পাঁচ নম্বর পয়েন্ট

অলংকরণ: শিখা

মিনুর মেজাজ খারাপ। সকালে উঠেই সে মায়ের বকা খেয়েছে। বকা খেতে কার ভালো লাগে? তার অপরাধ, সে কাল রাতে জ্যামের বোতল একাই অর্ধেক খেয়ে শেষ করেছে। মা টের পেল কী করে? আশ্চর্য! মিনু ফোরে পড়ে, মডেল গার্লস স্কুলে। আজ তার স্কুল বন্ধ। সে নাশতা খেয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। রিঙ্কু এলেই তার সঙ্গে খেলবে। আজকের খেলাটা আগেই ঠিক করা আছে। তারা দুজন একদিন রিঙ্কুর ইচ্ছায় খেলে, একদিন মিনুর ইচ্ছায়। এটাই ওদের নিয়ম। আজকে মিনুর ইচ্ছায় খেলা হবে। তার আগের দিন রিঙ্কুর ইচ্ছায় খেলা হয়েছে। তার আগের দিনও রিঙ্কুর ইচ্ছায় খেলা হয়েছে। পরপর দুই দিন রিঙ্কুর ইচ্ছায় খেলা হয়েছে কেন, মিনু মনে করতে পারল না। তবে আজ মিনুর ইচ্ছায় খেলা হতেই হবে। তখনই মিনু লোকটাকে দেখল। লম্বা পাঞ্জাবি পরা লোকটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। আশপাশে কেউ নেই। লোকটা এদিক–ওদিক তাকিয়ে একটু এগিয়ে এল—

খুকি আইসক্রিম খাবে?

মিনুর চট করে মনে পড়ে গেল, কদিন আগে তাদের স্কুলের সেই ফাইভ পয়েন্টসের ট্রেনিংটা। নিলুফার মিস পাঁচটা পয়েন্টস শিখিয়েছেন তাদের, যাকে বলে একবারে মুখস্থ করিয়েছেন। এক নম্বর হচ্ছে অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলা যাবে না। দুই নম্বর হচ্ছে অপরিচিত কেউ কিছু খেতে দিলে খাওয়া যাবে না। তিন নম্বর হচ্ছে...

—খুকি আইসক্রিম খাবে? লোকটা আরেকটু এগিয়ে এসেছে। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে এদিক–ওদিক তাকাচ্ছে।

—খাব। কিছু না ভেবেই বলে ফেলে মিনু ।

—তাহলে আমার সঙ্গে আসো।

তখনই তিন নম্বর পয়েন্টটা মনে পড়ল মিনুর । দুই দিকে দুই হাত ছড়িয়ে একটা চক্কর দিলে যে অদৃশ্য বৃত্তটা তৈরি হয়, তার ভেতর অপরিচিত কেউ যেন না ঢোকে। আর চার নম্বর পয়েন্টটা...চার নম্বর পয়েন্টটা আর কিছুতেই মনে করতে পারল না মিনু। তখনই লোকটা আবার বলল—

আইসক্রিম খেলে আমার সঙ্গে আসো।

—কী আইসক্রিম?

—তুমি যেটা খেতে চাও।

—আমি চকবার খাব।

—আচ্ছা, আসো।

—কোথায় যাব?

—এই তো কাছেই।

লোকটা আরেকটু এগিয়ে আসে । মিনু বুঝতে পারে, লোকটা তার দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে চক্কর দেওয়ার সেই অদৃশ্য বৃত্তটার ভেতরে চলে এসেছে। তখনই চার নম্বর পয়েন্টটা মনে পড়ল মিনুর। বাবা–ভাই ছাড়া অন্য কেউ শরীরের কিছু জায়গায় হাত দিলে খুব জোরে চিৎকার করতে হবে। লোকটা সে রকম কিছু করবে নাকি? মিনু চোখ কুঁচকে তাকায় লোকটার দিকে। লোকটার মতলব বোঝার চেষ্টা করে। তখনই তার অন্য একটা সন্দেহ হয়। আচ্ছা লোকটা ছেলেধরা নাকি? লোকটার হাতে অবশ্য কোনো চটের বা কাপড়ের বস্তা নেই, যেটাতে ভরে ওকে নিয়ে যাবে। তবু সে বলে ফেলল—

আপনি কি ছেলেধরা?

লোকটা থতমত খেয়ে যায়!

—না না, কী বলছ! বলে লোকটা হঠাৎ পিছিয়ে যায়।   

—তাহলে নিশ্চয়ই আপনি মেয়েধরা? কারণ, আমি তো মেয়ে।

—না না । বলে লোকটা ততক্ষণে ঘুরে হাঁটা শুরু করেছে।

—কী হলো আঙ্কেল? পেছন থেকে চেঁচায় মিনু।

এবং মুহূর্তে লোকটা অদৃশ্য হয়ে যায়। তখনই রিঙ্কুকে দেখা যায় লাফাতে লাফাতে আসতে।

—কিরে খেলবি না?

—জানিস, আজ আমাকে ধরতে একটা মেয়েধরা এসেছিল।

—মেয়েধরা মানে?

—ছেলেধরা যেমন থাকে, সে রকম মেয়েধরাও থাকে। ওরা শুধু মেয়েদের ধরে। মেয়েদের ধরে বস্তায় ভরে নিয়ে যায়। লোকটার হাতে অবশ্য বস্তা ছিল না। গম্ভীর হয়ে বলে মিনু।

মিনু বুঝতে পারে, লোকটা তার দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে চক্কর দেওয়ার সেই অদৃশ্য বৃত্তটার ভেতরে চলে এসেছে। তখনই চার নম্বর পয়েন্টটা মনে পড়ল মিনুর। বাবা–ভাই ছাড়া অন্য কেউ শরীরের কিছু জায়গায় হাত দিলে খুব জোরে চিৎকার করতে হবে।

—তারপর কী হলো?

—মেয়েধরা এসে বলল আইসক্রিম খাবে? আমি বললাম খাব।

—ছিঃ ছিঃ তুই তা–ই বললি? স্কুলে আমাদের কী শিখিয়েছে, মনে নেই?  দুই নম্বর পয়েন্ট, অপরিচিত কারও কাছ থেকে কিছু খাওয়া যাবে না।

—আহা, আমি তো জানিই। আমি খেতাম নাকি? আমি লোকটাকে পরীক্ষা করছিলাম।

—তারপর কী হলো?

—তারপর লোকটা তিন নম্বর পয়েন্টের ভেতর চলে এল।

—এই যে দুই দিকে হাত ছড়িয়ে একটা চক্কর  দিলে যে অদৃশ্য বৃত্ত তৈরি হয়, তার ভেতর যেন কেউ না ঢোকে, সেই বৃত্তটার ভেতর?

—হ্যাঁ, মাথা নাড়ে মিনু।

—তখন তুই কী করলি? চার নম্বর পয়েন্টটা তোর মনে ছিল?

—ছিল।

—তুই চিৎকার করলি?

—চিৎকার করব কেন? লোকটা তো তখনই পালাল।

—কখন পালাল?

—ওই যে আমি বললাম, আপনি কি মেয়েধরা? তখনই!

—আচ্ছা পাঁচ নম্বর পয়েন্টটা কী?

—তা তো আমারও মনে পড়ছে না।

দুজনেই ভাবতে বসল, পাঁচ নম্বর পয়েন্টটা কী ছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য! কিছুতেই মনে করতে পারল না দুজনের কেউই। আর জানা জিনিস মনে করতে না পারলে মাথার ভেতর কেমন যেন চিন চিন করতে থাকে...মিনু আর রিঙ্কু দুজনের মাথাই একসঙ্গে চিন চিন করতে শুরু করল। দুজনেই ছুটল পঞ্চম পয়েন্টটা জানতে আফিফার কাছে। আফিফা মিনুদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, রিঙ্কুদের বাসার পাশেই থাকে, তার নিশ্চয়ই মনে আছে পাঁচ নম্বর পয়েন্টটা, তার সবই মনে থাকে, ফার্স্ট গার্ল কিনা।