হিম দুর্গের গল্প শোনো

এখানকার সবকিছুই তৈরি একদম খাঁটি বরফ দিয়েছবি: তানভীর অপু
ফিনল্যান্ডের কেমি শহরে রয়েছে সম্পূর্ণ বরফে তৈরি একটি হোটেল। ভাবতে পারো, সেখানকার সবকিছুই নাকি বরফে তৈরি! তো সেই হোটেল ঘুরে এসেছেন ফিনল্যান্ডপ্রবাসী শিক্ষার্থী রাজশাহীর তানভীর অপু। তিনি আবার তোমাদের জন্য সেই বরফরাজ্যের চমৎকার কিছু ছবি তুলে এনেছেন। তাঁর কাছ থেকে গল্প শুনে সেই বরফরাজ্যের কথা জানাচ্ছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

বরফের বাড়িঘর। না, বাড়িঘরের চেয়েও বেশি। রীতিমতো বরফের দুর্গ। সেখানে যেমন আছে ঘুমানোর ঘর, তেমন আছে খাবারের হোটেল, উপাসনালয়—সবই বরফের। খাবারের টেবিল, পানি খাওয়ার গ্লাস—সেটিও বরফের। এমনকি ঘরের জানালাটাও। তবে জানালা একটু ভিন্ন রকমের। জানালার জায়গায় একটা পাতলা বরফ লাগানো রয়েছে। সবচেয়ে অদ্ভুত, ঘরের বাতিটাও বরফের। ফিনল্যান্ডের কেমি শহরেই রয়েছে এই অদ্ভুত ঘরবাড়ি। তোমরা হয়তো ভাবছ, এটা একটা আষাঢ়ে গল্প। আর সত্যি হলেও হয়তো এই হিমের ঘরে কেউ যায় না। থাকে না। কিন্তু না, বরফের এই হোটেল প্রতিবছর জানুয়ারির শেষ থেকে এপ্রিলের শুরু পর্যন্ত খোলা থাকে। ঘুরে দেখতে যায় লক্ষাধিক দর্শনার্থী।

বরফের এই রাজ্যের শুরুটা হয় ১৯৯৬ সালে। ওই বছরই দুর্গটি তার এক হাজার ১০০ মিটার দেয়ালের জন্য গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা করে নেয়। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত উন্মুক্ত এই দুর্গটিতে প্রবেশমূল্য ১৫ ইউরো। আবার কেউ চাইলে ১৫৫ ইউরো দিয়ে এক রাত ঘুমিয়েও নিতে পারে এর কোনো এক হিমঘরে, যেখানে ঘুমানোর জন্য খাট থেকে শুরু করে সবই বরফের তৈরি!

প্রথমবার এই দুর্গ নির্মাণ ছিল সারা বিশ্বের শিশুদের জন্য ইউনিসেফ ও কেমি শহরের একটি উপহার। কেমি শহরের লোকজনের কাছে বরফ খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। তবে বিশ্বের অধিকাংশ শিশুর কাছে এটা রীতিমতো উত্তেজনার একটা ব্যাপার। সে ভাবনা থেকেই এই বরফরাজ্যের জন্ম।

বরফ দুর্গের প্রবেশপথ
ছবি: তানভীর অপু

প্রথমবার যখন সেটি তৈরি করা হয়, তখন সেখানে শুধু ছিল একটি রেস্তোরাঁ ও উপাসনালয়। তৃতীয় দফায় নির্মাতারা দুই তলাবিশিষ্ট বরফ-স্থাপত্য নির্মাণের একটা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং সফল হন। পরেরবার ১৯৯৯ সালে তাঁরা এটাকে তিনতলাবিশিষ্ট করার দুঃসাহস দেখান। সে বছরই পর্যটকেরা সেখানে সারা রাত কাটানোর মতো বাড়তি আনন্দ পান। তৈরি করা হয় বরফের হোটেল। দুর্গের চারদিক দিয়ে তৈরি হয় আধা কিলোমিটার লম্বা বরফের দেয়াল।

এই নির্মাণকাজের জন্য প্রতিবছর দরকার হয় ৬০ জন সুদক্ষ কর্মীর। ২০০৯ সালে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করে প্রথমবারেই তাঁরা দারুণ সাফল্য লাভ করেন। কোথাও কোনো তার ঝুলে নেই, অথচ রয়েছে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি। জৌলুশ বেড়ে যায় পুরো দুর্গের।

প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন থিম ও পরিকল্পনা থেকে এই দুর্গ তৈরি করা হয়। এই বছরের থিম ছিল ‘সিক্রেট অব দ্য সি’। এর ভেতর থেকে রাতের আকাশের তারা দেখার সুযোগ যেমন আছে, তেমনি আছে উত্তর মেরুর মেরুজ্যোতি দেখার সুযোগও।

বরফের তৈরি টেবিল
ছবি: তানভীর অপু

রাতে যেসব অতিথি থাকতে আসেন তাঁদের প্রত্যেককে একটি করে গরম স্লিপিং ব্যাগ (ভেড়ার লোমের তৈরি) দেওয়া হয়। এগুলো উত্তর মেরুর ঠান্ডা আবহাওয়ার উপযোগী করে তৈরি করা। বিছানাও ভেড়ার চমড়া দিয়ে গরম করে তৈরি। টয়লেট রয়েছে লাউঞ্জে। রুমে কোনো টিভি দেওয়া হয় না। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে জাগার পর লাউঞ্জে তৈরি থাকে কফি ও পাউরুটিসহ নাশতা। গোসলখানায় রয়েছে ঝরনা ও ফিনল্যান্ডীয় রীতির বাষ্পস্নানের ব্যবস্থা।

রেস্তোরাঁর টেবিলগুলোও বরফের তৈরি। যদিও গরম খাবার পরিবেশনের সুবিধার্থে সেগুলো স্বচ্ছ তন্তু দিয়ে মোড়ানো থাকে।

ডিসেম্বরে তাপমাত্রা মাইনাস ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে বরফের দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। সাধারণ অবস্থায় এটা তৈরি করতে চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ সময় লাগে। এ বছরের ২৫ জানুয়ারি এর উদ্বোধন করা হয়েছে। আর খোলা ছিল এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপর এ বছরের জন্য হোটেলটি বন্ধ হয়ে গেছে।

(কিশোর আলোর জুন ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)