রানির মুকুট রহস্য

মার্কিন লেখক ম্যাক বার্নেটের জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ ‘কিড স্পাই’। এই সিরিজের প্রধান চরিত্রের নামও ম্যাক বার্নেট। ছোট্ট ম্যাককে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ বিভিন্ন মিশন দেন, সেগুলো সম্পন্ন করে ম্যাক। এই সিরিজের প্রথম বই ‘ম্যাক আন্ডারকভার’-এ ইংল্যান্ডের রানির হারিয়ে যাওয়া রত্ন খুঁজবে ম্যাক। এই অ্যাডভেঞ্চারে তোমাদের স্বাগত!

রাজা-রানির গল্প (প্রথম ভাগ)

‘হাজার বছরের বেশি সময় ধরে,’ বললেন রানি, ‘ইংল্যান্ডের সিংহাসনে একজন রাজা বা রানি ছিলেন। শুধু মাঝখানে অল্প সময়ের জন্য একটা ছোট বিরতি ছিল।’

‘বিরতি?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘হ্যাঁ,’ বললেন রানি। চার শ বছর আগে কিছুদিনের জন্য ইংল্যান্ডে কোনো রাজা ছিলেন না।’

‘কেন?’

‘ইংল্যান্ডে তখন গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। একদল প্রজা ছিল রাজা চার্লস প্রথমের পক্ষে, আরেকদল ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। শেষটা কিন্তু রাজার জন্য ভালো হয়নি।’

‘কী হয়েছিল?’

‘রাজহত্যা’

‘রাজহত্যা?’

‘হ্যাঁ, রাজাকে হত্যা করা হয়েছিল।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন রানি।

‘রাজাকে হত্যা?’ অবাক হয়ে বললাম আমি।

‘হ্যাঁ’, বললেন রানি। ‘রাজহত্যা আমার সবচেয়ে অপছন্দের বিষয়।’

‘এটা তো ভয়ংকর!’ বললাম আমি।

‘এটাই ইতিহাস,’ বললেন রানি। ‘রাজা চার্লস প্রথমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১১ বছর ইংল্যান্ডে কোনো রাজা ছিল না। অলিভার ক্রমওয়েল নামের একজন নিজেকে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের শাসক বলে ঘোষণা করল। ক্রমওয়েল রাজা-রানিদের ঘৃণা করত। এমনকি কোনো আনন্দ-উচ্ছ্বাসও সে পছন্দ করত না! সব থিয়েটার, সুন্দর পোশাক, বড়দিনের উৎসব—সবকিছু বন্ধ ছিল। বড়দিনের দিন আনন্দ করার পরিবর্তে সবাইকে উপোস থাকতে হতো। যদি তখন ভিডিও গেমসও থাকত, তবে সেগুলোও কেড়ে নিত! ভয়ানক মানুষ ছিল অলিভার।’

‘কিন্তু আপনি তো বললেন, ভিডিও গেমস বাজে জিনিস?’

‘একটা জিনিসকে বাজে বলা আর নিষিদ্ধ করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে,’ বললেন রানি, ‘এটা মনে রেখো।’

এটা আমি কখনো ভুলব না।

‘পুরো দেশটাই যেন তখন শাস্তি পাচ্ছিল,’ বললাম আমি।

‘সত্যিই তা–ই,’ বললেন রানি। ‘সময়টা খুব কঠিন ছিল। ক্রমওয়েল রাজপরিবারের সব মূল্যবান মণিমুক্তা গলিয়ে বিক্রি করে দিল নিজের কোষাগার ভরতে। রাজমুকুট, রাজদণ্ড, এমনকি রাজাদের তরবারিও ধ্বংস করে দিল। শুধু বেঁচে গেল একটা জিনিস।’

‘চামচ,’ বললাম আমি।

‘হ্যাঁ, চামচ,’ রানি বললেন। ‘রাজা চার্লস দ্বিতীয় সিংহাসনে ফিরে এসে নতুন রাজমুকুট, রাজদণ্ডসহ বাকি সব জিনিস আবার বানানোর আদেশ দিলেন। তার কিছু প্রতিলিপি এখন তোমার পেছনে রয়েছে। রাজা পুরোনো চামচটাও খুঁজে পেয়েছিলেন। রাজ্যাভিষেকের সময় একজন বিশপ তাঁর হাতে তেল ঢালার জন্য সেই চামচ ব্যবহার করেছিলেন।’

‘কী?’

‘এটাই রাজা-রানির গল্প,’ রানি বললেন।

‘আচ্ছা,’ বললাম আমি।

‘তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে, কেন এই চামচ এত মূল্যবান’ রানি বললেন। ‘মানুষ সবচেয়ে বেশি কী চায়? ঐতিহ্য। এই চামচ মাত্র ১০ ইঞ্চি লম্বা হতে পারে, কিন্তু এটি ইংল্যান্ডের অন্ধকার যুগের অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত পৌঁছেছে, খারাপ সময় থেকে শুরু করে ভালো সময়ের মধ্য দিয়ে গেছে, ওহ গড, তোমার হাতের লেখা তো দেখছি বিচ্ছিরি।’

সবকিছু লিখে নিচ্ছিলাম আমি, রানি আমার কাঁধের ওপর দিয়ে তা দেখেছেন।

‘আমি হাতের লেখা আরও ভালো করার চেষ্টা করছি!’

‘তা–ই করা উচিত,’ বললেন রানি।

‘আচ্ছা, আমি এখন একটা সূত্র খুঁজতে যাচ্ছি,’ বললাম আমি।

‘তার কোনো দরকার নেই,’ বললেন রানি। ‘আমি জানি কে আমার চামচ নিয়েছে।’

‘আপনি জানেন?’

‘হ্যাঁ,’ বললেন রানি।

‘কেজিবি নিয়েছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘কেজিবি?’ বললেন রানি।

‘এ ধরনের গোপন কাজ কেজিবি করে।’

‘না,’ বললেন রানি। ‘এটা কেজিবির কাজ নয়। আমার চামচ নিয়েছে…’

রাজা-রানির গল্প (দ্বিতীয় ভাগ)

‘কে আপনার চামচ চুরি করেছে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। সে একটা চিঠি রেখে গেছে।’

রানি তাঁর হাতব্যাগ থেকে একটা খাম বের করলেন। সেটা আমার হাতে দিলেন। চিঠিটা খুললাম।

‘বাহ! ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের হাতের লেখাও তো খারাপ! কিছু অক্ষর তো উল্টো।’

‘তাতে কী হয়েছে?’ বললেন রানি।

‘আমার হাতের লেখাও যেহেতু খারাপ, তাহলে বড় হয়ে আমিও প্রেসিডেন্ট হতে পারি!’

‘হ্যাঁ,’ বললেন রানি। ‘ তবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট!’

‘মানে কী?’ বললাম আমি।

‘শুধু চিঠিটা পড়ো,’ বললেন রানি।

‘আপনি নাকি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে জিহ্বা বের করে ভেঙিয়েছিলেন?’ বললাম আমি।

‘আমি ভেবেছিলাম সে পেছন ফিরে আছে!’ বললেন রানি।

‘হুমম,’ বললাম আমি।

‘সে খুব খারাপ আচরণ করছিল!’

‘আচ্ছা…,’ বললাম আমি।

ফ্রান্সের রাজার চিঠিতে যা লেখা ছিল—

‘ডিয়ার ইয়োর ম্যাজেস্টি,

আমি টাওয়ার অব লন্ডনে ঢুকে আপনার চামচটা চুরি করলাম। আমি নিশ্চিত করছি যে এই চামচ আপনি আর কখনো ফের‍ত পাবেন না। এটাই আপনার শাস্তি। আশা করি ভবিষ্যতে আমাকে আর জিব বের করে ভেঙাবেন না। হা হা হা…

দ্য প্রেসিডেন্ট অব ফ্রান্স’

‘যাহোক,’ রানি বললেন, ‘তুমি আজ রাতেই হোভারক্রাফ্টে চড়ে ফ্রান্সে যাবে এবং আমার চামচ ফিরিয়ে আনবে।’

‘ঠিক আছে!’ বললাম আমি। ‘আমাকে কি কোনো গোপন স্পাই গিয়ার দেওয়া হবে?’

‘স্পাই গিয়ার?’ রানি বললেন।

‘হ্যাঁ,’ আমি বললাম। ‘যেমন জেমস বন্ডের মতো!’

রানি হেসে বললেন, ‘ম্যাক, জেমস বন্ড একটা কাল্পনিক চরিত্র, একটা কাল্পনিক গল্প। আর এটা সত্যিকারের মিশন।’

‘ওহ,’ বললাম আমি। ‘ঠিক আছে।’

‘তবে অবশ্যই তোমাকে কিছু আধুনিক জিনিস দেওয়া হবে,’ বললেন রানি।

তিনি তার বিশাল হাতব্যাগ থেকে একজোড়া সাধারণ চশমা বের করলেন।

‘দেখতে সাধারণ সানগ্লাসের মতো হলেও এটা নাইট-ভিশন গ্লাস। এটা পরলে তুমি অন্ধকারে দেখতে পাবে।’

‘কিন্তু রাতে সানগ্লাস পরলে আমি হাসির পাত্র হব না?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

‘আত্মবিশ্বাস থাকলে কিছুই অদ্ভুত লাগে না!’ বললেন রানি।

‘আত্মবিশ্বাস!’ বললাম আমি।

তিনি আবার হাতব্যাগে হাত দিয়ে আরেকটা বাক্স বের করলেন।

‘এটা তোমার গোপন পরিচয় বাক্স। মানুষ যদি তোমাকে ছোট্ট শিশু মনে করে, তাহলে তুমি হোটেলে চেকইন বা গাড়ি চালাতে পারবে না।’

আমি বাক্সটা খুললাম।

‘তোমার নাম হিউ অ্যান্থনি ক্রেগ তৃতীয়। তুমি মিশিগানের কালামাজু থেকে আসা একজন পিয়ানো টিউনার।’

‘কিন্তু এটা হওয়ার জন্য আমি একটু বেশিই ছোট না?’

‘হ্যাঁ,’ ভ্রু কুঁচকে রানি বললেন। ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি আরেকটু লম্বা হবে।’

‘আমি আমার ক্লাসে সবচেয়ে ছোট!’

‘আচ্ছা’, বললেন রানি। ‘আত্মবিশ্বাসী হও! মানুষ হয়তো তোমার উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। এটা অভদ্রতা।’

‘ঠিক আছে,’ বললাম আমি।

‘অবশ্য, ফ্রান্সে অনেক অভদ্র মানুষ আছে। আবার ফ্রান্সে অনেক খাটো মানুষও আছে। তাই তোমাকে কেউ সন্দেহ করবে না। তুমি ওখানে ঠিকই থাকবে।’

‘এখানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে একটা টপ সিক্রেট রিপোর্ট আছে। তোমার মিশনের জন্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকতে পারে।’

‘কিন্তু বেশির ভাগ কথাই তো কালো কালি দিয়ে ঢাকা!’

‘হ্যাঁ। গোপন রিপোর্টে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ঢেকে দেওয়া হয়। কালো কালি দিয়ে বন্ধ মানেই এটা খুব গোপনীয়!’

‘কিন্তু এটা তো পড়াই যাচ্ছে না,’ বললাম আমি।

‘সবশেষে, তোমার মিশনের জন্য আমি আমার একটা কুকুর ধার দেব। তুমি তোমার পছন্দমতো একটা বেছে নিতে পারো।’

‘কুকুরেরা, লাইনে দাঁড়াও!’ বললেন রানি।

কুকুরগুলো একে অপরের লেজ কামড়ানো বন্ধ করে সুন্দরভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। মনোযোগ দিয়ে ওদের পর্যবেক্ষণ করলাম আমি।

‘এগুলো প্রশিক্ষিত গুপ্ত কুকুর?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

‘মোটেই না! কী ভয়ানক কথা!’ বললেন রানি।

‘তাহলে কি ওরা রোবট?’

‘অবাস্তব কথা বলো না’, বললেন রানি।

‘তাহলে আমাকে একটা দিচ্ছেন কেন?’

‘তোমাকে ধার দিচ্ছি,’ বললেন রানি। ‘গুপ্তচরদের জীবন খুব নিঃসঙ্গ হয়। তাই সঙ্গী থাকা ভালো।’

আমি সারির শেষে থাকা একদম ছোট্ট কুকুরটার দিকে আঙুল তুললাম।

‘ওইটা,’ বললাম আমি।

‘ফ্রেডি?’ রানি বললেন। ‘কিন্তু ফ্রেডি তো ছোট।’

‘স্কুলেও সবাই আমাকে একই কথা বলে!’ বললাম আমি।

‘ফ্রেডি?’ জিজ্ঞেস করলেন রানি।

‘না! ছোট!’ বললাম আমি।

‘আহ,’ বললেন রানি।

তিনি ফ্রেডিকে তুলে আমার হাতে দিলেন। ওটা আমার মুখ চাটতে শুরু করেছে।

‘চাটবে না, ফ্রেডি,’ বললেন রানি।

ফ্রেডি চাটতেই থাকল।

তিনি ফ্রেডিকে তুলে আমার হাতে দিলেন।

‘আচ্ছা, তোমার এখন যাওয়া উচিত। হোভারক্রাফ্ট শিগগিরই ছাড়বে।’

ফ্রেডি আর আমি দরজার দিকে হাঁটলাম। কিন্তু আমার এখনো একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা বাকি।

‘শুধু আরেকটি প্রশ্ন,’ বললাম আমি।

‘ওহ, দয়া করে শেষ করো,’ বললেন রানি।

‘এই মিশন শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে বলে আপনার মনে হয়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘যতক্ষণ লাগার লাগবে,’ রানি বললেন। ‘কিন্তু কেন?’

‘এই সপ্তাহের শেষে ডেরেক লাফয়ের কারাতে জন্মদিনের পার্টি আছে।’

রানি গম্ভীরভাবে আমার দিকে তাকালেন। ‘তোমাকে কি ডেরেক লাফয়ের জন্মদিনের পার্টিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

‘না, কিন্তু—’

‘তোমার মিশনের জন্য শুভকামনা,’ বললেন রানি।

চলবে…

মূল: ম্যাক বার্নেট অনুবাদ: কাজী আকাশ

*ম্যাক বার্নেট আমেরিকার জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক। লেখালেখির জন্য এ পর্যন্ত অনেক সাহিত্যিক পুরস্কার পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যাস্ত্রো ভ্যালিতে তাঁর জন্ম। তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাসের সিরিজের মধ্যে ‘কিড স্পাই’ ও ‘দ্য টেরিবেল টু’ বিশ্বব্যাপী পাঠকপ্রিয়তা পেয়ছে। একাধিক ভাষায় বইগুলো অনূদিত হয়েছে।

আরও পড়ুন