দুই বছর বয়সের একটি শিশু কতটুকুই বা বোঝে? আধো আধো কথা বলা, দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খাওয়া, একটু অ আ শেখা—এভাবেই তো কেটে যায় অধিকাংশ শিশুর দিন। তবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিমন্যু মিশ্রের শৈশব ছিল ভিন্ন। দুই বছর বয়সে সবাই যখন হামাগুড়ি থেকে দুই পায়ে হাঁটা শিখতে ব্যস্ত, অভিমন্যু তখন ব্যস্ত দাবার ঘুঁটি আর বোর্ড নিয়ে। ওই বয়স থেকেই খেলনা বা কার্টুনের জগতে না ঢুকে দাবার বোর্ডে ঘাড় গুঁজে থাকে অভিমন্যু মিশ্র। ৬৪ ঘরের ওই সাদা–কালো বোর্ড ঘিরেই তার জীবন।
অতটুকু বয়সে দাবায় হাতেখড়ি হওয়া অভিমন্যু গত ৩০ জুন ২০২১ সালে নাম লেখায় ইতিহাসের পাতায়। মাত্র ১২ বছর ৪ মাস ২৫ দিন বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করে সে। এর মাধ্যমে অভিমন্যু ভেঙে দেয় রাশিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টার সার্গেই কারিয়াকিনের ১৯ বছরের রেকর্ড। ২০০২ সালে মাত্র ১২ বছর ৭ মাস বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করে সে সময় সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন কারিয়াকিন।
খুব অল্প বয়সে অভিমন্যুকে দাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন বাবা হেমন্ত মিশ্র। দুই বছর বয়সী ছেলেকে তিনি চেনান দাবার ঘুঁটি এবং সেগুলোর চাল। তখন থেকেই দাবার সঙ্গে অভিমন্যুর সখ্য শুরু এবং বয়স পাঁচ হতে না হতেই বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া শুরু করে সে। এ সময়েই ছেলেকে দাবার আরেকটু গভীরে নিয়ে যাওয়ার জন্য হেমন্ত মিশ্র শরণাপন্ন হন অরুণ প্রসাদ নামের এক গ্র্যান্ডমাস্টারের। অভিমন্যুদের বাসার খুব কাছে ছিল তাঁর বাসা। অভিমন্যুর সঙ্গে দাবা নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করে অরুণ বুঝে ফেলেন, এই ছেলে যাবে অনেকদূর। অরুণ বলেন, ‘কোনো কষ্ট না করেই ও সব চাল বুঝে ফেলছিল। সেদিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এই ছেলে আমার আর ১০টা ছাত্রের মতো নয়। এই ছেলে ভবিষ্যতে খবরের শিরোনাম হতেই এসেছে।’ হীরা চিনতে ভুল করেনি জহুরি অরুণের চোখ।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হইচই ফেলে দেওয়ার আগে অভিমন্যু সাড়া ফেলে দেয় গোটা যুক্তরাষ্ট্রে। মাত্র ৯ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ন্যাশনাল মাস্টার খেতাব অর্জন করে সে। ১১ বছর বয়সে অর্জন করে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার খেতাব, যার অবস্থান গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবের এক ধাপ নিচেই।
সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার জন্য অভিমন্যুর হাতে ছিল মাত্র এক বছর ছয় মাস সময়। ১২ বছর ৭ মাসের মধ্যে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করতে পারলেই সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে যাবে অভি। হেমন্ত মিশ্র ভাবেন, চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? তাই একদিন ছেলেকে ডেকে বলেন, দেখো, এমন সুযোগ জীবনে একবারই আসে। আর কখনো তুমি ১২ বছরের অভি হতে পারবে না।
এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি অভিমন্যুও। কিন্তু তাঁর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুটি বিষয়। প্রথমটি হলো দাবার রেটিং–সংক্রান্ত জটিলতা। অন্তত ২৫০০ রেটিং অর্জন করতে না পারলে কাউকে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব দেওয়া হয় না। বয়স অনুযায়ী অভিমন্যুর রেটিং অনেক বেশি থাকলেও গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার জন্য তা মোটেও যথেষ্ট ছিল না। ফলে পর্যাপ্ত রেটিং অর্জনের জন্য এক বছরে তাকে খেলতে হতো প্রচুর ম্যাচ। আর শুধু খেললেও তো হবে না, ম্যাচগুলো জিততেও হবে। কিন্তু দাবার জন্য লেখাপড়া বিসর্জন যাক, এটাও চায় না অভিমন্যুর পরিবার। তাই অতটুকু বয়সে সব মিলিয়ে প্রায় হিমশিমই খেতে থাকে অভিমন্যু।
তার পথে দ্বিতীয় বাধা হয়ে দাঁড়ায় বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯। এই মহামারির মধ্যে পর্যাপ্ত ম্যাচ পাওয়াও ছিল বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। কারণ, যেসব টুর্নামেন্ট জিতে রেটিং অর্জন করা যেত, সেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু বাতিল হয়ে যায় কোভিডের জন্য।
এতকিছু দেখে হেমন্ত এবং অভি একরকম বাজিই খেলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, পঞ্চম ও ষষ্ঠ গ্রেডের পড়ালেখা অভি শেষ করবে মাত্র ১২ মাসে, এরপর পড়ালেখায় সাময়িক বিরতি দিয়ে দুজনে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বেন গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবের পেছনে।
ফলে ২০১৯-২০ সালে স্কুল থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যায় অভিমন্যু। কিন্তু স্কুলে যেতে না পেরে সে বিচলিত ছিল না একদমই। অভিমন্যু বলে ‘আসলে আমার হাতে স্কুল মিস করার মতো কোনো সময়ই ছিল না। আমি যদি এসব নিয়ে বেশি চিন্তা করতাম, তাহলে আমি আমার কাজটা ঠিকঠাকভাবে করতেই পারতাম না। অবশ্য এ কারণে স্কুলে আমার খুব বেশি বন্ধু নেই। আমি আবার ক্লাসে ফিরে গেলে আশা করি আমার বন্ধুর সংখ্যা বাড়বে।’
এত ছোট একটি ছেলের মুখে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো দায়িত্বশীল কথা শুনে সবাই ধাক্কা খেতে পারে। কিন্তু ১৯ বছর ধরে সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টারের খেতাব যিনি ধরে রেখেছিলেন, সেই সার্গেই কারিয়াকিনের কাছে ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক মনে হয়নি। তিনি নিজেও খুব ছোট থেকেই দাবার নেশায় ছিলেন বুঁদ। সাত বছর বয়সেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবা নিয়ে পড়ে থাকতেন কারিয়াকিন। কারিয়াকিন বলেন, ‘সাত বছর বয়স থেকেই আমি প্রতিদিন প্রায় সাত আট ঘণ্টা দাবা নিয়ে পড়ে থাকতাম। ফলে এ ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক। আমি মনে হয় আমার জীবনের প্রথম ছুটি পাই ১৩ বছর বয়সে। ওই দিনই প্রথম আমি দাবার কোনো ঘুঁটি ছুইনি বা এ–সংক্রান্ত কোনো আলোচনা করিনি।’
সময় যত কমে আসছিল, অভিমন্যুর জন্য ততই দুর্গম হচ্ছিল পথটা। করোনা মহামারির জন্য দাবা টুর্নামেন্টগুলো বাতিল হয়ে যাচ্ছিল, অথবা যেসব দেশে টুর্নামেন্টগুলো আয়োজন করা হচ্ছিল, সেসব দেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হচ্ছিল। ২০২০ সালের শুরুর দিকের বেশ কয়েকটি রেটেড আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে পারেনি অভিমন্যু। ১১ বছর বয়সেই ‘আন্তর্জাতিক মাস্টার’ খেতাব অর্জন করে অভিমন্যু ভেবেছিল, তার জন্য সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়াটা হয়তো খুব বেশি কঠিন হবে না। কিন্তু করোনা এলোমেলো করে দিল সবকিছু। যে সময়ের মধ্যে অভিমন্যুর বেশ কয়েকবার ইউরোপ ভ্রমণ করে ফেলার কথা, করোনার জন্য সে সুযোগটাই পেল না সে। মহামারিতে অভিমন্যু মাত্র একবার ইউরোপ ভ্রমণের সুযোগ পায় হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে। অনেকগুলো টুর্নামেন্ট হাতছাড়া হওয়া সত্ত্বেও বাবা-ছেলে মিলে ভেবে দেখেন, তাঁরা যদি বুদাপেস্টে বেশ কিছুদিন থেকে যেতে পারেন, তাহলে হয়তো এই এক দেশে থেকেই যথেষ্ট ম্যাচ খেলা যাবে এবং রেকর্ডটা অর্জনের একটা সুযোগও হয়তো চলে আসবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁরা দুজন বুদাপেস্টে আসেন কোনো ফিরতি টিকিট ছাড়াই। দুজনে মিলে চ্যালেঞ্জ নেন সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টারের খেতাব অর্জন করেই দেশে ফিরবেন।
বুদাপেস্টের এই থাকাটা দুজনের জন্য মোটেও আরামদায়ক কোনো ভ্রমণ ছিল না। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হেমন্ত মিশ্র চাকরি বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করতেন রাত তিনটা পর্যন্ত। দাঁতে দাঁত চেপে দুজনে নীরবে যুদ্ধ করে গেছেন মাসের পর মাস।
সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার যুদ্ধে নেমে মাত্র ৭৭ দিনের ব্যবধানে অভি খেলে ৭০টি ম্যাচ। দিনের বেলা সে টুর্নামেন্টে অংশ নিত, আর রাতে তৈরি হতো পরের দিনের খেলার জন্য। টুর্নামেন্টে সফল হতে হতে অভিমন্যু যখনই ২৫০০ রেটিংয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যায়, দাবার জগতে ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। মাত্র ৩ মাসেই অভিমন্যু অর্জন করে ১৩০ রেটিং পয়েন্ট! এবং পৌঁছে যায় গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবের খুব কাছাকাছি।
অভিমন্যুর কত যে কষ্ট হয়েছে এই খেতাব অর্জন করতে, সেটা একটি ছোট্ট ঘটনা থেকে সবাই বুঝতে পারবে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ‘ক্লাসিক্যাল চেস’ ফরম্যাটের খেলার শুরুতে উভয় প্রতিপক্ষের হাতেই সময় থাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময়, চল্লিশটা চাল দেওয়ার পর দেওয়া হয় অতিরিক্ত ৩০ মিনিট। পাশাপাশি প্রতিটি চাল দিলে যোগ হয় আরও ৩০ সেকেন্ড করে। ফলে খেলা চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, অনেক সময় তো কয়েক দিন ধরেও চলে। একবার এমনই একটি খেলা এত রাত পর্যন্ত গড়ায় যে ঘুম ধরে রাখা খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় ছোট্ট অভিমন্যুর জন্য। প্রতিপক্ষও সেটা বুঝে ফেলে এবং ইচ্ছা করে দেরি করে চাল দিতে থাকে, যেন অভিমন্যু খেলায় মনোযোগ দিতে না পারে। কিন্তু এসব কিছু থামাতে পারে না অভিকে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে তবেই ক্ষান্ত হয় সে।
অবশেষে যখন ৩০ জুন অভিমন্যু সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করে ফেলে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বয়ে যায় খুশির জোয়ার। বিভিন্ন স্থানে কেক কেটে তার এই অর্জনকে উদ্যাপন করা হয়। কিংবদন্তি দাবাড়ুরা অভিনন্দন জানান অভিমন্যুকে, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বর্তমান দাবা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেন এবং সাবেক দাবা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ।
নিজের এই রেকর্ড অবশেষে অভিমন্যু ভাঙতে পেরেছে দেখে খুবই খুশি হন সার্গেই কারিয়াকিন। অভিমন্যুর খেলার প্রশংসাও করেন তিনি, ‘আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে ১৯ বছর ধরে এই রেকর্ডের মালিক থাকতে পারব। এই আধুনিক যুগে এসেও এতদিন এই রেকর্ড টিকে থাকবে, এটা খুবই অবাক করার মতোই একটা ব্যাপার। অভিমন্যুর বেশ কয়েকটি খেলা দেখেছি আমি। কয়েকটা ম্যাচ তো ও খুবই ভালো খেলেছে।’
গ্র্যান্ডমাস্টারের পর আর কোনো খেতাব না থাকলেও যেসব গ্র্যান্ডমাস্টারের রেটিং ২৭০০ পয়েন্টের ওপরে, তাঁদের বলা হয় ‘সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার’। আপাতত অভিমন্যুর লক্ষ্য ১৫ বছর বয়সের মধ্যে ২৭০০ রেটিং অর্জন করার। কিন্তু তার মূল লক্ষ্য আরও বড়। ১২ বছরের অভিমন্যু স্বপ্ন দেখে, একদিন সে দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবে। এত অল্প বয়সে অভিমন্যু মিশ্র দাবার প্রতি যে নিষ্ঠা দেখিয়েছে, তার জন্য এই লক্ষ্য অর্জন করাটা নিশ্চয়ই অসম্ভব কিছু নয়।