সোনার খনি থেকে ফেরার পথে গান ধরল সাত বামন। ভয় কাটানোর জন্য।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ঘন জঙ্গল। তাদের গা ছমছম করে। এ কারণে তারা পরস্পর গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে পথ চলে আর ভয় তাড়ানোর জন্য গান ধরে।
জঙ্গলে নানা রকম হিংস্র শ্বাপদ আছে, সত্য। কিন্তু ভয় শুধু শ্বাপদে নয়, এই বনের আরও দুর্নাম আছে। কী দুর্নাম, মুখে আনা বারণ।
সাত বামন গা–ঘেঁষাঘেঁষি করে পথ চলে।
সরু পায়ে চলা পথ। মাঝেমধ্যে শিকড়-বাকড়, ডালপালা এসে পড়েছে পথের মধ্যে। থেকে থেকে অচেনা জীব-জানোয়ার এপার–ওপার করে।
সাত বামন লক্ষ রাখে যাতে পথ ভুল না হয়। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: পথ না হারানো। কারণ, তারা জানে, সারা বনে এ-ই একমাত্র নিরাপদ পথ। বাকি সব কুহকের ফাঁদ।
একবার পথ ভুল করেছিল তারা। অনেক দিন আগে। চলে গিয়েছিল অন্য পথে। গিয়ে পড়েছিল…উফ্…সেটা তারা আর চিন্তাও করতে চায় না।
সোনার খনি থেকে তাদের কুঁড়েঘর দীর্ঘ পথ। যাতায়াত করতে করতে মুখস্থ হয়ে গেছে। তবু তারা সাবধান থাকে। কুহকের নানা ছলনা, নানা ভেক। যেমন ওই যে সামনে যে কালোরঙা অজগরটা রাস্তা পার হচ্ছে, সেটা যে আসলে অজগর নয়, তারা ভালো করে জানে। অজগর কখনো কালো হয়? আর ও রকম মোটা? আর ও রকম রাস্তা পেরোচ্ছে তো পেরোচ্ছেই? ওটা যে কোনো প্রাণীই নয়, তারা বোঝে। ফলে গান গাইতে গাইতে তারা অপেক্ষা করে অজগরটার ধীর, ক্লান্তিকর পথ পেরোনোর।
তারা প্রায় পৌঁছে গেছে। সামনে দুবার ডানে আর একবার বাঁয়ে মোচড় নিলে তারা একটা খোলা জায়গায় এসে পড়ে। সেখানে তাদের কুঁড়েঘর। সেদিকে পা বাড়িয়েও থমকে যায় তারা। গান থেমে যায়।
কুঁড়েঘরে আলো জ্বলছে কেন?
বন্ধ জানালা আর দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে।
কে? কে ঢুকেছে ভেতরে?
তারা বেরিয়েছে সেই কাকডাকা ভোরে, প্রতিদিন যেমন বেরোয়। দরজা বাইরে থেকে গিঁট দিয়ে বেঁধে রেখেই গেছে তারা। এই গহিন জঙ্গলে কে ঢুকল ঘরে?
সাত বামন সতর্ক হয়ে যায়।
সন্তর্পণে তারা এগিয়ে যায় কুঁড়েঘরের দিকে। কেউ জানালা, কেউ দরজার ফাঁকে চোখ রেখে উঁকি দেয়।
খাবার ঘরে কেউ নেই। রান্নাঘরেও না। শোবার ঘরটা দেখা যাচ্ছে না। ওখানে কেউ ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকতেও পারে।
আলো জ্বলছে খাবার টেবিলে। একটা মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। সেটা যতটুকু পুড়েছে, তাতে বোঝা যায়, ঘণ্টাখানেক আগে জ্বালানো।
ফিসফিস করে সলাপরামর্শ করে সাত বামন।
তারা ঝুঁকি নেবে। না নিয়ে উপায় কী?
খননের ধারালো যন্ত্র তাদের কাঁধব্যাগে। সোনার খনিতে প্রতিদিন পাহাড় খুঁড়তে হয় তাদের। শাবল ধরনের সেই সব অস্ত্র বের করে শক্ত হাতে সেগুলো চেপে ধরে একসঙ্গে হুড়মুড় করে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল সাত বামন। ঢোকার সময় সমস্বরে হল্লামল্লা করল তারা।
শোবার ঘর টার্গেট তাদের।
শোবার ঘরের আধো অন্ধকারে পা রেখে তারা হাঁ হয়ে গেল।
সাত বিছানার একটিতে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে একটি মেয়ে। ঘুমাচ্ছিল। এখন উঠে বসেছে তাদের চেঁচামেচিতে।
এমন অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে তারা জীবনে দেখেনি।
মেয়েটির নাম স্নো হোয়াইট। তার মায়ের রাখা নাম। অন্য কোনো নামে মানাত না এ মেয়েকে। এমন বরফের মতো ধবধবে সাদা ত্বক কারও হতে পারে! আর এমন লালচে রক্তিম গাল! এত কুচকুচে কালো চুল!
মেয়েটা এক হতভাগ্য রাজকুমারী।
সৎমায়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে রাজপ্রাসাদ ছেড়েছে। মরেই যেত, যদি না জল্লাদের মনে করুণার উদ্রেক হতো। বনের ধারে এনে জল্লাদ ছেড়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘পালা মেয়ে! যত দূর পারিস, পালা! সৎমায়ের রাহুগ্রাস থেকে যত দ্রুত পারিস, পালিয়ে যা!’
প্রাণভয়ে বনের ভেতর দৌড়েছে মেয়েটা। দৌড়াতে দৌড়াতে কতবার পা হড়কে পড়ে গেছে। হিংস্র জন্তুর ছুটন্ত পায়ের শব্দ পেয়ে উঠে আবার দৌড়েছে। অবশেষে এসে পৌঁছেছে এই কুঁড়েঘরে। এখন সাত বামন যদি তাকে আশ্রয় দেয়, সে এখানেই থাকতে চায়।
সাত বামন আর কী বলবে। অসহায় এক রাজকুমারীকে তারা বনের জন্তুদের মধ্যে ছেড়ে দিতে পারে না। এত নিষ্ঠুর তারা কী করে হবে।
থাকো আমাদের সঙ্গে। ঘরের কাজকর্ম করো। রান্নাবান্না করো। ঘর গোছাও। বলল সাত বামনের মধ্যে যে বয়সে সবচেয়ে বড়।
সবচেয়ে ছোটজন একটু সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। সে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি এখানে এলে কোন পথে? এই কুঁড়েঘরে আসার একটাই পথ। আর সেটা এসেছে পাহাড়ের দিক থেকে, যেটা রাজপ্রাসাদের উল্টো দিকে। তুমি যদি রাজপ্রাসাদের দিক থেকে আসো, তাহলে এ কুঁড়েঘরে আসার কোনো পথ নেই।
বাকি ছয় বামন তাকে থামিয়ে দেয়। এত্তটুকু একটা মেয়ে। কী করে সে জানবে কোন পথে এসেছে?
ফলে কথাটা চাপা পড়ে যায়।
পরদিন মেয়েটা আরও বিস্তারিত বলল কীভাবে হিংসুটে সৎমায়ের ঈর্ষার শিকার হয়েছে সে।
সবকিছুর মূলে স্নো হোয়াইটের সুন্দর চেহারা। তার রূপ-লাবণ্য। তার চেয়ে সুন্দর চেহারার কেউ নেই এ জগতে। আর সেটাই তার কাল হয়েছে। তার সৎমাও যে জগতের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে হতে চায়। বলতে কি, সৎমায়ের ধারণা ছিল, সে-ই জগতের সবচেয়ে সুন্দরী নারী, যত দিন না স্নো হোয়াইটকে সে দেখেছে।
সৎমা তো আসলে একটা ডাইনি। স্নো হোয়াইট সেটা বুঝতে পেরেছে। নানা রকম জাদুবিদ্যার চর্চা করে ওই মহিলা। এই সব করে রাজাকে রূপের জালে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে।
পরদিন স্নো হোয়াইটকে কুঁড়েঘরে রেখে সাত বামন যখন যাচ্ছে দূর পাহাড়ের খনিতে খোঁড়াখুঁড়ি করতে, তখন বয়সে সবচেয়ে বড় বামনটা বলল, ডাইনি সৎমায়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়া কঠিন হবে। খুঁজে খুঁজে এখানে আসতে পারে মহিলা। তুমি দরজা খুলবে না, যে-ই আসুক।
পথিমধ্যে হাঁটতে হাঁটতে বয়সে সবচেয়ে ছোট বামনটা বলল, শুধু মেয়েটার কথা শুনেছি আমরা। ও যে ঠিক বলছে, তার ভরসা কী?
বয়সে মাঝারি বামনটা ধমক দেয় ওকে, তোর সারাক্ষণ খালি সন্দেহ। চুপ থাক।
সেই দিন দুপুরবেলা বৃষ্টি হলো। বনের রাস্তায় প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা। সোনার খনি থেকে ফিরে কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সাত বামন দেখল, ঘরে আলো জ্বলছে না। ঘরের চারপাশে কাদামাটিতে পায়ের ছাপ। মানুষের। কিন্তু এমন লম্বাটে পায়ের পাতা কোনো মানুষের হতে পারে?
স্নো হোয়াইটের কিছু হয়নি তো?
শঙ্কা নিয়ে দরজা নক করতেই স্নো হোয়াইট দরজা খুলে দিল।
আলো না জ্বেলে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। সারা দিন কাজ করে ক্লান্ত ছিল।
কেউ এসেছিল?
না তো।
কেউ দরজায় কড়া নাড়েনি?
না।
পরদিন সন্ধ্যাবেলা আবার সেই লম্বাটে পায়ের ছাপ।
সবচেয়ে ছোট বয়সী বামন ভালো করে পরীক্ষা করল সেই ছাপ। মেয়েলি পায়ের ছাপ। কিন্তু পায়ের চারটা আঙ্গুল। আর সেটা পেছনের বন থেকে সোজা কুঁড়েঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
আজও দরজা নক করলে ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে দেয় স্নো হোয়াইট।
কেউ আসেনি। কেউ দরজা নক করেনি।
রাতের বেলা স্নো হোয়াইট যখন ঢলে পড়েছে গভীর ঘুমে, সবচেয়ে ছোট বামন জাগিয়ে তুলল বয়সে সবচেয়ে বড় বামনকে। বড় বামন বিরক্ত হয়ে বলল, আবার কী?
একটা মোমবাতি হাতে বয়সে ছোট বামন খাবার ঘরে টেনে নিয়ে গেল বয়সে বড় বামনকে।
খাবার টেবিলে বসে ফিসফিস করে ছোট বামন বলল, ওই পায়ের ছাপ। ওটা খচখচ করছে মনের মধ্যে। ঘুমাতে পারছি না।
কী হয়েছে পায়ের ছাপ নিয়ে?
আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না, আসলে বন থেকে কেউ এসে দাঁড়ায়নি কুঁড়েঘরের দরজায়। বরং কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে বনে গেছে?
উঁহু, পায়ের ছাপ তো তা বলে না। পায়ের ছাপ বলছে, বন থেকে এসে কুঁড়েঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছে কেউ।
কিন্তু ধরো…ধরো যদি কারও পায়ের পাতা উল্টো দিকে হয়, তাহলে?
বড় বামন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ছোট বামনের দিকে।
মানে?
আমি স্নো হোয়াইটের পায়ের দিকটা লক্ষ করেছি। কাদা লেগে ছিল পায়ে। পা ধুয়েছে। কিন্তু তবু কোনায় লেগে ছিল একটু কাদা।
বয়সে ছোট বামন কথাটা বলেছে কি বলেনি, দপ করে নিভে গেল হাতের বোমবাতি। আর বিকট এক তীক্ষ্ণ হাসিতে থরথর করে কেঁপে উঠল কুঁড়েঘর। এমন পৈশাচিক হাসি কেউ কখনো শোনেনি। সারা বনে যেন ধ্বনিত–প্রতিধ্বনিত হলো সেই আওয়াজ। বনের পশুরাও ভয় পেয়ে ছুটে পালাল দূরে।
সেই রাতে আরও অনেক কিছুই ঘটেছিল কুঁড়েঘরে। কিন্তু সাত বামন প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। স্নো হোয়াইটরূপী কুহককে কীভাবে তারা পরাস্ত করেছে, সে এক দীর্ঘ কাহিনি। বিস্তারিত বলে কাজ নেই। শুধু এটুকু বলা যায়, সাত বামনের বীরত্ব আর সাহসিকতার জুড়ি মেলা ভার।
কুঁড়েঘরের পেছনে ডোবার ধারে একটা কবর খুঁড়ে ডাইনিকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।
ওরা কেউ ভুলবে না কুহকের ছলনা।
এ ঘটনার দুই মাস পর একদিন সন্ধ্যাবেলা খনি থেকে ফিরে কুঁড়েঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সাত বামন দেখতে পায়, কুঁড়েঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে।
সাত বামন অস্ত্র হাতে একসঙ্গে হুড়মুড় করে কুঁড়েঘরে ঢুকে দেখে, অপরূপ রূপসী এক মেয়ে বসা। ঘুমঘুম চোখ।
মেয়েটি বলে, আমি স্নো হোয়াইট। সৎমায়ের হিংসার শিকার হয়ে প্রাণে বেঁচে পালিয়ে এসেছি।
সাত বামন পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
ডোবার ধারে এখন দুটি কবর। পাশাপাশি।
সেই কবর দুটির পাশে বসে থাকে বয়সে সবচেয়ে ছোট বামনটি, যে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। বসে থেকে কী যেন ভাবে সে। তার মন খচখচ করে। হয়তো তাদের আরেকটু যাচাই করা উচিত ছিল। পরপর দুটি ঘটনা একই রকম হতে পারে না।
হয়তো দ্বিতীয় মেয়েটা সত্যি কথা বলেছিল।