একদিন হুট করেই বোঝা গেল ১৪টি হাতি নেই। প্রথম দিকে কেউ খুব একটা দুশ্চিন্তায় ভোগেনি। সংরক্ষিত বনভূমিতে থাকা প্রাণীগুলোর প্রায় সময়ই ঘরের বাইরে পা রাখার অভ্যাস ছিল। তবে এবার আর হাতিগুলো ফিরছিল না। আর হাওয়ায় ভাসছিল বনাঞ্চলের পাশের গ্রামের ঘর ভাঙা, ফসলের খেত দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বা মফস্বলের রাস্তায় হাঙ্গামা করার খবর!
এই হাতিগুলো চীনের ‘সিশুয়াংবান্না ন্যাশনাল নেচার রিজার্ভ’ বনভূমির। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, চীনের ইউনান প্রদেশের যে এলাকাটি মিয়ানমার ও লাওস সীমান্তের সঙ্গে লাগোয়া, সেখানে এই সংরক্ষিত বনভূমির অবস্থান। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই বনভূমির আয়তন ২ লাখ ৪১ হাজার হেক্টর। আরও সহজ করে বললে লন্ডনের দেড় গুণ বড় এই বনভূমি। এখানে মূলত এশীয় হাতির বসবাস।
তবে সিশুয়াংবান্না ন্যাশনাল নেচার রিজার্ভ বনভূমিতে যে শুধু হাতি থাকে, এমনটা নয়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস বলছে, এই ইউনান প্রদেশে ১১টি সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে, যার মোট আয়তন পাঁচ লাখ হেক্টরের বেশি। ১৯৫৮ সালে এর যাত্রা শুরু। ১৯৮০-এর দশকে ইউনান প্রদেশের এসব বনাঞ্চলে হাতি ছিল ১৯৩টি। সেই সংখ্যা বেড়ে এখন হয়েছে ৩০০–এর বেশি।
যে ঘটনার জন্য এত কিছু বলা, সেটা হলো গত বছরের মার্চের কোনো এক সময় সিশুয়াংবান্না ন্যাশনাল নেচার রিজার্ভ বনভূমি থেকে হাতির একটি দল বেরিয়ে পড়ে। বিবিসি বলছে, এই দলে ছিল ১৪টি হাতি। আবার যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিন বলছে, এই হাতির সংখ্যা আসলে ১৫। যাহোক, হাতিগুলো সিদ্ধান্ত নেয় তারা আর সেখানে থাকবে না। বনভূমি থেকে উত্তর দিকে হাঁটা শুরু করে হাতিগুলো।
এই হাতিগুলো গত বছরের মার্চের কত তারিখে বন ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল, তা জানা যায় না। কারণ, হাতির দল মাঝেমধ্যেই বনভূমি থেকে বের হয়। ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায়। কেউ তাদের বাধা দেয় না। এমনকি এসব হাতি বন থেকে বেরিয়ে এলে তাদের সমাদরও করা হয়। যেমন এই বনভূমির পার্শ্ববর্তী পুয়ের শহরে হাতিদের জন্য ক্যানটিনও আছে। সেখানে গেলে হাতিদের ভূরিভোজ করানো হয়। একটা সময় পর আবার হাতিগুলো ফিরে যায় বনে।
কিন্তু গত বছরের মার্চে বন ছেড়ে চলে যাওয়ার কয়েক মাস পরও যখন হাতিগুলো ফিরে আসছিল না, তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। তারা বুঝতে পারে, এবারে চলে যাওয়া অন্যবারের মতো নয়। হয়তো কর্তৃপক্ষের এরপরও টনক নড়ত না, যদি গণমাধ্যম মারফত তারা জানতে পারত, হাতিগুলো মানুষের ঘরবাড়িতে হামলা করছে, মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলছে, তাদের ফসলের খেত নষ্ট করছে, নির্বিকারভাবে তাদের পানিও খেয়ে ফেলছে।
হাতি খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যায়। এদিকে হাতির এমন আচরণে নড়েচড়ে বসেন বিশেষজ্ঞরাও। তাঁরা এ নিয়ে গবেষণাও শুরু করেন, কেন হাতিগুলো এমন আচরণ করছে? এখানে বলে রাখা ভালো, হাতিদের এমন আচরণ নিয়ে একটি গবেষণা কনজারভেশন লেটারস নামে একটি জার্নালে প্রকাশ হবে। চীনভিত্তিক এই জার্নালে যেটি প্রকাশিত হবে, সেই গবেষণার নেতৃত্বে রয়েছেন অধ্যাপক আহিমসা স্যাম্পোজ-আরসিজ (Professor Ahimsa Campos-Arceiz)। তিনি হাতির এমন আচরণের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, হাতিগুলোর বন ছাড়ার কারণ খাবারের চাহিদা। এই বন থেকে সেগুলো পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছিল না। কারণ, এই ইউনান প্রদেশের বনগুলোয় হাতি বাড়ছে। ফলে পর্যাপ্ত খাবার পেতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হচ্ছে হাতিগুলোকে।
যদিও পর্যাপ্ত খাবার পেয়েই হাতিগুলো সেখানে বড় হয়েছে, বংশবিস্তার করছে। তিন দশকের মধ্যে হাতির সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। তবে সিশুয়াংবান্না ট্রপিক্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা অধ্যাপক আহিমসা স্যাম্পোজ-আরসিজের বক্তব্য হলো, হাতির বংশবিস্তার ঘটিয়ে যে সাফল্য এসেছে, তার ফল ভোগ করতে হবে এখন। কারণ, সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এগুলো এখন আর নিজেদের মতো করে আর ঘুরতে পারছে না। মানুষের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হচ্ছে, তাদের শস্যখেতে এমনকি মানুষের বাড়িঘরেও হাতিগুলো হামলা চালাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত। এর প্রভাব পড়েছে চীনের এই হাতিগুলোর ওপরও। সেখানে খরা দেখা দিয়েছে। আর এই খরার কারণে সেখানে খাদ্যসংকট আরও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এসব কারণে হাতিগুলো বন ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
আরেক দল গবেষক অবশ্য মানবসৃষ্ট কারণও সামনে এনেছেন। তাঁরা বলছেন, সেখানে কয়েক দশক ধরে বন উজাড় করা হয়েছে। কৃষিজমি বাড়ানো হয়েছে। ফলে ঠিক সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে হাতির আবাসভূমি কমে যাচ্ছে।
এসব বনভূমি সংরক্ষণ এবং বনের আকার বাড়াতে চীনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়েছে। কারণ, বনে গাছপালার ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় সূর্যালোক পৌঁছাতে পারছে না মাটিতে। ফলে হাতির খাওয়ার উপযোগী গাছ-লতাপাতা জন্মাচ্ছে না। এসব তথ্য জানিয়েছেন অধ্যাপক আহিমসা স্যাম্পোজ-আরসিজ।
এই হাতিগুলো ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে পৌঁছায়। পাড়ি দেয় ৫০০ কিলোমিটার পথ। এর মধ্য দিয়ে একধরনের ইতিহাস রচিত হয়। কারণ, এই প্রথম ইউনানের বনাঞ্চল থেকে কোনো হাতি পা রাখে কুনমিং শহরে।
তো, হাতিগুলো যখন সবুজ পাহাড় আর বনভূমি পেরিয়ে উত্তরের দিকে এগোতে থাকে, তখন চীন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। উদ্দেশ্য, হাতিগুলোকে ফিরিয়ে আনা ও ক্ষয়ক্ষতি কমানো। এ ছাড়া হাতিগুলোর খাবারদাবারের ব্যবস্থা করাও ছিল টাস্কফোর্সের লক্ষ্য।
এই যাত্রাপথে হাতি যা করেছে, তা আসলেই বিস্ময়কর। কারণ, ১৭ মাসের এই চলতি পথে হাতিগুলো প্রায় ১৮০ জনের খাবার খেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, কলা, আনারসসহ অন্যান্য খাবার। বলা যায়, মনের আনন্দে পথ চলেছে হাতিগুলো। দেখা গেছে, কখনো হাতিগুলো কাদায় শুয়ে পড়েছে, একে অপরকে লাথি দিয়েছে, যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুমিয়েছে। তাদের পর্যবেক্ষণে যে গাড়ি ব্যবহার করেছে, ভেঙেছে সেই গাড়ির লুকিং গ্লাস। আর শহরে ঢুকে পড়ার পর তো তারা বাধিয়েছে এলাহিকাণ্ড। শহরে হাতিগুলো যে সড়কে হেঁটেছে, সেই সড়ক ফাঁকা করেছে কর্তৃপক্ষ। মানুষের বাড়িতেও ঢুকেছে হাতিগুলো। এখানেই শেষ নয়। এই চলতি পথে দুটি বাচ্চাও এসেছে হাতির পালে। শহরের সড়কেও ঘুমিয়েছে তারা।
এসব দৃশ্যই ধরা পড়েছে টাস্কফোর্সের ড্রোনে। হাতিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে ওড়ানো হয়েছিল ড্রোন। মানুষও বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখেছে এসব ভিডিও। হাতির গতিবিধি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিজিটিএনে।
আবার গুজবও ছড়িয়েছিল এই হাতিগুলো নিয়ে। বলা হচ্ছিল, ভুট্টার ওয়াইন খেয়ে মাতলামি করেছে হাতিগুলো। যদিও এই গুজব উড়িয়ে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
টাইম ম্যাগাজিন বলছে, হাতির পরিবার সাধারণত মাতৃতান্ত্রিক। দল বেঁধে তারা বসবাস করে। আর যেকোনো দলের নেতৃত্বে থাকে একটি বয়স্ক স্ত্রী হাতি। এই হাতি যেদিকে যায়, অন্য হাতিগুলো তাকে অনুসরণ করে। কিন্তু এপ্রিলে দুটি হাতি সিদ্ধান্ত নেয় তারা পুরোনো আবাসস্থল ফিরবে যাবে। এই দুটি হাতি ফিরিয়ে আনারও ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ। তবে তাদের ভয় ছিল, হাতি দুটি হয়তো বাঁচবে না। এ ছাড়া জুনে আরেকটি হাতি দলছুট হয়ে ফিরে আসে। যে তিনটি হাতি ফিরে এসেছিল, সেই তিনটি হাতিই পুরুষ।
গত জুন নাগাদ এই হাতিগুলো ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে পৌঁছায়। পাড়ি দেয় ৫০০ কিলোমিটার পথ। এর মধ্য দিয়ে একধরনের ইতিহাস রচিত হয়। কারণ, এই প্রথম ইউনানের বনাঞ্চল থেকে কোনো হাতি পা রাখে কুনমিং শহরে।
কুনমিং শহরের মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছিল হাতিগুলো। দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তারা। ঘুমিয়ে পড়ছিল যেখানে–সেখানে। তবে শহরের মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠলেও বিশেষজ্ঞরা এসব আচরণকে ভিন্নভাবে নিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, হাতিগুলো চাপ এবং ক্লান্তি থেকে এমন আচরণ করেছে।
শহরে হাতির প্রবেশে জনগণ খুশি হলেও বিশেষজ্ঞ এবং সরকারের কর্মীরা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। হাতিগুলো অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা অঞ্চলের দিকে যেতে শুরু করেছিল। শহর অঞ্চল সাধারণত তুলনামূলক কম ঠান্ডা হয়। আর শহরে ঢোকার ফলে বেড়ে গিয়েছিল মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার ঘটনাও। ফলে ইউনান প্রদেশের কর্মীদের এই উৎকণ্ঠা কমে গিয়েছিল হাতিগুলোর মন বদলে।
হাতিগুলো কুনমিং এলাকায় কয়েক সপ্তাহ থাকার পর আবার দক্ষিণ দিকে ঘুরে যায়। আর দক্ষিণে সেই বনাঞ্চল। যদিও এতে দেখা দেয় নতুন উদ্বেগ। এই পথেই আছে ইউয়ানজিয়াং নদী। এই নদীতে একটিমাত্র সেতু রয়েছে, যেটি হাতির ওজন বহনে সক্ষম। তাই হাতিগুলো যাতে ঠিক ওই সেতুটি দিয়ে পার হয়, তা নিশ্চিত করতে মোতায়েন করা হয় কয়েক হাজার সেনা। নেওয়া হয় আরও কিছু পদক্ষেপ। একটি কৃত্রিম পথ নির্মাণ করে সেনারা। এই পথ যেন হাতিগুলো ব্যবহার করে, সে জন্য চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া পথে ছিটিয়ে দেওয়া হয় পানি, যাতে হাতির চলতে কষ্ট না হয়।
যে হাতিগুলো এত দিন কথা শুনল না, সেই হাতি কি আর এখন কথা শুনবে? হাতিগুলো কৃত্রিম পথে হাঁটেনি। এই পথের দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ কিলোমিটার। কিন্তু হাতিগুলো হাঁটে ১৪৩ কিলোমিটার পথ। যদিও শেষমেশ গত ৮ আগস্ট হাতিগুলো ওই সেতুই দিয়েই নদী পাড়ি দেয়।
অবশেষে আবারও বনে ফিরছে হাতিগুলো। আর এই যাত্রায় তাদের কেটেছে ১৭ মাস। তবে তারা এখনো ২০০ কিলোমিটার দূরে। বনে হয়তো ফিরবে তারা। কিন্তু এই হাতিরা যে আর বের হবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। এ প্রসঙ্গে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক বিশেষজ্ঞ শেন কিংঝং বলেন, এটা প্রায় নিশ্চিত যে হাতিগুলো আবারও বনভূমি ছেড়ে উত্তরের দিকে ফেরত যেতে পারে।
এমন ঘটনা যদি ঘটে, ইউনানবাসীর জন্য তা যে সুখকর হবে না, সেটা স্পষ্ট। হাতির বনভূমি ছেড়ে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে, তার একটি হিসাব দিয়েছে চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিজিটিএন। গত আগস্ট পর্যন্ত এক হিসাবে বলা হয়েছে, এসব হাতির কারণে দেড় লাখ মানুষকে তাদের বাড়ি থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। হাতির কারণে যে সম্পদের ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ ১০ লাখ মার্কিন ডলার। এসব হাতির ওপর নজর রাখতে ড্রোন ওড়াতে হয়েছে ৯৭৩টি। মোতায়েন করতে হয়েছে ২৫ হাজার সেনা ও সরকারি কর্মী।