এক যে ছিল সিংহ। নিজের সম্পর্কে খুবই উঁচু ধারণা তার। অহংকারে সারাক্ষণ গটমট করতে থাকে। মাটিতে যেন পা পড়ে না তার, এমন অবস্থা। বনের অন্য পশুপাখি যারা আছে, কাউকে সে পাত্তাই দেয় না।
একদিন সিংহ খেয়েদেয়ে আরাম করছিল। চমত্কার খাওয়াদাওয়া হয়েছিল তো, জোশ খানার পর ঘুমটাও হয়েছে বেশ। আয়েশভরে হাই তুলতে তুলতে সে আপনমনে বলে,
‘আহ্ কী শান্তি! কী ভাগ্য আমার, দেখো তোমরা সবাই। সত্যি, রাজকপাল নিয়ে জন্ম হয়েছে আমার। কী বিপুল তেজ ও শক্তি আমার গায়ে। এমনটা এ জগতের অন্য কারও নেই। কাউকে ভয় করার কোনো কারণই নেই আমার। সে জন্যই তো আমি এই বনের রাজা। আমার আশপাশে দেখতে পাচ্ছি পুঁচকে মশার দল। দিনরাত খালি পিনপিন করে বেড়ায়, ওদের কী দুর্দশা! এত্তটুকু শরীর ওদের। ওরা সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে, কে যে কখন ওদের পিষে মেরে ফেলে।
‘থামো, থামো তোমরা। দোহাই লাগে, আমাকে বাঁচাও। আজকের মতো ছেড়ে দাও আমাকে। আমার দোষ হয়েছে। ক্ষমা চাচ্ছি তোমাদের কাছে। আসলে আমি তোমাদের সঙ্গে ঠাট্টা–মশকরা করেছিলাম। সত্যি সত্যি কোনো খারাপ কথা বলতে চাইনি। বিশ্বাস করো, ভবিষ্যতে আর কোনো দিন এমন কটু কথা তোমাদের বলব না। আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও। একটুখানি দয়া করো।’
সিংহ যেখানে আরাম করছিল, তার কাছেই জংলা–ঝোপে ছিল মশাদের আস্তানা। তারা সিংহের কথা পুরাটাই শুনেছে। শুনে ভীষণ রাগ হয়েছে তাদের। কী মানহানিকর কথা! শুনলে গায়ে জ্বালা ধরে যায়। তারা ঠিক করল, সিংহ যত শক্তিওয়ালাই হোক না কেন, তাকে আচ্ছামতো একটা শিক্ষা দিতে হবে। তারপর বাছাধন বুঝবে, কত ধানে কত চাল। আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার পরিণাম যে কত ভয়ংকর, সেটা তাকে এ দফায় ভালোমতো টের পাইয়ে দিতে হবে।
মশকবাহিনীর যে সরদার, সে সিংহকে বলল,
‘অত অহংকার ভালো নয় বাপু! এটা মানলাম যে তোমার গায়ে অনেক শক্তি আর তেজ। কিন্তু অন্য প্রাণীকে হেলাফেলা করা বা তুচ্ছ ভাবা একদমই উচিত নয়। যথাসময়ে আমার এ কথার প্রমাণ তুমি পেতেও পারো।’
সিংহ এ কথা শুনে রেগে টং। হুংকার ছেড়ে বলল,
‘চোপ বেয়াদব! যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা! কার সঙ্গে চোটপাট করছিস ছোটলোকের বাচ্চা? হুঁশ করে কথা বলবি, যদি জানে বাঁচতে চাস। জানিস, তোদের সব কটাকে আমি একমুহূর্তে পিষে ফেলতে পারি। আমার থাবার নিচে পড়লে তোদের কোনো চিহ্নই থাকবে না।’
খুদে মশার দল ভীষণ চটে গেল এ কথা শুনে। রাগের চোটে হাত–পা নিশপিশ করছে তাদের সবার। এটা কেমন ধরনের ব্যবহার? সিংহের কাছ থেকে এমন আবোলতাবোল অপমানজনক কথা শুনতে হবে, সেটা তারা ভাবতেই পারেনি।
সিংহকে তাদের সরদার বলে,
‘আচ্ছা বেশ। কে বা কারা বেশি শক্তি রাখে, এখনই তাহলে সেটার পরীক্ষা হয়ে যাক। তোমাকে আজ আমরা জন্মের মতো শিক্ষা দেব। তখন বুঝবে মশার শক্তি কত!’
মশকসরদার তার বাহিনীকে নির্দেশ দেয়, যেন সবাই মিলে সিংহকে আক্রমণ করে। সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এসপার কি ওসপার। মান–ইজ্জতের প্রশ্ন। কোনোমতেই হার মানা চলবে না আজ।
যে কথা, সেই কাজ। আর একমুহূর্তও দেরি নয়। হইহই করে সবাই কাজে লেগে পড়ে। তক্ষুনি। দল বেঁধে তারা উড়ে আসে সিংহের কাছে। বেধড়ক হুল ফোটানো শুরু করে। সিংহের সারা গায়ে বিঁধতে থাকে চোখা চোখা হুল। উহ–আহ্ করতে করতে আক্রান্ত সিংহ লেজের ঝাপটা মারে। দু–চারটা মশা প্রাণ হারায় এতে। কিন্তু মশার সংখ্যা অগুনতি। কেউ কানে হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে। কেউ পেটে, ঘাড়ে, চোয়ালে, চোখের কোণে—সারা গায়ে। কোনো জায়গা বাদ নেই।
মাটিতে গড়াগড়ি দিয়েও রক্ষা নেই সিংহের। লেজের বাড়িতে কয়েকটা মশা মারা পড়ছে ঠিকই। কিন্তু অন্যান্য মশা আক্রমণ করেই চলেছে। হামলা চলছে তো চলছেই। কোনো বিরাম নেই। ক্রমে হুল বেঁধানো বাড়ছে। এর মধ্যে খবর পেয়ে জঙ্গলের অন্য মশারাও চলে এসেছে। দলেবলে। এসেই হামলায় অংশ নিচ্ছে। সিংহের অবস্থা এখন কেমন? ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। গড়াগড়ি দিয়েও রেহাই মিলছে না। আজ বোধ হয় মশার কামড়ের জ্বলুনিতেই জানটা খোয়াতে হবে। প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে সিংহ, যাতে মশার সম্মিলিত আক্রমণ থেকে বাঁচা যায়! কিন্তু নাহ। কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়। উপায় নেই। সারা গা জ্বলে যাচ্ছে। বিষাক্ত হুল ঢুকে যাচ্ছে একের পর এক। ‘কে আছ, বাঁচাও বাঁচাও!’ সিংহের আহাজারি বনের কারও কানে গিয়ে পৌঁছায় না।
দাঁত কিড়মিড় করে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে সিংহ। কিছুতেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। লেজের ঝাপটা, চার পায়ের ছোড়াছুড়ি, এলোপাতাড়ি লাফঝাঁপ, কোনো কিছুই কাজে আসছে না। সামান্য লাভও হচ্ছে না। বিফল হচ্ছে সব চেষ্টাই। আজ মনে হয় মরতেই হবে।
দৌড়ে পালিয়ে একটা ঝোপের ভেতর ঢোকে আহত সিংহ। না, সেখানেও রেহাই মিলল না। মশারাও সঙ্গে সঙ্গে উড়ে এসেছে। কামড়ানো বেড়ে গেছে আগের চেয়ে। শেষতক হাল ছেড়ে দেয় সিংহ। কাতরকণ্ঠে মশাদের বলে,
‘থামো, থামো তোমরা। দোহাই লাগে, আমাকে বাঁচাও। আজকের মতো ছেড়ে দাও আমাকে। আমার দোষ হয়েছে। ক্ষমা চাচ্ছি তোমাদের কাছে। আসলে আমি তোমাদের সঙ্গে ঠাট্টা–মশকরা করেছিলাম। সত্যি সত্যি কোনো খারাপ কথা বলতে চাইনি। বিশ্বাস করো, ভবিষ্যতে আর কোনো দিন এমন কটু কথা তোমাদের বলব না। আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও। একটুখানি দয়া করো।’
মশকদল দেখল, যথেষ্ট হয়েছে। সিংহ ব্যাটা এবার বুঝতে পেরেছে, মশারা ছোট্ট হলেও তাকে নাজেহাল করতে ওস্তাদ। সেটা প্রমাণিত হয়েছে বেশ ভালোমতোই। এখন তাকে ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে।
মশাদের সরদার মুচকি হেসে বলে,
এবার বুঝতে পারলে তো? খুব তো আস্ফালন করছিলে। এখন মজা বোঝো। তোমার সেই চোটপাট কি তোমার কোনো কাজে লাগল? নিজের শক্তি নিয়ে এমন অন্যায়ভাবে বড়াই কোরো না আর। জগতের অন্যদেরও সম্মান করতে শেখো। সে যত ছোটই হোক না কেন। দেখলে তো, ফালতু অহংকার বা ফুটানি তোমাকে বাঁচাতে পারেনি।’