মোমিন চিকিৎসার জন্য বেশ নামীদামি একটা হাসপাতালে এসেছে।
সবকিছুর দামই একটু বেশি এখানে। পিজি হাসপাতালে ত্বকের বায়োপসি করাতে খরচ করতে হয় ৫০০ টাকা। এখানে সেটার বিল ১১ হাজার টাকা। ২১০০% বেশি। ৫০০ টাকা অবশ্য অনেক কম, সরকারি চিকিৎসালয় ছাড়া ওই দামে বায়োপসি করানো সম্ভব নয়। তবে ১১ হাজার টাকা রাখাটাও অতিরিক্ত।
এ মুহূর্তে মোমিন শুয়ে আছে অপারেশন বেডে। ১১ হাজার টাকা খুইয়ে ফেলার যন্ত্রণা তাকে ভোগাচ্ছে কি না, কে জানে। উপায়ও নেই অবশ্য। এই হাসপাতালে করানো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এখানকার বিশেষজ্ঞরা ওর ফাইল ছুঁয়েও দেখবেন না। যস্মিন যদাচার।
হিস্টোপ্যাথলজির সার্জন এলেন। প্রথমে ঢুকেই নাক কুঁচকে ফেললেন তিনি। অদ্ভুত কটু একটা গন্ধ ধাক্কা দিল সেখানে। পাত্তা দিলেন না ডাক্তার। হাসপাতালে কাজ করতে গেলে অনেক অদ্ভুত গন্ধই ফুসফুস ভরে নিতে হয়। মোমিনের ফাইল খুলে দেখলেন প্যাথলজিস্ট। সবার আগে সার্জিক্যাল প্যাথলজির রিকুইজিশন ফরম। সেখানে ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রি হিসেবে দেওয়া আছে স্কেলি প্যাচ, হিস্ট্রি অব ক্যানসার নেই, ক্লিনিক্যাল ডায়াগনসিসে বিশেষজ্ঞ সোরাইসিস অথবা লাইকেন প্ল্যানাস হিসেবে সন্দেহ করছেন; আর সাইট হচ্ছে পা।
‘কেমন আছেন, মোমিন সাহেব?’ জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার। ফরমের কোনায় সাঁটানো স্টিকার দেখে মোমিনের নাম জেনে নিয়েছেন তিনি।
‘জ...জি। ভালো। ভালো আছি।’
‘নার্ভাস বোধ করছেন?’ মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন প্যাথলজিস্ট। ‘নার্ভাস হওয়ার কোনো কারণ নেই। একদম রুটিন প্রসিডিউর। কিছু টেরই পাবেন না।’
‘জি,’ বলল মোমিন।
‘কই দেখি আপনার পা?’
মোমিন দেখাল, ডাক্তার তাকে একদিকে কাত হতে নির্দেশ দিলেন। আগেই একজন নার্স ক্ষতের আশপাশে থাকা লোমগুলো চেঁছে দিয়েছেন। পায়ের ওপর দগদগে ঘায়ের দিকে আরও আলো ফেললেন প্যাথলজিস্ট। ঘা খুব একটা বেশি জায়গাজুড়ে নয়। ডাক্তার সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেল। কেমন দগদগে নীলাভ একটা ভাব ক্ষতটির। আকারে প্রায় দুই ইঞ্চির মতো হবে। রোগীর ফাইলটা আবার হাতে নিলেন ডাক্তার সাহেব। আজকেই মোমিন প্রথম এসেছে এই অত্যাধুনিক প্রাইভেট হাসপাতালে।
‘কোনো অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছেন কি?’ মোমিনকে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার।
‘জি না।’
‘সম্প্রতি খেয়েছেন?’
‘জি না।’
‘ওহ। এই দাগ আপনার কত দিন ধরে?’
‘অনেক দিন। হিসাব নেই।’
ভ্রু কুঁচকে গেল ডাক্তার সাহেবের। এত দিনে সেকেন্ডারি ইনফেকশন শুরু হয়ে গেছে কি না কে জানে। সে রকম হলে সেটা সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অত ভেবে কাজ নেই, নিজেকে প্রবোধ দিলেন প্যাথলজিস্ট। চর্মরোগবিশেষজ্ঞের ডায়াগনসিস হিসেবেই এগোতে হবে তাঁকে।
‘প্রেসের ব্যাপার’ বলতে এখানে গণমাধ্যমকে বোঝানো হয়েছে। এই পাঁচজন দেশের অন্যতম ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছেন। নিজেদের ক্ষমতাবলে ওই হাসপাতালে গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার খর্ব করে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য বেশি দিন চাপা থাকবে না এই বিষয়। এতগুলো মানুষ একসঙ্গে ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ব্যাপার চাপা রাখাটা তাদের এই অমিত ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।
লাইডোকেন বা লোকাল অ্যানেসথেটিক দেওয়া হলো। সফলভাবে সম্পন্ন করা হলো পাঞ্চ বায়োপসি। মোমিনের পা থেকে ক্ষতস্থানের বেশ খানিকটা তুলে ফেলা হলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নিমিত্তে।
‘ডাক্তার সাহেব, আপনি কি আমার ঘা-টা খালি হাতে ধরেছেন?’ আচমকা জিজ্ঞেস করল মোমিন।
হাসলেন না প্যাথলজিস্ট। ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত হওয়ার পর হরেক রকমের কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। এখন আর ধৈর্যচ্যুতি হয় না সহজে।
‘খালি হাতে ধরব না। আমার হাতের জীবাণু আপনার থেকে নেওয়া স্যাম্পলে চলে গেলে তো লাভ নেই। তখন আর বোঝা যাবে না আপনার আসলে কী হয়েছে, তাই না?’
‘আমার জন্য বলছি না, স্যার। আপনার কথা ভেবেই বললাম। তবে এখন গ্লাভসের ভেতর দিয়ে যদি এই জিনিস কাজ করে, তাহলে ভিন্ন কথা।’
ডাক্তার সাহেব পাত্তা দিলেন না। রোগীদের কথা বোঝা তাঁর কাজ নয়। কাজ আপাতত মোমিনের পা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা।
‘এখন ও কতটা শক্তিশালী, আমি জানি না।’ বলে চলল মোমিন।
‘ও যতটাই শক্তিশালী হোক না কেন, আমরা তার চাইতেও বেশি শক্তিশালী।’ হেসে বললেন ডাক্তার। কোথায় যেন সেই হাসির আড়ালে সূক্ষ্ম একটা শ্লেষ্মাত্মক রেশ ছিল। ‘আপনি ভাববেন না। বায়োপসির রেজাল্ট আজকে সন্ধ্যায় পাবেন। ঠিকমতো ওষুধ খেয়ে নেবেন। ওই জায়গা শুকনা রাখবেন। গোসলের সময় পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেবেন। পানি লাগতে দেবেন না।’
নমুনা সংগ্রহের পর সেই ক্ষতের জায়গাটুকু সেলাই করে দিয়েছেন ডাক্তার। ফসফেট বাফারে থাকা ফরমালিনে আপাতত সংরক্ষণ করা আছে নমুনা। মোমিন আজকের শেষ রোগী ছিল। একে একে সব কটি স্যাম্পল নিয়ে বসতে হবে, তারপর ফলাফল দিতে হবে প্যাথলজিস্টকে।
মোমিনের নমুনাসহ টেস্টটিউবটি ল্যাবের ভেতরে অদূরের এক ডেস্কে পাঠানো হলো। সেখান থেকে মাইক্রোস্কোপিক স্লাইড তৈরি করা হবে। আপাতত জমে থাকা কাজগুলো নিয়ে বসে পড়লেন ডাক্তার সাহেব। বেশ কয়েকটা স্লাইড চলে এসেছে তাঁর মাইক্রোস্কোপের কাছে। প্রথম স্লাইডটিতে চোখ বোলাতে যাবেন ডাক্তার, এমন সময় ল্যাবের অন্য প্রান্ত থেকে চিৎকার–চেঁচামেচি ভেসে এল। প্যাথলজিস্ট ভদ্রলোক বিরক্তবোধ করলেন। মনোযোগসহকারে বিভিন্ন রোগবালাই শনাক্ত করাটা তাঁর কাজ। এর মধ্যে ল্যাবের ভেতরে এ রকম চেঁচামেচি একদমই কাম্য নয়। ডাক্তার সাহেব প্রথমে ভাবলেন, চিল্লাপাল্লা নিজ থেকে থেমে যাবে। সেটা না হওয়ায় যথেষ্ট বিরক্ত বোধ করলেন। দুদ্দাড় করে এগিয়ে গেলেন ল্যাবের অন্য অংশের দিকে। রাগে ফুঁসতে শুরু করেছেন তিনি।
সেখানে গিয়ে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। হালকা ঝাঁজালো গন্ধটা নাকে এসে লাগল প্রথমে। তারপর দেখতে পেলেন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের নমুনা। টেস্টটিউবটি ভেঙে চৌচির হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। ভাঙা কাচ আর ছড়িয়ে পড়া ফরমালিন দ্রবণের মধ্যে পড়ে আছে নমুনাটুকু।
‘এই! এখানে এত চেঁচামেচি কিসের?’ সরোষে বললেন ডাক্তার।
‘স্যা...স্যা...এই জিনিসটা ন...ন...ন...’ কথা শেষ করতে পারল না ল্যাব টেকনিশিয়ান। হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো কাঁপছে সে। এয়ারকন্ডিশনার থাকার পরও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিচ্ছে।
‘এই জিনিস কী? এত কেয়ারলেস কেন তোমরা? একটা স্যাম্পল রাখতে পারো না ঠিকমতো!’ ধমকে উঠলেন প্যাথলজিস্ট। তবে এ ধরনের অবস্থা থেকে বের হওয়ার উপায় তিনি জানেন। প্রথমত মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্যাম্পল ফরমালিন আর একদম লঘু স্যালাইন সলিউশনে ওয়াশ করে নিতে হবে। এতে ক্রাস্টসহ অনেক জায়গার ক্ষতি হতে পারে, তবে উপায় নেই। রোগীকে তো আরেকবার ডেকে নমুনা সংগ্রহ করা যাবে না। একদম ১০০ ভাগ সঠিক ফলাফল এতে আসবে না। হয়তো ‘ইনকনক্লুসিভ’ বা অমীমাংসিত রায় দিতে হবে শেষমেশ। রোগী বেচারাকে আবারও করতে হতে পারে এই পরীক্ষা।
তবে এই বেখেয়ালি ল্যাব টেকনিশিয়ানকে দেখে নিতে হবে, মনে মনে ঠিক করলেন ডাক্তার। ম্যানেজমেন্টের কাছে একদম বিধ্বংসী এক প্রতিবেদন দেবেন এই টেকনিশিয়ানের ব্যাপারে।
‘এখন ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তোলো এই স্যাম্পল!’ ধমকে উঠলেন ডাক্তার। কেউ যখন নড়ছিল না, তখন নিজে এগিয়ে গিয়েই তুলে নিলেন নমুনাটুকু।
এবং আচমকা থেমে গেলেন।
ডাক্তার সাহেব খেয়াল করেননি যে তাঁর হাতে আর ল্যাটেক্সের দস্তানা নেই। অনেক আগেই খুলে ফেলেছেন। এমনকি তার নতুন জুতার নিচে কাচের টুকরাও পড়ল বেশ কয়েকটা। নমুনাটুকু খালি হাতে ছোঁয়ার পরপরই একদম জায়গায় জমে গেলেন তিনি।
*
হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজে অবশ্য এত কিছু ফুটে ওঠেনি। সেখানে দেখা গেছে, মোমিনের আগমন, তার ক্ষতর নমুনা সংগ্রহ, আচমকা ল্যাব টেকনিশিয়ানের ভয় পেয়ে টেস্টটিউব ভেঙে ফেলা, ডাক্তারের রাগান্বিত হয়ে সেদিকে যাওয়া এবং সবশেষে মেঝে থেকে ডাক্তারের ওই স্যাম্পল তোলার চেষ্টা করা।
ব্যস।
এরপর একটি তীব্র সাদা আলোর স্ফুরণ ঘটে। তারপর সিসিটিভি ক্যামেরাটি বিকল হয়ে যায়। একে একে হাসপাতালের ওই ফ্লোরে থাকা সব ক্যামেরা বিকল হয়ে যায়।
ভিডিওটি এই নিয়ে ১৬ বার চালানো হলো। বাংলাদেশের কোনো এক অজানা, সুরক্ষিত এলাকায় অবস্থিত এই কনফারেন্স রুমটার ভেতরে চলছে অতি গোপনীয় এক মিটিং। সেখানে উপস্থিত আছেন দেশের সুরক্ষায় নিয়োজিত থাকা একদল করিতকর্মা মানুষ। সংখ্যায় মোট পাঁচজন।
‘জেন্টলম্যান। আই অ্যাম ওপেন টু সাজেশনস। এ অবস্থায় কী করা উচিত আমাদের?’
কথাটি বললেন সবচেয়ে প্রবীণ এবং উচ্চপদস্থ লোকটি। উর্দি জানান দিচ্ছে, মেজর জেনারেল পদে আছেন তিনি। কাঁচাপাকা চুল। কায়দা করে রাখা গোঁফেরও বেশ কয়েক জায়গায় পাক ধরেছে।
‘স্যার, ইফ আই মে?’ হাত তুললেন নবীনতম সদস্য। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালেন মেজর জেনারেল।
‘স্যার প্রেসের ব্যাপারটা আর নমুনা কালেকশন যেহেতু হয়ে গেছে, আমাদের উচিত এখন প্রতিটি উদ্ধারকৃত জিনিস খুঁটিয়ে দেখা।।’
‘প্রেসের ব্যাপার’ বলতে এখানে গণমাধ্যমকে বোঝানো হয়েছে। এই পাঁচজন দেশের অন্যতম ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করছেন। নিজেদের ক্ষমতাবলে ওই হাসপাতালে গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার খর্ব করে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য বেশি দিন চাপা থাকবে না এই বিষয়। এতগুলো মানুষ একসঙ্গে ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ব্যাপার চাপা রাখাটা তাদের এই অমিত ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।
‘তার ব্যবস্থাও হয়েছে, মেজর। সিএমএইচ থেকে আসা প্যাথলজিস্টের দলটা তো আমাদের মিটিংয়ের শুরু থেকে স্যাম্পল পরীক্ষা করে যাচ্ছে। আচ্ছা যে রোগীটা থেকে ওই হাসপাতালের ওরা স্যাম্পল নিয়েছিল, তার রেকর্ড কী বলে?’
‘ডেড এন্ড, স্যার। ছেলেটার নাম মোমিন।’
‘হাসপাতালের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিল যেহেতু, কোনো ফোন নম্বর তো নিশ্চয়ই ব্যবহার করেছে।’
‘জি, স্যার। কিন্তু সেটা ওর নামে রেজিস্টার্ড না। এমনকি ওর কোনো আত্মীয় বা পরিচিতর নামেও না। সিমটা যার নামে রেজিস্টার্ড সে তিন মাস আগে মারা গেছে। সিলেটের বাসিন্দা। নাম আবদুর রউফ। প্রিস্টিন ব্যাংকে ছিল সিনিয়র অফিসার হিসেবে।’
‘হুম।’ বললেন মেজর জেনারেল। তাঁর মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এই মোমিন ছেলেটিকে পাকড়াও করতে পারলে অনেক কিছু বোঝা যেত। শহরে আচমকা কিছু জায়গায় বেড়ে গেছে তেজস্ক্রিয়তা। এসব জায়গায় যাওয়ার পর সালফারের কটু গন্ধ সবার আগে ধাক্কা মারে নাকে। এই দামি প্রাইভেট হাসপাতালেও এ রকম আচমকা তেজস্ক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল। জেনারেলদের প্রতিষ্ঠান তটস্থ ছিল, সারা শহরে এই তেজস্ক্রিয়তার খোঁজে তারা টহল চালাচ্ছিল। তবে এভাবে সবার জ্ঞান হারানোর মতো ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।
ফ্রস্টেড গ্লাসের দরজায় টোকা পড়ল। মেজর জেনারেল অনুমতি দিলেন জলদগম্ভীর গলায়। দরজা খুলল, ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন টেকনিশিয়ান।
‘স্যার, দ্রুত একটু ওয়ার্ডে আসতে হবে।’
পাঁচজনই একসঙ্গে ওয়ার্ডে ঢুকলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের নাক চেপে ধরলেন। সালফারের গন্ধ একদম তুঙ্গে পৌঁছে গেছে। সারি সারি বেডে শুয়ে আছে সেই প্রাইভেট হাসপাতালের ওই ফ্লোরে কর্মরত সব কলাকুশলী। কারোরই জ্ঞান নেই। এত বেড ওদের ফ্যাসিলিটিতে ছিল না। বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা হয়েছে।
‘কী হচ্ছে এখানে?’ বাজখাঁই গলায় জিজ্ঞেস করলেন মেজর জেনারেল। হঠাৎ বুঝতে পারলেন, কামরার ভেতর বেশ অস্বাভাবিকতা বিরাজ করছে। কেউ কোনো নড়াচড়া করছে না।
শিগগিরই প্যাথলজিস্ট দলের একজন এসে মেজর জেনারেলের হাত স্পর্শ করল।
সবাই দেখতে পেল মেজর জেনারেল মহাশয় ঠায় নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন। একদম স্থাণুর মতো।
মেজর জেনারেল সাহেব কী দেখছিলেন, সেটা অন্তত তখন তার দলের কেউ দেখতে পেল না।
তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে। সেন্ট্রাল এয়ারকন্ডিশনার কেন কাজ করছে না, তাঁর মাথায়ও এল না। নিচে তাকিয়ে দেখলেন, শক্ত মাটি। তাপের কারণে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। একদম খোলা আকাশের নিচে আছেন তিনি। আশপাশে তাকিয়ে ধন্ধে পড়ে গেলেন মেজর জেনারেল মহাশয়। দেখতে পেলেন কিছু পরিচিত মুখ। এরা সবাই প্যাথলজিস্ট টিমের মানুষজন না? আরও কিছু মানুষ দেখতে পেলেন তিনি। এক সেকেন্ড পর বুঝলেন, এরা সবাই সেই প্রাইভেট হাসপাতালের কর্মী-ডাক্তাররা। এরা এখানে কী করছে? তিনিই–বা এখানে এলেন কী করে?
আচমকা জেনারেলের ওপর একটা বিশাল ছায়া পড়ল। ওপরে তাকানো মাত্র ভয়ে জমে গেলেন মেজর জেনারেল সাহেব। রাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত সব ক্ষমতাকে অতি ঠুনকো মনে হতে লাগল তাঁর। বুঝতে পারলেন, তিনি তাকিয়ে আছেন একটা প্রকাণ্ড কুৎসিত চোখের দিকে। যে চোখ তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ওপরে। ঠিক তাঁকে নয়, তাঁর ভেতরের পুরো সত্তাকে যেন। কারণ, মেজর জেনারেল সাহেব তাঁর নিজের দেহকে অনুভব করতে পারছেন না। তিনি আচমকা সব বুঝতে পারলেন। এই হিংস্র চোখটি আদতে শুষে নিতে চাইছে তাঁকে। তাঁর একার কোনো অস্তিত্ব আর থাকবে না। তিনি হয়ে যাবেন সমষ্টিগত একটি সত্তার অংশমাত্র। এই অদ্ভুত ফেটে যাওয়া জমিনে থাকা সবাইকেই এই ভাগ্য বরণ করে নিতে হবে। ঠিক যেমন মোমিনের হয়েছিল। এখন সেই মোমিনের কোনো পৃথক অস্তিত্ব নেই। এই চোখই মোমিন, মোমিন তার ক্ষুদ্র একটি অংশ।
চাইলেও এই মিলনকে বাধা দেওয়া সম্ভব নয়।