীব্র চোখে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ ডাস্টার, চক আর রোলকলের খাতা নিয়ে বের হয়ে গেলেন। বের না হয়ে উপায় নেই। পরের ক্লাস হেডস্যারের। তিনি ঘণ্টা পড়ার আগেই এসে ক্লাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন।
সেদিন আর নতুন কোনো ঘটনা ঘটল না। তবে রাফিন টের পেল, পুরো স্কুল যেন তার বিরুদ্ধে। স্কুলের দারোয়ান থেকে শুরু করে তার ক্লাসের ছাত্ররা সবাই। কিন্তু কেন? বাবা বলতেন, ‘কেউ যদি তোমাকে অপছন্দ করে, বুঝে নেবে এর পেছনে তিনটা কারণ আছে।’ কারণ তিনটা নিয়ে রাফিন ভাবতে লাগল।
তবে স্কুল ছুটির পর গেটের বাইরে তার ক্লাসের চারটা ছেলে তাকে ঘিরে ধরল। এরা তার পেছনের বেঞ্চে তার সঙ্গেই বসেছিল। তবে পেছনে জুতায় লাথি মারার ছেলেটা এবং তার ক্লাসের আরও দুজন একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
‘এই দাঁড়া।’ রাফিন দাঁড়াল। ‘তুই তো স্কুলে নতুন ঢুকলি?’
‘হু।’
‘এই স্কুলে ঢুকলে কিছু নিয়মকানুন আছে।’
‘কী নিয়ম?’
‘আগে আমাদের সঙ্গে চল।’ বলে ওরা রাফিনকে স্কুলের পেছনে নিয়ে এল। স্কুলের পেছনটা নিরিবিলি। বেশ বড় কয়েকটা গাছ, তারপর উঁচু দেয়াল। শার্টের কলার উঁচু করা ছেলেটা এগিয়ে এল।
‘কী বললাম?’
‘স্কুলের নিয়ম নিয়ে কী বলছিলে।’
‘হ্যাঁ, স্কুলের কিছু নিয়ম আছে। যেমন ধর, এই যে স্কুলের পেছনে কত কাগজ পড়ে আছে, এগুলা দেখতে ভালো লাগে?’
‘দেখলাম।’
‘এইগুলা তুই খাবি।’
‘কাগজ খাব? কেন, খেতে হবে কেন?’
‘ওই যে বললাম, স্কুলে ঢুকলে নতুনদের জন্য কিছু নিয়মকানুন আছে। আর জায়গাটাও পরিষ্কার হইল।’
‘তাই? যদি না খাই?’
রাফিনের বলার ভঙ্গিতে ওরা একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত হলো। খেয়াল করল রাফিন। তার ক্লাসের আরও কয়েকটা ছেলে এসে ভিড় করেছে। একটা মেয়েও আছে। সবাই সম্ভবত মজা দেখতে এসেছে।
‘না খাইলে কী করুম, সেইটা পরে। আগে ক, তুই কাগজ খাবি কি খাবি না?’
‘খাব না। কী করবি কর।’
এবার রাফিনও ওদের তুই তুই করে বলল। এতে যেন ছেলেগুলো খেপে উঠল ভেতরে–ভেতরে। একটা ছেলে এসে তার পেছনে দাঁড়াল। দুই হাতে শক্ত করে কোমর ধরল রাফিনের, আরেকটা ছেলে এগিয়ে আসছে, আস্তিন গুটিয়ে। কী করবে ওরা? রাফিনকে মারবে? বোঝা যাচ্ছে, নতুন আসা ছাত্রদের সঙ্গে এই কাজ তারা আরও করেছে। হয়তো ভবিষ্যতেও করবে। রাফিন বাবার কথা মনে করার চেষ্টা করল। ‘...যদি কখনো বিপদে পড়িস, নিজেকে পঞ্চম মাত্রার মানুষ মনে করবি, মাত্রা হিসেবে বেছে নিবি স্থানকে। স্থান হচ্ছে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রহেলিকাময়।’ বাবা ‘প্রহেলিকা’ শব্দটা প্রায়ই ব্যবহার করতেন! এই শব্দ রাফিন বোঝে আবার বোঝে না। সে নিজেকে পঞ্চম মাত্রার একজন মানুষ ভাবতে শুরু করল। তার চারপাশে শুধু স্থান আর স্থান...স্পেস...এস পি এ সি ই...। রাফিন দুই হাতে পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটার কাঁধের দুই পাশ ধরল। তারপর আর তার কিছু মনে নেই। তবে সবাই দেখল, পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটা শূন্যে উঠে ছিটকে পড়ল সামনের গাছটার কাণ্ডের ওপর। আর উঠে দাঁড়াল না।
চলবে সংশোধনী: এই উপন্যাসটির নাম কিশোর আলোর মার্চ সংখ্যায় 'উড়তে জানা ছেলেটা' লেখা হয়েছে। অনাকাঙ্খিত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত।