পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে রাব্বির অনেক দেরি হলো। মুখটুখ ধুয়ে নাশতার টেবিলে এসে দেখে ঝর্ণা খালা আর নেলি বসে গল্প করছে। যথেষ্ট অবাক হলো রাব্বি! বলেই ফেলল—
‘তুই?’
‘বাব্বাহ্, এতক্ষণ ঘুমাও তুমি, আমি কখন এসেছি! ঝর্ণা খালার সঙ্গে গল্প করছি।’
‘কেন এসেছিস?’
‘কী আশ্চর্য! এটা কেমন প্রশ্ন হলো?’ ঝর্ণা খালা কড়া চোখে তাকালেন রাব্বির দিকে। ‘বন্ধু বন্ধুর কাছে কেন আসে?’
রাব্বি তখন মনে মনে বলে, ‘এহ্! বন্ধু না ঘোড়ার ডিম। আমাকে চশমাচোর বলেছে সবার সামনে...’
‘নে, খেতে বস।’ বললেন খালা। ‘সব তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। নেলি, তুমি আর কিছু খাবে?’
‘না খালা।’ জবাব দিল নেলি।
‘তাহলে চা খাও, আমিও চা খাব।’
‘জি, চা খেতে পারি।’
খালা উঠে গেলেন চা আনতে আর তখন নেলি ফিসফিস করে বলল, ‘কৌশিকদা ফিরে এসেছে।’
‘কী বলছিস?’
‘হ্যাঁ, আমি সকালে দেখলাম একটা ব্যাগ হাতে বাসায় ফিরছে। বাজারের ব্যাগ।’
‘তোর সঙ্গে কথা হয়েছে?’
‘না।’
রাব্বি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে নেলির দিকে। পরোটা–ডিম মুখের ভেতর যেন আটকে গেল। নিউটনের সূত্র মেনে আর গলা দিয়ে নিচে নামবে বলে মনে হচ্ছে না। ঠিক তখন তিন কাপ চা নিয়ে ফিরল ঝর্ণা খালা।
কোনোমতে নাশতা শেষ করে চা খেয়ে রাব্বি বেরোল নেলির সঙ্গে।
‘এই রাব্বি, তুমি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছ?’
রাব্বি আশ্চর্য হলো, নেলি তাকে তুমি তুমি করে বলছে!
‘ওই দিন মাঠে সবার সামনে আমাকে চোর বললি ক্যান?’
‘ইচ্ছা করেই বলেছি। তোমাকে রাগানোর জন্য।’
‘মানে?’
‘মানে...’, ঠোঁট ওলটায় নেলি। নেলির এই ঠোঁট ওলটানোর মানে অনেক কিছুই হতে পারে। সেই গবেষণায় আর গেল না রাব্বি, বলল—
‘কৌশিকদাকে সত্যিই দেখেছিস তো?’
‘বললাম তো দেখেছি। চল, ওর বাসায় যাই।’
‘চল।’
কৌশিকদার বাসায় গিয়ে দেখে সত্যি কৌশিকদা ঘরদোর পরিষ্কার করছে। ওদের দেখে বলল—
‘কী খবর তোদের?’
‘ভালো। তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’ নেলি বলে।
‘কোথায় গিয়েছিলাম মানে? আমি তো এখানেই ছিলাম। যাবটা কোথায় আমি?’
‘কিন্তু তুমি...’
নেলি হঠাৎ রাব্বির হাত চাপ দিল। রাব্বি থেমে গেল। তারপরও রাব্বি বলল—
‘তুমি কোথাও যাওনি?’
‘নাহ্।’
‘কেন, তুমি চতুর্মাত্রার জগৎ থেকে পঞ্চম মাত্রার জগতে যাওনি?’
‘মানে? কী বলছিস এসব?’ কৌশিকদার ভ্রু কুঁচকে গেল। তারপর হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা, আজ তোরা যা, আমাকে একটু বেরোতে হবে। পরে তোদের সঙ্গে কথা হবে।’
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, কৌশিকদা ওদের এড়ানোর জন্য কথাটা বলল। আসলে সে কোথাও যাবে না। কিন্তু ওরা দুজন অবশ্য আপত্তি করল না। বের হয়ে এল।
‘তুই আমার হাতে চাপ দিলি কেন?’
‘এটা অন্য কৌশিকদা।’ গম্ভীর হয়ে বলে নেলি।
‘কী বলছিস তুই?’
‘ঠিকই বলছি। কৌশিকদার স্মৃতি ওরা মুছে দিয়েছে। এত দিন যা ঘটেছে, তার কিছুই কৌশিকদার স্মৃতিতে নেই। অন্য সময় হলে আমাদের চা খাওয়াত। আজ কিন্তু তা বলল না। উল্টো মিথ্যে বলে আমাদের অ্যাভয়েড করল। আর কৌশিকদা নিজে কখনো ঘরদোর পরিষ্কার করে না। তার একটা বুড়ো বাধা বুয়া আছে, সে সপ্তাহে একবার আসে। এখন দেখছি নিজেই পরিষ্কার করতে লেগেছে। তার মানে বুঝতে পারছিস?’ নেলি গড়গড় করে একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নেয়।
‘তুই বলছিস কৌশিকদা মিথ্যা বলল?’
‘অবশ্যই। দেখিস, কৌশিকদা কোথাও যাবে না। বাসায়ই থাকবে। আমার ধারণা, সকালেই কলেজ থেকে এসেছে, ফেরার পথে বাজার করেছে, হাতে বাজারের ব্যাগ দেখলাম।’
রাব্বি আর নেলি কৌশিকদার বাসার কাছে দোকানটায় বসে চা খেল। দেখা যাক নেলির কথা সত্যি কি না। সত্যিই তাই; ঘণ্টাখানেকের মধ্যেও কৌশিকদাকে বেরোতে দেখা গেল না।
‘তোর কথাই ঠিক নেলি।’ হতাশ গলায় বলল রাব্বি।
‘চলো, ফেরা যাক। চা খাওয়ানোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।’
‘তুই হঠাৎ আমাকে তুমি তুমি করে বলছিস যে?’
‘কারণ, তুমি আমার থেকে দুই ক্লাস উঁচুতে পড়ো, তাই। আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই।’ রাব্বি তাকিয়ে দেখে, নেলি ঠোঁট চেপে হাসছে। নেলিও কি কৌশিকদার মতো বদলে গেল! রাব্বি খেয়াল করল, আগের দিন যে তারা একটা অ্যাডভেঞ্চার করে এল, তা নিয়ে সে বা নেলি কেউ কোনো কথা বলল না। তারা কথা বলছে তারও আগের দিন থেকে...। যেদিন নেলি রাব্বিকে চশমাচোর বলেছিল। যেন মাঝখানে একটা দিন নেই। কেউ মুছে দিয়েছে! নেলির বাসার সামনে এসে নেলি হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে চলে যেতে গিয়েও আবার কী মনে করে ফিরে এল।
‘তোমাকে আরেকটা কথা বলা হয়নি রাব্বি।’
‘কী?’
‘তুমি কৌশিকদার লাল পাহাড় বইটা পড়তে নিয়েছিলে না?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওটা কৌশিকদাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে?’
‘না, ওটা তো আমার বাসায়। আমার বাসায় এখন দুটো লাল পাহাড় বই।’
‘না, একটা, তোমারটা। কৌশিকদার লাল পাহাড় বইটা তার টেবিলেই দেখলাম।’
‘অসম্ভব!’
‘আমার মনে হয় কী জানো, রাব্বি?’
‘কী?’
‘প্রকৃতি ভুল কিছুকে প্রশ্রয় দেয় না। ভুল হলে সেটা ঠিক করে নেয় নিজের মতো করে। নেলি হাত নেড়ে চলে গেল তার বাসায়। আর হতভম্ব হয়ে নেলিদের বাসার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইল রাব্বি। নেলির কথাগুলো মনে হচ্ছে নেলির না। অন্য কেউ নেলিকে দিয়ে বলিয়েছে। রাব্বি দুহাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে। বসে পড়ল নেলিদের সিঁড়িতে। এসব কী হচ্ছে?
নেলির কথাই ঠিক। তার বাসায় একটা লাল পাহাড় বই। ঝর্ণা খালাও কৌশিকদার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। অথচ ওই দিন বলেছিল, কৌশিকদার সঙ্গে দেখা করে একটা থ্যাঙ্কস দেবে। দুদিন থেকে বিদায় নিল ঝর্ণা খালা। তার ফাইনাল পরীক্ষার নাকি আবার ডেট পড়েছে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ক্লান্টু এখন সারা দিন তাদের বাসার সামনে বসে থাকে। কোথাও যায় না। রাব্বিও কদিন ধরে কোথাও যায় না। মা তো একদিন বলেই ফেলল, ‘কী রে, কুনো ব্যাঙের মতো সারা দিন ঘরেই বসে থাকিস, ঘটনা কী?’
‘এমনি।’ বলে রাব্বি।
‘বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি?’
‘না তো।’
‘কী জানি বাপু, তোদের ব্যাপারস্যাপার কিছুই বুঝি না।’
মা চলে যেতেই রাব্বির মনে হলো, ইনফ্রারেড চশমাটা স্কুলের ল্যাবে ফেরত দিয়ে আসা দরকার। কিন্তু চশমাটা কোথাও পেল না। কী আশ্চর্য, ওটা যত্ন করে তার টেবিলের ড্রয়ারে রাখা ছিল। কী একটা সন্দেহ হলো। পরদিন স্কুলে গেল। দারোয়ান মজিদ রাব্বিকে দেখে বলল—
‘কী খবর রাব্বি মিয়া?’
‘মজিদ ভাই, স্কুলের ল্যাবটা একটু খুলবেন?’
‘কেন?’
‘বিজ্ঞান স্যার ইনফ্রারেড চশমার ওপর হোমওয়ার্ক লিখতে দিয়েছিলেন। সেটা লিখেছি, কিন্তু চশমার ছবিটা আঁকতে পারছি না। চশমাটা যদি একনজর দেখতে পারতাম।’
‘চা–নাশতা খাওয়ার টেকা দিবা তো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, দেব।’
‘আচ্ছা চলো।’
‘এই যে রাখেন।’ ৫০ টাকার একটা নোট এগিয়ে দেয় রাব্বি। রাব্বির বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে। এখন গিয়ে যদি দেখে, চশমাটা নেই।
৫০ টাকার নোটটা পকেটে ঢুকিয়ে শিস দিতে দিতে রওনা দিল মজিদ মিয়া। তার পিছে পিছে চলল রাব্বি। ল্যাবের দরজার তালা খোলা হলো। যে আলমারিতে চশমাটা ছিল, তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রাব্বি। তার বুকটা ধক করে উঠল। ৩ নম্বর তাকে দিব্যি শোভা পাচ্ছে ইনফ্রারেড চশমটা। অথচ এই চশমাটা দুদিন আগেও তার টেবিলের ড্রয়ারে ছিল।
‘হাতে লয়া ভালোমতো দেইখা লও।’ মজিদ বলল।
‘দরকার নেই। দেখেছি। চলেন যাই।’
‘এই দেইখাই আঁকতে পারবা?’
‘হ্যাঁ, পারব।’ কোনোমতে বলে রাব্বি। তার যেন কেমন লাগছে। নেলির কথাটা মনে পড়ল। নেলি বড়দের মতো করে বলছিল, ‘প্রকৃতি ভুল কিছুকে প্রশ্রয় দেয় না। ভুল হলে সেটা ঠিক করে নেয় নিজের মতো করে!’ তাহলে ভুলটা কে করেছিল? রাব্বি? কৌশিকদা? রনি? নেলি? চক্করবক্কর শার্ট পরা ওই লোক দুইটা? নাকি ক্লান্টু?
ফিরে এসে খেয়েদেয়ে ঘুম দিল রাব্বি। সারা দুপুর পড়ে পড়ে ঘুমাল। সন্ধ্যায় বারান্দায় এসে দেখে, ক্লান্টু দুই পায়ের মধ্যে মুখ গুঁজে ঝিমোচ্ছে। তাকে দেখে মুখ তুলে কুঁই কুঁই করল একটু। রাব্বি ক্লান্টুর পাশে বসে ওর গলা চুলকে দিতে দিতে ফিসফিস করল, ‘ক্লান্টু, এসব কী হচ্ছে রে, বল তো? তুই ওই লাল দালানটায় আর যাস না কেন?’ ক্লান্টু অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাব্বির দিকে!
তারপর একদিন কী মনে করে রাব্বি সেই লাল দালানটার ওখানে গেল। সঙ্গে অবশ্য ক্লান্টু ছিল। গিয়ে তো হতভম্ভ! দেখে, দোতলা লাল দালানটা ভাঙা হচ্ছে। প্রায় অর্ধেক ভাঙা হয়ে গেছে। বাইরে একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে, তাতে বিশাল একটা অ্যাপার্টমেন্টের ছবি আঁকা। নিচে লেখা ‘গোল্ডেন অ্যাপার্টমেন্ট হাউস’। সেই চায়ের দোকানটা এখনো আছে। সেই তিন বুড়ো বসে চা খাচ্ছে। তারা অবশ্য রাব্বিকে চিনতে পারল না।
‘একটা চা দিন না।’ রাব্বি বলে।
‘তোমার কুকুর?’ এক বুড়ো জিজ্ঞেস করে। মাথা নাড়ে রাব্বি।
‘কী নাম?’
‘ক্লান্টু।’
‘সেই ষাটের দশকে আমারও একটা কুকুর ছিল, সরাইল হাউন্ড।’ আরেক বুড়ো বলতে শুরু করে। তারা আগে কী নিয়ে আলোচনা করছিল কে জানে। তবে এখন ওদের আলোচনার বিষয় কুকুর। সরাইল হাউন্ড, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই কুকুর পৃথিবীবিখ্যাত...
‘ওরে একটা বিস্কুট খিলাও।’ দোকানদার বলে। দোকানদারটাকে বেশ ভালো মনে হচ্ছে। আগেরবার যখন কৌশিকদার সঙ্গে এসেছিল, তখন ব্যাটাকে বদ মনে হয়েছিল। লোকটা নিজেই একটা টোস্ট বিস্কুট ছুড়ে দিল ক্লান্টুর দিকে। ক্লান্টু শুঁকল বিস্কুটটা কয়েকবার, তারপর কামড়ে কামড়ে খেতে লাগল। চা খেতে খেতে রাব্বি ভাঙা লাল দালানটা দেখছিল।
‘তোমার নাম কী?’ একটা বুড়ো তাকে জিজ্ঞেস করে।
‘আমার নাম?’ রাব্বি তাকায় ওদের দিকে। তারা তিনজনই একসঙ্গে মাথা নাড়ে। আর কী আশ্চর্য, রাব্বি কিছুতেই তার নাম মনে করতে পারছে না। যেন তার কোনো নাম নেই। তার মনে পড়ল। লাল পাহাড় বইটার সেই ছেলের কোনো নাম ছিল না। তার একটা নম্বর ছিল, ১৮১-৪০-৫৭৭। রাব্বির কেন যেন মনে হচ্ছে, নম্বরটা বলে...!