মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘অন্য জীবন’ (পঞ্চম পর্ব)

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

গোপেন ডাক্তার সোজাসুজি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কেমন জানি একটু মাথা নাড়লেন। তারপর নিজের পেট মোটা ব্যাগটা বন্ধ করে বললেন, ‘আজ রাতে তো আর কিছু করার নেই, কাল সকালে একটা ব্যবস্থা করতে হবে।’

আব্বু বললেন, ‘ঠিক আছে। আমরা কিছু একটা ব্যবস্থা করব।’

গোপেন ডাক্তার বললেন, ‘এখন তো আর কিছু করার নেই। আমরা যাই।’

আব্বু ইতস্তত করে বললেন, ‘এখানে কে দেখবে?’

ফজল বলল, ‘আমি দেখতে পারব।’

‘তুমি একা?’

‘আমি তো সব সময়ই একাই দেখি।’

‘এখন তো একটু অন্য ব্যাপার।’

ফজল বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই।’

তখন আমি বললাম, ‘আমিও থাকি ফজলের সঙ্গে?’

আব্বু একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘তুই থাকবি?’

‘হ্যাঁ।’

আব্বু এক সেকেন্ড কী একটা যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে থাক তাহলে। দুই বন্ধু এক রাত কাটিয়ে দিবি।’

‘হ্যাঁ, আব্বু।’

আব্বু পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে সেখান থেকে কয়েকটা টাকা বের করে আমাকে দিলেন। বললেন, ‘সঙ্গে রাখ।’

আমার তখন মনে হলো আমি বুঝি বড় হয়ে গেছি। এর আগে আমি পকেটে বড়জোর আনি, দোয়ানি বা সিকি রেখেছি, পুরোপুরি কয়েকটা টাকার নোট নিজের পকেটে? সেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

আব্বু আর গোপেন ডাক্তার টর্চলাইট জ্বালিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকলেন, আমি আর ফজল বারান্দায় দাঁড়িয়ে যতক্ষণ তাঁদের দেখা গেল দেখলাম। তারপর ফজল আর আমি ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। ফজল কিছুক্ষণ তার নানিকে দেখল, একবার আস্তে একটু ঠেলা দিয়ে নিচু গলায় ডাকল তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে তার বিড়ালের মতো চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকাল। তার হাতে কুপিবাতিটির শিখা দপ দপ কর জ্বলছিল, সেই আলোতে ফজলকে কেমন যেন অন্য রকম মনে হয়। হঠাৎ সে ফুঁ দিয়ে কুপিবাতিটি নিভিয়ে দিল। আমি চমকে উঠে বললাম, ‘কী হলো? বাতি নিভালি কেন?’

ফজল কোনো কথা বলল না, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ভয় পাওয়া গলায় ডাকলাম, ‘ফজল।’

‘উঁ।’

‘বাতি নিভালি কেন?’

‘আমার বাতি ভালো লাগে না। তা ছাড়া—’

‘তা ছাড়া কী?’

‘ওরা যখন আসে তখন—’

আমি কাঁপা গলায় বললাম, ‘ওরা কারা? ওরা যখন আসে তখন কী?’

‘ওরা আলোতে আসে না।’

‘ওরা কারা?’

‘ওই তো। পোলাপান।’

আমি চুপ করে গেলাম, হঠাৎ করে আমার কেমন যেন ভয় লাগতে লাগল। অন্ধকার একটা ঘরে ফজলের থুত্থুড়ে বুড়ি নানি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ঘরের ভেতর ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার, সেখানে বিড়ালের মতো চোখ নিয়ে ফজল দাঁড়িয়ে আছে, আমিও দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ করে আমার মনে হলো রাতের বেলা ফজলের বাড়ি থাকার বুদ্ধিটা মনে হয় ভুল হয়েছে।

আমি খসখস একটা শব্দ শুনলাম। মনে হলো ফজল বের হয়ে যাচ্ছে। ভয় পাওয়া গলায় ডাকলাম, ‘ফজল।’

‘উঁ।’

‘কী করছিস?’

‘বাইরে যাই।’

‘কেন?’

‘ভেতরে থেকে কী করব! আর—’

‘আর কী?’

‘ওরা আসবে এখন।’

আমার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠল। অনেক কষ্টে সাহস করে বললাম, ‘দাঁড়া। আমাকে নিয়ে যা।’

ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু ফজলের মনে হলো কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। আমি ফজলের পিছু পিছু অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

বাইরে মনে হয় চাঁদের আলো পড়েছে, আবছা আবছা সব দেখা যাচ্ছে। বাড়ির সামনে উঠান, সেখানে আবছা আবছা গাছের ছায়া। বাড়ির পেছনে বড় বড় গাছ, বাতাসে গাছের পাতা শিরশির করে নড়ছে। সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেন থমথমে একটা ভাব।

ফজল বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসল। কী করব বুঝতে না পেরে আমিও তার পাশে গিয়ে বসলাম। ফজল কোনো কথা না বলে পিঠ শক্ত করে বসে রইল। হঠাৎ করে উঠানের মাঝখান দিয়ে কী যেন একটা দৌড়ে গেল, আমি চমকে উঠে বললাম, ‘ওইটা কী?’

ফজল কোনো কথা বলল না, আমি আবার জিগ্যেস করলাম, ‘কী গেল ওটা?’

‘শিয়াল-কুকুর কিছু একটা হবে।’

‘এভাবে দৌড়ায় কেন?’

‘ওরা যখন আসে তখন ভয় পায়।’

আমি শুকনো গলায় বললাম, ‘ভয় পায়? ভয় পায় কেন?’

‘জানি না।’

সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটা কুকুর কিংবা শিয়াল উঠানের মাঝখান দিয়ে ইতস্তত ছুটে গেল। একেবারে নিঃশব্দে ছুটে যাচ্ছে দেখে মনে হয় এগুলো কী করবে, কোন দিকে ছুটে যাবে বুঝতে পারছে না।

আমি কাঠ হয়ে বসে রইলাম। হঠাৎ মনে হলো ফিসফিস করে কেউ কথা বলছে, আমি চমকে উঠে আশপাশে তাকালাম, কেউ কোথাও নেই। চারদিকে আবছা অন্ধকার, গাছের ছায়ায় মনে হয় এদিকে সেদিকে অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে। হঠাৎ করে মনে হতে থাকে এই অন্ধকারগুলোতে বুঝি কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে তাকালে দেখা যায় কেউ নেই। ফিসফিস কথাগুলো যে শুধু আমি শুনছি তা নয়, মনে হলো ফজলও শুনতে পাচ্ছে। আমি কথাগুলো বুঝতে পারছি না কিন্তু ফজল মনে হলো কথাগুলো বুঝতে পারছে। হঠাৎ করে সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘না না, এখন আমি খেলব না। নানির খুব অসুখ।’

আমি চমকে উঠলাম। কার সঙ্গে কথা বলছে? ফজলকে কিছু জিগ্যেস করতেও আমার ভয় হলো। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে তার বিড়ালের মতো চোখ নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে, স্পষ্ট মনে হলো কিছু দেখছে। আশপাশে ফিসফিস শব্দ আরও বেড়ে গেল, এখন শুধু ফিসফিস না আমার মনে হলো এক-দুইটা কথা জোরে জোরেও শোনা যাচ্ছে। কথাগুলোর কোনো অর্থ নেই, শুধু এক ধরনের শব্দ। মনে হচ্ছে, খুব ছোট বাচ্চার গলায় একধরনের শব্দ। আমি উঠানে ধুপধুপ একধরনের শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হলো, একজন কিংবা কয়েকজন বুঝি উঠানের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় দৌড়ে যাচ্ছে। শুধু উঠানে না, উঠানের পাশে বড় বড় গাছের নিচে শুকনো পাতার ওপর খচমচ শুনতে পেলাম, মনে হলো সেখানেও কেউ হাঁটাহাঁটি করছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি চারদিকে অনেকে আমাদের ঘিরে রেখেছে। আমি তাদের দেখছি না কিন্তু টের পাচ্ছি। প্রচণ্ড আতঙ্কে আমার শরীর তখন কুলকুল করে ঘামছে।

ফজল হঠাৎ চিৎকার করে বলল, ‘খবরদার, কাছে আসবি না।’

আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম ফিসফিস করে চাপা গলায় কিছু বলল, হঠাৎ করে মনে হলো গরম হলকার মতো একটা বাতাস আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেল। শুধু বাতাস না, এক ধরনের পোড়া গন্ধ, মাংস পোড়ালে যে রকম গন্ধ হয়, অনেকটা সে রকম। ফজল চিৎকার করে বলল, ‘না, না। ওকে কিছু করবি না। ও আমার বন্ধু।’

ফজলের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম ফজলকে কেউ যেন হ্যাঁচকা টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল, সে তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে উঠানের মাঝে পড়ে গেল এবং সেখানে গড়াগড়ি খেতে লাগল। স্পষ্ট বুঝতে পারছি সে ওঠার চেষ্টা করছে কিন্তু উঠতে পারছে না, অনেকে তাকে মাটিতে চেপে রাখছে। এতক্ষণ ফিসফিস কথা শুনতে পাচ্ছিলাম এবার হঠাৎ করে চাপা হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হলো খিলখিল করে অনেকে হাসছে।

ফজল চিৎকার করে বলল, ‘খবরদার! খবরদার ওকে ধরবি না!’ সে আমাকে বাঁচানোর জন্য ওঠার চেষ্টা করছে কিন্তু উঠতে পারছে না। আমি স্পষ্ট টের পেলাম আমাকে কারা যেন ঘিরে ফেলছে। চাপা হাসি আর নিঃশ্বাসের শব্দ, এক ধরনের পোড়া গন্ধ আর গরম বাতাসের হলকা। তার মধ্যে হঠাৎ করে বরফের মতো ঠান্ডা হাত কে যেন আমার ঘাড়ে রাখল। আমি পেছন দিয়ে তাকালাম, পেছনে কেউ নেই। কে একজন আমার হাত ধরল, হাত বরফ থেকেও ঠান্ডা, আমি সামনে তাকালাম, সামনেও কেউ নেই! আশপাশে কেউ নেই কিন্তু তার পরও কারা যেন আমাকে জাপটে ধরে ফেলে, ঠেলে নিচে ফেলে দেয় আমার বুকের ওপর চেপে বসে। আমি খিলখিল হাসি শুনতে পাই।

ফজল গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, কী বলছে আমি শুনতে পাচ্ছি না। শুধু ভয়ংকর এক ধরনের আতঙ্কে আমি টের পেলাম আমার অনেক বড় বিপদ! হাসতে হাসতে কারা যেন আমাকে মেরে ফেলবে।

ঠিক তখন আমার মনে পড়ল আমার পকেটে ম্যাচটা রয়ে গেছে। ফজল বলেছিল বাতি জ্বালানো থাকলে ওরা আসে না। আমি অনেক কষ্ট করে পকেট থেকে ম্যাচটা বের করে আনি, ম্যাচটা মনে হয় খালি ভেতরে একটা না-হয় দুইটা কাঠি, সেখান থেকে একটা কাঠি বের করে ফস করে সেটা জ্বালালাম, সঙ্গে সঙ্গে রক্তশীতল করা একটা আর্তনাদ শুনতে পেলাম। যারা আমাকে ধরে রেখেছিল, সবাই হঠাৎ করে আমাকে ছেড়ে দেয় ম্যাচের কাঠির আলোতে মনে হলো অনেক মুখ দেখতে পেলাম, ছোট ছোট বাচ্চার মুখ কিন্তু কী ভয়ংকর চেহারা! চোখগুলো মনে হয় ধক ধক করে জ্বলছে। ছোট ছোট ধারালো দাঁত, লাল জিব।

আমাকে ছেড়ে দিয়ে প্রাণীগুলো ছিটকে সরে গেল। ফজলকেও মনে হয় ছেড়ে দিয়েছে—সেও উঠে দাঁড়িয়েছে, আমার কানের কাছে মুখ রেখে বলল, ‘পালা, তুই এখনই পালা!

আরও পড়ুন