কাহিনি রচনা: কাজী শাহনূর হোসেন | তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর: শামসুদ্দীন নওয়াব
সাত
‘কিন্তু আমরা তো এর মধ্যেই সবকিছু দেখে ফেলেছি,’ বলে কার্পেটে বসে পড়ল মুসা।
মাছের ট্যাংকটার কাছে গিয়ে খাবারের কনটেইনারটা তুলে নিল রবিন।
‘ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত,’ বলল ও। ‘পানিতে খাবার ভাসছে। তোমরা কি কেউ খাবার দিয়েছ?’
‘না,’ বলল কিশোর।
‘আমিও না,’ জানাল মুসা।
পানিতে ভাসা খাবারের দিকে চেয়ে রইল রবিন।
‘তাহলে কেউ দিয়েছে,’ বলল।
‘হয়তো মাছের পরি,’ বলল মুসা।
‘হায় খোদা!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
‘কী হলো?’ প্রশ্ন করল কিশোর। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। সে আর কিশোর শশব্যস্তে এগিয়ে এল।
‘দেখো, নিচে কী!’ বলে পানি ভেদ করে তর্জনী নির্দেশ করল রবিন।
কাচে নাক ঠেকাল মুসা।
‘দেখে তো মনে হচ্ছে একঝাঁক পাথরের টুকরা।’
ভ্রু কোঁচকাল রবিন।
‘একজন গিয়ে আলোটা নেভাও,’ বলল।
কিশোরকে ঠেলা দিল মুসা।
‘তুমি যাও।’
দেয়ালের কাছে গিয়ে সব কটা সুইচ অফ করল কিশোর। বাজনা, ফ্যান, আলো বন্ধ হয়ে গেল।
ট্যাংকের নিচে আঙুল তাক করল রবিন।
‘সবুজ পাথরটা আলো ছড়াচ্ছে দেখেছ? আমার মনে হয় ওটাই পান্নাটা!’
মুসাকে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে পাথরটার দিকে চাইল কিশোর।
‘না, এটা অনেক বড়। পান্নাটা গলফ বলের সমান ছিল।’
‘পানির নিচে জিনিস সব সময় বড় দেখায়, চোখ তোমাকে আবারও ধোঁকা দিচ্ছে, কিশোর!’ বলল রবিন।
রবিন হাত ডুবিয়ে দিয়ে ট্যাংক থেকে সবুজ পাথরটা তুলে আনল। জিনসে ওটাকে মুছতেই মেঝেতে পানির ফোঁটা পড়ল।
মিশেলকে ওরা সোজা মাছের ট্যাংকের দিকে আসতে দেখল। ওখানে পৌঁছে মাছদের উদ্দেশে চুমুর শব্দ করলেন তিনি। এবার খাবারের প্যাকেট তুলে নিয়ে খানিকটা খাবার ছিটালেন। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেলেন।
বাইরে বের করে আনাতে এখন আর অন্যান্য পাথরের মতো লাগছে না ওটাকে। ট্যাংকের আলোয় উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়াচ্ছে পাথরটা।
‘খাইছে! দুর্দান্ত!’ বলে উঠল মুসা।
‘এটা ওখানে গেল কীভাবে,’ প্রশ্ন করল কিশোর।
‘মনে হয় চোর রেখে গেছে,’ বলল মুসা।
‘কিন্তু চোর অমন কাজ করবে কেন?’ কিশোরের প্রশ্ন।
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘চট করে জিনিসটা লুকানোর দরকার ছিল,’ বলল ও।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
‘জেমস এখানে সকাল সকাল এসেছিল। কাজটা হয়তো ওরই!’ বলল।
‘আলো জ্বেলে দিচ্ছি,’ বলে দেয়ালের দিকে এগোল মুসা।
‘থামো!’ বলে উঠল কিশোর! ‘শব্দটা কিসের?’
‘কই শব্দ?’ বলে সব কটা সুইচ অন করে দিল মুসা।
কিশোর এগিয়ে গিয়ে সুইচগুলো অফ করে দিল।
‘এখন শোনো, শুনতে পাচ্ছ?’ আঁধারে ফিসফিসিয়ে বলল।
‘মনে হচ্ছে গুঞ্জনধ্বনি,’ বলল রবিন।
‘হয়তো মাছের ট্যাংকের শব্দ,’ বলল মুসা।
বাব্লার অফ করে দিল রবিন।
‘না, এখনো শোনা যাচ্ছে,’ বলল।
‘এখন আমিও শুনতে পাচ্ছি। কিসের শব্দ? সব তো বন্ধ,’ বলল মুসা।
‘শুধু বাতিগুলো জ্বেলে দেখি,’ বলল কিশোর।
দৃষ্টি স্বচ্ছ হলে ছেলেরা অফিসটায় তল্লাশি চালাতে লাগল।
বুককেসের সামনে থমকে দাঁড়াল কিশোর।
‘শব্দটা এখানে জোরাল!’ বলল।
হেসে ফেলল মুসা।
‘দ্য কেস অব দ্য বাজিং বুকস!’ বলল ও।
পায়ের ডগায় ভর দিয়ে তাকে হাত চালাল কিশোর। ছোট্ট এক বোতাম খুঁজে পেয়ে টিপে দিল। হঠাৎই এক তাক হড়কে খুলে গেল।
‘দেখো!’ চেঁচিয়ে উঠল ও।
‘খাইছে, বইগুলো ভুয়া! এটা গোপন খুপরি,’ বলল মুসা।
খুপরির মধ্যে ছোট এক টিভি সেট আর ভিসিআর। খুপরিটা খোলাতে গুঞ্জনধ্বনিটা জোরাল হয়েছে। এবার ভিসিআর ‘টিক’ করে উঠলে শব্দ থেমে গেল।
‘রিওয়াইন্ড হচ্ছিল,’ মুসা বলল, ‘নিশ্চয়ই টেপের শেষে চলে এসেছিল।’
‘কিন্তু কী রিওয়াইন্ড করছিল?’ কিশোর প্রশ্ন করল।
এবার আবারও টিক করে উঠল ভিসিআর। লাল এক বাতি জ্বলে উঠল, তারপর কাউন্টআপ শুরু হলো—১, ২, ৩...
‘খাইছে, ওটা রেকর্ডিং করছে!’
‘হিরু চাচা হয়তো নিরাপত্তার জন্য এটা রেখেছেন,’ বলল রবিন।
‘তুমি মনে হয় ঠিকই বলেছ,’ বলল কিশোর। ছাদের দিকে চোখ বোলাল। ‘অফিসের কোথাও নিশ্চয়ই ক্যামেরা আছে।’
‘আমরা ভিডিও হয়ে গেছি, তাই না? দেখা দরকার।’ বলল রবিন।
‘ঠিক বলেছ!’ বলল মুসা।
টেপটা রিওয়াইন্ড করে টিভি অন করল কিশোর। প্লে বাটন চাপল। পর্দায় এক ছবি ফুটল। দেখা গেল, ওরা টিভি আর ভিসিআরের সামনে দাঁড়িয়ে।
‘খাইছে!’
এবার ছবিটা লাফিয়ে পাল্টে গেল। এখন অফিসটা ফাঁকা আর অন্ধকার। অফিসের দরজা খুলে গেল। জেমস ব্রাউন ঢুকল ভেতরে।
‘নিশ্চয়ই আজকে সকালের ছবি,’ বলল রবিন। ‘জেমস আমাদের আগে এখানে এসেছিল।’
‘হয়তো পান্না চুরি করছে সেটা রেকর্ড হয়ে গেছে,’ বলল মুসা।
ছবিতে দেখা গেল জেমস বাতিগুলো জ্বালল। এরপর রেইনকোট খুলে নিজের অফিসে গিয়ে ঢুকল।
পরস্পর মুখ তাকাতাকি করল তিন বন্ধু। জেমস বাক্সটার ধারেকাছে যায়নি।
‘ফাস্ট ফরওয়ার্ড দাও,’ বলল মুসা। ‘সামনে কী আছে দেখি।’
কিশোর বাটন টিপতেই শোঁ শোঁ করে সামনে এগোল টেপ। কেঁপে উঠল পর্দার ছবি।
‘দেখো!’ বলে উঠল রবিন। ‘কিছু একটা ঘটছে!’
‘কিশোর প্লে বাটন টিপে দিল। টেপটা ধীর হয়ে এল। দেখা গেল হিরু চাচা আর ওরা অফিসে হেঁটে ঢুকছে।
জেমস ব্রাউনের সঙ্গে দেখা হলো ওদের। এবার হিরু চাচা ড. ক্রুককে ঢুকতে দিল। বাক্সটা খোলা হলো আবারও, প্রতিটা প্যাকেজ পরখ করলেন ড. ক্রুক।
‘এবার জাগুয়ারটা বাক্স থেকে বের করা হবে,’ বলল কিশোর।
‘আর ডক্টর বলবেন জিনিসটা নকল,’ মুসা যোগ করল।
পর্দার দিকে ইশারা করল রবিন।
‘এখানে উনি ফ্ল্যাশলাইট বের করেন।’
‘কিশোর আর আমি শেড টেনে বাতি নিভিয়ে দিই,’ বলল মুসা।
ছবি কালো হয়ে গেল।
এরপর দেখা গেল ড. ক্রুকের ফ্ল্যাশলাইটের আলো। এবার সেটাও নিভে গেল।
‘এ সময় তুমি তার ফ্ল্যাশলাইট খুঁজে দাও,’ রবিন বলল মুসাকে।
এক মিনিট বাদে ড. ক্রুক ফ্ল্যাশলাইট হাতে পান্নাটায় আলো ফেলেন।
এবার আলো ফিরে আসে। একটু পরেই উদয় হন সেলিনা হায়েক এবং তারপর পুলিশ আসে। টেপে দেখা যায় সবাই অফিস ত্যাগ করছে।
কিশোর হাত বাড়িয়ে স্টপ বাটন টিপল।
‘দাঁড়াও! মিশেল আর সেলিনা হায়েকের ব্যাপারে কী হবে?’ রবিনের প্রশ্ন।
‘ও, হ্যাঁ।’
একটুক্ষণ ফাঁকা অফিসটা পরীক্ষা করল ওরা। কিশোর টেপের আগে কী আছে দেখতে যাবে, এ সময় খুলে গেল জেমস ব্রাউনের অফিসের দরজা। মিশেল ভেতরে ঢুকলেন!
‘গোপন দরজাটার সঙ্গে মিশেলের কিচেনের যোগাযোগ আছে,’ বলল রবিন।
মিশেলকে ওরা সোজা মাছের ট্যাংকের দিকে আসতে দেখল। ওখানে পৌঁছে মাছদের উদ্দেশে চুমুর শব্দ করলেন তিনি। এবার খাবারের প্যাকেট তুলে নিয়ে খানিকটা খাবার ছিটালেন। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেলেন।
পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তিন বন্ধু।
‘মনে হয় উনি চোর নন,’ বলল মুসা।
টিভির দিকে ফিরে চাইল রবিন।
‘সেলিনা হায়েকের ব্যাপারটা?’
আরও কিছুক্ষণ টেপটা দেখল ওরা, কিন্তু সেলিনা হায়েক এলেন না। শেষমেশ নিজেদেরকে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখল।
কিশোর টেপটা থামিয়ে রিওয়াইন্ড বাটন চাপল।
‘হিরু চাচা পুলিশকে টেপটার কথা বললেন না কেন?’ মুসা বলল। ‘এটা দেখলে ওরা অন্তত বুঝত জেমস আর মিশেল পান্নাটা চুরি করেনি।’
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
‘মিশেল জানতেন না পান্নাটা মাছের ট্যাংকে আছে,’ বলল। ‘কাজেই বলা যায় জাঁ পিয়েরে ওটাকে ওখানে রাখেননি।’ বিষণ্ন দেখাল ওকে। ‘আর সেলিনা হায়েক যদি অফিসে না-ই ঢুকে থাকেন...’
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রবিন।
‘তার মানে—’
‘হিরু চাচাই একমাত্র সাসপেক্ট!’ বলল কিশোর।
আট
‘কিন্তু হিরু চাচা পান্নাটা নিতে পারেন না, কেননা আমরা সর্বক্ষণ তার সঙ্গে ছিলাম। তা ছাড়া টেপেও কিছু দেখা গেল না,’ বলল রবিন।
কিশোরের মনটা বিমর্ষ।
‘বাতি নিভিয়ে দেওয়ার পর নিতে পারে না?’
‘ব্যাপারটা এত কম সময়ের জন্য ছিল যে কীভাবে তাঁর পক্ষে’—বলল রবিন।
‘খাইছে! ডেস্কটা দেখো! কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ছে?’ হঠাৎই বলে উঠল মুসা।
হিরু চাচার ডেস্কের দিকে চাইল কিশোর আর রবিন।
‘কী বলতে চাইছ তুমি? ব্লটার আর লেটার ওপেনার ছাড়া কিছুই তো নেই। এগুলো কালকে আর আজকে সকালেও দেখেছি,’ বলল কিশোর।
ভিসিআরের প্লে বাটন দাবাল মুসা। ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে নিয়ে এল, যেখানে রুমটা আর সবাইকে দেখা যাচ্ছে।
‘দেখো! লেটার ওপেনারটার ফলা জানালার দিকে তাক করা, তাই না?’ বলল মুসা।
‘হ্যাঁ, তাতে কী?’ কিশোর বলল।
‘এক সেকেন্ড অপেক্ষা করো, দেখতে পাবে।’
ছবিতে বাতি নিভে গেছে। ড. ক্রুক ফ্ল্যাশলাইটটা রত্নটার ওপরে ধরার পরে বাতি ফিরল।
‘এখন দেখো!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ‘লেটার ওপেনারটার ফলা জানালার দিকে নেই। ঘুরে গেছে!’
‘তাতে কী?’ রবিনের জিজ্ঞাসা।
‘জানি না, কিন্তু বাতি যখন ছিল না, তখন কেউ একজন লেটার ওপেনারটা তুলে নেয়, এরপর আবার নামিয়ে রাখে,’ জানাল মুসা।
‘কে সবচেয়ে কাছে দাঁড়িয়ে ছিল?’ স্টপ আর রিওয়াইন্ড বাটন চেপে বলল কিশোর।
‘মনে হয় ড. ক্রুক,’ বলল মুসা। ‘তিনি জাগুয়ারের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। লেটার ওপেনারটা ছিল মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে।’
‘কিন্তু আঁধারে তার লেটার ওপেনার লাগবে কেন?’ রবিনের প্রশ্ন।
ঠিক এ সময় অফিসের দরজার বাইরে থপথপ শব্দ শোনা গেল। কেউ যেন কার্পেটে পা দাপাচ্ছে।
‘কে ওটা?’ ফিসফিস করে প্রশ্ন করল রবিন।
ঢোঁক গিলল মুসা।
‘খাইছে, দরজাটা বন্ধ নাকি?’
‘মনে হয় না!’ পাল্টা ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর। দেয়ালের সুইচগুলোতে একটা হাত বোলাল ও। মাছের ট্যাংকের ওপর ছোট্ট এক বাতি জ্বলছে শুধু। সারা ঘর অন্ধকার।
‘দেখো!’ বিড়বিড় করে বলল মুসা। দরজার ফ্রস্টেড গ্লাসের জানালা ভেদ করে দীর্ঘ এক ছায়ামূর্তি দেখতে পেল ওরা।
টিক করে শব্দ উঠল, এরপর খুলে গেল দরজা।
‘পালাও! জেমসের অফিসে!’ ফিসফিসে কণ্ঠে জরুরি তাগিদ দিল কিশোর।
ছোট অফিসটায় দৌড়ে ঢুকে পড়ল ছেলেরা। দরজাটা সামান্য ফাঁক করে রেখেছে কিশোর, কে ঢোকে দেখার জন্য।
ড. ক্রুক।
চলবে...