তিথির খুব শখ তাদের বাসার ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে। কিন্তু তাদের বাসার ছাদের দরজায় সব সময় একটা বড়সড় চায়নিজ তালা মারা থাকে। বাড়িওয়ালা তালা মেরে রাখেন, কোনো ভাড়াটে ছাদে উঠতে পারেন না। ছাদে ওঠা নিষেধ। তাদের বাসাটা একটা চারতলা বিল্ডিংয়ে, প্রতি তলায় পাশাপাশি দুটো করে ফ্ল্যাট। মোট ফ্ল্যাট আটটা। দোতলার দুটো ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন বাড়িওয়ালা। আর বাকি ছয়টা ফ্ল্যাটে ছয়জন ভাড়াটে। তিথিরা থাকে তিনতলার বাঁ দিকের ফোর-বি ফ্ল্যাটে।
তো তিথির ছাদে বৃষ্টিতে ভেজার ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন তিথির বাবা আফজাল সাহেব বাড়িওয়ালাকে বললেন, ‘ভাই সাহেব, আমরা কি একদিন একটু ছাদে যেতে পারি? আমার মেয়েটার খুব শখ ছাদে বৃষ্টিতে ভিজবে।’
‘না।’
‘কেন?’
‘এই কেনর উত্তর নেই। আপনি তো কলেজের শিক্ষক, ইংরেজি পড়তে পারেন নিশ্চয়ই। আপনার বাড়ির ডিডটা আরেকবার একটু পড়ে দেখেন। ৩ নম্বরে স্পষ্ট করে লেখা আছে, ভাড়াটেরা ছাদে যেতে পারবেন না।’
বাবা যখন বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল তিথি। সে এবার ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে। বাড়িওয়ালার ওপর ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো ওর। এভাবে কেউ কথা বলে? না বলা উচিত?
‘আচ্ছা ঠিক আছে, ছাদে না হয় গেলাম না।’ বাবা বললেন। ‘কিন্তু আপনারা তো মাঝে মাঝে যান। ছাদটা এত ইম্পরট্যান্ট কেন যে শুধু বাড়িওয়ালা, মানে আপনারাই ছাদে উঠতে পারবেন?’
‘দেখুন, আমার ছাদে একটা ছাদবাগান আছে। ওখানে অনেক দামি দামি গাছ আছে। আমি চাই না ভাড়াটেরা ছাদে উঠে বাগানটা নষ্ট করুক।’
‘ভাড়াটেরা ছাদবাগান নষ্ট করবে কেন?’
‘আমি আর আপনার সাথে এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আপনার বাড়ি পছন্দ না হলে বাড়ি ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু ছাদে ওঠা যাবে না।’
‘আপনার ছাদটা তাহলে গোল্ডেন রুফ! তাই না আঙ্কেল?’ কে বলল কথাটা? তিথি তাকিয়ে দেখে, চারতলার সিঁড়ির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভার্সিটিতে পড়ুয়া ভাইয়াটা। তার মুখটা হাসি হাসি।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই গোল্ডেন রুফ, আমার কাছে।’
‘আঙ্কেল, গুলশানে এ রকম একটা বাসার গোল্ডেন রুফে অনেক দামি দামি গাছ ছিল, সেখানে গাঁজাগাছ পাওয়া গিয়েছিল, জানেন?’
‘হোয়াট? আমার সাথে ফাজলামো করো?’
‘ফাজলামো করলাম কোথায়? একটা তথ্য শেয়ার করলাম। আপনি বললেন ছাদে দামি দামি গাছ আছে, হয়তো গাঁজাগাছও আছে। গাঁজাগাছ তো অনেক দামি গাছ।’
‘শাটআপ! তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। উনি কোথায়?’
তিথি হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল। তিথির বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, বাদ দিন। আমরা ছাদে যাব না। শফিক, তুমি ঘরে যাও।’
শফিক, মানে ভার্সিটিতে পড়ুয়া ভাইয়াটা অবশ্য ঘরে গেলেন না। ওখানে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। আর বাড়িওয়ালা ‘আমার সাথে ফাজলামো...আমি দেখে নেব...তোমার বাবা কখন আসবে?’ বলতে বলতে, মানে গজ গজ করতে করতে নেমে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে।
আর সেদিন বিকেলেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। বাবা তিথিকে বললেন, ‘চল রে মা, বাইরে রাস্তায় গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজি।’
‘চলো বাবা।’
দুজনই রাস্তায় নেমে এল। মা অবশ্য পেছন থেকে চেঁচাতে লাগলেন, ‘এই বৃষ্টিতে ভিজে দুজনেই এবার ঠান্ডা বাধাবে...!’ ওদের বাসার সামনের রাস্তাটা সুন্দর, ছিমছাম। বৃষ্টির জন্য এখন ফাঁকা। এমনিতেও ফাঁকাই থাকে। তারা দুজন ভিজতে লাগল মনের আনন্দে। বাবা বললেন, ‘আয় নৌকা বানাই।’ বাবা পকেটে করে একটা কাগজ এনেছিলেন, ওটা দিয়ে নৌকা বানালেন একটা, কাগজের নৌকা। তারপর তিথির হাতে দিয়ে বললেন, ‘নে, এটা ড্রেনে ছেড়ে দে।’ তিথি রাস্তার পাশের ড্রেনে ছেড়ে দিল নৌকাটা। আর কী আশ্চর্য! তরতর করে নৌকাটা ছুটতে লাগল। পেছন পেছন ছুটতে লাগল তিথিও। বেশ মজা। বাবার মনে পড়ল, ছোটবেলায় বৃষ্টি হলেই তারা এ রকম কাগজের নৌকা নিয়ে রেস লাগাতেন। কারটা আগে যায়। এখন অবশ্য শুধু তিথির নৌকাটাই ছুটছে একা।
‘ভাই সাহেব, আমরা কি একদিন একটু ছাদে যেতে পারি? আমার মেয়েটার খুব শখ ছাদে বৃষ্টিতে ভিজবে।’
সত্যি, বেশ মজা হলো।
অনেকক্ষণ ভেজার পর বাবা বললেন, ‘এখন বাসায় যাও, নইলে তোমার মা রাগ করবে। আমি দোকান থেকে চা আর ডিম কিনে নিয়ে আসছি। তোমার মা আনতে বলেছে।’
তিথি ভেজা শরীর নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে দেখে চারতলার শফিক ভাইয়া নামছেন।
‘কী মিস তিথি, ছাদে বৃষ্টিতে ভেজা হলো না?’
‘রাস্তায় ভিজেছি, অনেক মজা হয়েছে।’
‘ভেবো না। আমরা সবাই ছাদেও ভিজব শিগগিরই...দেখো।’ বলে শফিক ভাইয়া ভ্রু নাচিয়ে চলে গেলেন। ব্যাপারটা বুঝল না তিথি।
কয়েক দিন পর আবার ঝমঝম বৃষ্টি। অবশ্য প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষাকাল বেশ জোরেশোরে শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু আজ প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল তিথি। হঠাৎ কলিং বেল বাজল। তিথি ছুটে গেল দরজা খুলতে, নিশ্চয়ই অফিস থেকে কাকভেজা হয়ে বাবা এসেছেন। না, দরজা খুলে তিথি অবাক। তিনজন পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে আছেন।
‘এটা মারুফ সাহেবের বাসা?’
‘না, দোতলায় থাকেন উনি। মারুফ সাহেব হচ্ছেন বাড়িওয়ালা।’
‘ও আচ্ছা। তোমার নাম কী খুকি?’
‘তিথি।’
‘সুন্দর নাম।’ বলে পুলিশ তিনজন নিচে চলে গেলেন। তিথি শুনতে পেল, নিচতলায় কলিং বেল বাজাচ্ছেন পুলিশের লোকজন। দরজা খুললেন কেউ। তিথি শুনতে লাগল ওদের কথাবার্তা।
‘আপনি মারুফ সাহেব?’
‘জি।’
‘আপনিই তো বাড়িওয়ালা?’
‘জি।’
‘এখানে কে কে থাকে?’
‘আমি আর আমার স্ত্রী।’
‘ছেলে–মেয়ে?’
‘আমার দুই ছেলে। ওরা বিদেশে থাকে। একজন আমেরিকায়, আরেকজন মালয়েশিয়ায়। কেন?’
‘আপনার বাসার ছাদের চাবি নিয়ে আসুন। ছাদটা খুলতে হবে।’
‘কেন?’
‘কেনর উত্তর পরে দিচ্ছি। আমরা একটা ইনফরমেশন পেয়ে এসেছি। ছাদের চাবিটা নিয়ে আসুন জলদি।’
তিথি দেখল, তিনজন পুলিশ বাড়িওয়ালাকে নিয়ে ছাদে উঠছে। সে দরজা একটু ফাঁক করে দেখতে লাগল।
আর কী আশ্চর্য! বেশ কিছুক্ষণ পর তিথি দেখল, পুলিশ ছাদ থেকে দারোয়ানকে দিয়ে দুটি বড় বড় টব নামাচ্ছে। তাতে কোনো একটা ঝাঁকড়া গাছ। ওদের কথায় বুঝল, এটা গাঁজার গাছ। যে গাছ সরকারের অনুমতি ছাড়া লাগানো কঠিনভাবে নিষেধ। বাড়িওয়ালা তখন তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন। ‘এটা ষড়যন্ত্র। গাঁজার গাছ আমার ছাদে ছিল না...কেউ এটা ছাদে রেখেছে...’
‘আচ্ছা, সেটা থানায় গিয়ে ব্যাখ্যা দেবেন। এখন আমাদের সাথে থানায় চলুন।’
এর মধ্যে অনেক কাহিনি হয়ে গেল। পাড়ার সবাই জেনে গেল, মারুফ সাহেবের বাসার ছাদে গাঁজার গাছ পাওয়া গেছে। পুলিশ এসে মারুফ সাহেবকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। মারুফ সাহেবের আত্মীয়স্বজন ঘন ঘন আসতে লাগলেন। আশপাশের দোকানে, চায়ের টঙে এ নিয়ে বেশ আলোচনা চলতে লাগল। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ছাদের দরজাটা কিন্তু খোলাই রইল।
দুদিন পর মারুফ সাহেব ফিরলেন। এই দুদিনে তার গাল বসে গেছে। চোখের নিচে কালি। ভেজা বিড়ালের মতো নিজের বাসায় ঢুকলেন। যদিও ওই দিন মোটেই বৃষ্টি হচ্ছিল না। কেউ তাকে কোনো প্রশ্নও করল না। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ছাদটা কিন্তু খোলাই রইল। ২৪ ঘণ্টা খোলা। এখন ভাড়াটেরা প্রায়ই ছাদে গিয়ে বিকেলে হাঁটেন। বৃষ্টি হলে মনের আনন্দে ভেজেন। তিথিও বেশ কয়েকবার ভিজেছে। একদিন সিঁড়িতে শফিক ভাইয়ের সাথে দেখা। তিনি ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
‘কী? বলেছিলাম না, একদিন আমরা সবাই ছাদে ভিজব?’ তিথি হাসিমুখে মাথা নাড়ে। শফিক ভাইয়া ফিসফিস করে বলেন,
‘ম্যাজিক!’