মেরি শেলির বিখ্যাত উপন্যাস ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন-এর নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। শুনেছ নিলস বোরের পরমাণুর উন্নত গঠন আবিষ্কারের কথা, আলো নিয়ে আইনস্টাইনের যুগান্তকারী ভাবনা কিংবা কেকুলের বেনজিনের গঠন আবিষ্কারের কথা। কিন্তু শুনলে নিশ্চয় চমকে যাবে, এগুলোর সবই তাঁরা পেয়েছিলেন স্বপ্নে! হ্যাঁ, একটুও বাড়িয়ে বলছি না। এগুলো ছাড়াও এমন ভাবনা আছে কাঁড়ি কাঁড়ি। রাস্তার পাশে অনেক সময় বিভিন্ন ‘স্বপ্নে পাওয়া ওষুধের’ দেখা মেলে। এগুলো যে নিছক ‘আষাঢ়ে ওষুধ’ তাতে সন্দেহ নেই। তবে ফুটপাতের ওষুধের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক বা সাহিত্যিক ভাবনাগুলোর পার্থক্য আছে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা ভাবনাগুলো এসেছিল বিজ্ঞানীদের দিনের পর দিনের চিন্তা-গবেষণা থেকে। মনোবিদেরা বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে থাকলে ঘুমের মাঝেও মস্তিষ্কে চলতে থাকে সেই চিন্তার চর্চা। চলো, এমন কিছু আবিষ্কারের খোঁজ জেনে নিই।
রামানুজান ও অসীম
ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি গণিতবিদ রামানুজান। একাডেমিক পড়াশোনা ছাড়াই হয়ে উঠেছিলেন বাঘা গণিতজ্ঞ। সংখ্যাতত্ত্ব, উপবৃত্তীয় ফাংশন, অবিচ্ছন্ন ভগ্নাংশ, অসীম ধারা—কোথায় নেই তাঁর অবদান। আয়ু পেয়েছিলেন মাত্র ৩২ বছরের। এই অল্প কদিনেই প্রমাণ করেন তিন হাজারের বেশি গাণিতিক উপপাদ্য। গণিতের অনেক ভাবনাই তাঁর মাথায় এসেছিল স্বপ্নের মধ্যে। তেমনই একটি হলো বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত পাই-এর একটি অসীম ধারা। তাঁর নিজের ভাষ্যমতে, ‘ঘুমের মধ্যে একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। প্রবহমান রক্ত থেকে একটা লাল পর্দা তৈরি হলো। হঠাত্ একটি হাত পর্দায় কিছু লিখতে শুরু করল। উপবৃত্তীয় ইন্টিগ্র্যালের বেশ কিছু ফলাফল লেখা হয়ে যেতে দেখলাম। মাথায় গেঁথে গেল সেগুলো। কাজে বসে গেলাম ঘুম থেকে জেগেই।’ রামানুজান ও তাঁর স্বপ্ন নিয়ে রচিত ভালো একটি বই হলো রবার্ট ক্যানিগেলের লেখা দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি: অ্যা লাইফ অব দ্য জিনিয়াস রামানুজান।
অটো লোভির মেডিকেল থেরাপি
অটো লোভি ছিলেন একজন জার্মান ফার্মাকোলজিস্ট। তাঁর আবিষ্কৃত অ্যাসিটাইলকোলিন মেডিকেল থেরাপির অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রাখে। ১৩ বছর পর এ অবদানই তাঁকে নোবেল এনে দেয়। মজার ব্যাপার হলো, এই অ্যাসিটাইলকোলিনই আবার স্বপ্নের উদ্দীপনা তৈরি করতে সক্ষম। যা-ই হোক, ১৯২১ সালের কথা। লোভি ভাবলেন এমন একটি পরীক্ষার কথা, যা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করবে যে স্নায়ুর সংকেত পরিবহন হয় রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। স্বপ্নে পেয়ে গেলেন পথ। রাতে হঠাত্ জেগে গিয়ে কলমের আঁচড়ে তা লিখেও রাখলেন। এরপর আবার ঘুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে তো চক্ষুু চড়কগাছ! নিজের হাতের লেখাই যে পড়া যাচ্ছে না! রাতে ঘুমের ঘোরে কী সব ছাইপাঁশ লিখে রেখেছেন! তবে, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন পরের রাতে একই স্বপ্ন আবার দেখে। এবার আর লিখে রাখারাখি নয়। সোজা ছুট দিলেন পরীক্ষাগারে। পেয়ে গেলেন নোবেল পাওয়ার উপযোগী তত্ত্ব।
আইনস্টাইন ও আলোর গতি
পর্যবেক্ষক সাপেক্ষে আলোর ধ্রুব বেগের ব্যাখ্যা দিয়ে আপেক্ষিক তত্ত্ব রচনার জন্য তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত। ছোটবেলা থেকেই ভাবতেন, কেউ আলোর বেগে চলতে থাকলে প্রকৃতিকে কেমন দেখবে। ১৯০৫ সালের কথা। একদিন স্বপ্ন দেখলেন, চলছেন খাড়া পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে। বেগ বাড়তে বাড়তে একসময় আলোর বেগের সমান হয়ে গেল। এ সময় স্বপ্নের তারাগুলোর চেহারা বদলে গেল। আরেকটু চিন্তা-গবেষণা করে ভাবনাগুলোকে গাণিতিক রূপ দিয়ে তৈরি করে ফেললেন বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব। আইনস্টাইনের স্বপ্ন নিয়ে অ্যালান লাইটম্যান আইনস্টাইন’স ড্রিমস নামে একটি বইও লিখেছেন। এটি ১৯০৫ সালের আইনস্টাইনের অনেক কাল্পনিক স্বপ্নের সংকলন। একটি স্বপ্নে সময় বৃত্তাকার। ফলে জীবনের সফলতা আর ব্যর্থতাগুলো ঘুরেফিরে আবার আসে। আরেকটিতে সময় থেমে যায়। অন্যটিতে আবার সময় হলো খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মতো।
নিলস বোর ও পরমাণুর গঠন
কোয়ান্টাম মেকানিকসের অন্যতম জনক। পদার্থবিদ্যার জটিল সব সমস্যার সমাধান করে ছোটবেলায়ই খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। ১৯১১ সালে অর্জন করেন পিএইচডি। সে সময়ের কথা বলছি, যখন তাঁর ভাবনার বিষয় পরমাণু। এর আগে রাদারফোর্ডের দেওয়া পরমাণু মডেলে কিছু ত্রুটি ছিল। এক রাতের ঘুমে স্বপ্ন দেখলেন পরমাণু। এমআইটির একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, স্বপ্নে দেখা পরমাণুর একটি চেহারার ওপর ভিত্তি করেই চিন্তাভাবনা করে পরমাণু মডেলকে উন্নত করার পথ পেয়ে যান তিনি।
মেরি শেলির ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন
১৮১৬ সালে রচিত উপন্যাসটিকে অনেক সময় পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনিও বলা হয়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে এটি লেখেন শেলি। সে বছরই সুইজারল্যান্ডের লেক জেনেভার তীরে ইংরেজ কবি লর্ড বাইরনের সঙ্গে সাক্ষাত্। অস্বাভাবিক অগ্ন্যুত্পাতের কারণে সে বছর আবার ইউরোপের আবহাওয়া খুব ভিন্ন। বছরটিকে বলা হয় দ্য ইয়ার উইদাইট সামার। বাইরে বেরুবার জো নেই। সারাক্ষণ কি আর এমনি এমনি ঘরে বসে থাকা যায়? তো বাইরন সাহেব প্রস্তাব দিলেন, দুজনেই একটি করে ভূতের গল্প লিখবেন। বলা তো সহজ, কিন্তু রাতের পর রাত পেরিয়ে গেলেও শেলির মাথায় কোনো বুদ্ধি আসছিল না। ভাবলেন, মৃতকে জীবিত করলে কেমন হয়? সে রাতেই এমন একটি স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নের চরিত্রও ঠিক এ কাজই করছে। স্বপ্নে দেখা ঘটনার ওপর নির্ভর করেই রচনা করে ফেললেন কালজয়ী উপন্যাস ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন।
স্বপ্নে পাওয়া কালজয়ী ভাবনাগুলোর মধ্যে আরও আছে কেকুলের বেনজিন গঠন আবিষ্কার। স্বপ্নে বৃত্তাকার সাপের মুখে নিজেরই লেজ দেখে বেনজিনের ষড়্ভুজী গঠনের ভাবনা তাঁর মাথায় আসে। ১৮৮৬ সালে রবার্ট স্টিভেনসনের লেখা দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড-এর ভাবনাও এসেছিল স্বপ্ন থেকে। ১৮৪৫ সালে ইরিয়াস হোয়ে সেলাই মেশিন আবিষ্কার করেন। সে ভাবনাটিও পান স্বপ্নে।
সূত্র: এমআইটি, ক্র্যাকড, ওয়ার্ল্ড অব লুসিড ড্রিমিং